পোস্টস

বিশ্ব সাহিত্য

দ্য স্পেকেল্ড ব্যান্ড (দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অফ শার্লক হোমস)

১৭ মে ২০২৪

ফাহ্‌মিদা বারী

মূল লেখক স্যার আর্থার কোনান ডয়েল

অনুবাদক ফাহ্‌মিদা বারী

                            

গত আট বছরে আমি আমার বন্ধু শার্লক হোমসকে সত্তরটিরও বেশি কেস নিয়ে কাজ করতে দেখেছি। এগুলোর মধ্যে ইংল্যাণ্ডের অতি সুপরিচিত সারে পরিবারের সাথে সম্পর্কিত কেসটি ছিল সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো। সারে পরিবার, অর্থাৎ স্টক মোরানের রয়লটদের পরিবার।

সেই কেসটি নিয়ে হোমস যখন কাজ করে, তার খুব বেশিদিন আগে ওর সাথে আমার পরিচয় হয়নি। এটি ছিল আমার বিয়ের আগের সময়ের ঘটনা। তখন আমি আর হোমস বেকার স্ট্রিটে একই রুম শেয়ার করে থাকতাম।

১৮৮৩ এর এপ্রিলের শুরু। 

আমি সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখলাম বন্ধু শার্লক হোমস আমার বিছানার পাশে পুরো পোষাক আষাকে সজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে সাধারণত অনেক দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম মাত্র সোয়া সাতটা সাজে। আমি চোখ পিটপিট করে বেশ বিস্ময় নিয়ে ওর দিকে তাকালাম।

‘বিরক্ত করার জন্য অত্যন্ত দুঃখিত ওয়াটসন। আজ সকালের জন্য এটা একরকম মেনে নাও। মিসেস হাডসনকে ডেকে তোলা হয়েছে, তিনি ডেকেছেন আমাকে আর আমি ডেকে তুললাম তোমাকে।’ হোমস বললো।

‘ব্যাপার কী? আগুন লেগেছে নাকি?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘না, মক্কেল এসেছে। একজন তরুণী খুবই উত্তেজিত হয়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। 

যখন তরুণী মেয়েরা এত সকালবেলা রাস্তায় বের হয়ে ঘুমন্ত লোকজনকে ঘুম থেকে জাগিয়ে কিছু বলতে আসে, তখন বুঝতে হবে যে তারা খুব জরুরি কিছু একটা নিয়েই কথা বলতে চায়। আর কেসটা যদি আকর্ষণীয় কিছু হয়, তাহলে আমি চাই যে তুমি গোড়া থেকেই এটা দেখ। তাই মনে করলাম যে, তোমাকে ডাক দেওয়া দরকার।’

‘ওঃ তাই? প্রিয় হোমস, আমি কোন কিছুর বিনিময়েই এটা মিস করতে চাইছি না।’

হোমসের পেশাদার তদন্তের কাজগুলো দেখার মতো আনন্দ আর কোনোকিছুতেই ছিল না। তার নিখুঁত ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং একই সাথে অনুমানের কারিকুরিগুলো ছিল দেখার মতো। প্রতিটি অনুমানই দাঁড়িয়ে থাকতো শক্ত লজিকের ওপরে যার ভেতর দিয়ে সে প্রতিটি কেস সুনিপুন দক্ষতায় সমাধান করে ফেলতো।

তাই আর একটুও কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি কাপড় চোপড় পরে নিয়েই আমি হোমসের সাথে নীচে আমাদের বসার ঘরে চলে গেলাম।

কালো পোষাক আর পুরু মুখাবরণীতে সজ্জিত হয়ে এক তরুণী আমাদের বসার ঘরের জানালার পাশে বসে ছিল। আমরা ঘরে ঢুকতেই সে উঠে দাঁড়ালো।

‘শুভ সকাল ম্যাডাম,’ হোমস উৎফুল্ল গলায় বললো। 

‘আমার নাম শার্লক হোমস। ইনি আমার বন্ধু ডাক্তার ওয়াটসন। এর সামনে আপনি সাচ্ছন্দ্যে আপনার কথাগুলো আমাকে বলতে পারেন।

ওহ! যাক, খুশি হলাম যে, মিসেস হাডসন আজ বুদ্ধি করে ফায়ারপ্লেসের আগুনটা জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন। এদিকে সরে এসে ফায়ারপ্লেসের পাশে আরাম করে বসুন। আমি আপনার জন্য এককাপ কফি দিতে বলি। দেখতে পাচ্ছি আপনি রীতিমত কাঁপছেন।’

চুপচাপ হোমসের কথামত জায়গা পরিবর্তন করে নিয়ে তরুণীটি শান্তসুরে বললো,

‘ঠিকই বলেছেন আপনি। তবে আমি ঠিক শীতের জন্য কাঁপছি না।’

‘আচ্ছা! তাহলে কীসের জন্য কাঁপছেন?’

‘ভয়ের কারণে মিঃ হোমস। একটা বিভীষিকা আমাকে ঘিরে আছে!’ 

কথা বলতে বলতেই তরুণীটি তার মুখের আবরণী সরিয়ে ফেললো। 

মেয়েটির মুখ একেবারে ফ্যাকাশে। ভীত চকিত কোনো অসহায় প্রাণীর চোখের মতো তার চোখদুটি ভয়ে কাতর হয়ে আছে। অবয়ব ও দেহের গঠন দেখে মনে হচ্ছে তার বয়স ত্রিশের মতো, কিন্তু চুল ইতিমধ্যেই ধূসর হয়ে গেছে।

একটু সামনে ঝুঁকে তরুণীটির বাহু স্পর্শ করে তার স্বভাবসুলভ আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে হোমস বললো,

‘আপনি একদম ভয় পাবেন না। আশা করছি খুব তাড়াতাড়িই আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারবো। এই ব্যাপারে আমার অন্ততঃ কোনোরকম সন্দেহ নেই। আপনি আজ সকালের ট্রেনে করে এসেছেন, তাই না?’

‘আপনি কি আমাকে চেনেন? তরুণী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।

‘না, তা নয়। আমি ধারণা করছি। আপনার বাঁ হাতের দস্তানার ভেতরে ফিরতি টিকিটের অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে। তাই এ’কথা মনে হলো।আর খুব ভোরে যাত্রা শুরু করলেও স্টেশন পর্যন্ত আপনাকে খুব ব্যস্ত রাস্তায় কুকুর চালিত যানে আসতে হয়েছে।’

বিস্ফোরিত চোখে হোমসের দিকে তাকালো তরুণীটি।

স্মিত মুখে হোমস বললো,

‘এতে কোনো রহস্য নেই ম্যাডাম। আপনার জ্যাকেটের অন্তত সাত জায়গা কাদায় মাখামাখি হয়ে আছে। আর কাদার দাগ যথেষ্ট নতুন। সব যানবাহনই কুকুরচালিত যানকে কাদা ছিটাতে ছিটাতে যায়, আর আপনি নিশ্চয়ই ড্রাইভারের বাঁ দিকেই বসে ছিলেন।’

তরুণী বললো,

‘আপনার যুক্তি যাই হোক না কেন, মিঃ হোমস...আপনি একেবারে ঠিকই অনুমান করেছেন। আমি সকাল ছয়টার আগে বাসা থেকে বেরিয়েছি, কুড়ি মিনিট পরে লেদারহেডে পৌঁছে প্রথম ট্রেনে চেপেই ওয়াটারলু এসেছি। 

স্যার, কী বলবো...আমার সাথে যা ঘটছে তা যদি একইভাবে অব্যাহত থাকে তাহলে আমি বোধহয় শেষমেষ একেবারে পাগলই হয়ে যাব। 

শুধুমাত্র একজন মোটে মানুষই আমাকে নিয়ে সত্যিকার অর্থে চিন্তা করে। কিন্তু সে নিজেই অসহায় ...আমাকে সে কোনো সাহায্য করতে পারবে বলে মনে হয় না।

আমি মিসেস ফারিন্টোশের কাছে আপনার ব্যাপারে শুনেছি জনাব হোমস। তার কঠিন প্রয়োজনের মুহুর্তে আপনি তাকে সাহায্য করেছিলেন। 

স্যার! আমি অনেক আশা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি। আপনি কি আমাকেও একটু সাহায্য করতে পারবেন? যে সাংঘাতিক অন্ধকারে আমি এখন আছি অন্ততঃ যদি কিছুমাত্র আলোর দিশাও আমাকে দেখাতে পারতেন...আমি সত্যিই খুব কৃতজ্ঞ থাকতাম আপনার প্রতি। 

এই মুহুর্তে আপনার কাজের জন্য আমি হয়ত আপনাকে কোনো পারিশ্রমিক দিতে পারবো না। কিন্তু এক মাস অথবা ছ’সপ্তাহের মধ্যেই আমার বিয়ে হয়ে যাবে। বিয়ের পরে আমার নিজের টাকার ওপরে অধিকার জন্মাবে। আশা করি, তখন আপনাকে আমি আপনার যথাযোগ্য পারিশ্রমিক দিতে পারবো।’

হোমস তার ডেস্কের কাছে গিয়ে তালা খুলে তা থেকে তার ছোট নোটবুকটা বের করলো। এক মুহুর্ত ভেবে নিয়ে সে বললো,

‘ফারিন্টোশ... ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে কেসটার কথা। ওখানে কিছু জুয়েলারী ঘটিত ব্যাপার ছিল। একটা ওপাল পাথরের টায়রা। ওয়াটসন, আমার মনে হয় তোমার সাথে পরিচয়ের আগের সময়ের কেস ছিল ওটা। 

ম্যাডাম, আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যে, আপনাকে সহযোগিতা করতে পারলে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হবো। আপনার বন্ধুকে আমি যেমন সহযোগিতা করেছিলাম আপনাকেও একই রকমভাবেই সহযোগিতা করবো। 

আর পারিশ্রমিকের কথা যদি বলেন তাহলে বলবো, আমার পেশাই আমাকে যথাযোগ্য বিনিময় দেয়। অবশ্য তার পরেও চাইলে আপনি আমাকে পারিশ্রমিক দিতে পারেন, যে সময়ে আপনার পক্ষে দেওয়া সম্ভবপর হয়। 

এখন দয়া করে আমাদের কাছে খুলে বলুন তো আপনার সমস্যাটা আসলে কী।’

‘ওহ, অনেক ধন্যবাদ জনাব।’ আমাদের অতিথি বললেন। ‘আমার পরিস্থিতির সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে, আমার ভয় এতো অস্পষ্ট আর সন্দেহগুলো এত ছোট ছোট জিনিসের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে যে, সমস্ত ব্যাপারটাই খুব তুচ্ছ আর গুরুত্বহীন মনে হচ্ছে। যাকে আমি আমার বন্ধু বলে মনে করছি তার সাথে আমি এই ব্যাপারে আলাপ করেছি। 

এমনকি সেও মনে করেছে যে, এই সবকিছুই একজন স্নায়ুচাপে আক্রান্ত নারীর অযাচিত কল্পনাছাড়া আর কিছুই নয়। যদিও সে আমাকে এটা মুখ ফুটে বলেনি, কিন্তু যেভাবে সে আমার দিকে তাকিয়েছে আর কথা বলেছে তাতে আমি ঠিকই বুঝে নিয়েছি যে সে এমনটাই ভাবছে।

কিন্তু জনাব হোমস, আমি শুনেছি যে আপনি এমন একজন, যিনি মানুষের মনের ভেতরটা দেখতে পান। মানুষের মনের নানারকম পাপাচারের গন্ধ আপনি বুঝতে পারেন। 

