- দুই
শুক্রবার
০৯ এপ্রিল ২০১০ খ্রি.
রাত সোয়া দুইটা
ঝিলটুলি, ফরিদপুর।
সুবেহতারা
তোমার চিরকুটে লেখা ছিল রাতে চিঠি পড়তে হবে। তাও আবার রাত ১২টার পর! এই চিন্তা করে চিঠি পাওয়ার পাঁচ দিনেও চিঠিটা পড়তে পারছিলাম না। ভাবলাম শর্ত যেহেতু দিয়েছো তো শর্তটা মেনেই চিঠিটা পড়ি। কি লাভ হলো! কোনো লাভ নেই। যেই লাউ সেই কদু…
তোমার তিন কন্যা কেমন আছে? খুউব জানতে ইচ্ছে করছে। আর তোমার হিজড়া জামাই? কি রাগ করলা নাকি! যতোই হোক, তোমার জামাই তো! তাকে কেউ হিজড়া বললে তোমার তো রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। তাও আবার তিন সন্তানের জনক। তাকে আসলে হিজড়া বলাও পাপ। কান ধরলাম। এবার মাফ করে দাও। আর মাফ না করলেও তো কিচ্ছু করার নাই।
এই চিঠিটাও এখন তোমাকে লিখতাম না। ইদানীং মন-মেজাজ তেমন ভালো না। এনজিও কর্মীর মুড ভালো যাচ্ছে না এটা পুরাতন খবর। নতুন খবর হচ্ছে সে আমাকে আরো স্বাধীনতা দিয়েছে। এখন ইচ্ছে করলে নাকি আমি আরেকটা প্রেম করতে পারি। তার সাথে সেক্সও করতে পারি। হাসতে হাসতে যখন এসব কথা বলছিল তখন আমিও হাসছিলাম। তবে বলে দিয়েছে—‘কনডম নিয়ো কিন্তু।’ একথা শুনে আমার আরো হাসি পেয়েছিল।
আমি বলেছি—‘কেন তোমার সাথে তো কনডম ব্যবহার করি না। তাতে তো গাল ফোলাও না।’
‘আমিও কি প্রথমে রাজি ছিলাম? তোমার জেদের কারণেই তো রাজি হয়েছি। দুনিয়ার সকল মানুষ কনডম নিতে পারে। তাতে তাদের সুখের কোনো কমতি ঘটে না। আর তোমার নবাবী! সুখ কমে যায়। যত্তোসব।’
যাক এসব কথা, তোমাকে বলা মোটেও নিরাপদ নয়। তুমি কবি মানুষ। সরি, কথাসাহিত্যিক বলতে হবে। এইসব নিয়ে কবে যে একটা রসালো গল্প লিখে ফেলবে। তখন আমি না হাসতে পারবো—না কাঁদতে পারবো। আর সেই গল্প যদি সেতু পড়ে তো আমার আমার পিঠে আর জায়গা থাকবে না। প্লিজ, তুমি এমন কিছু কখনো করিও না। ওহ্ বলে রাখি তোমার চিঠির সাথে একটা সারপ্রাইজ আছে। হয়তো সেটা এতক্ষণে আর সারপ্রাইজ হয়ে নেই। তুমি আবিষ্কার করে ফেলেছো! তুমিই একদিন চেয়েছিলে এখন মনে হয় ভুলে গেছো। দেখলে ঠিকই মনে পড়বে। সারপ্রাইজ পেয়ে আমাকে একশ্বাসে যতোগুলো গালি জানো সব দিবা। কিন্তু মনে মনে খুশিও হবা। এটা আমি জানি।
