Posts

গল্প

এক অহঙ্কারী আপেল শাখার গল্প

September 23, 2024

মাসুদ হোসেন

Original Author মূল গল্পঃ The Conceited Apple-Branch ( দ্য কন্‌সিটেড অ্যাপ্‌ল্‌ ব্রাঞ্চ, ১৮৫২)

Translated by মাসুদ হোসেন

52
View
এক অহঙ্কারী আপেল শাখার গল্প

সেটা ছিল মে মাস। বাতাসে তখনও শীতের আমেজ; কিন্তু ঝোপ-ঝাড় আর গাছের কচি পাতা, সবুজ মাঠ আর নতুন কুঁড়িরা গুনগুন করে গাইছিল, “ এসে গেছে বসন্ত ঋতু ”। বাগানের বেড়াগুলি বুনো ফুলে ভরে ভরে উঠছিল। ছোট্ট আপেল গাছটার কাছে বসন্তরাজকে দেখা গেল; গাছের একটি শাখাকে তিনি সাজিয়ে তুলেছেন টাটকা ,  কোমল গোলাপি ফুলে - সেগুলি এই ফুটল বলে! ফুলে ভরা সেই শাখাটি খুব ভাল করে বুঝতে পারছিল তাকে কতটা সুন্দর দেখাচ্ছে; তার প্রতিটি পাতা, তার কোষে কোষে বয়ে যাওয়া জীবনরস- সব্বাই বুঝতে পারছিল সে কথা। তাই যখন পাশের রাস্তায় এক অল্পবয়সী কাউন্টেসকে নিয়ে চলতে চলতে একটা জুরিগাড়ি থেমে গেল, কেউই একটুও অবাক হল না। কাউন্টেস* বললেন,  আপেল শাখাটি বড় সুন্দর, বসন্ত ঋতুর সৌন্দর্যের প্রতীক সে। তাঁর কথায় গাছের ছোট শাখাটিকে ভেঙে নেওয়া হল, আর তিনি সেটিকে আলতো হাতে ধরে নিজের শৌখিন রেশমের ছাতার ছায়ায় রাখলেন। তাঁকে নিয়ে গাড়ি প্রাসাদে ফিরে গেল। সে প্রাসাদে ছিল বিশাল বিশাল দালান আর দারুণ সুন্দর সব বসার ঘর। খোলা জানলাগুলির সামনে দুধসাদা পর্দাগুলি হাওয়ায় উড়ছিল, আর স্বচ্ছ , চকচকে সব ফুলদানিতে নানারকমের সুন্দর ফুল সাজানো ছিল; ফুলদানিগুলির মধ্যে একটিকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন সদ্য পড়া তুষার দিয়ে সেটিকে তৈরি করা হয়েছে। সেই ফুলদানিতে আপেল শাখাটিকে রাখা হল, সাথে ছিল বীচ গাছের কয়েকটি কচি পল্লব। সব মিলিয়ে দেখতে বড়ই সুন্দর লাগছিল। আর এইটা বুঝতে পেরে সেই আপেল শাখার খুব গর্ব হল, ঠিক যেমন মানুষদেরও হয়ে থাকে।

সেই ঘরে নানা ধরনের লোকজন যাওয়া আসা করছিল। সমাজে তাদের যার যতটা খাতির, আপেল শাখা সমেত ফুলদানিটিকে দেখে তারা ঠিক ততটাই প্রশংসা করছিল। কেউ কেউ কিছুই বলল না, কেউ কেউ অনেক কথা বলল, আর সে সব শুনে আপেল শাখা বুঝতে পারল, গাছপালা আর ফুলের যেমন রকমফেরের শেষ নেই, মানুষের চরিত্রও তেমনই রকমারি হয়।কারোর কারোর শুধুই ভড়ং আর দেখনদারি, অন্য কিছুজনকে নিজেদের গুরুত্ব বজায় রাখার জন্য কত কিছুই না করতে হয়, আর বাকিদের কথা মনে না রাখলে কারোরই কিছু আসবে যাবে না। খোলা জানলার সামনে ফুলদানিতে সাজানো আপেল শাখা জানলার বাইরে গোছানো বাগান আর ছড়ানো মাঠভরা গাছ  আর ফুলগুলিকে দেখতে দেখতে এইসবই ভাবছিল; কেউ কেউ খুব ধনী আর সুন্দর হয়; কেউ কেউ হয় গরীব আর সাদাসিধে।

