Posts

উপন্যাস

সিন্দবাদ নাবিকের সপ্ত সমুদ্রযাত্রা (পর্বঃ ১)

January 1, 2025

Arif Ali Mahmud

13
View

মধ্যযুগের বিখ্যাত আরবী সাহিত্য সংকলন 'আলফ লায়লাহ ওয়া লায়লাহ' বা 'আরব্য রজনী'-এর সবচেয়ে জনপ্রিয় কাহিনীগুলোর অন্যতম হলো সিন্দবাদ নাবিকের সাতটি সমুদ্রযাত্রার কাহিনী, যা পাঠ করে আজকের দিনেও ছোট-বড় সব শ্রেণীর পাঠকেরা বেশ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে। রোমাঞ্চে ভরা এই জনপ্রিয় কাহিনীটি উপন্যাসের মতো দীর্ঘ হওয়ায় পাঠকদের সুবিধার্থে আটটি পৃথক ভাগে উপস্থাপন করা হলো। এটি Sir Richard Burton কর্তৃক আরব্য রজনীর বিখ্যাত ইংরেজি অনুবাদ 'Book of the Thousand Nights and a Night' গ্রন্থ থেকে উক্ত কাহিনীর সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ এবং সামান্য পরিমার্জিত রূপ। 

-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

সিন্দবাদ নাবিকের সমুদ্রযাত্রা


 

বাগদাদ নগরীতে খলিফা হারুনুর রশিদের শাসনামলে এক ব্যক্তি বাস করতেন, যার নাম ছিল সিন্দবাদ হাম্মাল (কুলি)। তিনি একজন গরিব ব্যক্তি ছিলেন, যিনি অর্থের বিনিময়ে মাথায় ভারী বোঝা বহন করতেন। একদিন তীব্র গরমের সময়, যখন তিনি একটি ভারী বোঝা বহন করছিলেন, তখন তিনি অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং প্রচণ্ড ঘামতে থাকেন। গরম এবং ওজন দুটোই তাকে ভারাক্রান্ত করছিল। কিছুক্ষণ পর, যখন তিনি একজন বণিকের বাড়ির দরজার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যেখানে মাটিতে ঝাড়ু দেওয়া এবং পানি ছিটানো হয়েছিল, এবং সেখানে বাতাসটা বেশ আরামদায়ক ছিল, তখন তিনি দরজার পাশে একটি বড় বেঞ্চি দেখতে পান। তিনি তার বোঝাটা সেখানে রেখে একটু বিশ্রাম নিতে বসেন এবং ঠান্ডা বাতাস উপভোগ করতে থাকেন। 

আর এইসময়ে শাহরাজাদ সকাল হয়ে যাওয়া অনুভব করলেন এবং তার কাহিনী বলা বন্ধ করলেন।
 

পাঁচশত সাঁইত্রিশতম রজনীর শেষ 
 

তিনি বললেন, “হে সৌভাগ্যশালী বাদশাহ, আমার জানা মতে, যখন হাম্মাল তার বোঝাটি বেঞ্চির ওপর রেখে বিশ্রাম নিতে বসেন এবং ঠান্ডা বাতাসে শ্বাস নেন, তখন বাড়ির দরজা থেকে একটি মনোরম হাওয়া এবং সুগন্ধি তার দিকে আসতে লাগল। তিনি বেঞ্চির প্রান্তে বসে পড়লেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই ভেতর থেকে বীণা এবং অন্যান্য তার যন্ত্রের মধুর সুর শুনতে পেলেন, পাশাপাশি কিছু আনন্দদায়ক গান এবং কবিতার সুরেলা কণ্ঠস্বরও তার কানে এলো। পাখিদের গান, যারা বিভিন্ন সুরে এবং ভাষায় মহান আল্লাহর গুণকীর্তন করছিল, যেমন—কচ্ছপ, হরবোলা, ময়না, বুলবুলি, হুদহুদ এবং চক্রবাক—এইসব শুনে তিনি অবাক হলেন এবং তার মনে প্রচণ্ড আনন্দ ও স্বস্তি অনুভব করলেন।

