Posts

গল্প

ছোটগল্পঃ বসবাস

September 23, 2024

আলমগীর ভূঁইয়া

172
View

হুট করে গ্লাস ভাংগার শব্দ হলে আমরা তিন ভাই-বোন একসাথে যার যার রুম থেকে দৌড়ে আসলাম ডাইনিং রুমে। 

নিতু ডাইনিং রুমের লাইট জ্বালাতেই দেখল বাবা একটা চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আর ফ্লোরের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভাংগা গ্লাসটি।বাবাকে প্রচন্ড বিমর্ষ দেখাচ্ছে। এই মধ্যরাতে বাবাকে এইভাবে দেখতে আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না।বাবা আমাদের দেখে বললেন,কিরে তোরা ঘুমাস নি?

নিতু চিৎকার দিয়ে বলল, বাবা, তোমার পায়ে রক্ত! 

বাবা আমতা আমতা করে বললেন, চশমাটা যে কই রেখেছি! হয়েছে কি বেশ পানির পিপাসা লেগেছে। একটু পানি খেতে এসেছিলাম।গ্লাসটা কোনদিকে ছিল দেখি নাই। হাতের ধাক্কা লেগে পড়ে গেছে।গ্লাস ভাংগার পর পা ফেলতেই পা টা ভাংগা টুকরার উপর পড়ে।একটু কেটেছে।যা তোরা ঘুমাতে যা।

বাবা বেশ অপরাধীর মত ভাংগা ভাংগা গলায় বর্ণনা করছিলেন। 

নিতুর হঠাত মনে পড়লো বাবার রুমে কাল রাতে পানি রাখতে ভুলে গিয়েছে সে। 

সাধারণত এই কাজগুলো আম্মা করতেন।আম্মা কখনোই এমন ভুল করতেন না। আম্মা প্রতি রাতেই একটা গ্লাস আর এক জগ পানি এনে শোয়ার রুমে রেখে দিতেন। নিতুর এই অভ্যেস নেই বলে সে ভুলে গেছে।অন্য যেকোন সময় হলে নিতুকে বাবা কড়া কথা শুনিয়ে দিতেন। 

"সারাদিন মোবাইল আর মোবাইল। বাপকে পানি খাওয়াতেই ভুলে যায়।তোদের দিয়ে যে কি হবে।"

কিন্তু আম্মা মারা যাওয়ার পর বাবা কেমন জানি হয়ে গেছেন।আমাদের আগের মত বকাবকি করেন না। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়েছে এই মেজাজে। আম্মা মারা যাওয়ার পর বাবা এখনো আমাদের কাউকে উচ্চস্বরে কিছু বলেন নি।আমাকে তো মাঝেমধ্যে তুমি বলেও সম্বোধন করেন।এই যেমন সেদিন বাবা বলছিলেন,

“তোমার নানাবাড়িতে একটু যেতে হবে তোমাকে। তোমার আম্মা চেয়েছেন তার সন্তানেরা তার মৃত্যুর পরও নিয়মিত সে বাড়িতে যাবে। তুমি একটু তোমার নানা-নানীর কবরটা জেয়ারত করে আসবে। পারবে তো?”

আমি সেদিন হা হয়ে তাকিয়ে ছিলাম বাবার দিকে।ইনি আমার বাবা?এই মানুষটা আমাকে কোনদিন তুমি করে বলেন নি। এই তুমি করে বলাটা আমার কাছে একটা ধাক্কা হয়ে এসেছে। চেনা মানুষটার অচেনা রুপ।

বাবা আগে কখনোই আমাদের রুমে আসতেন না। দেখা গেছে মাসে একবার আসতেন তাও আমরা বুঝতাম সেদিন আমাদের কপালে দুঃখ আছে।আম্মা মারা যাওয়ার অনেক আগে একবার আমার রুমে এসেছিলেন।আইরিনের সাথে আমার সম্পর্কের কথা বাবা জেনে গিয়েছিলেন। আমার রুমে এসে সে কি ধমকা ধমকি! 

"পড়ালেখার তো গন্ধও নাই রুমে।শুধু প্রেমের গন্ধ। পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পাস নাই এই লজ্জা কেটে গেছে? আমার এতগুলো টাকা নষ্ট করে কি তোরে প্রেম করার জন্য ভার্সিটিতে পাঠাচ্ছি? মন দিয়ে পড়ালেখা কর। নাইলে তোর পড়ালেখাই বন্ধ করে দিব। দুইটা বলদ কিনে দিব।তিন বলদ মিলে হাল চাষ করবি।"

