পোস্টস

গল্প

গুপ্তচরীর ডায়েরি

২৩ মে ২০২৪

ফাহ্‌মিদা বারী

মূল লেখক ফাহ্‌মিদা বারী

১২ই মে’২০১৭

গত পরশুদিন ১০ই মে ২০১৭ তারিখে আমি এই ফ্ল্যাটটিতে এসে উঠলাম। গোছগাছ সবকিছু শেষ করে হাতে একটু সময় পেলাম। এতদিনে ডায়েরিটা নিয়ে বসার সময় হলো। গতকালই ডায়েরিটা আমার ক্লায়েন্টের কাছ থেকে গিফট পেয়েছি। আমার ডায়েরি লেখার অভ্যাসের কথাটা কথা প্রসঙ্গেই বলেছিলাম উনাকে। নতুন চকচকে দামী ডায়েরি। কাগজগুলো মাখনের মতো মসৃণ। ইচ্ছে করছে আজকেই পুরো ডায়েরিটা লিখে শেষ করে ফেলি।

যদিও বছরের প্রথমদিন থেকে শুরু করতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু আমার জীবনের নতুন বছরের সূচনা তো বলতে গেলে আজ থেকেই...অর্থাৎ এই ফ্ল্যাটে ওঠার প্রথমদিন থেকেই!

এগারো তলা এপার্টমেন্টের সাত তলার ফ্ল্যাট। পোজপাজ আছে ভালোই। এমন একটা ফ্ল্যাটে থাকতে হলে পকেট মোটাতাজা হওয়া জরুরি। আমার পকেট খুব একটা মোটাতাজা নয়। তবে আমার ক্লায়েন্টের পকেটে জোর আছে। আর সেটা আছে বলেই এরকম একটা ফ্ল্যাটে আমাকে থাকতে দিয়েছে! 

 

বিনিময়ে শুধু ছোট্ট একটা কাজ করে দিতে হবে। সামনের বারোতলা ফ্ল্যাটের আট তলায় অবস্থিত তার স্ত্রীর কার্যকলাপের দিকে একটু নজর রাখতে হবে। সন্দেহজনক কিছু পেলে তাকে জানাতে হবে।

কাজটা পাওয়ার পর মনে হয়েছিল, ভদ্রলোক বুঝি নিজের স্ত্রীকে খুব সন্দেহ করেন। নইলে এমনি এমনি নজরদারি করার জন্য লোক লাগাবেন কেন? তাও আবার আমার মতো একজন পেশাদার গুপ্তচরকে নিয়োগ করার জন্য তো সন্দেহটা ভালোরকম পাকাপোক্ত হওয়া জরুরি। 

 

আমার সাথে উনার, অর্থাৎ আমার ক্লায়েন্টের পরিচয় তার অফিসেই। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এমডি উনি। হাইফাই জীবনযাপন। তার কাছাকাছি যাওয়ার জন্যও দিনের পর দিন এপোয়েনমেন্ট নিয়ে বসে থাকতে হয়। তবে আমি দেখা করেছিলাম উনার অফিসিয়াল প্রয়োজনেই। কাজেই আমাকে বসিয়ে রাখার তার উপায় ছিল না।

আমার বন্ধু শিহাব আমাকে উনার অফিসের কাজটা পাইয়ে দিয়েছিল। বার বার সতর্কও করে দিয়েছিল, ‘জান দিয়ে কাজটা করিস বুঝলি? একবার মন জয় করতে পারলেই আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। কই থেকে কই উঠে

 যাবি বুঝতেও পারবি না!’

 

বন্ধু ভুল কিছু বলেনি। নীচতলা থেকে এক ধাক্কাতেই সাত তলায় উঠে গেছি। কাজ দিয়ে কতটুকু মন জয় করতে পেরেছি সেটা বলতে পারি না। তবে অন্যকিছু দিয়ে যে তার মনটাকে ভালোভাবেই কব্জা করে ফেলেছি সেটা তো আর বলে দেওয়ার দরকার পড়ে না!

বন্ধুমহলে সবাই আমার স্টাইল আর ফ্যাশনবোধের প্রশংসা করে। মেয়েবন্ধুরা তাকায় ঈর্ষামেশানো চোখে। আর পুরুষ বন্ধুদের চোখে লোভ লালসা, কামনা বাসনা কতকিছুই যে দেখেছি তার ইয়ত্তা নেই! শাহরিয়ার তো খোলাখুলিই বলে, ‘দোস্ত তোর ফিগারটা একেবারে আগুন! যা একখানা বানাইছিস না!’