তোমার জামাইকে যদি পারো একটা বস্তার মধ্যে ভরে মুঠি বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটাও। তাতে যদি কোনো কাজ হয়। বেচারা! এমন পুরুষের আবার বিয়ে করার দরকার কি! শুনে ভাবছো কি এমন মহাপুরুষ আমার! স্বামীর পৌরুষত্ব নিয়ে সন্দেহ করছে। আমার পৌরুষত্বের প্রমাণ যদি জানতে চাও? সেতুর কাছে যেতে পারো। যদিও সে তোমাকে কিচ্ছু বলবে না। আর আমাকেও ঝাঁটাপেটা করবে। আচ্ছা একটা কথা বলি—তোমার সাথে তো কোনো প্রেম নেই আমার। সেটা তুমিও জানো আমিও জানি। কিন্তু তোমাকে সেতু মোটেও সহ্য করতে পারে না। কেন? আবার তোমাদের নামেরও কেমন একটা মিল দেখেছো। ঋতু আর সেতু। তোমরা দুই বোন হলে তো ভালোই হতো। একজন আবার বউ আর একজন আমার শালী। খুব জমতো। প্লিজ, ঝাঁটা হাতে এগিয়ে এসো না। তোমার রাগ করা মুখ সত্যিই ভয়ংকর। অতো সুন্দর মুখে কি রাগ মানায়? তোমার বস বকাবকি করলে কি তুমি কাঁদো? তোমাকে রাগলে কেমন দেখায় সেটা আমি জানি। ওই যে একদিন জিয়া উদ্যানে কি নিয়ে তর্ক হচ্ছিলো তখন তুমি রেগে আগুন। বিষয়টাও খুব গোপন কিনা। আবার মনে করিয়ে দিবো? একটু বলি রাগ করো না। একজোড়া বিপরীত লিঙ্গের মানুষ সারাদিন ধরে সেক্সুয়াল গল্প করলো কিন্তু তাদের শরীরের বিশেষ জায়গায় কোনো প্রভাব পড়লো না। এটা আমরা একে অপরকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না। শুরু হয়ে গেলো তর্ক। যদিও সেই তর্কে আমরা দুজনেই জিতেছি। কারণ তর্কটা শেষ হয়নি। তোমার জামাই ফোন দেওয়াতে সেই তর্ক থামিয়ে তাড়াতাড়ি তোমার বোনের বাসায় ফিরতে হয়েছিল। আসো সেই তর্কটা আবার শুরু করি। না বাবা থাক। তোমার ওই রাগানো মুখ দেখলে আমার ভয় লাগে। তোমার বাড়ি ভোলা না হয়ে তোমার বাড়ি হওয়া উচিত ছিল সুন্দরবনের কাছাকাছি কোনো জেলায়। বাগেরহাট অথবা মোড়েলগঞ্জ হলে বেশ মানাতো তোমাকে। বাঘের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করতে পারতে।
আমার বিরুদ্ধে যেসব মনগড়া কথা তুমি বলেছো সব কিন্তু সত্যি নয়। আমি সারাদিন থ্রি-এক্স দেখি এটা তোমাকে কে বললো? নিজের অতৃপ্ত সেক্সুয়াল হিংসা আমার উপর কেন চাপিয়ে দাও! তাতে কি শান্তি লাগে? থ্রি-এক্স তো তুমিও দ্যাখো। কেন তুমি বলোনি? তেরো পার করেই তোমার ঘুমের মধ্যে একা একা অর্গাজম হতো। আর দুই বোন মিলে পাশের বাজারের দর্জির সুঠাম দেহের দিকে তাকিয়ে রাতে ঘুমের মধ্যে তাকে ভাবতে। প্রাপ্তবয়স্ক যেকোনো মেয়েদের এগুলো তো হতেই পারে।