এক ভয়ানক বিপদ আমাকে ঘিরে রয়েছে। আমি জানি না কীভাবে তার মোকাবেলা করবো। আপনি নিশ্চয়ই আমাকে কিছু উপদেশ দিতে পারবেন।

আমার নাম হেলেন স্টোনার। আমি আমার সৎ বাবার সাথে থাকি। সারের পশ্চিম সীমানার স্টক মোরানের রয়লট পরিবার হচ্ছে ইংল্যাণ্ডের বেশকিছু প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী পরিবারের একটি। আমার সৎ বাবা সেই পরিবারের সর্বশেষ জীবিত সদস্য।’

হোমস মাথা নাড়লো, ‘জি, আমি তাদের সম্পর্কে জানি।’

‘এই পরিবারটি একসময় ইংল্যাণ্ডের সবচেয়ে ধনী পরিবার হিসেবে সুপরিচিত ছিল। তাদের ছিল প্রচুর জমিজমা। উত্তরে বার্কশায়ার সীমানা আর পশ্চিমে হ্যামশায়ার সীমানা পর্যন্ত তাদের জমাজমি বিস্তৃত ছিল। 

গত শতাব্দীতে এই পরিবারের চার পরম্পরাগত উত্তরাধিকারী, একের পরে আরেকজন, পরিবারটির সৌভাগ্যকে একেবারে ধুলিস্মাৎ করে দিয়েছে।

এখন একটা দুইশো বছরের পুরনো বাড়ি আর ছোট একটুকরো জমি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। প্রচুর টাকা পয়সার ঋণও আছে। সর্বশেষ উত্তরাধিকারী সেখানে ধুকে ধুকে বেঁচে ছিলেন। তার দশা হয়েছিল ঠিক একজন অভিজাত ভিক্ষুকের মতো।

কিন্তু তার একমাত্র ছেলে, আমার সৎ বাবা বুঝতে পেরেছিলেন যে তাকে নতুন পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। তিনি তার এক আত্মীয়ের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলেন। ডাক্তার হওয়ার পরে তিনি কলকাতা চলে গিয়েছিলেন। যেখানে খুব সফল একজন চিকিৎসক হিসেবে পসারও গড়ে তুলেছিলেন।

এই সময় একদিন তার বাসা থেকে কিছু টাকাপয়সা চুরি হয়। তিনি তার এক চাকরকে এটার জন্য দোষী সাব্যস্ত করে বসেন। প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে মারতে মারতে একেবারে মেরেই ফেলেন। এই ঘটনার জন্য তার অনেক বছরের জেলে হয়েছিল। জেল থেকে মুক্তি পেয়েই তিনি ইংল্যণ্ড ফিরে আসেন। ততদিনে তার নিজের ওপরে আর কোনো নিয়ন্ত্রনই নেই। তিনি তখন একজন অত্যন্ত হতাশ এবং রাগী মানুষ।

ডাক্তার রয়লট যখন ভারতে ছিলেন, তখন তিনি আমার মা মিসেস স্টোনারকে বিয়ে করেন। মা ছিলেন তখন তরুণী বিধবা। আমার মা’র প্রথম স্বামী, আমার বাবা মেজর জেনারেল স্টোনার ছিলেন বেঙ্গল আর্টিলারীতে। আমার মা যখন ডাক্তার রয়লটকে বিয়ে করেন তখন আমার বোন জুলিয়া আর আমার বয়স ছিল মাত্র দু’বছর। আমরা ছিলাম জমজ।

আমার মা প্রচুর টাকা পয়সার অধিকারিনী ছিলেন। কম করে হলেও বছরে তা প্রায় এক হাজার পাউণ্ডের মতো তো হবেই। কিন্তু দ্বিতীয় বিয়ের পরে তিনি এই সম্পত্তির উইল করে ফেলেন।

কিছু শর্ত সাপেক্ষে তিনি এর পুরোটাই ডাক্তার রয়লটের নামে উইল করে দেন। শর্ত মোতাবেক, যতদিন আমরা ডাক্তার রয়লটের সাথে থাকবো ততদিন এই পুরো টাকার মালিক থাকবেন ডাক্তার রয়লট। আর যদি আমাদের মধ্যে কারো বিয়ে হয়ে যায় তখন আমরাও এই টাকার একটা বড় অংশের মালিক হতে পারবো।

ইংল্যাণ্ডে ফেরার অল্প কিছুদিন পরেই মা আমাদের ছেড়ে চলে যান। ক্রু’র কাছে একটি রেল দূর্ঘটনায় আমার মা’র মৃত্যু হয়।

ডাক্তার রয়লট লণ্ডনে তার পসার জমানোর চেষ্টায় ছিলেন। মা’র মৃত্যুর পরে তিনি আচমকা ডাক্তারী পেশা একরকম ছেড়েই দেন। প্রাক্টিস করা পুরোপুরি বন্ধ করে দেন। আমাদের দু’বোনকে তিনি স্টক মোরানে তাদের পারিবারিক বাড়িতে নিয়ে আসেন।

মা যে পরিমাণ টাকা আমাদের জন্য রেখে গিয়েছিলেন, তা আমাদের সবরকম চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। সুখে শান্তিতে বাঁচতে না পারার কোন কারণই আমাদের ছিল না। 

কিন্তু এই সময়ে আমাদের সৎ বাবা কেমন যেন পাল্টে গেলেন। স্টক মোরানের একজন রয়লট আবার পুরনো বাড়িতে ফিরে এসেছে দেখে প্রথমদিকে আমাদের প্রতিবেশিরা বেশ খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের সৎ বাবা সবকিছু থেকে নিজেকে কেমন যেন গুটিয়ে নিলেন। কোনো বন্ধু তৈরি করা অথবা কারো বাসায় যাওয়া...এসবের কোনটাই তিনি করতেন না। আর কোথাও কারো সাথে দেখা হয়ে গেলে সামান্য কারণেই ঝগড়া বিবাদ বাঁধিয়ে বসতেন। কারো সাথেই তার সুসম্পর্ক গড়ে উঠলো না। বরং সকলের সাথেই তিনি তর্ক জুড়ে দিতেন।

এই পরিবারের লোকজনের মেজাজ সবসময়েই উগ্র ছিল। আর গরমের দেশে দীর্ঘ দিন থাকার কারণেই কী না, আমার সৎবাবার ক্ষেত্রে এটা প্রকট আকার ধারণ করেছিল। তার অনেকগুলো বড় বড় ঝগড়া ফ্যাসাদ বেঁধেছিল যার মধ্যে দুটো বিবাদ পুলিশ কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল। লোকজন তার ব্যবহারে একরকম অতিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আর এসব নানাবিধ ঘটনার কারণে শেষমেষ তিনি তার নিজের গ্রামেই একটি বিভীষিকায় পরিণত হন।

তিনি একজন প্রবল প্রতাপশালী মানুষ, কিন্তু যখন রেগে যান তখন আর নিজের ওপরে কোন নিয়ন্ত্রণই থাকে না। গত সপ্তাহে স্থানীয় একজন লোককে তিনি একটি ব্রিজের ওপর থেকে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। 

এই ঘটনাটি পুলিশকে জানানো হয়নি। ঘটনাটি যাতে নিষ্পত্তি হয়ে যায় সেজন্য আমি যেটুকু টাকা জোগাড় করতে পেরেছিলাম তার পুরোটাই ক্ষতিপূরণ হিসেবে জমা দিয়েছি। 

শুধুমাত্র কিছু যাযাবর জিপসী ছাড়া আমার সৎ বাবার আর কোন বন্ধুবান্ধব ছিল না। বনের মধ্যে আমাদের ছোট যেটুকু জমি আছে, সেখানে তিনি এই যাযাবর জিপসীদেরকে তাঁবু বানিয়ে থাকতে দিয়েছেন। সেই লোকগুলোর তাঁবুতে তিনি মাঝেমাঝেই যান। তারা তাকে বেশ সাদরেই অভ্যর্থনা জানায়।  আর এছাড়া প্রায়ই বেশ কয়েক সপ্তাহের জন্য তিনি হুটহাট এই জিপসীদের সাথে এখানে ওখানে বেরিয়ে পড়েন।

ভারতীয় পশু পাখির ওপরে তার একটা দূর্বলতা ছিল। তার একজন পরিচিত এইরকম কিছু ভারতীয় পশু তাকে পাঠিয়েছিলেন। এই মুহুর্তে তার কাছে একটি চিতা আর একটি বেবুন আছে। পশুগুলো পরম নিশ্চিন্তে একেবারে স্বাধীনভাবে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায়। এদের মালিকদের মতো এরা নিজেরাও একসময় গ্রামবাসীদের আতঙ্কে পরিণত হয়ে গেছে।

আপনি নিশ্চয়ই ভালোই বুঝতে পারছেন, আমার মা’র মৃত্যুর পরে থেকে আমার বোন জুলিয়া আর আমার নিজের জীবনে বলতে গেলে কোনো আনন্দই ছিল না। আর সেটা থাকার তো কোনো কারণও নেই। কোনো চাকরই বেশিদিন আমাদের বাসায় থাকতে চাইতো না। এমনকি আমাদের নিজেদেরই বাসার সব কাজ করতে হতো। 

জুলিয়ার মৃত্যুর সময়ে তার বয়স ছিল মাত্র ত্রিশ বছর। কিন্তু তখনই তার চুল সাদা হতে শুরু করেছিল, ঠিক যেমনটা এখন আমার হয়েছে।’

‘তার মানে আপনার বোন মারা গিয়েছে?’

‘দুই বছর আগেই সে মারা গিয়েছে। আর তার মৃত্যুর কারণেই আজ আমি এখানে এসেছি। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, যে জীবন আমি আর জুলিয়া যাপন করেছি সেখানে আমরা আমাদের বয়স আর অবস্থার কাউকেই আশেপাশে দেখতে পেতাম না। 

আমাদের অবশ্য একজন খালা আছেন, আমার মা’র কুমারী বোন মিস হনোরিয়া ওয়েস্টফেইল। তিনি হ্যারো’র কাছাকাছি থাকেন। আমরা মাঝেমধ্যে খুবই অল্প দিনের জন্য গিয়ে তার সাথে দেখা করে আসার অনুমতি পেতাম।

দুই বছর আগে ক্রিসমাসের সময় জুলিয়া সেখানে গিয়ে একজন ভদ্রলোকের সাথে পরিচিত হয়। ভদ্রলোক ছিলেন মেরিনের একজন অল্প বেতনভোগী মেজর। তিনি জুলিয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। জুলিয়া ফিরে আসার পরে আমাদের সৎ বাবা এ’সম্পর্কে জানতে পারেন। তবে তিনি অমত করেন না। বরং এই বিয়ের ব্যাপারে জানতে পেরে তাকে বেশ খুশিই মনে হয়।

কিন্তু বিয়ের দুই সপ্তাহ আগে এমন একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যা আমার কাছ থেকে আমার একমাত্র সঙ্গীকে কেড়ে নেয়।’

হোমস চোখ বন্ধ করে তার চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসেছিল। এবারে সে তার চোখ অর্ধেক খুলে আমাদের আগন্তুক অতিথির দিকে তাকালো।

‘অনুগ্রহ করে আমাকে সবকিছু সবিস্তারে খুলে বলুন’, হোমস বললো।

‘হ্যাঁ, তা বলছি। কারণ সেটা বলা এখন আমার জন্য খুবই সহজ। সেই সময়ের প্রতিটি ঘটনা আমার স্মৃতিতে একেবারে গেঁথে বসে গিয়েছে।

আমি ইতিপূর্বেই বলেছি যে, আমাদের পারিবারিক বাড়িটি খুবই পুরাতন এবং আমরা এই বাড়ির একটি মাত্র অংশেই বাস করি। এই অংশের শোয়ার ঘরগুলো নীচের তলায়। 

প্রথম ঘরটি ডাক্তার রয়লটের, দ্বিতীয়টি আমার বোনের এবং তৃতীয়টি আমার নিজের। এই ঘরগুলোর মাঝখানদিয়ে কোন দরজা নেই। তবে সবকয়টি ঘরের দরজা দিয়েই একটি মাত্র করিডোরেই প্রবেশ করা যায়। আমি কি আপনাকে জিনিসটা বোঝাতে পেরেছি?’