"বেচারা, ছোটখাটো যত মেঠোগাছের দল", ভাবলো আপেল শাখাটি," ওদের মধ্যে আর আমার মত যারা , তাদের মধ্যে একটা তফাৎ সত্যিই আছে। ওরা কি আমাদের মত ভাবতে পারে? তাহলে নিশ্চয় ওরা খুবই অসুখী! একটা তফাৎ তো থেকেই যায়, থাকতেই হবে কিছু একটা তফাৎ, নাহলে তো আমরা সবাই সমান হয়ে যেতাম।"

আর এইসব ভেবে সেই অহংকারি আপেল-শাখা সেইসব ছোটছোট মেঠো গাছপালাকে বেশ খানিক করুণার চোখে দেখতে লাগল, বিশেষ করে মাঠে-ঘাটে যত্রতত্র ফুটে থাকা একটা বিশেষ ছোট ফুলকে। এই ফুলগুলোকে একসাথে করে কেউ তোড়া বাঁধত না, বড়ই সাধারণ ছিল ফুলগুলো। সেগুলি এতই সাধারণ ছিল যে পরগাছার মত পাথরে বাঁধানো রাস্তার ফাঁকফোকরগুলির মধ্যেও মাথা তুলে দাঁড়াত। আর তাদের নামও ছিল বড় বাজে -'কুকুরে ফুল' বা 'ড্যান্ডেলিয়ন'।

"বেচারা,বুনো গাছের দল", নিজের মনেই বলল আপেল শাখাটি," এই যে তোরা দেখতে এত বাজে, এই যে তোদের এরকম বাজে একটা নাম, এটা তোদের দোষ নয়; আসলে মানুষদের মতই গাছেদের মধ্যে কিছু না কিছু তফাৎ তো থাকতেই হবে।"

"তফাৎ!" ফুলে ফুলে ভরা আপেল শাখাটিকে আদর করতে করতে অবাক হয়ে বলল সূর্যের রশ্মি, আর তারপরেই মাঠে গিয়ে চুমু দিল হলুদ ড্যান্ডেলিয়ন গুলির মাথায়। আসলে ধনীই হোক বা গরিব, সব ফুলেরাই যে একে অপরের ভাইবোন-  সূর্য রশ্মি সেটা জানে বলেই সবাইকে তার আদর ভাগ করে দিল।

আপেল শাখা কোনদিন প্রকৃতির অসীম ভালোবাসার কথা ভাবেনি, সেই ভালোবাসা যা ছড়িয়ে আছে তাঁর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে-যা কিছুর প্রাণ আছে, যা কিছু সচল, সজীব, প্রাণ পেয়েছে তাঁর থেকে; আপেল শাখা কোনদিন ভাবেইনি যে সব ভালো আর সুন্দর বিষয় সবসময়ে চোখের সামনে দেখা যায় না; সে এটাও জানত না যে সেইসব ভালত্ব আর সৌন্দর্য কখনই প্রকৃতির নজর এড়ায় না - সে গাছপালা-পশুপাখিদের মধ্যেই হোক, আর মানুষের মধ্যেই হোক। কিন্তু সূর্যরশ্মি, সে তো আলো দেয়, তাই সে এ সবই জানত।

এক অহঙ্কারী আপেল শাখার গল্প

সে আপেল শাখাকে বলল, "তুমি বেশিদূর অবধি দেখতে পাওনা, আর পরিষ্কার তো দেখই না। কোন তুচ্ছ গাছটাকে তুমি এত করুণা করছ?"

"ওই যে, ড্যান্ডেলিয়ন", উত্তর দিল আপেল গাছের সেই অহঙ্কারি শাখাটি, "কেউ ওদেরকে নিয়ে তোড়া বাঁধে না; বেশিরভাগ সময়ে পায়ের তলায় চাপা পড়ে ওরা- এত এত বেশি ফোটে  যে ! আর যখন  বীজ হয়, তখন ফুলগুলো সব পশমের মত হয়ে যায়, সেগুলি ছোট ছোট ভাগ হয়ে রাস্তায় উড়তে থাকে, আর লোকজনের জামায় আটকে যায়। ওগুলো শুধুই আগাছা; কিন্তু হ্যাঁ, আগাছাও তো থাকতেই হবে। ওহ, আমি সত্যিই ভাগ্যবান যে আমি এইরকম তুচ্ছ ফুলগুলোর মত হয়ে জন্ম নিইনি।"