তোমাকে যে নামটা দিলাম সেটা কেমন? তুমি তো আসলেই ডুবে যাচ্ছো। অথবা নিজেকে ডুবিয়ে রাখার একটা চেষ্টা করছো। কিন্তু তোমার মধ্যে জ¦লন্ত এক আগ্নেয়গিরি। যাকে তুমি ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় লুকিয়ে রেখেছো। যেভাবে সূর্য ওঠার আগে রাতের পেটে সকালকে লুকিয়ে রাখে। ওহ্ ভালো কথা—তোমার সেই ব্যবসায়ী বুড়োর খবর কী? বেচারা তোমার প্রেমে ডুবে যাচ্ছে। আর তুমি নির্বিকার। আর ঢাকার সেই জুনিয়র সাংবাদিক? ছবির হাটে যাকে দেখে তোমার চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল। মানুষের সমাগম ছিল বলে খাওয়া হয়নি। ইস্! কি যে একটা ভুল করে ফেলেছো! সেটা আরো পাঁচ বছর পর বুঝতে পারবে। তুমি যদি আমাকে না লুকাও তাহলে তোমার সেই পণ্ডিত প্রেমিক—যিনি এখন উপ-সচিব। তাকে শেষ চুমু খেয়েছিলে। তারপর আর কাউকে চুমু খাওনি। এমনকি জামাইকে পর্যন্তও না। ওই জুনিয়র সাংবাদিককে চুমু খেয়ে অন্তত ঠোঁটের যৌবনটাকে ফিরিয়ে আনতে পারতে।
আরে বাবা, ক্ষেপে গেলে তো সমস্যা। আমি তো আর চ, ছ বলছি না। তুমি শুধু ওই মুখেই বলতে পারবে। এসব ছেড়ে একটু হাঁটা শেখো। এখনো দুনিয়ায় অনেক কিছু দেখার বাকি আছে জাদু। না হয় পরে পস্তাতে হবে। একটা কাজ করো—গোসলের সময় আয়নায় নিজের সবটা একবার দেখো তো। দেখবে তুমি এখনো কতোটা লোভনীয়। ছি ছি! মনে করো না আমি তোমাকে পটানোর জন্য এসব বলছি। তোমাকে পটানোর ইচ্ছে থাকলে অনেক আগেই হতো। সেটা তুমিও জানো। আর সে কারণে তোমার আক্ষেপও কম নয়। কিন্তু সত্যি বলতে তুমি আমাকে টানো না। না বয়স-ফয়স আমার কাছে কোনো বিষয় না। টানতে পারাটাই আমার কাছে আসল। তোমার মধ্যে কোনো কিছুর কমতি নেই সত্য। কিন্তু আমার মধ্যের তৃষ্ণা যেটা খুঁজে সেই জিনিসটা যেন তোমার মধ্যে নেই। প্লিজ…প্লিজ, রাগ করে মাথা ফাটিয়ে ফেলো না। তোমার সেই ব্যাংকের বড়কর্তা তো আমার থেকে অনেক ভালো। সুঠাম দেহের মানুষ। তার শরীরের উত্তাপটা একটু মেপে দেখো। জীবন তো থেমে থাকছে না জাদু। শোনো— হাজিসাবদের আমি দেখতে পারি না। আমার সাথে হাজিসাবগিরি করবা না। সমাজের ওই দেওয়াল যদি না থাকতো তাহলে কতো পুরুষের জ্বরের খবর তোমার ঝুড়িতে থাকতো সেটা আমার জানা আছে। কি নারীবাদী সিংহ এবার ক্ষেপে উঠলো? উঠুক। কাছে তো আর পাচ্ছো না জাদু…
আরে তোমার প্রতি আমার একটা আগ্রহ আছে। সফট কর্নার আছে। এটা তো তুমি ভালো করেই জানো। আমি তোমাকে খারাপ হতে প্ররোচিত করছি না। তোমাকে ভালোভাবে বাঁচতে বলছি। নিজেকে চিনতে বলছি। নিজেকে চিনো। দুনিয়ায় অনেক রং আছে। আমাদের রংধনুটাতো দুই-তিন রঙেই থেমে থাকে। আমরা থামিয়ে রাখি। কিন্তু রংধনুর তো সাত রং। সেটা যদি দেখতে না পারি তাহলে মানুষ হিসেবে দুনিয়ায় জন্ম নিয়ে কি লাভ বলো!