 

তো যাহোক যা বলছিলাম! আমার পেশা গুপ্তচরবৃত্তি অর্থাৎ আমি একজন গুপ্তচর বা স্পাই। আমাদের দেশে এই পেশার যে এতটা কদর আছে, সেটা জানা ছিল না আমার। অনেকটা শখের বশেই এই পথে পা বাড়িয়েছিলাম। বন্ধু বান্ধবদের সাথে মজা করে টুকটাক স্পাইগিরি করে বেড়াতাম। আহামরি কিছু ছিল না তেমন। হয়ত কারো ব্যক্তিগত কোনো কথা খুব কায়দা করে বের করে আনা কিংবা গোপন কোনো কার্যকলাপের নাড়িনক্ষত্রের হদিস খুঁজে বের করা। কেউ কেউ সত্যিকারের প্রশংসা মিশিয়েই বলেছে, ‘গুপ্তচর হিসেবে ভালো নাম করতে পারতি রে তুই!’

ওদের প্রশংসাটা মনে ধরে গিয়েছিল। পারতাম বলে হা হুতাশ করতে যাবো কেন? পেরে দেখিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকলে এখনই দেখাই! পাশ করার পর অফিসে অফিসে ঘুরে তো স্যাণ্ডেলের শুকতলা ঝাঁঝরা করে ফেলেছি। সিকিভাগও ফায়দা হয়নি। তাই অন্য কোথাও যদি প্রতিভা দেখানোর সুযোগ থাকে, চুপ করে বসে থাকাটা বোকামি।

 

শুরুর দিকের কাজগুলো শিহাবের মাধ্যমেই পেয়েছি। মহা কামিয়াব ধুরন্ধর ছেলে আমাদের এই বন্ধু শিহাব। আমার প্যাশনের কথাটা ওকে বলতেই অল্প কিছুদিনেই বেশকিছু কাজ জোগাড় করে দিয়েছিল। অফিস দিয়েই যাত্রাটা শুরু হয়েছিল। বিভিন্ন প্রাইভেট অফিসে টুকটাক প্রতিযোগিতা, রেষারেষি এসব লেগেই থাকে। কনস্ট্রাকশন ফার্মগুলোতে থাকে অন্য প্রতিযোগিতা। টেণ্ডারবাজি সেখানে নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। বড় বড় ঠিকাদাররা কাজ বাগিয়ে বসে থাকে। ছোট ঠিকাদাররা অক্ষম আক্রোশে বসে বসে আঙুল চোষে। কিছু কিছু টেণ্ডারের খবর তাদের কাছ পর্যন্ত আসেই না। ভাগ বাটোয়ারা যা হওয়ার আগেই হয়ে যায়।

আমি এই ছোট ঠিকাদারদের জন্য কিছু ছোট কাজ করে দিলাম। কী সেই কাজ, তা আর বিস্তারিত লিখতে চাই না। যদিও এটা আমার ব্যক্তিগত ডায়েরি, কিন্তু পেশাগত জীবনের গোপনীয়তা বজায় রাখতে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কাজেই এখানেও খোলাশা করে কিছু না লেখাই উচিত মনে করি। 

 

তো যাহোক, ছোট ছোট কাজ করে আত্মবিশ্বাসের পাল্লাটা একটু একটু করে ভারী হতে শুরু করেছিল। কিন্তু পকেট তো তখনো গড়ের মাঠ। সামান্য যা রোজগার করি, তা দিয়ে নিজেরই চলে না। দেশের বাড়িতে মাকে আর কী পাঠাবো? তখনই শিহাব আমাকে নিয়ে গিয়েছিল এই ক্লায়েন্টের অফিসে। গুলশানের সেই অফিসের ফোটফাটের কথা আর কী বলবো! দেখেই আমার চোখদুটো চকচক করে উঠেছিল। শিহাবের তাগাদার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। নিজের মনের মধ্যে থেকেই জোর তাগাদা এসে গিয়েছিল...এখানে টিকতে হবেই, যে করেই হোক!

এমডি ফরহাদুর রেজার বয়স মেরেকেটে বায়ান্ন। সুঠাম দেহ। দেখলেই বোঝা যায় নিয়মিত জিম করা শরীর। চেহারাতে নানাবিধ পরিপক্কতা আর অভিজ্ঞতার ছাপ। তবে ভদ্রলোক যথেষ্ট হ্যাণ্ডসাম, এ কথা মানতেই হবে! আমাকে দেখেই চোখদুটোকে আমার ওপর থেকে নিচে ঘুরিয়ে আনলেন একবার। তারপর মেঘ গজরানো গলায় বললেন, ‘এসব কাজের অভিজ্ঞতা আছে? করতে পারবে তো?’