আহ! বাবার সেই মারমুখী স্বভাবটা আর নাই।বাবা এখন প্রতি রাতে আমাদের রুমে আসেন কয়েকবার করে। যদি দেখেন রুমের লাইট জ্বলে তাহলে আর রুমে আসেন না।লাইট বন্ধ দেখলেই রুমে এসে গায়ের কাঁথাটা টেনে দেন।এই ব্যাপারটা আমার বেশ ভালো লাগে।আগে আম্মা এমনটা করতেন। রাতে এসে দেখতেন।গায়ের কাঁথাটা ঠিকঠাক করে দিতেন। আর সব ঠিকঠাক থাকলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। আমি তো মাঝেমধ্যে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতাম।একদিন আম্মা এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। আমি ভাবলাম আমি সজাগ আম্মা তা বুঝতে পারেন নি। 

'কিরে ঘুমাস নি? আমি উঠে বসে গেলাম।'

'তুমি ঘুমাও নি।'

'ঘুম আসছে না।'

এরপর আমাকে বললেন, তোরা কত বড় হয়ে যাচ্ছিস! আর আমরা বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। আমি মারা গেলে তোদের কে দেখে রাখবে? তোর বাবা তো নিজেকেই দেখে রাখতে পারেন না। আমি না থাকলে তোদের আর তোদের বাবার যে কি হবে!

আম্মার সেই দুশ্চিন্তা কেটে গেছে।আম্মা মারা যাওয়ার পর বাবা কেমন জানি আমাদের উপর বেশ দায়িত্বশীল হয়ে পড়েছেন। আম্মা যে কাজগুলো করতেন বাবা এখন নিজে সেই কাজগুলো করার চেষ্টা করেন। একদম হুবহু আম্মার মত করেই। তার মানে কি বাবা সবকিছু আগেও খেয়াল করতেন?

বাবা রাতে আমার রুমে আসেন। নিনা আর নিতুর রুমেও যান।নিনা আর নিতু আমার দুই বোন।নিতু এবার ইন্টারমেডিয়েটে পড়ে আর নিনা ক্লাস নাইনে। আর আমি একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে।বাসা গুছিয়ে রাখার কাজটা অনেকটাই নিনা করতো। নিতু হয়েছে অগোছালো টাইপের। বড়বোন হয়েও ওর সব কাজ ও নিনার উপর চাপিয়ে দেয়।অন্যদিকে নিনা হয়েছে একদম মায়ের মত। সবকিছু গুছিয়ে রাখে।আম্মা থাকতে নিতুকে প্রায়ই বকা দিতেন আর বলতেন, বড় টা হইছে বাপের মত আর আমার ছোট মেয়েটা আমার মত। ভাগ্যিস ওইটাও বাপের মত হয় নাই। নিতু আসলেই একদম বাবার মত হয়েছে। প্রচন্ড রাগী আর অগোছালো। কারো কথা শুনে না। তবে আম্মা মারা যাওয়ার পর বাবার মধ্যে যেমন আমূল পরিবর্তন এসেছে নিতুর মধ্যেও তেমন পরিবর্তন এসেছে। নিতুও এখন বাবার মত আর উচ্চস্বরে কথা বলে না।একদম চুপচাপ থাকে।আর নিনা? দিনের একটা সময় আম্মার জন্য তার বরাদ্ধ থাকবেই। কখনো আমাকে, কখনো নিতুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করবে সে।

একদিন রাতে বাবা আমার রুমে আসলেন। এসে আমার পাশে বসলেন।অন্ধকারে বাবার চেহারাটা আবছা দেখা যাচ্ছিল।

‘ঐ মেয়েটার কি খবর রে?’

‘কোন মেয়েটা?’

‘ঐ যে তোর গার্লফ্রেন্ড।’

‘তুমি না করার পর তো ওর সাথে সেই কবেই ব্রেক আপ করে ফেলেছি।’

‘তো বাসায় আসতো কেন?’

‘কই!’

‘তোর মা থাকলে তো আনতি। আমি অফিসে গেলে মেয়েটা আসতো তাই না? আমার ভয়ে তোর মা তখন আসতে বলতো।আমি কি বেশ রাগী? তোর মা কি এজন্যই আমাদের ছেড়ে চলে গেছে রে?’ 

এরপর বাবা উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। 

তোর মা কি এজন্যই আমাদের ছেড়ে চলে গেছে রে? - এই কথাটা বলার সময় বাবার কন্ঠে এক ধরণের অভিমান বা হাহাকারের সুর পাওয়া গেছে।বাবা এখনো মেনে নিতে পারছেন না আম্মার চলে যাওয়াটা।

আমাদের প্রিয় মানুষদের ক্ষণিকের চলে যাওয়া বা দূরত্ব আমাদের হয়তো ভাবায় না।কিন্তু কেউ একজন চিরতরে চলে যাবে এই দৃশ্য ভাবা গেলেও এর সাথে বসবাস করা বেশ কঠিন।

Comments

    Please login to post comment. Login