PART 3----- রহস্য এবং অনুসন্ধান
দূর্বার গতিতে পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের পঙ্খীরাজ আব্রাহাম লিঙ্কন কর্কটক্রান্তি অতিক্রম করে জ্যাকুইস এবং স্যান্ডউইচ দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি হাজির হল।বিশালাকার সামুদ্রিক প্রাণীটাকে সবাই এ অঞ্চলেই দেখতে পেয়েছিল ।
আমাদের জাহাজটা উল্কার বেগে জাপান ও আমেরিকার উপকূলে ছুটোছুটিকরে বেড়ালো রহস্য ও আতঙ্ক সৃষ্টিকারী বিশালায়তন প্রাণীটার সন্ধানে। ভস্মে ঘি ঢালাই সার হ'ল।
আমাদের জাহাজ আব্রাহাম লিঙ্কন বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তিন-তিনটে মাস অনবরত চক্কর মেরে বেড়াল।দিনের পর দিন ব্যার্থ প্রয়াস চালিয়ে আমাদের জাহাজের কর্মীরা হতাশ হয়েপড়ল। যে উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে সবাই জাহাজে উঠেছিল তা প্রায় নিঃশেষ হতে চলেছে।
ক্যাপ্টেন ফ্যারাগুট নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। তিনি ভাঙবেন কিন্তুমচকাবার পাত্র নন। তিনি একটু নরম হলেই হতাশায় জর্জরিত জাহাজের কর্মীরা এতক্ষনে প্রত্যাবর্তনমুখী থাকত।
দিনের পর দিন ব্যার্থতা আর হতাশায় জর্জরিত হয়ে জাহাজের কর্মীরা অনন্যোপায় হয়ে জোট বেঁধে ক্যাপ্টেনের কেবিনের দরজায় হাজির হ'ল। জাহাজেরমুখ ঘুরিয়ে স্বদেশের অভিমুখে যাওয়ার জন্য বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই তার কাছে তাদেরইচ্ছার কথা ব্যক্ত করল।
ক্যাপ্টেন তার অধঃস্তন কর্মীদের কাছ থেকে তিনদিনের সময় চাইলেন। এরমধ্যে যদি বহু আকাঙ্ক্ষিত সামুদ্রিক প্রাণীটার দেখা না পাওয়া যায় তবে তিনিঅবশ্যই তাদের অনুরোধ অনুযায়ী কাজ করবেন, প্রতিশ্রুতি দিলেন।
জাহাজের কর্মীরা এবার নতুন উদ্যেমে অতিকায় তিমিটাকে গভীর জল থেকেওপরে তুলে আনার জন্য চমৎকার একটা ফন্দি বের করল। তারা একের পর এক শুয়োরের মাংসের টুকরো উত্তাল-উদ্দাম সফেন সমুদ্রের জলে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল।হায় কপাল, জাহাজের কর্মীদের ফেলা শুয়োরের মাংস দিয়ে হাঙ্গরের ভোজন চলতে লাগল।
নিরবচ্ছিন্ন হতাশা আর হাহাকারের মধ্যে দিয়ে জাহাজের কর্মীদের চৌঠা নভেম্বরের রাত্রি কাটল।
পূর্ব-আকাশে ভোরের আলো ফুটে উঠল। পাঁচই নভেম্বরের ভোর। সেদিন বেলা বারোটা বাজলেই ক্যাপ্টেনের নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাবে।
যাত্রীদের মনে অফুরন্ত আনন্দের জোয়ার। আর মাত্র ঘন্টা ছয় বাদেই জাহাজের মুখ ঘোরানো হবে। উল্কার বেগে স্বদেশের দিকে বিশালায়তন জাহাজ আব্রাহামলিঙ্কন ধরতে হবে।আব্রাহাম লিঙ্কন এখন জাপান দ্বীপপুঞ্জ থেকে দু'শ' মাইল ভেতরের দিকে অবস্থান করছে।
ঘড়িতে তখন আটটার কাছাকাছি বাজে। আমি জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে,রেলিঙের ওপর ঝুঁকে সমুদ্রের ওপর নজর রেখে চলেছি। আমার ব্যাক্তিগত ভৃত্য কনসীল আমার প্রায় গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের জলরাশির ওপর ব্যস্ত চোখের মনিদুটোকে বুলিয়ে চলেছে।
জাহাজের ক্যাপ্টেন আমাদের থেকে মাত্র কয়েক হাত দুরে দাঁড়িয়ে। তাঁর চোখে দুরবীণ। অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে সমুদ্রের উপর নজর রেখে চলেছেন।আমরা যখন অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে সমুদ্রের বাঞ্ছিত সে বিশালায়তন সামুদ্রিক প্রাণীটার খোঁজ করে চলেছি ঠিক তখনই হারপুনবীর নেড-এর আর্তস্বর কানে এল-‘ওই-ওই যে দেখুন! ওই দিকে ওই দেখুন! আমরা উদ্ভ্রান্তের মত যার খোঁজ করেবেড়াচ্ছি-ওই যে সে! ওই যে-ওই দেখুন!’