সুপর্ণা! আবার সুপর্ণা বললাম কেনো? সেটা নিশ্চয়ই তোমার জানতে ইচ্ছে করছে। সেই কবিতাটি মনে পড়ে গেলো। ‘কবে শীতকাল আসবে সুপর্ণা’। আচ্ছা, কোনো কবি কি এমন কোনো লাইন লেখেনি ‘ঈশ্বর গরম কবে আসবে?’ তোমার জানা থাকার কথা। তুমি গল্পকার হলেও মাঝেমধ্যে তো কবিতাও লিখো। একটা বিষয় খেয়াল করেছো? যারাই গল্প, উপন্যাস লেখে প্রথম জীবনে তারা স্বরবৃত্তের ছড়া অথবা ভুল ছন্দে কবিতার মতো কিছু একটা দিয়েই শুরু করে। এই যে দেখো সমকালীন পণ্ডিতদের একজন ড. সলিমুল্লাহ খান। তারও নাকি প্রথম জীবনে কবিতার বই বের হয়েছিল। আর ফরহাদ মজহার তারও তো অনেক কবিতার বই। হুমায়ূন আহমেদ চাইলেও যে ভালো কবিতা লিখতে পারতেন সেটা তার গান শুনে বোঝা যায়। ক্ষেপে যেও না। এই সব কথা যে আমার মতো একজন শৌখিন ফটোগ্রাফারের মুখে মানায় না সেটা আমি জানি। তারপরও তুমি খুঁজে দেখো গরম কবে আসবে এমন কোনো কবিতার লাইন পাওয়া যায় কিনা। তার কাছে তোমাকে পাঠিয়ে দিবো। তুমি ইচ্ছেমতো গরম নিয়ে আসবা। তখন তোমার ঈশ্বর-শুভ্র-জামাই-জুনিয়র সাংবাদিক প্রেমিককে দরকার হবে না। আর তোমার দৌড় তো জানি। যা কিছু সব মনে মনে। আরে বাপু মনে মনে আর কতোকাল! শরীর বুড়িয়ে গেলে মনটা তো একসময় আর এমন তাজা থাকবে না। তখন?
তুমি কখনোই তোমার চৌকাঠ ডিঙাতে পারবে না। সেটা তুমি জানো। খালি খালি হুডতোলা রিকশায় প্রেমিকের ঠোঁটে ঠোঁট রাখার ইচ্ছের যে কথা ফোনে বলেছিলে সেটা স্বপ্নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখো। তোমার কি মনে আছে আমাদের ফোনে কী ধরনের কথা হতো। আমার কিন্তু এখনো সবটাই মনে আছে। অফিসে সময় পেলেই ল্যান্ডফোন থেকে তুমি ফোন করতে। আর তখন আমার হাতেও থাকতো অফুরন্ত সময়। দুপুর সাড়ে বারোটায়ও মাঝেমধ্যে সকাল হতো না। সেই বাসি বিছানায় সকাল হওয়াতো তোমার জড়ানো কণ্ঠস্বর—
‘কি! এখনো সকাল হয়নি?’
আমি গলা টেনে টেনে বলতাম ‘না হয় নি। তবে এখন হলো। কিন্তু তোমার গলা শুনে তো মনে হচ্ছে এখন আবার তুমি রাত্রি নামাবে।’
তোমার মুখে হাসি। চেপে ধরা হাসি। মনে হচ্ছিলো একটা দুর্দান্ত হাসি বের হয়ে আসতেছিল। সেটাকে দাঁত দিয়ে আটকে রেখে তুমি বলতে—‘সেই ভাগ্য কি আর আমার আছে? সেটা তো তোমার পরি’র জন্যই।’
‘আরে পরি পরি করিও না তো। পরি তো সেই কবেই পটল তুলেছে। তার জন্য এখন তোমার আবার ব্যথা শুরু হলো কেন?’
‘হবে না! এতো বছর পর শেষ বয়সে একজন হ্যান্ডসাম নায়ক পেলাম। তাও আবার মরে যাওয়া প্রেমিকার নামেই জিকির করে। সামনের জ্যান্ত বুক তার নজরেই আসে না।’
‘ওসব বুক-বাঁক আমাকে আর টানে না।’
‘তা টানবে কেনো ! খেয়ে খেয়ে তো পেট ফুলে আছে। আর কতো খাবে?’