তখন তিনি দরজার কাছে গেলেন এবং দেখতে পেলেন একটি বিশাল ফুলের বাগান, যেখানে রাজকীয় চাকর-বাকরের দল এবং কালো গোলামরা উপস্থিত ছিল। সেখানকার সৌন্দর্য এবং সাজসজ্জা দেখে মনে হচ্ছিল যেন এই ধরণের পরিবেশ কেবল রাজা এবং সুলতানদের সাথেই দেখা যায়। তার নাকে সমস্ত ধরণের সমৃদ্ধ এবং সুস্বাদু খাবারের গন্ধ পৌঁছল, সঙ্গে মনোহর পানীয়ের সুবাস। তখন তিনি চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হে মালিক, হে স্রষ্টা ও রিজিকদাতা! তুমি যাকে ইচ্ছা তাকে সীমাহীনভাবে রিজিক দান করো! হে পবিত্র সত্তা, আমি তোমার কাছে আমার সমস্ত পাপের ক্ষমা চাই এবং আমি সমস্ত অপরাধ থেকে তওবা করছি! হে প্রভু, তুমি যা ইচ্ছা করো তাই হয়, আর তোমার নির্দেশনার বিরুদ্ধে কিছু বলা যায় না। কারণ, তুমি সবকিছুর উপর শক্তিশালী। তোমার মহিমা কত মহান এবং তোমার রাজত্ব কত দীর্ঘস্থায়ী, এবং তোমার শাসন কত চমৎকার! নিশ্চয়ই, তুমি তোমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করো, এবং যার প্রতি তুমি সন্তুষ্ট, তাকে সকল জীবনের আনন্দ দাও। এই বাড়ির মালিক সুখ-শান্তিতে বাস করছেন, সুগন্ধি এবং সুস্বাদু খাবার ও পানীয়ের মধ্যে আনন্দ উপভোগ করছেন। কেননা তুমি তোমার সৃষ্টির জন্য যা ইচ্ছা তাই নির্ধারণ করো; কেউ পরিশ্রান্ত হয়, আবার কেউ শান্তিতে থাকে। কেউ ভাগ্যবান হয় এবং প্রাচুর্যের মধ্যে বসবাস করে, আর কেউ আমার মতোই কষ্ট ও দুঃখের মধ্যে দিন কাটায়।’
 

এরপর তিনি আবৃত্তি করতে লাগলেনঃ

‘আমার কঠোর পরিশ্রমের ফলে কতো মানুষ সুখে জীবন কাটায়, ঠান্ডা ছায়ায় শুয়ে বিশ্রাম নেয়,

আর আমি প্রত্যেক সকালেই দুঃখ-কষ্ট নিয়ে জেগে উঠি, 

আমার অবস্থা অদ্ভুত, আর আমার বোঝা আমাকে ক্লান্ত করে তোলে।

অনেকেই সুখে আছে, দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্ত,

কিন্তু ভাগ্য তাদেরকে আমার মতো বোঝা দেয়নি।

তারা সম্মানের সাথে শান্তিতে জীবন কাটায়, খায়, পান করে এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করে।

সব জীবের উৎপত্তি তো সামান্য এক ফোঁটা বীর্য থেকে,

তোমার উৎসও আমার মতোই এবং আমারও তোমার মতোই।

তবুও আমাদের মধ্যে পার্থক্য আকাশ-পাতাল, যেমন- সিরকা আর মদের স্বাদে পার্থক্য।

কিন্তু হে প্রজ্ঞাময় আল্লাহ, তোমার বিধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাহস আমার নেই,

যিনি ন্যায়পরায়ণ এবং যাঁর ন্যায়বিচার নির্ভুল।’

যখন সিন্দবাদ হাম্মাল তার কবিতা আবৃত্তি শেষ করলেন, তখন তিনি তার বোঝা তুলে নিলেন এবং চলে যেতে চাইলেন। হঠাৎ করে বাড়ির দরজা থেকে এক সুন্দর চেহারার, শৃঙ্গারিক বেশে সজ্জিত একটি ছেলে তার দিকে এগিয়ে এলো। ছেলেটি তার হাত ধরে বলল, ‘এসো, আমার মালিকের সাথে কথা বলো, কারণ তিনি তোমাকে ডেকেছেন।’ সিন্দবাদ প্রথমে ছেলেটির কথায় অস্বীকৃতি জানাতে চাইলেন, কিন্তু ছেলেটি কোনো অজুহাত শুনতে চাইল না। তাই তিনি তার বোঝা দরজার রক্ষকের কাছে রেখে ছেলেটির পিছু নিলেন। তিনি একটি সুন্দর এবং বিশাল বাড়িতে প্রবেশ করলেন, যেখানে রাজকীয় সৌন্দর্য এবং মহিমা ছড়িয়ে ছিল। এরপর ছেলেটি তাকে একটি বিশাল বৈঠকখানায় নিয়ে গেল, যেখানে অনেক উচ্চপদস্থ ব্যক্তি এবং রাজকীয় প্রভুরা সজ্জিত টেবিলের চারপাশে বসে ছিলেন। টেবিলগুলোতে ফুল এবং সুগন্ধি ভেষজ ছড়িয়ে রাখা ছিল। এছাড়াও দারুণ স্বাদের খাবার এবং তাজা ও শুকনো ফল ছিল। মিষ্টি ও সর্বোত্তম মানের মদও ছিল সেখানে। এছাড়াও সংগীতের যন্ত্র এবং গান-বাজনার ব্যবস্থা ছিল, যেখানে দাসীরা বাজনা বাজাচ্ছিল এবং গান গাইছিল। সবাই তাদের মর্যাদা অনুযায়ী বসেছিলেন, আর তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থানে এক মহান ও সম্মানীয় চেহারার বৃদ্ধ ব্যক্তি বসেছিলেন। তার চেহারার একপাশে সাদা চুলের ছাপ পড়ে গেছে, আর তিনি ছিলেন লম্বা এবং সুন্দর চেহারার, গম্ভীর, মর্যাদাপূর্ণ এবং মহিমান্বিত। সিন্দবাদ হাম্মাল যা দেখলেন তাতে তিনি বিস্মিত হলেন এবং নিজের মনে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! এটি হয় জান্নাতের একটি টুকরো, না হয় কোনো রাজার প্রাসাদ!’ তারপর তিনি তাদের সকলকে সম্মানের সাথে সালাম জানালেন, তাদের মঙ্গল কামনা করে মাটিতে চুমু খেলেন এবং মাথা নিচু করে বিনম্র অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলেন।
 