আমার বয়স ছাব্বিশ। প্রথম পরিচয়েই কেউ সরাসরি তুমি বলে সম্বোধন করে না। তবে এনার কথা বোধহয় আলাদা। ইনি তুই করে বললেও প্রতিবাদ করা যাবে না। 

 

শিহাবের দেওয়া তাগিদনামার কথা মনে পড়ে গেল। আমি চুপিসারে নিজের খোলশ খুলে বেরিয়ে এলাম। 

বন্ধুরা শুধু যে আমার ফিগার আর স্টাইলেরই প্রশংসা করে তা নয়। আমার স্মার্টনেসের কথাও তারা শতমুখে বলে। সেই স্মার্টনেসের একটুখানি ঝলক দেখিয়ে বললাম, ‘অভিজ্ঞতা না থাকলে কি আপনার কাছ পর্যন্ত আসতে পারতাম স্যার? কী করতে হবে বলুন! কাজ দিয়েই প্রমাণ হয়ে যাক!’ 

ফরহাদুর রেজা আরেকবার আমাকে জরিপ করলেন। এবারে যেন বেশ কিছুটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। আমার উত্তরে যে উনি যথেষ্ট চমকে গেছেন তা মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম। কিন্তু অভিজ্ঞ মানুষ তিনি। তাই এত সহজে মাছকে টোপে ঢোকার অনুমতি দিলেন না। আরকটু খেলিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা থেকেই বললেন, ‘আচ্ছা? বেশ, কাজের অনুমতি দিলাম তোমাকে। কিন্তু সময় খুব বেশি দিতে পারবো না। সেভেন ডেজ...আই ওয়ান্ট আ রেজাল্ট উইদিন সেভেন ডেজ!’

‘এনাফ ফর মি স্যার! থ্যাংকস এ লট।’

 

উনার অফিসের কাজটা আমি তিনদিনেই করে দিয়েছিলাম। এত সহজ এসাইনমেণ্ট ছিল ওটা! এজন্য গুপ্তচর কেন লাগিয়েছিলেন ঠিক বুঝতে পারিনি। টাকাও দিয়েছিলেন মোটা অংকের। আগামি এক মাস আর কিছু না করলেও চলে যাবে। কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলতে যাবো, তখন উনিই অন্য আরেকটা অফার দিয়ে বসলেন। তার স্ত্রীর ওপরে একটু নজরদারি করতে হবে। বাসায় কখন কে আসে কে যায়...এসবের খুঁটিনাটি তথ্য চাই তার।

আমার আপত্তি জানানোর প্রশ্নই আসে না। এটাই আমার কাজ! তাছাড়া এত সরস ক্লায়েন্ট! আমার তো ইচ্ছে করছিল আঠার মতো সেঁটে যাই, যাতে ঘন ঘন নানারকম কাজ করে দিয়ে তার কাছের একজনে পরিণত হতে পারি।

 

আমার সেই ইচ্ছা বাস্তবে রূপ নিলো অচিরেই। উনি আমাকে অন্যরকম এক প্রস্তাবও দিয়ে বসলেন। মাঝে মাঝে আমার ফ্ল্যাটে তিনি অতিথি হয়ে আসবেন। এর বিনিময়ে আমি পাবো ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে চকচকে নতুন ফ্ল্যাট! টাকাপয়সার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি। খুব বেশি ভাবাভাবির সুযোগ পেলাম না। মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগলো মাসশেষে অনেকগুলো টাকার স্বপ্ন। 

ফরহাদুর রেজা কাব্য করে বলেন, তিনি আমাকে ভালোবাসেন। আমার দেখে তার নাকি ভোরের শিউলির কথা মনে পড়ে। দূর থেকে সুবাস নিয়ে মন ভরে না। কাছে এসে আঁজলা ভরে কুড়িয়ে সুবাস নিতে চান।

আমি তাকে সেই সুবাস নিতে দিলাম। যখন ইচ্ছে তখন তিনি তার দু’হাতের আঁজলা ভরে শিউলি কুড়িয়ে যান। 

 

২৭শে মে’২০১৭

আমার মূল কাজের কথা কিন্তু ভুলে যাইনি আমি! 