তোমার মুখে আমাকে কুপোকাত করতে পারার খুশিতে বিজয়ীর হাসি। কিন্তু আমি তো তোমার কাছে হেরে যেতে রাজি না। আমিও কোমরে গামছা বেঁধে দাঁড়ালাম—‘ভালো জিনিস বারবার খাওয়া যায়। তোমার কি খুব শখ! তোমার…’
তুমি আমাকে থামিয়ে দিতে। আর বলতে পারতাম না। তারপর তুমি খুটিয়ে খুটিয়ে পরি’র কথা—শুটকু প্রভাষকের পুতুপুতু কান্নার কথা জানতে চাইতে। আমি একের পর এক জবাব দিতাম। সেই কথার মধ্যে কোনো কাম থাকতো না। থাকতো শুধু জীবনের চেনাজানা পথে হাঁটতে থাকার আনন্দ।
তোমার খুব সুন্দর একটা অভ্যাস আছে। সেটা কি তুমি জানো? জানার কথা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথাও যেগুলো আমার সাথে বলেছো সেগুলোর কথা উঠলে তুমি ভুলে যাওয়ার ভান করো। যেন কখনো বলোই নি। আমার ধারণা, এগুলো তুমি ইচ্ছে করেই করো। কারণ ওইসব কথায় অশ্লীলতা থাকে। কিন্তু অস্বীকার করার কোনো প্রয়োজন তো দেখি না। তোমার মুখের পর্দা এমনিতেই অনেক পাতলা। তোমার দাবি মতে, আমার কাছে অকপটে সব বলে দাও। তাহলে এই নাটকটা কেন! তোমার প্রথম পিরিয়ডের আগেই চাচাতো বোনের সাথে শরীরী খেলায় মেতেছিলে। তোমার চাচাতো বোন ছিল তোমার থেকে বড়। তার কারণেই তোমাকে তার নাটকটা মঞ্চস্থ করতে হয়েছে। সেই কথাও নিশ্চয়ই এখন বলবে তুমি বলোনি অথবা ভুলে গেছো। আর অফিসের ফাঁকে নেটে বাংলা চটি পড়তে পড়তে ওয়াশরুমে গিয়ে…। সে কথাও যে আমাকে বলেছিলে সেটাও নিশ্চয়ই এখন আর তোমার মনে নেই! কিন্তু তোমার কপাল খারাপ এইসব কথা আমার আবার খুব ভালো করে মনে থাকে।
কি? এতোক্ষণে তোমার চোখে মুখে তো আগুন ধরে যাওয়ার কথা। বিলিভ মি—এগুলো আমি আসলে কাউকেই বলিনি। তাহলে তারা তো তোমাকে অন্যরকম ভাবার সাথে সাথে আমাকেও সেরকম ভাববে। আর আমার প্রেমিকা [যদিও এখন আর তার সাথে আমার আর তেমন যোগাযোগ নেই] যদি জানতে পারে! তাহলে একবার ভাবো তো আমার কি অবস্থা হবে! যাই হোক, আগুনটা এবার একটু নিভাও। না হলে তোমার আগুনে তোমার জামাইয়ের সাথে সাথে আমার হবু সংসারও পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। তোমার ফেসবুকে সেদিন দেখলাম তুমি লিখেছো—
ইদানীং মনে হচ্ছে কবিতাময় হয়ে যাচ্ছে সবকিছু! কিছু একটা পোস্ট করলে লাইক-কমেন্টের বন্যা। আর সে যদি ফটোশপ সেলিব্রেটি হয় তো হাজার ছাড়িয়ে যায়। সমুদ্র লিখলো না মিছিল স্লোগান লিখলো — না বাড়ির পিছনে পাট পচানো ডোবার গন্ধ লিখলো তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। লাইক আর কমেন্ট করে জাতিকে স্বর্গে নেওয়াই হচ্ছে তাদের দায়িত্ব। এটা যতোটা সুখের সংবাদ হওয়ার কথা ততোটা আসলে নয়। ফেসবুকের লাইকারদের মধ্যে নব্বই ভাগই কবিতা না পড়ে লাইক দেন। বাকি দশভাগের লাইক অনেকটা আবছা বুঝে লাইক দিলো নাকি না বুঝে দিলো সেটাও বোঝা মুশকিল। আর যারা কমেন্ট করে কবিতার গোষ্ঠীকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। তাদের মধ্যে পঞ্চাশ ভাগই কবিতাটা ভালোভাবে একবারও পড়েন না। আর বাকি ঊনপঞ্চাশ ভাগ কমেন্টকারী কবিতা না