‘একেবারে সঠিকভাবে। বলতে থাকুন।’

এই সব ক’টি ঘরের জানালা বাইরে বাগানের দিকে ছিল। 

আমার বোন যে রাতে মারা যায়, সেই রাতে ডাক্তার রয়লট বেশ আগেই তার ঘরে ঢুকে গিয়েছিলেন। তবে আমরা জানতাম যে, তিনি তখনো বিছানায় যাননি। কারণ আমার বোন তার ভারতীয় সিগারের তীব্র গন্ধটা পেয়েছিল। প্রতি রাতে এই ভারতীয় সিগার খাওয়াটা তার একরকম নিয়মের মধ্যেই ছিল।

এই তীব্র গন্ধের কারণে আমার বোন জুলিয়া ঘুমাতে পারছিল না। সে তখন তার নিজের ঘর ছেড়ে আমার ঘরে চলে এসেছিল। একটু গল্পগুজব করে সময় কাটানোর জন্য। জুলিয়া সেদিন তার বিয়ে নিয়ে আলাপ করেছিল। আর অল্প কিছুদিন ছিল তার বিয়ের। 

রাত এগারোটার দিকে সে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু দরজার কাছে গিয়েই কিছু একটা চিন্তা করে খানিকক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-আচ্ছা হেলেন, বল তো! তুমি কি কখনো মাঝরাতে কোনো হুইসেলের আওয়াজ শুনতে পাও?

-নাঃ, কখনোই নয়। 

-তুমি নিজে কি ঘুমের মধ্যে হুইসেল বাজাও?

-কী বলছো! নিশ্চয়ই না! কিন্তু এসব কেন জিজ্ঞেস করছো বলতো?

-জিজ্ঞেস করছি কারণ গত কয়েক রাত ধরেই আমি খুব নীচু কিন্তু পরিষ্কার একটা হুইসেলের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। সবসময় প্রায় রাত তিনটার দিকেই আমি এই আওয়াজ শুনতে পাই। তুমি তো জানোই, আমার ঘুম খুব পাতলা। এই আওয়াজ শুনেই আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমি বলতে পারবো না, কোথা থেকে এই আওয়াজ আসে...হয়ত পাশের ঘর থেকে অথবা হয়ত বাগান থেকে। সত্যিই তুমি কখনো শোনোনি?

-নাহ! কখনোই শুনিনি। কে জানে, হয়ত বনের জিপসীদের কাছ থেকেই এই আওয়াজ আসছে।

-খুব সম্ভব। কিন্তু যদি এটা বাগান থেকে এসে থাকে তাহলে আমি এই ভেবে অবাক হচ্ছি যে, তোমার কানে এটা কেন ঢুকছে না।

- হুম! ঢুকছে না কারণ, আমার ঘুম তোমার চেয়ে অনেক বেশি গাঢ়।

-হতে পারে। তবে সে যাক, এটা নিয়ে তেমন চিন্তাভাবনা করার দরকার নেই। মনে হয় না, এটা এত বড় কোনো ব্যাপার।

এই কথা বলেই জুলিয়া আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। তারপর বেরিয়ে গেল। এর অল্প কিছুক্ষণ পরেই আমি ওর ঘরের তালা খোলার আওয়াজ শুনতে পেলাম।’

‘তাই নাকি? আপনারা কি রাতে সবসময় নিজেদের ঘরের দরজা তালাবন্ধ করে রাখেন নাকি?’ হোমস জানতে চাইলো।

‘ জি, সবসময়।’

‘কিন্তু কেন?’

‘আমি আপনাকে আগেই বলেছি যে ডাক্তার রয়লট একটা চিতা আর একটা বেবুন পুষতেন এবং এরা এখানে ওখানে ইচ্ছামত ঘুরে বেড়াতো। তাই ঘরের দরজা বন্ধ না করলে আমরা ঠিক নিরাপদ বোধ করতাম না।’

‘আমি বুঝতে পেরেছি। তারপর?’

‘সেই রাতে আমার ঘুম আসলো না। একটা কেমন যেন অসাড় অনুভূতি আমাকে চেপে বসলো। আমার কেবলই মনে হতে লাগলো, খুব খারাপ কিছু একটা হতে যাচ্ছে। আমার বোন আর আমি ছিলাম জমজ। আর জমজরা নিজেদের খুব কাছাকাছি থাকে। একই বন্ধনে তাদের আত্মাগুলো জুড়ে থাকে। অনুভূতিগুলোও খুব একইরকম হয়।

সেই রাতটি ছিল ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ। বাইরে প্রচণ্ড জোরে বাতাস বইছিল আর বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা খুব জোরে জোরে এসে জানালায় আঘাত হানছিল। 

আচমকা ঝড়ের সব আওয়াজকে ছাপিয়ে আমি একটি তীব্র চিৎকার শুনতে পেলাম। বুঝতে পারলাম এটি আমার বোনের আওয়াজ। আমি লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামলাম। গায়ে কোনমতে একটা শাল জড়িয়ে নিয়েই আমি করিডোরের দিকে ছুটে গেলাম। 

দরজাটা খুলতেই আমার মনে হলো, খুব নীচু একটা হুইসেলের আওয়াজ যেন শুনতে পেলাম। ঠিক যেমনটা আমার বোন আমাকে বলেছিল। এর কিছু সময় পরেই ধাতব কিছু একটা পতনের আওয়াজ আমার কানে এল।

আমি করিডোরের দিকে ছুটে যাওয়ার পর পরই আমার বোনের ঘরের দরজাটা খুলে গেল। করিডোরের বাতির আলোয় আমি দেখতে পেলাম, জুলিয়া করিডোরের মুখেই দাঁড়িয়ে আছে। 

তীব্র ভয়ে তার সারা মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে। দু’হাত সামনে বাড়িয়ে সে যেন একটুখানি সাহায্যের আশায় এগিয়ে আসছে।  অথচ নিজের ওপরে তখন তার কোনোই নিয়ন্ত্রণ নেই। একজন পাঁড় মাতালের মতোই বেসামাল্ভাবে এখানে ওখানে পা ফেলে চলছে।

আমি ছুটে গেলাম তাকে জড়িয়ে ধরার জন্য। কিন্তু তার আগেই জুলিয়া মাটিতে পড়ে গেল। তীব্র যন্ত্রণায় তার সারা শরীর কেমন যেন কুঁকড়ে যেতে লাগলো।

প্রথমে আমার মনে হচ্ছিলো, জুলিয়া ঠিক যেন আমাকে চিনতে পারছে না। কিন্তু  একটু নীচু হয়ে তার দিকে ঝুঁকে বসতেই সে হঠাৎ তীব্র চিৎকার করে উঠলো। ওঃ! সেই চিৎকার আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না! সমস্ত শক্তি জড়ো করে জুলিয়া বলে উঠলো,

-ওহ ঈশ্বর! হেলেন! এটা একটা বন্ধনী! একটা দাগওয়ালা বন্ধনী!

সে আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলো এবং ডাক্তারের ঘরের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখাচ্ছিল। কিন্তু আর কিছুই সে বলতে পারলো না। একটা তীব্র খিঁচুনি এসে একেবারে রুদ্ধ করে দিলো তার কণ্ঠস্বর।

আমি চিৎকার করে আমার সৎ বাবাকে ডাকতে লাগলাম। তিনি তাড়াতাড়ি তার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। জুলিয়া তখন অচেতন হয়ে পড়েছে।

দুজনে মিলে আমরা তার জীবন বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করলাম। সাহায্যের আশায় গ্রামের চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে গেলাম। কিন্তু আর কিছুই করা সম্ভব হলো না। ধীরে ধীরে জুলিয়া একেবারেই তলিয়ে গেল। সেই অচেতন অবস্থা থেকেই আমার প্রাণপ্রিয় বোন চিরতরে হারিয়ে গেল।’

‘এক মিনিট’, হোমস তাকে থামিয়ে বললো, ‘সেই হুইসেল আর ধাতব আওয়াজটা কি আপনি সত্যিই শুনতে পেয়েছিলেন?’

‘তদন্তের সময় পুলিশও আমাকে একই কথাই জিজ্ঞেস করেছিলেন। আমার যতটুকু মনে আছে আমি সত্যিই আওয়াজটা শুনতে পেয়েছিলাম। আবার এমনটাও হতে পারে যে, সেই ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ রাতের বিরূপ আবহাওয়া আর সেই আবহাওয়ায় আমাদের জরাজীর্ণ পুরাতন বাড়ির কাঁপাকাঁপিতে আমি অন্য আওয়াজকে তার সাথে গুলিয়ে ফেলেছি।’

‘আপনার বোন কি পুরো পোশাক পরিহিত অবস্থায় ছিল?’ হোমস জানতে চাইলো।

‘না, জুলিয়া রাতের পোশাকই পরে ছিল। তার ডান হাতে ছিল একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠির পুড়ে যাওয়া শেষ অংশ আর বাঁ হাতে ধরা ছিল একটা দিয়াশলাইয়ের বাক্স।’

‘অর্থাৎ ঘুম থেকে জেগেই সে আলো জ্বালিয়ে তার চারপাশটা দেখার চেষ্টা করেছিল। এটা উল্লেখ করার মতো একটা ব্যাপার। পুলিশ কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?’

‘পুলিশ খুব সময় নিয়ে আর অনেক যত্ন করে কেসটা তদন্ত করার চেষ্টা করেছেন। কারণ ডাক্তার রয়লটের খারাপ ব্যবহার সম্পর্কে তাদের ভালোমতই ধারণা ছিল। এখানে তাই তারা কোনোরকম অযত্ন দেখানোর কথা চিন্তাও করেননি। কিন্তু আমার বোনের মৃত্যুর কোন কারণই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এটা আমি বেশ নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি যে, ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। আমাদের বাড়িটা পুরনো। তাই ঘরের দরজায় আগের দিনের লোহার মজবুত কপাট লাগানো আছে। আর জানালাগুলোও প্রতি রাতেই বন্ধ থাকতো।

কক্ষের দেওয়ালগুলো খুব সতর্কতার সাথে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু কোনোরকম গোপন চোরা দরজা খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুলিশ ঘরের মেঝেও পরীক্ষা করে দেখেছিলেন। কিন্তু সেখান থেকেও কিছুই পাওয়া যায়নি।

আমাদের ঘরের চিমনি খুব প্রশস্ত। কিন্তু তার ভেতরে আড়াআড়িভাবে চারটা লোহার পাত বসানো আছে। অতএব সেটা দিয়ে কারো ঢোকার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। কাজেই এটা সুনিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে, সেই রাতে আমার বোন তার ঘরে একাই ছিল। আর তার শরীরে কোনরকম জখম বা নৃশংসতার চিহ্নও ছিল না।’

‘বিষজাতীয় কিছু কি হতে পারে?’ হোমস জানতে চাইলো।

‘ডাক্তাররা তার শরীরে বিষক্রিয়ার সম্ভাবনাও পরীক্ষা করে দেখেছেন। কিন্তু কোন সাফল্য তাতে পাওয়া যায়নি।’

‘তাহলে আপনার কী মত?  কীভাবে এই হতভাগ্য তরুণীর মৃত্যু হয়েছিল?’

