Posts

বাংলা সাহিত্য

সপ্তপদী

May 20, 2024

ওয়াসিম হাসান মাহমুদ

Original Author ওয়াসিম হাসান মাহমুদ

"বাহির সংসারে মানুষ মরলে তাকে পুড়িয়ে ছাই করি, মাটির তলায় কবর দি। মনের সংসারে মানুষ জীবিতকেও মাটির তলায় চাপা দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়।"

ভূমিকায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কোন এক ফাঁকে এই অতীব নিষ্ঠুর কিন্তু দরকারি সত্যটি উচ্চারণ করেছেন। ভূমিকাটি সপ্তপদীর।

পূজার আনন্দবাজারে বাংলা বর্ষ ১৩৫৬ সালে এ বিখ্যাত এবং সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ উপন্যাসটি প্রকাশ পেয়েছিলো।

লেখক মূলতঃ তার বেশ পরিচিত একটি চরিত্র এবং প্রায় অপরিচিত আরেক চরিত্রের মধ্যকার ভালোবাসার গল্প এ উপন্যাসে রচনা করেছেন। বাস্তব এবং কল্পনা মিলিয়ে নিয়েছেন।

এ আখ্যান কৃষ্ণেন্দু এবং রিনার‌। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের দেয়া নাম‌ই ব্যবহার করেছেন সপ্তপদীতে। ভূমিকায় নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন এ নভেলের তেমন একটা সম্পাদনা ছাড়াই উন্মোচনের।

অ্যাঙ্গলো-ইন্ডিয়ান নারীর সাথে ঘটনাপরিক্রমায় গাঁও-গেরাম থেকে উঠে আসা, মানে শুধু উঠে আসা নয় বেশ খানিকটা এগিয়ে যাওয়া পুরুষের এক ধরণের অতৃপ্ত প্রেমের কাহিনী‌ই মনে হতে পারে শুরুতে।

আসলেই কি এ ভালোবাসা অতৃপ্ত? ধর্মে অবিশ্বাসী কাঁলাচাদের রেভারেন্ড কৃষ্ণেন্দুতে রূপান্তর কী পরিমাণ অবিশ্বাস, অনিশ্চয়তা এবং ভগ্ন হৃদয়ের সারথীর যাত্রা তা লেখক লিখেছেন এক কখনো মুগ্ধ কখনো স্তব্ধ করে দেয়ার মতো গদ্যে।

উপন্যাসে দু'টি চরিত্রের ব্যাপক উত্থান-পতনের মিথস্ক্রিয়ার পর একটি সময়রেখা ধরে এগিয়েছে। টাইমলাইন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গদ্যেও দেখেছি বিশ্বযুদ্ধকে মহাযুদ্ধ বলতে। আমার কাছে তো মহাযুদ্ধ‌ই বেশি সঠিক অর্থের শব্দ মনে হয়েছে।

সপ্তপদীর মতো উপন্যাসে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ পাতাও দু'এক ঝিলিক বা আর একটু বেশি উঁকি দিয়ে যায়।

তাছাড়া ফ্ল্যাশব্যাকে যখন কাহিনী যায় তখন তারাশঙ্কর পাঠককে এমনভাবে হুক করে রাখেন যে বর্তমানে ফিরে আসলে রীতিমতো ধাক্কা খেতে হয়। যেন কোন ডাইমেনশন পোর্টাল দিয়ে লেখক রিডারদের সময় পরিভ্রমণ করিয়েছেন।

ভারতীয় সন্ন্যাসীতে পরিণত সাবেক কালাচাঁদ এবং তাকে আপাত দৃষ্টিতে অদ্ভূত কারণে ফিরিয়ে দেয়া রিনা ব্রাউনের চরিত্রের এরকম এক ধরণের ব্যক্তিত্বের এধার-ওধার হয়ে যাওয়াটা যেভাবে লেখক তার ছোট ছোট বাক্যের যথোপযুক্ত এবং সুন্দর উপমা দিয়ে পুরো নভেল সাজিয়েছেন তা চোখে পড়ার মতো।

শাস্ত্রে আছে এক সাথে সাত পা অগ্রসর হলে সে সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য হয়। জন ক্লেটন এবং রিনা ব্রাউন হয়তো একসাথে ৭ পা হেঁটেছেন তবে কৃষ্ণেন্দু রেভারেন্ড যেন আশপাশের জগতের সকলের সাথে দয়া, ভালোবাসা, সেবা এবং মানবতার এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছেন।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ উপন্যাসে কৃষ্ণেন্দুকে অতোটা রাজনীতি সচেতন মনে হয় নি। ভারতবর্ষ স্বাধীন হচ্ছে এবং বিভক্ত হচ্ছে এসব‌ই রেভারেন্ড ঈশ্বরের কৃপার বাইরের বিষয়ের উর্ধ্বে কিছু ভাবেন নি।

রিনা ব্রাউন‌ও সময়-ক্ষেত্রের স্রোতে ভেসে বেড়ানো এক সুতোহীন ঘুড়ি যেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য যেরকম হ্যাপি এন্ডিং লেখক দিয়েছেন, যেভাবে মিলিয়ে দিয়েছেন অনেক কিছুই, এবং সেটির সমর্থনে বারবার উচ্চারণ করে গেছেন,

"ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন।"

এ বিষয়টি কৃষ্ণেন্দুকে হয়তো এক ধরণের কনসোলেশন প্রাইজ দিয়ে থাকতে পারে, তাকে এক ধরণের সেইন্টের লেভেলে পাঠিয়ে দিয়ে, তবে আমার মধ্যে কেমন যেন মিশ্র প্রতিক্রিয়া কাজ করেছে।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় পড়া শুরু করলাম বহু বছর পর। এ ধরণের ব‌ই কেন ধ্রুপদি বা ক্লাসিক হিসেবে গণ্য করা হয় তা শুধুমাত্র নভেলের সেই ওথেলো নাটকের অংশের কৃষ্ণেন্দু ও রিনার চরিত্রায়ণ এবং ডায়লগের সাথে পুরো উপন্যাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের তারাশঙ্করীয় ভাষায় স্বতস্ফূর্তভাবে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে উপমা হিসেবে জড়িয়ে ফেলাটা পড়লেই সচেতন পাঠক বুঝে নিতে পারবেন।

ব‌ই রিভিউ

নাম : সপ্তপদী
লেখক : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সব্যসাচী হাজরা
ধ্রুপদি মনোগ্রাম ডিজাইন : সোমনাথ ঘোষ
বাতিঘর ধ্রুপদি সংস্করণ : শ্রাবণ ১৪২৯, আগস্ট ২০২২
[ প্রথম প্রকাশ ১৮৬৬ ]
প্রকাশক : বাতিঘর
রিভিউয়ার : ওয়াসিম হাসান মাহমুদ

Comments

    Please login to post comment. Login