নেড-এর আর্তস্বর জাহাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। ফলে জাহাজের ক্যাপ্টেনথেকে শুরু করে খালাসী পর্যন্ত সবাই হুটোপাটা ডেকের ওপর উঠে এল। এমন কি ইঞ্জিনীয়ার ও স্ট্রোকাররাও তাদের দায়িত্বপূর্ণ কাজ ফেলে হন্তদন্ত হয়ে ডেকের সিঁড়িবেয়ে ওপরে উঠতে লাগল।
আমার মনেও সন্দেহ দানা বাঁধল, নেড কি তবে সত্যিই কিছু দেখেছে? ফলে আমার পক্ষে উত্তেজনা এড়িয়ে দূরে থাকা সম্ভব হ'ল না। আমি ভিড় ঠেলে নেড এরকাছে হাজির হয়ে দেখি, সমুদ্রের দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে ক্যাপ্টেনকে কি যেন দেখাচ্ছে।আমি নেড-এর অঙ্গুলি-নির্দেশিত পথে দৃষ্টিপাত করা মাত্র সচকিত হয়ে খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে পড়লাম। চোখের তারায় বিস্ময়ের ছাপ এঁকে তাকিয়ে রইলাম জাহাজ থেকে মাত্র দু’রশি দূরবর্তী স্থান অত্যুজ্জ্বল আলোকরশ্মি চোখ ধাঁধিয়ে দিতে লাগল। সমুদ্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অভাবনীয় সে আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যাপারদেখে আমার হৃদপিণ্ডের গতি স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড় হ'ল।
প্রথম দর্শনে আমি ধরেই নিয়েছিলাম, সেটা ফসফরাসের আলো ছাড়া কিছু নয়। পর মুহুর্তেই আমার মনের ধন্দ ঘুচল। অতিকায় একটা দানব ভুস করে জলের তলা থেকে ভেসে উঠেছে।
গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতে লাগল। শরীরের সব কটা স্নায়ু যেন এক সঙ্গে ঝনঝনিয়ে উঠল। কিন্তু সে আর কতক্ষণ। চোখের পাতা ফেলতে না ফেলতে রহস্যময় দানবটা অতুউজ্জ্বল আলোকরশ্মি সমেত আবার জলের তলায় গা-ঢাকা দিল। ব্যস, একেবারে নিশ্চিহ্ন।
আমি পূর্বস্মৃতি মন্থন করতে লাগলাম। হ্যাঁ, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন জাহাজের নাবিকদের মুখ থেকে অত্যুজ্জ্বল আলোটার যে বর্ণনা শুনেছিলাম এর সঙ্গে সামান্যতম বৈসাদৃশ্য তো নেই-ই বরং পুরোপুরি সাদৃশ্য রয়েছে। আর আলোটা অনবরত নড়ছিলও বটে।