‘আমি বিশ্বাস করি ভয়ের কারণেই জুলিয়ার মৃত্যু ঘটেছে। তীব্র ভয় আর তা থেকে একরকম স্নায়ু বিকৃতি। কিন্তু এটা আমার ধারণাতেও আসে না ঠিক কী কারণে সে এতটা ভয় পেয়েছিল।’

‘আপনার বোনের মৃত্যুর সেই সময়টাতেও কি জিপসীরা বনে বাস করছিল?’

‘হ্যাঁ, সবসময়ই কিছু না কিছু জিপসী সেখানে বাস করেই আসছে।’

‘হুম, আর বন্ধনী...দাগওয়ালা বন্ধনী এসব ধোঁয়াশা শব্দগুলো দিয়ে সে কী বোঝাতে চেয়েছিল?’

‘আমি জানি না। হতে পারে ভয়ের তীব্রতায় কোনো প্রলাপ বকছিল সে। হতে পারে সে একদল লোকের কথা বোঝাতে চেয়েছে... ঐসব জিপসীদের কথাও বোঝাতে পারে যারা বনে থাকতো। তাদের অনেকেই মাথায় একরকম দাগওয়ালা রুমাল বাঁধতো।’

হোমস প্রবল অসন্তোষে মাথা নাড়লো। দেখে মনে হলো না সে এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হয়েছে। মুখে বললো,

‘আচ্ছা, বলতে থাকুন।’

সেই ঘটনার পরে দুই বছর কেটে গেছে এবং সেই থেকে আজ অবধি আমি নিঃসঙ্গ একাকী জীবন যাপন করছি।

এক মাস আগে আমার একজন অতি প্রিয় বন্ধু, যাকে আমি বেশ অনেক বছর যাবত চিনি...তিনি আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছেন। তার নাম আর্মিটেজ...পার্সি আর্মিটেজ। সে ক্রেন ওয়াটারের জনাব আর্মিটেজের দ্বিতীয় ছেলে। 

আমার সৎ বাবা এই বিয়েতে সম্মতি দিয়েছেন এবং এই বসন্তেই আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি।

দুইদিন আগে আমাদের বাড়ির পশ্চিম অংশে কিছু মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে। সেই কাজ করতে গিয়ে আমার ঘরের দেওয়ালে একটি ছিদ্র দেখা গিয়েছে। সেজন্য আমাকে নিজের ঘর ছেড়ে আমার বোনের ঘরে উঠতে হয়েছে।

আমার ভয়টা একবার কল্পনা করে দেখুন! গতরাতে আমি ঠিক সেই রকমই একটা নীচু হুইসেলের আওয়াজ শুনতে পেয়েছি যার কথা মৃত্যুর দিন রাতে আমার বোন আমাকে বলেছিল। আমি লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে বাতি জ্বালিয়েছি, কিন্তু ঘরের মধ্যে কোনোকিছুই দেখতে পাইনি।

ভয়ে আমি রীতিমত ঠকঠকিয়ে কেঁপেছি। বিছানায় আবার ফিরে যাবার মতো সাহস আমার ছিল না। তাই আর দেরি না করে আমি উঠে বাইরের পোশাক পরে নিই। দিনের আলো ফুটতেই দৌড়ে ক্রাউন ইনে এসে লেদারহেড পর্যন্ত একটা কুকুরটানা গাড়ি ভাড়া করি। সেখান থেকেই আমি এই সাতসকালে ট্রেন ধরে আপনার কাছে চলে এসেছি, আপনার পরামর্শ নেওয়ার জন্য।’

‘আপনি খুব বিবেচকের মতো কাজ করেছেন। কিন্তু ঠিক করে বলুন তো, আপনি কি সবকিছু আমাকে খুলে বলেছেন?’ হোমস জিজ্ঞেস করলো।

‘হ্যাঁ, সবকিছুই খুলে বলেছি।’

‘না মিস স্টোনার। আপনি সবকিছু খুলে বলেননি। আপনি আপনার সৎ বাবাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন।’

‘আপনি কী বলতে চাইছেন?’

হেলেন স্টোনারের হাতটা তার উরুর ওপরে রাখা ছিল। কালো ঘের দেওয়া লেসের আড়ালে হাতের কব্জিটা ঢাকা পড়ে ছিল। হোমস সেটাকে সরিয়ে দিয়ে তার কব্জিটাকে দেখালো । মিন স্টোনারের ফর্সা কব্জিতে পাঁচটা ছোট ছোট লালদাগ। দাগগুলো একেবারে জীবন্ত হয়ে ফুটে রয়েছে। চারটা আঙ্গুলের আর একটা বৃদ্ধাঙ্গুলির।

‘আপনার সৎ বাবা আপনার প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করেছেন।’ হোমস বললো।

কথাটা শুনেই মিস স্টোনারের মুখের রঙ বদলে গেল। খুবই অপ্রস্তুত হয়ে তাড়াতাড়ি সে নিজের কব্জিটাকে লুকিয়ে ফেললো। মুখে বললো,

‘আসলে তিনি খুব কঠিন স্বভাবের একজন মানুষ। প্রচণ্ড গায়ের জোর। সম্ভবতঃ নিজের শক্তি সম্পর্কে তার একেবারেই ধারণা নেই।’

ঘরের মধ্যে কিছু সময়ের জন্য নীরবতা নেমে এল। হাত দিয়ে নিজের থুতনি চেপে ধরে হোমস একমনে আগুনের দিকে তাকিয়ে ছিল। 

একসময় সে মুখ খুললো,

‘সত্যিই এটা খুব জটিল একটা কেস। হাজারটা বিষয় আছে যেসব সম্পর্কে আমি বিস্তারিত জানতে চাই। কিন্তু আমাদের হাতে মোটেও নষ্ট করার মতো সময় নেই। আমরা যদি আজ স্টক মোরানে আসতে চাই, তাহলে কি আপনার সৎ বাবার বিনা অবগতিতে আমরা ঐ ঘরগুলো দেখতে পারবো?’

‘জি, আমার মনে হয় পারবেন। আমার সৎ বাবার আজ সারাদিন লণ্ডনে কাটানোর কথা। আজকে তার লণ্ডনে কীসের যেন জরুরি কাজ আছে। আর আমাদের বাসায় এখন একজন গৃহকর্মী আছে। তবে সে বেশ বৃদ্ধ আর বোকাসোকা। আমি তাকে সেই সময়ে কিছু বলে কয়ে বাইরে পাঠিয়ে দিতে পারবো। ’

‘দারুণ! ওয়াটসন, তুমি কি আমার সাথে আসতে চাও?’

‘আমি আসতে পারলে খুবই আনন্দিত হবো, হোমস।’ আমি বললাম।

মিস স্টোনার বললো,

‘লণ্ডনে এলে আমি সাধারণত দু’একটি কাজ করে যাই। কিন্তু বারোটার মধ্যেই আমি ফিরতি ট্রেনে রওয়ানা দিব। অতএব আপনারা এসে পড়ার আগেই আমি বাসায় পৌঁছে যাবো আশা করছি।’

হোমস বললো,

‘তাহলে আজ বিকেলের প্রথম ভাগেই আপনার সাথে আমাদের আবার দেখা হচ্ছে মিস স্টোনার। আপনি কি আমাদের সাথে সকালের নাস্তা করবেন?’

‘না না, আমাকে এখন অবশ্যই যেতে হবে। আপনাকে সবকিছু বলতে পেরে আমি সত্যিই খুব ভালো বোধ করছি। বিকেলে আপনাদের সাথে দেখা হওয়ার অপেক্ষায় থাকবো আমি।’

কথাটা বলেই মিস স্টোনার মুখাবরনীটাকে আবার তার মুখের ওপরে ফেলে দিয়েই দ্রুতপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

চেয়ারে বসতে বসতে হোমস জিজ্ঞেস করলো,

‘সবকিছু শুনে তোমার কাছে কী মনে হচ্ছে ওয়াটসন?’

‘এটা তো আমার কাছে ভীষণরকম অভাবনীয় একটি কেস বলে মনে হচ্ছে। তরুণীটি বলছে যে, দেওয়াল অথবা মেঝের মধ্য দিয়ে কোনো পথ নেই। চিমনির মাঝখানে লোহার দণ্ড লাগানো আছে, যা দিয়ে আসা যাওয়া করা অসম্ভব। দরজা অথবা জানালার মধ্য দিয়েও কেউ আসা যাওয়া করতে পারেনি। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, অদ্ভূত মৃত্যুটাকে বরণ করে নেওয়ার সময় তরুণীটি তার ঘরে সম্পূর্ণ একা ছিল।’

‘নিশি রাতের সেই হুইসেল আর মৃত্যুপথযাত্রীনির মুখের ঐসব অদ্ভূত কথাগুলোরই বা কী অর্থ দাঁড়ায়?’

‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’ আমি হতাশ গলায় বললাম।

‘ঐ জিপসী লোকগুলোর সাথে এটার কোন সংযোগ থাকতে পারে। তারা ডাক্তারের খুব নিকট বন্ধু। ডাক্তার তার সৎ মেয়েদের বিয়ে বন্ধ করতে চাইতে পারেন। আর এই কাজে জিপসীদের সহযোগিতাও তিনি পেতে পারেন।

মিস হেলেন স্টোনার যে ধাতব কিছুর আওয়াজের কথা বলছিলেন, সেটা হতে পারে দরজার কপাট বন্ধ হওয়ার আওয়াজ। কপাটের ধাতব দণ্ডগুলো স্বস্থানে বসে যাওয়াতেই ওমন কিছু একটা আওয়াজ হতে পারে। কিন্তু কীভাবে.........!

হোমসের শেষ কথাগুলো তার মুখেই রয়ে গেল, কারণ হঠাৎ আমাদের ঘরের দরজাটা প্রচণ্ড এক ধাক্কায় খুলে গেল এবং একজন বিশালদেহী লোক ঘরে প্রবেশ করলেন। তিনি এতটাই লম্বা যে আমাদের ঘরের দরজার মাথা প্রায় তার মাথার সাথে লেগে গেল। চওড়াতেও কিছু কম যান না! 

অদ্ভূত এক মিশেল পোষাক পড়ে ছিলেন তিনি। তার কালো টুপি আর লম্বা কালো কোট ছিল পেশাদারী ব্যক্তিদের মতো, কিন্তু আবার ট্রাউজারটি ছিল অনেকটা কৃষকদের মতো। মোটা একটা হাঁটার ছড়ি ধরা ছিল হাতে।

অসংখ্য বলিরেখায় ক্লিষ্ট তার বিশাল মুখটা ছিল খুবই তীক্ষ্ণ আর সূর্যের তাপে হলদেটে হয়ে পুড়ে যাওয়া। মাংসহীন সুঁচালো নাকটা তার মুখটাকে অনেকটা শিকারী পাখীর আকৃতি দিয়েছিল। তীব্র ঘৃণাভরা দুটি কুতকুতে চোখ সে আমাদের দুজনের ওপরে নিক্ষেপ করে বললো,

‘তোমাদের দু’জনের মধ্যে হোমস কে?’