আর তখন শাহরাজাদ সকাল হয়ে যাওয়া অনুভব করলেন এবং তার কাহিনী বলা বন্ধ করলেন।

পাঁচশত আটত্রিশতম রজনীর শেষ

তিনি বললেন, “হে সৌভাগ্যশালী বাদশাহ, আমার জানা মতে, সিন্দবাদ হাম্মাল মাটিতে চুমু খেয়ে এবং বিনম্রভাবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাড়ির মালিক তাকে কাছে আসতে এবং বসতে বললেন এবং তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। এরপর তিনি তার সামনে বিভিন্ন ধরনের সমৃদ্ধ, সুস্বাদু এবং মনোহর খাবার পরিবেশন করলেন। সিন্দবাদ হাম্মাল “বিসমিল্লাহ” বলে খেতে শুরু করলেন এবং পেট ভরে খাওয়ার পর বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের অবস্থা যেমনই হোক না কেন।” তারপর তিনি হাত ধুয়ে অতিথি হিসেবে তার আপ্যায়নের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানালেন। বাড়ির মালিক বললেন, ‘তুমি স্বাগত এবং তোমার দিনটি হোক বরকতময়। কিন্তু তোমার নাম ও কাজ কী?’ সিন্দবাদ হাম্মাল উত্তর দিলেন, ‘হে মালিক, আমার নাম সিন্দবাদ হাম্মাল এবং আমি মানুষের মালপত্র মাথায় বহন করে নিয়ে যাই অর্থের বিনিময়ে।’ বাড়ির মালিক হাসলেন এবং বললেন, ‘জেনে রাখ, হে হাম্মাল, তোমার নাম আমার নামের মতোই, কারণ আমি হচ্ছি সিন্দবাদ বাহরি (নাবিক)। আর এখন, হে হাম্মাল, আমি চাই তুমি সেই কবিতাগুলি আমাকে শোনাও যা তুমি দরজায় আবৃত্তি করেছিলে।’ সিন্দবাদ হাম্মাল লজ্জিত হয়ে বললেন, ‘আল্লাহর কসম, আমাকে ক্ষমা করুন, কারণ পরিশ্রম, কষ্ট এবং দুর্ভাগ্য, যখন হাতে কিছু থাকে না, তখন মানুষকে খারাপ আচরণ এবং অভদ্রভাবে চলতে শেখায়।’ বাড়ির মালিক বললেন, ‘লজ্জিত হয়ো না। তুমি এখন আমার ভাই। কিন্তু আমাকে সেই কবিতাগুলি আবার শোনাও, কারণ আমি সেগুলি শুনে আনন্দিত হয়েছি।’ 
 

তখন হাম্মাল আবার সেই কবিতাগুলি আবৃত্তি করলেন এবং সেগুলি শুনে বণিক খুবই সন্তুষ্ট হলেন। এরপর বণিক বললেন, ‘জেনে রাখ, হে হাম্মাল, আমার কাহিনী এক বিস্ময়কর কাহিনী, এবং তুমি শুনবে কীভাবে আমি এই সম্মানজনক অবস্থায় এসে পৌঁছেছি, যা তুমি এখন আমাকে দেখতে পাচ্ছো। এই অবস্থায় পৌঁছতে আমার কত পরিশ্রম এবং ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে! আমি সাতটি সমুদ্রযাত্রা করেছি, প্রতিটি যাত্রার সাথে একটি আশ্চর্যজনক গল্প জড়িত, যা মানুষের বুদ্ধিকে হতবাক করে দেয়। এসব ঘটনাগুলি ঘটেছে ভাগ্যের খেলায় এবং নিয়তির দ্বারা নির্ধারিত ছিল। কারণ, কপালে যা লেখা আছে, তার থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই।’ (চলবে) 

Comments

    Please login to post comment. Login