বুঝেই পণ্ডিতের মতো কমেন্ট করেন। একভাগকে গুরুত্ব দেওয়া যায়। তবে আশার কথা এই যে—কবিতা না বোঝার ব্যাপারটায় একটা সুফল আছে। তা হলো কবিতা বুঝলে কেউ কাঁদতো। কেউ বিমর্ষ হয়ে বসে থাকতো। আর আমাদের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত রাষ্ট্র অধিকাংশ কবির পাছায় বাম্বু—সহজ কথায় বাংলার সবচেয়ে জাতওয়ালা বাঁশটা দিতো। ফলাফল জেল-জরিমানা মুচলেকা। তো এই মহৎ জাতির মহৎ লাইকার — কমেন্টার আর পণ্ডিতদের জন্য শুভ কামনা। সাথে রাষ্ট্রের জন্যও। আপনারা যেমন আছেন তেমনই থাকুন। দুধে-ভাতে…
আমি তো ভাই কবিতা বুঝি না। সেই জন্য কিচ্ছু লিখিনি। তুমি কবি। আবার কথাসাহিত্যিকও। দেখা যাবে একদিন বাংলা একাডেমি তোমার পায়ের কাছে চলে এসেছে। কিন্তু মহামান্য সুবেহতারা—পাঠককে এমনভাবে বলবেন না। পাঠক না থাকলে আপনাদের কোনো দাম আছে ? আমার মতো এই যে একজন পাঠক পেয়েছেন সেটাও কি হারাতে চান? হা হা হা, ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। তোমার ধারণা তোমার কোনো লেখা আমি পড়ি না। কিন্তু তোমার সব লেখাই আমি পড়ি। সেজন্য বলি, আরো বিনয়ী হও। বিনয় মানুষকে অনেক বড় বানায়। কি রাগ করেছো?
ধ্যাৎ, উপদেশ না। বিনে পয়সার মাল তো দিলেই দেওয়া যায়। যে দেশে পঞ্চাশ একশত টাকায় মেয়েদের শরীর পাওয়া যায়। সেই দেশে আর কীসের দাম আছে বলো তো? সেই দেশে আবার সাহিত্য! সরি, ছোট মুখে অনেক বড় কথা বলে ফেললাম। এখন একটু বের হবো। বেড়িবাঁধ থেকে ঘুরে আসি। বেড়াতে পারলে নাকি মনটা হালকা হয়। সেই জন্যই তো ঢাকা থেকে ফরিদপুর এলাম। এখন থেকে সুলভ আদরের গলিও খুবই কাছে। ভাবছি একবার দেখা করে আসবো কিনা।
সোমবার
১২ এপ্রিল ২০১০ খ্রি.
ঝিলটুলি, ফরিদপুর।
রাত দেড়টা। আমার মতো অলস মানুষকে দিয়ে যে কিচ্ছু হবে না তার আবার একটা প্রমাণ পেলে তো? একটা চিঠি লিখতেও চার-পাঁচদিন লাগে। আসলে মন না চাইলে তো কিছুই করা যায় না। মনটাই তো সব খাইলো…
সাধারণত আমি কারো সাথে কখনো রাগারাগি করতে চাই না। যদি তার প্রাপ্যও হয় তাও না। সে যদি এমন একটা অপরাধ করে যে তাকে খুন করে ফেলা উচিত। তাও আমি তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার একটা যুক্তি খুঁজি। কারণ কারো সাথে রাগারাগি করলে কিংবা কাউকে বকাঝকা করলে আমার সারাটা দিন খুব খারাপ যায়। রাগারাগি করলেই কান্না পায়। কান গরম হয়ে থাকে। কান গরম হওয়ার ব্যাপারটা এক অন্য ধরনের ব্যাপার। আমি যখন রাগ করি তখন আমার যে কোনো একটা কান গরম হয়ে যায়। যতক্ষণ রাগটা না কমে ততক্ষণ কানটা গরম হয়েই থাকে। সেজন্য নিজেকে যতোটা পারি অবদমনের মধ্যে রাখি। রাখার চেষ্টা করি।
আজকে মাত্রাতিরিক্ত রাগারাগি করে ফেলেছি। তাও একজন না তিনজনের সাথে। যদিও যে ধরনের রাগারাগি করেছি তার থেকেও হাজার গুণ তাদের প্রাপ্য। কিন্তু একান্ত বাধ্য হয়েই কিছু কথা বলেছি। অনেক দিনের রাগ। অনেকটা মার্জিত ভাষায়ই বলেছি। তাও কান্না পাচ্ছে। কান গরম হয়ে আছে। কী করবো…
রবিবার
২৫ এপ্রিল ২০১০ খ্রি.