‘এটি আমার নাম জনাব’ হোমস বললো। ‘এবং আপনি...?’

‘আমি স্টক মোরানের ডাক্তার গ্রিমসবী রয়লট।’ লোকটি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন।

‘সত্যিই? বসুন দয়া করে।’ হোমস একান্ত বিনীতভাবে কথাগুলো বললো

‘জি না, আমি এখানে বসতে আসিনি। আমার মেয়ে এখানে এসেছিল। জানতে এসেছি, সে তোমাকে কী বলতে এসেছিল?’

‘বছরের এই সময়ে শীত এবারে একটু কম।’ হোমস বললো।

‘সে তোমাকে কী বলতে এসেছিল?’ বৃদ্ধ লোকটি চিৎকার দিয়ে উঠলো। এবারে প্রচণ্ড হিংস্রভাবে।

হোমস শান্তমুখে তার কথা চালিয়ে গেল,

‘কিন্তু ফুলগুলো ফুটতে শুরু করে দিয়েছে।’

এক পা সামনে এগিয়ে নিজের ছড়িটাকে বাতাসে একবার ঘুরিয়ে নিয়ে আমাদের নতুন আগন্তুক বললেন,

‘হাহ! তুমি উত্তর দিতে চাইছো না, তাই না? আমি চিনি তোমাকে, ঝামেলাবাজ এক লোক!’

হোমস হাসলো। ভদ্রলোক তার কথা চালিয়ে গেলেন,

‘তুমি হচ্ছো হোমস, যে অন্য মানুষের কাজকর্ম থেকে নিজের নাকটাকে কখনো সরাতে পারে না।’

হোমসের হাসিমুখ এবারে বেশ চওড়া হলো। ভদ্রলোক সেদিকে না তাকিয়েই বলে চলেছেন,

হাহ! হোমস! যে নাকি নিজেকে পুলিশ মনে করে!’

হোমস এবার শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতেই বললো,

‘ওহ! আপনার কথাবার্তা সত্যিই খুবই উপভোগ্য। অনুগ্রহ করে বের হয়ে যাওয়ার সময় দরজাটা বন্ধ করে দেবেন।’

‘আমি তখনই বের হবো যখন আমার কথা শেষ হবে। যা বলতে এসেছি তা না বলে আমি এখান থেকে বিদায় হচ্ছি না। 

সাবধান করে দিলাম। খবরদার! আমার ব্যাপার থেকে দূরে থাকো বলছি। আমি জানি মিস স্টোনার এখানে এসেছিল। আমি তাকে অনুসরণ করেছি! আমি একজন ভয়ংকর লোক! বুঝেছো?’ 

বলতে বলতে সে দ্রুত এক পা সামনে এগিয়ে আসলো। একটা পোকার ছিনিয়ে নিয়ে সেটাকে তার বিশাল বাদামী হাত দিয়ে একেবারে বাঁকিয়ে ফেললো। তারপরে সেটাকে ফায়ারপ্লেসে ছুঁড়ে মেরে তীক্ষ্ণ একটা দৃষ্টিপাত করে ভারী পদক্ষেপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

হোমস হাসতে হাসতে বললো,

‘দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব দারুণ মানুষ। আমি যদিও এতটা বিশালদেহী নই, তবু আমার বিশ্বাস আমার শক্তিও তার চেয়ে খুব বেশি কম নয়।’ 

বলতে বলতে হোমসও একটা পোকার ওঠালো। কোনা ধরে একটু টান দিয়ে সে আবার সেটাকে সোজা করে রেখে দিল।

তারপরে আগের কথার সাথে যোগ করলো,

‘পুরো কেসটাকে এখন আরো বেশি চমকপ্রদ বলে মনে হচ্ছে। 

এই মুহুর্তে শুধু এটাই আশাই করছি যে, আমাদের সকালের আগন্তুক বন্ধুটিকে এখানে আসার জন্য যাতে কোনো বিপদের মুখোমুখি হতে না হয়। ওয়াটসন, এখন আমরা কিছু নাস্তার অর্ডার করি। তারপরে আমি একটু রেকর্ড অফিসে যেতে চাই। আশা করছি সেখান থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাবো।’

শার্লক হোমস যখন ফিরে এল, তখন একটা বেজে গেছে। তার হাতে একটা নীল কাগজ ধরা ছিল। তাতে কিছু হিজিবিজ নোট আর সংখ্যা লেখা ছিল। সে জানালো,

‘আমি ডাক্তার রয়লটের মৃতা স্ত্রীর উইল দেখে এলাম। টাকার পরিমাণ নেহায়েত কম নয়। গত আট বছর আগে বছরে প্রায় এগারোশ দশ পাউণ্ডে এসে দাঁড়ায়। এখন কৃষিদ্রব্যের পড়তির কারণে এটা কমে দাঁড়িয়েছে সাতশো পঞ্চাশ পাউণ্ডের কম। আর যখন কোনো মেয়ে বিয়ে করবে তখন সে বছরে আড়াইশো পাউণ্ড করে পাবে।

সুতরাং বুঝতেই পারছো, যদি দুজন মেয়েই অথবা একজনও যদি বিয়ে করে বসেন তাহলে ডাক্তার রয়লটের জন্য নির্ধারিত টাকার পরিমাণ একেবারেই কমে যাবে। 

অতএব বুঝলে? আমার প্রাতঃভ্রমন একেবারে বৃথা যায়নি। মেয়েদের বিয়ে থামিয়ে দেওয়ার পক্ষে তার খুব জোরালো কারণ ছিল।

ওয়াটসন, আশাকরি তোমার আর বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে এটা এখন খুব সাংঘাতিক একটা ব্যাপারে দাঁড়িয়ে গেছে। বৃদ্ধ ডাক্তারও জেনে গেছেন যে, আমরা তার ব্যাপারে নাক গলাতে শুরু করেছি। তুমি যদি এই মুহুর্তে তৈরি থাকো, তাহলে এখনই একটা গাড়ি ভাড়া করে আমরা ওয়াটারলু’র পথে যাত্রা করতে পারি। আর হ্যাঁ, দয়া করে তোমার রিভলভারটি সঙ্গে নাও। যিনি হাতের তালু দিয়ে স্টিলের পোকার বাঁকিয়ে ফেলতে পারেন, তার সাথে মোকাবেলা করতে চলেছো। 

সুতরাং এটি ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়তে পারে।’

ওয়াটারলু থেকে আমরা লেদারহেড যাওয়ার ট্রেনে চেপে বসলাম। স্টেশনে নেমে আমরা একটা গাড়ি ভাড়া করলাম গন্তব্য যাওয়ার জন্য। 

সার’এর মনোরম গ্রাম্য পথ দিয়ে চলেছি। চমৎকার একটা দিন। আকাশে উজ্জ্বল সূর্য আবার একই সাথে অল্প কিছু মেঘেদের আনাগোনা। গাছগুলো সদ্য তাদের নতুন পাতা দেখাতে শুরু করেছে। বাতাসে মিশে রয়েছে সোঁদা মাটির মিষ্টি গন্ধ।

এক অদ্ভূত অনুভূতি ঘিরে ধরলো আমাকে। যে ঘন কুয়াশাঘেরা রহস্য আজ আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে তার সাথে বসন্তের এই আগ্রাসী সৌন্দর্যের অনেক ফারাক।

আমার বন্ধু হোমস বসেছে গাড়ির সামনে। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কঠিন চিন্তায় সে মগ্ন হয়ে রয়েছে। টুপি দিয়ে নিজের চোখ দুটোকে ঢেকে রেখেছে সে। থুতনি ঝুঁকে রয়েছে একেবারে বুকের ওপর। যুক্তি আর অনুমানের খেলায় সে আচ্ছন্ন এখন।

হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়েই আমার কাঁধ স্পর্শ করে মাঠের ওপর পাশে দেখলো। ঘন বাঁশঝাড়ে ঘেরা একটি বিশাল অতি পুরাতন বাদামি রঙের বাড়ির দিকে আঙ্গুল তুলে দেখালো।

‘দেখ ঐদিকে। ওটাই সম্ভবত স্টোক মোরান।’ হোমস বললো।

‘জি স্যার। ওটাই ডাক্তার গ্রিমসবী রয়লটের বাসা।’ গাড়ির কোচোয়ান বললো।

‘ঐদিকে কিছু বাসাবাড়ি দেখা যাচ্ছে। আমরা মনে হয় ঐদিকেই যাচ্ছি।’ কিছু দূরে একসারি ছাদের দিকে দেখিয়ে হোমস বললো। 

‘ঐদিকে গ্রাম।’ কোচোয়ান বললো। ‘কিন্তু আপনি যদি ঐ বাড়িটার দিকে যেতে চান তাহলে মাঠের এই পায়ে হাঁটার পথটাই বেশি কাছে হবে। ঐ যে ওটাই, দেখতে পাচ্ছেন যেখানে একজন ভদ্রমহিলা হাঁটছেন?’

হোমস নীচু স্বরে বললো, ‘এবং আমার মনে হয় সেই ভদ্রমহিলা হচ্ছেন মিস স্টোনার।’

আমরা গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। কোচোয়ান গাড়ি ঘুরিয়ে আবার লেদারহেডের দিকে যাত্রা করলো।

সেদিয়ে তাকিয়ে হোমস বললো,

‘আমার কাছে মনে হলো কোচোয়ান আমাদের আর্কিটেক্ট বা বাড়ি সংক্রান্ত কোনো কাজ নিয়ে এসেছি বলে মনে করেছে। সে কারণেই সে আর খুব বেশি কৌতুহল দেখায়নি।’

তারপরে মিস স্টোনারের কাছে এগিয়ে এসে বললো,

‘শুভ বিকেল, মিস স্টোনার।’

আমাদের সকালের অতিথি আমাদেরকে দেখতে পেয়েই আনন্দিত মুখে ছুটে আসলো। উষ্ণ করমর্দন করে উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,

‘সবকিছুই ঠিকঠাকমত চলছে। ডাক্তার রয়লট লণ্ডনে গিয়েছেন এবং মনে হচ্ছে না যে, আজ সন্ধ্যার আগে তিনি আর ফিরবেন।’

‘আমাদের ইতিমধ্যেই তার সাথে সাক্ষাৎ হয়ে গেছে। তার উপস্থিতি আমাদের বেশ বিনোদন যুগিয়েছে!’ কথাটা বলেই ডাক্তার রয়লটের সাথে সকালে আমাদের কী কী কথা হয়েছে হোমস সংক্ষেপে তার একটা বর্ণণা দিল।

শুনতে শুনতে মিস স্টোনারের মুখ সাদা হয়ে গেল। প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,

‘হা ঈশ্বর! তার মানে তিনি আমাকে অনুসরণ করেছেন! এখন কী হবে? তিনি যে এত ধূর্ত একজন মানুষ তা বলার মতো নয়! আমি ভুলেই গেছি কবে আমি তার কাছে নিরাপদ ছিলাম অথবা আদৌ ছিলাম কী না।’

‘চিন্তা করবেন না।’ হোমস বললো, ‘তিনি নিজেই এখন সতর্ক হয়ে থাকবেন, কারণ ডাক্তার সাহেব বুঝে গেছেন যে তার চেয়েও ধূর্ত কেউ এবারে তার পিছু নিয়েছে।

 আর আপনি আজ রাতে তার কাছে থেকে দূরে থাকবেন। নিজের ঘরে ভালোমত তালাবন্ধ করে রাখবেন। যদি এর পরেও তিনি বাড়াবাড়ি কিছু করেন, তাহলে আমরা আপনাকে হ্যারোতে আপনার খালার বাসায় রেখে আসবো। 

এখন আমাদেরকে নিজেদের এই অল্প সময়টুকুর যথাযোগ্য সদ্ব্যবহার করতে হবে। দয়া করে আমাদেরকে সেই ঘরগুলোতে নিয়ে চলুন। সেগুলো খুব ভালোমত পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখতে হবে।’

বাড়িটা ধূসর পাথর দিয়ে তৈরি যার একটি কেন্দ্রীয় অংশ এবং দু’পাশে দুটি বাঁকানো পার্শ অংশ । একটি অংশের জানালাগুলো ছিল ভাঙ্গা এবং সেগুলো কাঠের বোর্ড দিয়ে ঢেকে রাখা। কেন্দ্রীয় অংশ বেশ ভালো অবস্থাতেই ছিল এবং ডান পাশের অংশটা ছিল সবচেয়ে আধুনিক। এই অংশটিতেই এই পরিবারটি বাস করতো।

সবশেষের দেওয়ালটিতে কিছু কাজ চলছিল। তবে আমরা যে সময়টাতে বাড়িটা দেখতে গিয়েছিলাম সেই সময় সেখানে কোন শ্রমিক কাজ করছিল না। জানালার বাইরের দিকগুলো হোমস খুব সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করে দেখছিল।

‘আচ্ছা, মিস স্টোন ...তাহলে এটি আপনার আগের ঘর। মাঝখানেরটি ছিল আপনার বোনের। আর তার পাশের ঘরটি আপনার সৎ বাবার, ঠিক তো?’