এর কিছু পরেই মাঠে এল একদল ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, তাদের মধ্যে সবথেকে ছোট্টসোনাটি তো এতই ছোট যে সে এল অন্যদের কোলে চড়ে; তাকে ঘাসের ওপর , হলুদ ফুলগুলির মাঝে বসিয়ে দিতেই  সে আনন্দে হেসে উঠল, হাত পা নাড়াল, গড়াগড়ি দিল, হলুদ ফুলগুলিকে তুলল, আর  সরল মনে সেগুলিকে অনেক অনেক চুমু খেল। একটু বড় ছেলেমেয়েগুলি লম্বা বোঁটাওয়ালা ফুলগুলিকে তুলে নিল, সেগুলির বোঁটাগুলিকে একে অপরের মধ্যে দিয়ে ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে শিকলের মত বানিয়ে ফেলল; এইভাবে প্রথমে তারা গলার মালা বানাল, তারপরে কাঁধের ওপর দিয়ে গিয়ে কোমর অবধি ঝোলার  মত একটা ফুলের উত্তরীয় বানাল, আর শেষে বানাল মাথায় পরার  মুকুট। সবুজ বোঁটার সোনালি ফুলের অলঙ্কারগুলি পরে তাদের দারুণ সুন্দর লাগছিল। কিন্তু সেই ছেলেমেয়েদের মধ্যে যারা সবথেকে বড়, তারা শুকনো ফুল গুলিকে সযত্নে জড়ো করছিল। সেই শুকনো ফুলগুলির বোঁটার আগায় বীজগুলি সাদা পালকের তৈরি বিয়ের মুকুটের মত  আটকে ছিল। এই হালকা-পলকা, পশমেরএর মত ফুলগুলিকে দেখতে খুবই সুন্দর, দেখলেই মনে হয় যেন বরফে তৈরি পালকের গুচ্ছ।ছেলেমেয়েগুলি সেগুলিকে মুখের সামনে ধরে, এক ফুঁয়ে পুরো পালকের মুকুটের মত গোছাটিকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। কেন জান? কারণ তাদের দিদিমা-ঠাকুমারা তাদেরকে বলেছিলেন, যে এই কাজটা একবারে ঠিকঠাক করতে পারবে, সে নিশ্চয়ই বছর শেষ হওয়ার আগে নতুন জামা পাবে।এইভাবে সেই তুচ্ছ ফুল ড্যান্ডেলিয়ন প্রায় ভবিষ্যৎ-বক্তার বা গণৎকারের মত সম্মান পেয়ে যাচ্ছিল।

" দেখতে পাচ্ছ তুমি?" জিজ্ঞসা করল সূর্য রশ্মি, "ওই ফুলগুলির ক্ষমতা দেখতে পাচ্ছ? দেখতে পাচ্ছ ওরা কেমন করে সবাইকে খুশি করতে পারে?"
"হ্যাঁ, বাচ্চাদেরকে খুশি করতে পারে,"  গম্ভীর মুখে বলল আপেল শাখা।

একটু পরেই এক বৃদ্ধা মাঠে এলেন। তিনি হাতলবিহীন একটা ভোঁতা ছুরি নিয়ে মাটি খুঁড়ে কয়েকটি ড্যান্ডেলিয়ন গাছের শিকড় টেনে তুললেন। সেগুলির কিছুটা দিয়ে তিনি চা খাবেন, কিন্তু বাকিটুকু তিনি কিছু টাকার বিনিময়ে এক ওষুধ-প্রস্তুতকারীকে বিক্রি করবেন।

"কিন্তু এসবেরই ওপরে হল রূপ," বলে উঠল আপেল গাছের সেই অহঙ্কারি শাখাটি; " শুধুমাত্র কয়েকজনকেই যথার্থ সুন্দরের দলে ফেলা যায়। মানুষের মধ্যে যেমন, গাছেদের মধ্যেও সেরকম তফাৎ তো আছেই।"

এই কথা শুনে সূর্য রশ্মি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করল প্রকৃতির অনন্ত ভালোবাসার কথা; যে ভালোবাসা দেখতে পাওয়া যায় তাঁর সমস্ত সৃষ্টিতে, আর সমস্ত জীবিতের মধ্যে; জানাল কীভাবে তিনি সর্বদাই সবার মধ্যে নিজের সমস্ত ভালোবাসা সমান ভাবে উজাড় করে দিয়েছেন।