সিপাহীবাগ
খিলগাঁও, ঢাকা।
পরিবার বলতে তো আসলে আমার কিচ্ছু ছিল না। তাও যেটুকু ছিল—তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি এক যুগেরও বেশি সময়। আত্মীয়-স্বজনদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে যেমন তারা আমার মতামতের প্রয়োজন মনে করে না। তেমন আমিও আর তাদের কাজে বিঘ্ন ঘটানোর প্রয়োজন মনে করি না। দূরে আছি। দূরেই থাকি। আপনজন বলতে কিছু গাছপালা। যারা গাছ থেকে আস্তে আস্তে পাখি হয়ে ওঠে। উড়ে যায় সীমাহীনে। আমাকেও উড়ায়। উড়তে থাকি।
রক্ত আর পানির মধ্যে সাঁতার আমার পছন্দের মধ্যে ছিল না কখনোই। বাসন্ডা নদী আমাকে শিখিয়েছে একা একা হাসার বিদ্যা। কীভাবে কাঁদতে হয়। কষ্টকে কীভাবে ঢেউয়ে ঢেউয়ে খেলাতে হয়। কীভাবে নিজের মধ্যে ভেঙে ভেঙে আবার জোড়া লেগে যেতে হয়। আমি ভাঙি আবার জোড়া লেগে যাই। কিন্তু গাছ-নদী-পাখি আমাকে আর কতোটুকু আপন ভাবে! মনে হতো এরা আমার মতোই আমাকে ভালোবাসে। আমাকে তাদের দরদের উঁচু মিনারে বসিয়ে জীবন শিখায়। আমি আবার পড়তে থাকি সম্পর্কের আদর্শলিপি। যে গলিতে আমি একা নই। গাছ-পাখি-নদী সবাই আমার। সবাই মিলে একটা গাছ হয়ে উঠি আমরা। কোনো গাছকে দেখলে চিমটি কেটে বলি—দেখো আমরা কতো ভালো আছি। মনে মনে শৈশবের বন্ধু বাসন্ডা নদীকে বলি—দেখো আমার মধ্যে আজ কতো বাসন্ডা! আমি কাঁদলেও তারা খেয়ে নেয়। আমি হাসলেও তারা বয়ে যায়। নদীরাও আমার মতো করে হাসতে থাকে, ভাসতে থাকে পথে পথে…
কিন্তু বিচ্ছিন্ন পায়রারা আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কোথাও যেন ঝড়ের শব্দে সবাই মানুষ হয়ে ওঠে। গাছ ভুলে যায় তার ডালপালা আছে। নদী ভুলে যায় তার ঢেউ আছে। আমি শুধু বাসন্ডা বুকে নিয়ে কাঁদি আর কাঁদি… আমার আর ফেরা হয় না সেই গ্রামে। পরি’র কবরের পাশে। পরি’র একাকিত্বে। ফুফু বাড়ির সেই উঠোনে। গোল্লাছুটের দলে। আমি হাঁটি। একাই হাঁটি। রাজধানীর মুখ বদলানো মানুষের পায়ে পায়ে…
তোমার মনোযোগী শ্রোতা
শুভ্র