‘জি, ঠিক আছে। তবে এখন আমি মাঝখানের ঘরটিতে ঘুমাই।’

‘হুম, বাড়ির কাজ চলার জন্য আপনাকে শিফট করতে হয়েছে, বুঝতে পেরেছি। তবে শেষের দেওয়ালটিতে মেরামত কাজের খুব বেশি কিছু প্রয়োজন ছিল বলে তো মনে হলো না।’ হোমস বললো।

‘জি, ঠিকই বলেছেন। এই কাজ করার কোনোই দরকার ছিল না। আমার কাছে তো মনে হয় এটা আমাকে আমার ঘর থেকে সরিয়ে দেওয়ার একটা বাহানা মাত্র।’

‘বাহ! চমৎকার! হুম সেটাই তো মনে হচ্ছে।’ হোমস বললো, ‘এখন আপনি আপনার বর্তমান ঘরে ঢুকে কপাটটা ভালোমত বন্ধ করে দিন তো!’

মিস স্টোনার হোমসের কথামত কাজ করলো। হোমস একটা ছুরি নিয়ে কপাটটাকে কে খুব চাপাচাপি করে খুলে ফেলার চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। নিজের লেন্স দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হিঞ্জগুলো পরীক্ষা করে দেখলো। বোঝা গেল সেগুলো শক্ত ধাতব পাতের তৈরি। আর খুব শক্ত ভাবে ইটের সাথে গেঁথে রাখা। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে হোমস বললো,

‘হুম! আমার তত্ত বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেখা যাচ্ছে। নাঃ! এই শাটার ঠিকমত লাগানো থাকলে কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না। নিখুঁত নির্মাণ। বেশ! তাহলে এখন দেখা যাক, কক্ষের ভেতরে কিছু পাওয়া যায় কী না!’

একটা ছোট পাশ দরজা দিয়ে সাদা রঙ করা করিডোরটাতে যাওয়া যায়। হোমস প্রথম ঘরটি দেখতে চাইলো না। তার আগ্রহ দ্বিতীয় ঘরটাতে যেটাতে এখন মিস স্টোনার ঘুমাচ্ছেন আর মৃত্যুর রাতে মিস জুলিয়া স্টোনার ঘুমিয়েছিলেন।

আমরা সর্বপ্রথমে সেই ঘরটাতেই গেলাম। এই ঘরটি ছিল বেশ ছোট। ছাদ অনেক নীচুতে আর ঘরের ফায়ারপ্লসটি বেশ চওড়া।

ঘরটির এক কোনায় একটি ছোট বাদামী চেস্ট অফ ড্রয়ার আর আরেককোণায় একটি সরু বিছানা পাতা রয়েছে। জানালার বাঁ পাশে একটি ড্রেসিং টেবিল। আর ছোট ছোট দুটি চেয়ার। ব্যস, ঘরটির আসবাব বলতে এটুকুই।

ঘরটির দেওয়ালগুলো ওক কাঠের তৈরি, যাদের বয়স বাড়িটার বয়সের সমান বলেই মনে হয়। 

হোমস একটা চেয়ারক টেনে এক কোনায় নিয়ে গেল এবং কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। তার চোখ দুটি ঘরের চারপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগলো আর কক্ষের প্রতিটি অংশ নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।

পর্যবেক্ষণ শেষে সে জিজ্ঞেস করলো,

‘ঐ ঘন্টাটি কখন বাজানো হয়? ঘণ্টা বাজলে কে সাড়া দেয়? প্রশ্নটা করে হোমস একটি মোটা দড়ির দিকে নির্দেশ করলো যা বিছানার একপাশে ঝুলে ছিল। আর তার শেষ মাথাটি ছিল বালিশের ওপরে।

‘ওহ, এটা চাকরদের ঘরের সাথে সংযুক্ত।’ মিস স্টোনার উত্তর দিল।

‘ঘরের আর অন্য অন্যকিছুর চেয়ে এটা তুলনামূলকভাবে নতুন বলে মনে হচ্ছে।’

‘হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। এটা দু’বছর আগেই এখানে বসানো হয়েছে।’

‘হুম, তাহলে আমি ধারণা করছি আপনার বোন হয়ত এটা লাগাতে চেয়েছিলেন।’

‘না, সে এটা কখনো ব্যবহারই করেনি। আমাদের কিছু দরকার হলে আমরা নিজেরাই তা নিয়ে নিতাম। চাকরদের ডাকার কখনো প্রয়োজন পড়তো না।’

‘তাহলে ঐখানে ওমন সুন্দর একটা ঘন্টার দড়ি ঝুলিয়ে রাখার তো কোন প্রয়োজনই দেখছি না।’ হোমস বললো, ‘আচ্ছা, আমাকে কিছু সময়ের জন্য মেঝেটা ভালো করে দেখতে দিন।’

হোমস তার মুখটা নীচু করে মেঝের বোর্ডগুলোর মাঝের জায়গাটা ভালোমত পরীক্ষা করলো। তারপরে সে দেওয়ালে মুড়ে রাখা কাঠের কাছে গিয়েও একই কাজ করলো। অতঃপর বিছানার কাছে এগিয়ে এসে সেদিকে তাকিয়ে থাকলো। সবশেষে সে ঘণ্টার দড়িটা হাতে নিয়ে সেটাতে একটা টান দিল।

‘এ কী! এ তো দেখছি আসল ঘন্টা নয়! কোনো তারের সাথেই এটা সংযুক্ত নয়।’ হোমস সবিস্ময়ে বললো, ‘কী আশ্চর্যজনক ব্যাপার! এটি ভেন্টিলেটরের ওপরে হুক দিয়ে দেওয়ালের সাথে আটকে রাখা হয়েছে মাত্র!’

মিস স্টোনার বললো, ‘কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার! আমি এটা আগে খেয়ালই করিনি!’

‘খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার!’ দড়িটা টেনে ধরেই হোমস খুব শান্তভাবে বললো। ‘এই কক্ষটিতে দু’একটি জিনিস খুব খুব অস্বাভাবিক। যেমন, ভেন্টিলেটর বাইরের দিকে খোলা না রেখে কেন পাশের কক্ষের সাথে লাগানো থাকবে?’

মিস স্টোনার উত্তর দিলো, ‘সেটা অনেক বেশি মাত্রায় আধুনিক ধারণা হতে পারে, হয়ত সেজন্য।’

‘ভেন্টিলেটরটি কি এই ঘন্টার দড়ির সাথে একই সময়ে লাগানো হয়েছে? হোমস জিজ্ঞেস করলো।

‘হ্যাঁ, সেই সময়ে বেশ কিছু ছোটখাট কাজ করানো হয়েছিল।’

‘হুম, ঘণ্টার দড়ি যা ঠিকমত টানা যায় না...ভেন্টিলেটর যা ভেন্টিলেশনের কাজ করে না...বেশ! তা মিস স্টোনার, আপনার অনুমতি পেলে আমরা এখন পাশের ঘরটা দেখে আসতে পারি।’ হোমস বললো।

ডাক্তার রয়লটের ঘরটি আগের ঘরটির চেয়ে বেশ বড়, তবে এখানেও আগেরটার মতোই খুব সামান্যই আসবাব। একটি বিছানা, বইভর্তি একটি কাঠের শেল্ফ, বিছানার পাশে একটি আরাম কেদারা, একটি অতি সাধারণ কাঠের চেয়ার দেয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখা, একটি গোল টেবিল আর একটি লোহার বড় বাক্স। জিনিসপত্র বলতে এটুকুই ছিল ডাক্তারের কক্ষে।

হোমস গভীর মনোযোগের সাথে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটি জিনিস ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো।

‘এর ভেতরে কী আছে? বাক্সটি দেখিয়ে সে বললো।

‘আমার সৎ বাবার ব্যবসার কাগজপত্র।’

‘ওহ! তাই নাকি? আপনি কি ভেতরটা দেখেছেন?’

‘কয়েকবছর আগে একবারের জন্য মাত্র দেখেছিলাম। আমার মনে আছে বাক্সটি কাগজ দিয়ে ভর্তি ছিল।’

‘আশা করছি যে এর মধ্যে বিড়াল থাকে না, তাই না?’

‘নাহ! এটা কী রকম আশ্চর্য কথা! এখানে বিড়াল থাকবে কেন?’

‘বেশ, তাহলে এখানে দেখুন!’ হোমস এই কথা বলতে বলতে একটা ছোট দুধ ভর্তি পাত্র ভেতর থেকে বের করলো। পাত্রটি বাক্সের উপরেই রাখা ছিল।

‘না, আমরা তো বিড়াল পুষি না! তবে আগেই বলেছি আমার সৎ বাবার পোষা একটি চিতা আর একটি বেবুন আছে।’

‘হ্যাঁ, তা ঠিক আছে। কিন্তু এই দুধের পাত্রটি তো বেশ ছোট! এটাতে করে ঐসব পশুদের জন্য তো আর দুধ রাখা সম্ভব নয়! আচ্ছা, এখন আমাকে একটা জিনিস পরীক্ষা করে দেখতে হবে।’

কথাটা বলেই হোমস দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখা কাঠের চেয়ারটার সামনে ঝুঁকে বসে পড়লো। গভীর মনোযোগের সাথে সে চেয়ারটাকে পরীক্ষা করতে লাগলো। তারপরে উঠে দাঁড়িয়ে মিস স্টোনারকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘হুম, ধন্যবাদ। দেখলাম...ঠিক আছে। এখানে কিছু জিনিস খুবই বিস্ময় জাগাচ্ছে আমার মনে, সন্দেহ নেই।’

বিছানার এক কোনায় হোমস কুকুরের গলায় বেঁধে রাখার একটা চেন দেখতে পেল, বিছানার কোনা থেকে চেনটা ঝুলছে। চেনটার শেষ মাথা একটা ছোট বৃত্তের সাথে বেঁধে রাখা। সেটা দেখে হোমস আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

‘এটা দেখে তোমার কী মনে হচ্ছে ওয়াটসন?’