"সেটা তুমি ভাবো", মুখ ফিরিয়ে বলল আপেল শাখা।

এক অহঙ্কারী আপেল শাখার গল্প

এই সময়ে ঘরে এল কিছু মানুষ, তাদের মধ্যে ছিলে সেই কাউন্টেসও, যিনি সূর্যের আলোর কাছে, স্বচ্ছ কাঁচের ফুলদানিতে আপেল শাখাটিকে সাজিয়ে রেখেছিলেন। মনে হল তাঁর হাতে ফুলের মত কিছু একটা রয়েছে। সেটিকে ফুলে ভরা আপেল শাখাটির থেকেই অনেক বেশি যত্নে নিয়ে আসছিলেন তিনি। কয়েকটা বড় গাছের পাতা সেটিকে বর্মের মত আড়াল করে রেখেছিল, যাতে কোন দমকা হাওয়া সেটিকে আঘাত না করতে পারে। ঘরে ঢুকে কাউন্টেস খুব সাবধানে বড় বড় পাতাগুলিকে সরালেন। আপেল শাখা দেখতে পেল সেটা হল তুচ্ছ ড্যান্ডেলিয়নের একটা পালকে ঢাকা মুকুটের মত দেখতে বীজের গুচ্ছ। এই ফুলটাকেই কাউন্টেস সাবধানে তুলে, সযত্নে রক্ষা করে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন, যাতে তার  হালকা পালকের মত অংশগুলি উড়ে চলে গিয়ে সেই সুগোল পালকের মুকুটের মত, কুয়াশার গোলকের মত আকার নষ্ট না হয়ে যায়। এইবার তিনি সেটাকে সামনে নিয়ে এলেন, আর মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন। এই শুকনো ফুলটি যেকোন সময়ে বাতাসের টানে উড়ে যাবে, এর অংশগুলি ছড়িয়ে যাবে যেখানে সেখানে, কিন্তু তাও এই  শুষ্ক অবস্থাতেও কত সুন্দর দেখতে লাগছে !

" দেখ তোমরা", সবাইকে বললেন তিনি, " প্রকৃতি কী অসাধারণভাবে এই ফুলটিকে বানিয়েছেন। আমি এই ফুলটিকে ওই আপেল শাখাটির সাথে রেখে দুটির ছবি আঁকব। সবাই আপেল শাখার রূপের কদর করে। কিন্তু এই ছোট ফুলটাকেও প্রকৃতি আরেকরকমের সৌন্দর্য দিয়েছেন; এরা দুজনেই সমান সুন্দর, যদিও দুটিকে দেখতে একেবারেই আলাদা।"

এই কথা শুনে সূর্যের রশ্মি সেই তুচ্ছ শুকনো সাদা পালকের মুকুটের মত সেই ফুলটিকে একটু আদর করে দিল, আর তারপরে  নরম গোলাপি ফুলে ফুলে ভরা আপেল শাখাটিকেও আদর করে দিল। দেখে মনে হল আপেল শাখার পাতাগুলি লজ্জায় একটু একটু লাল হয়ে গেছে।

**********

*কাউন্টেসঃ ইউরোপে রাজার বন্ধুস্থানীয় /পারিষদকে বলা হয় 'কাউন্ট' । কাউন্ট এর পত্নী কাউন্টেস।


মূল গল্পঃ The Conceited Apple-Branch ( দ্য কন্‌সিটেড অ্যাপ্‌ল্‌ ব্রাঞ্চ, ১৮৫২)

লেখক পরিচিতিঃ হান্স খ্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেন ( ২ এপ্রিল ১৮০৫- ৪ আগস্ট ১৮৭৫) ডেনমার্ক দেশের মানুষ। যদিও তিনি বড়দের জন্য নানাধরনের লেখা লিখেছেন, তাঁর খ্যাতির মূলে রয়েছে ১৮৩৫ থেকে ১৮৭২ এর মধ্যে লেখা তাঁর রূপকথাগুলি। এই রূপকথাগুলির বেশিরভাগই ছোটদের জন্য লেখা হলেও, কয়েকটি লেখা হয়েছিল বড়দের জন্যেও। এই কাহিনিগুলি বিশ্বের সর্বত্র ছোটদের এবং বড়দের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয়। তাঁর রূপকথাগুলি বিশ্বের ১২৫টিরও বেশি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। অ্যান্ডারসন মোট ১৬৮ টি রূপকথা লেখেন, এর মধ্যে প্রথমদিকেরগুলি ছিল তাঁর ছোটবেলায় শোনা লোককথা থেকে অনুপ্রাণিত। কিন্তু পরে তিনি একাধিক মৌলিক রূপকথা রচনা করেন। তাঁর লেখা বিখ্যাত বেশ কয়েকটি রূপকথা অবলম্বনে তৈরি হয়েছে একাধিক অ্যানিমেটেড ছবি এবং ছায়াছবি।

Comments

    Please login to post comment. Login