আমি বললাম,

‘এটা তো দেখতে একটা সাধারণ কুকুর বেঁধে রাখার চেন বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু বুঝতে পারছি না এটা এখানে এভাবে বাঁধা রয়েছে কীসের জন্য!’

‘এটা খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না, তাই না? হুম, ঠিক আছে...মনে হচ্ছে এখনকার মতো অনেককিছুই দেখে ফেলেছি মিস স্টোনার। এখন আপনার অনুমতি পেলে আমরা আবার বাগানের দিকে যেতে পারি।’

ঘরটা ছাড়ার সময় আমার মনে হলো হোমসের মুখ খুব গম্ভীর হয়ে উঠেছে। এমনটা আমি আগে কখনো দেখিনি। বাগানটা বেশ কয়েকবার চক্কর কাটার পরে হোমস মুখ খুললো,

‘মিস স্টোনার, আপনাকে আমার উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে। যদি তা না করেন, তাহলে আপনি মারা পড়তে পারেন।’

‘আপনি যেভাবে আমাকে করতে বলেন আমি সেভাবেই সবকিছু করবো জনাব হোমস!’

‘প্রথম কথা হচ্ছে, আজকের রাত আমি এবং আমার বন্ধু ওয়াটসন আপনার ঘরেই কাটাবো।’

হোমসের কথা শুনে আমি এবং মিস স্টোনার দুজনেই তার মুখের দিকে অবাক চোখে তাকালাম।

‘জি, আমাদের থাকতেই হবে। আচ্ছা, আমাকে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে দিন। আমার মনে হয়, ঐটা গ্রামের অতিথি শালা...তাই না?’

‘জি, ঐ টা ক্রাউন।’

‘বেশ। আপনার ঘরের জানালা তো ওখান থেকে দেখা যায়, ঠিক না?’

‘নিশ্চয়ই।’

‘এখন শুনুন কী করতে হবে। আপনার সৎ বাবা যখন ফিরে আসবেন, তখন আপনি আপনার ঘরেই থাকবেন। যখন তিনি রাতে ঘুমানোর জন্য তার নিজের ঘরে চলে যাবেন, তখন আপনি আপনার জানালার কপাট গুলো খুলে দেবেন এবং সেখানে একটা বাতি জ্বালিয়ে রাখবেন যাতে আমরা সেটাকে দেখতে পারি।

তারপরে আপনি আপনার নিজের পুরনো ঘরে চলে যাবেন। আমার তো মনে হয়, এক রাতের জন্য আপনি ঠিকই একটা ব্যবস্থা করে নিতে পারবেন। পারবেন না?’

‘জি, হ্যাঁ...নিশ্চয়ই পারবো!’

‘আমরা রাতটা আপনার বর্তমান ঘরটাতেই কাটাবো। যে শব্দ আপনি শুনতে পাচ্ছেন, আমরা তার কারণ আবিষ্কার করার চেষ্টা করবো।’

নিজের হাতটাকে হোমসের বাহুতে রেখে মিস স্টোনার বললো,

‘আমার তো মনে হচ্ছে, আপনি ইতিমধ্যেই সেই কারণ আবিষ্কার করে ফেলেছেন, জনাব হোমস।’

‘হুম, সম্ভবত আমি করতে পেরেছি।’

‘তাহলে অনুগ্রহ করে বলুন, কী ছিল আমার বোনের মৃত্যুর কারণ!’

‘কিছু বলার আগে আমি আরো নিশ্চিত হয়ে নিতে চাই, মিস স্টোনার।’

‘আপনিও কি মনে করেন, ভয় থেকেই তার মৃত্যু হয়েছিল?’

‘না, আমি তা মনে করি না। বরং আমি বিশ্বাস করি, আরো বাস্তবসম্মত কোন কারণেই আপনার বোনের মৃত্যু হয়েছে। আচ্ছা, এখন আমাদের যাওয়া উচিত মিস স্টোনার। কারণ যদি ডাক্তার রয়লট চলে আসেন আর এসে আমাদের দেখতে পান, তাহলে আমাদের এই ভ্রমন আপনার কোনো কাজেই আসবে না।

বিদায়, মনে সাহস রাখুন।’

শার্লক হোমস আর আমি গ্রামের অতিথি শালা ক্রাউন ইনে একটি শোয়ার আর একটি বসার ঘর ভাড়া করলাম। ঘরদুটো দোতলা অতিথি শালার ওপরের তলাতে ছিল। সেখানকার জানালা থেকে আমরা মিস স্টোনারদের বাড়ি একেবারে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম।

সন্ধার প্রথমভাগেই দেখতে পেলাম ডাক্তার রয়লট একটি গাড়িতে চেপে আসছেন। অল্প কিছুক্ষণ পরেই গাছপালার ফাঁক দিয়ে একটা হঠাৎ আসা আলো চোখে পড়লো। বুঝতে পারলাম, কোনো একটি ঘরে বাতি জ্বালানো হয়েছে।

নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে পাশাপাশি বসে আছি আমি আর হোমস। হোমস বলে উঠলো,

‘ওয়াটসন, আজ রাতে তোমাকে সাথে নেওয়ার ব্যাপারে আমি কিছুটা দ্বিধায় ভুগছি। আজ কিছু একটা ভয়ানক বিপদের আঁচ করতে পারছি আমি।’

‘আমি কি তোমার কোনো কাজে লাগতে পারবো বলে মনে করো?’

‘তুমি থাকলে খুব ভালো হয়।’

‘তাহলে আমি নিশ্চয়ই তোমার সাথে যাবো। আর আমার মনে হয় তুমি সেই ঘরে অনেক কিছুই দেখেছিলে যা আমি দেখতে পাইনি।’

‘হুম, ঐ বাসায় যাওয়ার আগেই আমি জানতাম যে ওখানে কোনো ভেন্টিলেটরের সন্ধান আমি পাবো।’

‘বল কী!’

‘হ্যাঁ, ঠিকই! হেলেন স্টোনার বলেছিলেন যে, তার বোন ডাক্তার রয়লটের সিগারের গন্ধ পেতেন। সেটা থেকে বোঝা যায় যে, দুইটি ঘরের মাঝখানে নিশ্চয়ই কিছু একটা ফাঁকা জায়গা আছে। এটা খুব ছোট হতে পারে, কারণ পুলিশ এই ব্যাপারে কিছু জানায়নি। তারমানে এটা একটা ভেন্টিলেটরই হতে পারে।’

‘কিন্তু এটা কি এমন কিছু উল্লেখ করার মতো বিষয়?’

‘তোমার কাছে কি এটাকে আশ্চর্যজনক মনে হচ্ছে না? একটা ভেন্টিলেটর লাগানো আছে, একটি ঘণ্টার দড়ি ঝোলানো আছে আর একজন তরুণী তার বিছানায় মারা যাচ্ছে! 

এটা কি খেয়াল করেছো বিছানাটা মেঝের সাথে আটকে রাখা? তরুণীটি কিন্তু তার বিছানা নাড়াতেও পারবে না।

বিছানাটাকে ঠিক সেই জায়গাটাতেই থাকতে হবে...ঘণ্টার দড়িটার কাছে, আর ঠিক ভেন্টিলেটরটার নীচে।’

‘হোমস!’ আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, ‘কী সাঙ্ঘাতিক! আমি এখন বুঝতে শুরু করেছি। একটা অত্যন্ত ধূর্ত আর মারাত্মক অপরাধ ঘটে যাওয়ার হাত থেকে আমাদের অবশ্যই থামাতে হবে।’

‘হ্যাঁ, ওয়াটসন! একজন ডাক্তার যখন অপরাধ করতে শুরু করে, সে তখন সব অপরাধীদের চেয়ে বড় অপরাধী হয়ে ওঠে। কারণ, নিখুঁতভাবে একটি খুন করার মতো সবরকম জ্ঞানই তার কাছে থাকে।

আমার ধারণা, আমাদের সামনে আজ একটি ভয়ংকর রাত অপেক্ষা করে আছে। কাজেই আপাতত সেটাকে ভুলে গিয়ে আমরা একটু শান্ত থাকার চেষ্টা করি। এসো আমরা একটু আরাম করে পাইপ টানি আর আনন্দদায়ক কিছু ভাবার চেষ্টা করি।’

রাত প্রায় ন’টার দিকে গাছের ফাঁক দিয়ে আসা আলোটা সরে গেল আর মিস স্টোনারদের বাসাটা একেবারে অন্ধকারে ডুবে গেল।

দুই ঘণ্টা ধীরে ধীরে কেটে গেল। আর তারপরে, আচমকা একটি উজ্জ্বল একক শিখা জ্বলে উঠতে দেখা গেল।

‘ঐ টা আমাদের জন্য সংকেত।’ হোমস লাফ দিয়ে উঠে বললো, ‘আলোটা আসছে মাঝখানের ঘর থেকে।’

অল্প কিছুক্ষণ পরেই আমরা অন্ধকার রাস্তায় চলতে শুরু করলাম। মিস স্টোনারদের বাসার কাছাকাছি আসতে রাস্তা ছেড়ে গাছপালার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। বাগানে ঢোকার পরে সাবধানে হেঁটে এসে আমরা জানালার খোলা কপাট দিয়ে শোয়ার ঘরটাতে প্রবেশ করলাম। 

হোমস সাবধানে একেবারে নিঃশব্দে কপাট বন্ধ করে দিল। তারপর সে বাতিটাকে টেবিলের ওপরে রেখে দিয়ে ঘরটার চারপাশে গভীর মনোযোগ সহকারে দেখতে লাগলো। সবকিছুই আগের মতোই আছে বলে মনে হলো।

আমার খুব কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে হোমস বললো,

‘একটুখানি শব্দও আমাদের পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিতে পারে। আমাদের এখন আলো ছাড়াই বসে থাকতে হবে। কারণ ডাক্তার রয়লট ভেন্টিলেটরের ভেতর দিয়ে আলোটা লক্ষ্য করতে পারে। 

ঘুমিয়ে পড়ো না। তোমার জীবন বিপদের মুখে পড়ে যেতে পারে। আর, রিভলভার প্রস্তুত রাখো।

আমি বিছানার একপাশে বসে থাকবো আর তুমি বসে থাকবে ঐ চেয়ারে।’

আমি আমার রিভল্ভার তুলে নিয়ে টেবিলের এক কোনায় রাখলাম। হোমস সাথে করে একটা লম্বা চিকন লাঠি নিয়ে এসেছে। সে সেটাকে বিছানার ওপরে তার পাশে রেখে দিল। পাশেই রাখলো একটা দিয়াশলাই ভর্তি বাক্স আর একটি মোমবাতি।

তারপরে হোমস বাতিটাকে নিভিয়ে দিলো আর আমরা পুরোপুরি অন্ধকারে ডুবে গেলাম।

এর পরে আমরা যে সময়টাকে অতিবাহিত করতে লাগলাম তা কখনোই আমার পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। হঠাৎ কখনো মনে হচ্ছিলো বাইরে কোনো রাতজাগা পাখি ডেকে উঠলো। চার্চের ঘড়ি প্রতি পনেরো মিনিট পরে পরেই বেজে উঠছিল।

বারোটা বাজলো। তারপরে একটা, দুইটা, তিনটা...

আমরা স্থির বসে রইলাম। কিছু একটা ঘটার অপেক্ষায়।

হঠাৎ ভেন্টিলেটরের ভেতরে একটা আলোর রেখা দেখা গেল। এক মুহুর্তের জন্য। প্রায় তৎক্ষনাৎই এটা মিলিয়ে গেল, কিন্তু তার পরপরই পোড়া তেল আর উত্তপ্ত ধাতুর একটা তীব্র গন্ধ নাকে ভেসে এলো।

পাশের রুমে একটা ছোট বাতি জ্বালানো হয়েছে। চলাফেরার মৃদু আওয়াজ শোনা গেল আর তারপর সবকিছু আবার চুপচাপ হয়ে গেল। যদিও সেই গন্ধটা আরো তীব্রতর হয়ে উঠলো।

তারপরে প্রায় আধঘণ্টার মতো আমি কান খাড়া করে রাখলাম। আর তার পরই আমি অন্যরকম কিছু একটা শুনতে পেলাম। 

খুব মৃদু একটা শব্দ, ঠিক যেন কোনো পাত্র থেকে ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। হোমস বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নামলো আর মোমবাতি জ্বালালো। 

তারপরে সে প্রবল বেগে তার লাঠিটা দিয়ে ঘণ্টার দড়িটাকে নাড়া দিতে লাগলো। 

‘দেখতে পাচ্ছো ওয়াটসন? তুমি দেখতে পাচ্ছো?’

আমি কিছুই দেখতে পেলাম না। হোমস দিয়াশলাই জ্বালাতেই আমি খুব নীচু একটা হুইসেলের মতো শব্দ শুনতে পেলাম। কিন্তু এই হঠাৎ আলোতে আমার বন্ধু কী বস্তুকে নাড়া দিচ্ছে তা দেখা আমার পক্ষে আরো অসম্ভব হয়ে উঠলো। কিন্তু এর মধ্যেও আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম ওর মুখ একেবারে বিবর্ণ আর প্রচণ্ড ভয়ে ভীত হয়ে উঠেছে।

হোমস এবার তার লাঠিটাকে নামিয়ে রেখে ভেন্টিলেটরের দিকে তাকালো। তারপরেই শোনা গেল সেই প্রচণ্ড চিৎকার, যা আমি কখনোই ভুলতে পারবো না। এমন চিৎকার আমি আমার সারা জীবনে কখনো শুনিনি। যন্ত্রণা আর রাগ মেশানো এক তীব্র চিৎকার যা ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। সেই চিৎকার শুনে আমাদের প্রাণ যেন হিম হয়ে গেল।

তীব্র তীক্ষ্ণ সেই চিৎকার না থামা পর্যন্ত আমি হোমসের দিকে তাকাতে থাকলাম আর হোমস আমার দিকে।

‘এসবের মানে কী?’ শেষমেষ আমি বললাম।

‘এর মানে হচ্ছে, খেলা অবশেষে সমাপ্ত হয়েছে। এবং সম্ভবত যা হয়েছে এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারতো না। তোমার রিভলভার নাও, আমরা এখন ডাক্তার রয়লটের ঘরে প্রবেশ করতে যাচ্ছি।’ হোমস উত্তর দিলো।

হোমস বাতিটা জ্বালিয়ে করিডোরের দিকে এগিয়ে গেল। ডাক্তার রয়লটের ঘরের দরজায় দু’বার টোকা দিল। কিন্তু ভেতর থেকে কারো সাড়া পাওয়া গেল না। 

তারপরে দরজার কড়া ধরে টান দিয়ে সে ভেতরে প্রবেশ করলো। আমি ঠিক তার পিছনেই ছিলাম। আমার হাতে রিভল্ভার ধরা।

ঘরের ভেতরে ঢুকে দেখলাম টেবিলের ওপরে ছোট একটা বাতি জ্বালানো। লোহার বাক্সটা খুলে রাখা আর তার ঠিক পাশেই কাঠের চেয়ারটাতে ডাক্তার গ্রিমস্পবি রয়লট বসে আছেন।

তার উরুতে সেই কুকুরের চেনটা পড়ে আছে, যেটাকে আমরা আগেই দেখেছিলাম। ডাক্তারের চোখদুটো নিথর হয়ে আছে। তীব্র ভয় এখনো ফুটে রয়েছে সেই চোখদুটোতে। তার মাথার কাছে কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে একটা অদ্ভূত হলুদ রঙের দাগওয়ালা বন্ধনী!

‘বন্ধনী! দাগওয়ালা বন্ধনী!’ ফিসফিসিয়ে বললো হোমস।

আমি এক পা সামনে এগুলাম। বন্ধনীটি নড়ে উঠলো। আর তখনই দেখতে পেলাম ওটা একটা সাপ!

হোমস উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,

‘এটা ভারতের অত্যন্ত দুর্ধর্ষ প্রজাতির সাপ! এটি দংশন করার দশ সেকেণ্ডের মধ্যেই ডাক্তারের মৃত্যু ঘটেছে। 

পাপ এমনই এক জিনিস! হিংস্রতার পরিণাম এমনই নিষ্ঠুর! অন্যের জন্য খুঁড়ে রাখা গর্তে একসময় নিজেকেই পড়তে হয়!’

বলতে বলতেই হোমস কুকুরের চেনটাকে ডাক্তারের উরুর ওপর থেকে সরিয়ে নিলো। এর গোলাকার অংশটাকে সাপটির মাথার ওপরে রাখলো। তারপরে সেটাকে ছুড়ে মারলো লোহার বাক্সে।

এই হচ্ছে স্টক মোরানের ডাক্তার রয়লটের মৃত্যুর প্রকৃত সত্য।

আমরা বিষণ্ন মিস হেলেন স্টোনারকে এই সংবাদ জানালাম। তারপরে তাকে সকালের ট্রেনেই হ্যারোতে তার খালার বাসায় পৌঁছে দিলাম। অতঃপর আমরা পুলিশকে খবর দিলাম। 

পুলিশ এই সিদ্ধান্তে আসলো যে, ডাক্তার রয়লট অত্যন্ত বিপজ্জনক পোষ্য নিয়ে খেলার সময় মারা গিয়েছেন।

পরের দিন ট্রেনে করে লণ্ডনে ফেরার পথে হোমস আমাকে জানালো সেই প্রকৃত ঘটনা যেটা আমার তখনো জানা বাকী ছিল।

‘সর্বপ্রথমে...’হোমস শুরু করলো, ‘আমি এই কেসটা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভুল ধারণা পেয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম ‘বন্ধনী’ বলতে মৃতা তরুণী জিপসীদের কোনো দলের কথা বোঝাতে চেয়েছেন। তারপর যখন আমি দেখলাম যে, ঘরের জানালা বা দরজা দিয়ে কেউই ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না...তখন আমি আরেকবার ভাবতে শুরু করলাম।

ঘরটাতে তিনটি আশ্চর্য জিনিস ছিল- ভেন্টিলেটর, ঘন্টার দড়ি আর বিছানা। আমি সবকিছু দেখার পরে এই সিদ্ধান্তে আসতে পারলাম যে, দড়িটা নিশ্চয়ই কোনো সেতু হিসেবে কাজ করছে যা ভেন্টিলেটরের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করে বিছানায় এসে পৌঁছে।

সাপের চিন্তা আমার মাথায় ঠিক তখনই আসে যখন আমি জানতে পারি যে, ডাক্তার সাহেব ভারত থেকে বেশ কিছু পশু আনিয়েছেন। 

তিনি একজন ডাক্তার, আবার তিনি ভারতে ডাক্তার হিসেবে কাজও করছেন। কাজেই তার ভালোই জানা আছে কোন বিষ এখনো কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষার দ্বারা সনাক্ত করা যায় না। 

সাপ ব্যবহার করার আরেকটি সুবিধা হচ্ছে এই যে, এর বিষ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে কাজ করে। সেই হতভাগ্য তরুণীর শরীরে যে ছোট্ট দুইটি কাঁটা দাগ ছিল, সেটা কোনো পুলিশের চোখেই পড়েনি।

তারপরে আমার হুইসেলের কথাটা মাথায় এলো। নিশ্চয়ই সাপটাকে ডাক্তার রয়লট দিনের আলো মিলিয়ে যাবার আগেই ঘরেই ঘরে ফিরিয়ে আনতেন। ডাক্তার সাহেব এটা শিখেছিলেন যে কীভাবে এটাকে নিয়ে আসতে হয়। দুধের পাত্রটাও এই কাজেই ব্যবহার করা হতো। 

যখন তিনি সেই হুইসেল বাজাতেন তখন সাপটা আবার ফিরে আসতো। প্রতিদিন অনেক রাতে তিনি সাপটাকে ভেণ্টিলেটরের ওপরে উঠিয়ে দিতেন। সাপটি এই ঘণ্টার দড়িটাকে বেয়ে বিছানায় নেমে আসতো। প্রতি রাতেই ডাক্তার রয়লট এই একই কাজ করতেন।

তিনি আসলে একটা সম্ভাবনা নিয়ে খেলতেন। একটি ভয়ংকর সম্ভাবনা।

সাপটা ঘুমন্ত মেয়েটাকে কামড় দিতেও পারে আবার নাও পারে। সে জন্যই তাকে প্রতি রাতেই এই কাজ করতে হতো। হয়ত কখনো পুরো এক সপ্তাহই মেয়েটি সাপের দংশনের হাত থেকে বেঁচে যেতে পারে। কিন্তু আজ হোক অথবা কাল, একসময় না একসময় তাকে দংশিত হতে হবেই।

ডাক্তার রয়লটের ঘরে প্রবেশ করার আগেই আমি সবকিছুই বুঝতে পেরেছিলাম, এবং যা করতে হবে তার সিদ্ধান্তও আমি নিয়ে ফেলেছিলাম।

তার চেয়ার পরীক্ষা করে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, তিনি প্রায়ই সেখানে উঠে দাঁড়ান। ভেণ্টিলেটরের নাগাল পাওয়ার জন্যই তিনি সেটাকে ব্যবহার করেন।

তারপরে যখন আমি লোহার বাক্স, কুকুরের চেন আর দুধের পাত্র দেখতে পেলাম তখন বুঝতে পারলাম যে আমার ধারণা অক্ষরে অক্ষরে ঠিক। মিস স্টোনার ধাতব কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজের কথা বলেছিলেন। সেই আওয়াজটি হতো তখনই, যখন সাপটা ভেতরে ঢুকে যাওয়ার পরে ডাক্তার খুব দ্রুত লোহার বাক্সের ঢাকনাটা বন্ধ করে দিতেন।

এরপরে অপেক্ষা করছিলাম শুধু। আমি জানতাম আমার ধারণা একেবারে সঠিক। সেই সঠিক ধারণাটিকেই বাস্তবে রূপ লাভ করার অপেক্ষা করে যাচ্ছিলাম আমি।

যখন আমি হিস হিস আওয়াজটা শুনতে পেলাম, বুঝতে পারলাম যে সাপ ভেতরে ঢুকে পড়েছে। আমি দ্রুত মোমবাতি জ্বালালাম, আর সাপটাকে উল্টো আক্রমন করলাম।

আক্রান্ত হয়ে এটা আবার ভেন্টিলেটরের ভেতরে দিয়ে বের হয়ে ওপরপাশে চলে গেল। 

হ্যাঁ, তারপরেই এটা ডাক্তার রয়লটকে দংশন করে। সাপটাকে আমি আক্রমন করাতে সে ক্রুদ্ধ হয়ে ডাক্তারকে পাল্টা আক্রমন করে। কাজেই সেই অর্থে পরোক্ষভাবে বলা যেতেই পারে যে, আমিই ডাক্তার রয়লটের মৃত্যুর জন্য দায়ী।

 

কিন্তু এই হত্যার জন্য আমি কোনোরকম অনুশোচনাই বোধ করছি না।’