ফরহাদুর রেজা সাহেবের স্ত্রীর দিকে আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি লাগিয়ে রেখেছি। যদিও নিজের স্ত্রীকে কেন তিনি নজরদারির আওতায় রেখেছেন, এতগুলো দিনেও সেটা বুঝতে পারিনি আমি। বলেছিলেন, সন্দেহজনক কিছু টের পেলে জানাতে। নাকি সন্দেহভাজন কারো কথা বলতে চেয়েছেন? যাই হোক, এতগুলো দিনে তেমন কিছুই আমার নজরে আসেনি।

আমার অত্যাধুনিক ছোট্ট দূরবীন যা আমার চশমার সাথেই সুন্দরমতো সেঁটে নেওয়া যায়, সেটার সাহায্যে তার বাসার মোটামুটি দৃশ্যমান প্রতিটা কোনাই জরিপ করে নিয়েছি। আমার ড্রোনটাকেও দিনে অন্তত দুইবার সামনের ফ্ল্যাটের চারপাশ থেকে ঘুরিয়ে আনতাম। আমার নির্দেশ মোতাবেক ছবি সাপ্লাই দিত আমার ড্রোন। সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কিংবা বিকেলে বারান্দার গাছগুলোতে পানি দেওয়ার ফাঁকফোকড়ে বেশ দীর্ঘসময় ঐ বাসার দিকে তাকিয়ে থেকেছি। সারাদিনের কাজের ফাঁকে যখন তখন জানালার পর্দা সরিয়ে চোখ লাগিয়ে রাখা তো আছেই! আমার কাজের সুবিধার্থে ফরহাদুর রেজা নিজেই তার বাসার জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

মিসেস রেজা প্রতিদিন ভোর ছ’টায় মর্নিংওয়াকে বের হন। সেই অনুযায়ী আমিও নিজের মর্নিং শিডিউলটাকে সাজিয়ে নিয়েছি। আটটা নয়টায় ঘুম থেকে ওঠা আমি ইদানিং রোজ ভোরে জগিং এ যাচ্ছি। প্রতিদিন ভদ্রমহিলাকে পাশ কাটানোর সময় তার শরীর থেকে শ্যানেলের মাদকতাকরা সুবাসটা পাই। নিজের এ্যালসেশিয়ান কুকুরটাকে সামলাতে সামলাতে আনন্দময় পদক্ষেপে পা ফেলেন তিনি। 

 

ফরহাদুর রেজার স্ত্রী ফ্যাশনেবল সুন্দরী এক নারী। বয়স তার স্বামীর মতোই। রেজা সাহেবই একদিন গল্পচ্ছলে বলেছিলেন, স্ত্রী একদা তার সহপাঠী ছিল। অল্প বয়সের আবেগের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। সেই আবেগের মাশুল দিচ্ছেন প্রতি মুহূর্তেই। তার ধারণা স্ত্রী তাকে টেক্কা দিচ্ছে। কিন্তু কী সেই টেক্কা, সেটা তিনি ধরতে পারছেন না। হতে পারে ব্যবসায়িক দিক দিয়ে এগিয়ে থাকতে চাইছে কিংবা অন্যকিছু। ব্যক্তিগত সম্পর্কের ব্যাপারেও কিছু একটা হতে পারে।

ফরহাদুর রেজার স্ত্রীও তার স্বামীর মতো অন্য আরেকটি কোম্পানির এমডি। সেই কোম্পানি আবার রেজা সাহেবের শশুরের মালিকানাধীন। অন্যদিকে রেজা সাহেব তার শশুরের কোম্পানির পুচ্ছধারী না হয়ে নিজের যোগ্যতার সাক্ষর রেখেছেন। কাজেই একই বাসায় দুই ভিন্ন কোম্পানির দুইজন এমডির মধ্যে একটু আধটু পারসোনালিটি ক্ল্যাশ তো থাকতেই পারে! ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা থাকাও খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে নজরদারি রাখার ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। রেজা সাহেব কি অন্যকিছুর আঁচ পেয়েছেন? পরকীয়া বা এই জাতীয় কিছু?

 

২৮শে জুন’২০১৭ 

দুই সপ্তাহ আগের কথা। বাসার সামনের শপিংমল থেকে কেনাকাটা শেষ করে বাসায় ফিরছিলাম। আমার সামনেই একটি ছেলে বেছে বেছে আপেল তুলে কার্টে রাখছিল। ছেলেটিকে দেখেই আমার মনের মধ্যে সাইরেন বেজে উঠলো। চুপচাপ নিজের শপিং শেষ করে ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালাম। ছেলেটাও আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারলাম। বিল দেওয়ার সময় নিজের পার্স বের করে বোকা বনে গেলাম। দুশো টাকা কম পড়ছে। আবার বাসায় চলে যাবো নাকি কোনো আইটেম রেখে দিব? কী করবো ভাবছি। ‘আচ্ছা তাহলে আমি এটা রেখেই আসি’ এই বলে একটা চানাচুরের বক্স রাখতে যাচ্ছি, এমন সময় পেছন থেকে ছেলেটি কথা বলে উঠলো।

‘ইয়ে...যদি কিছু না মনে করেন, আমি কি আপনার জন্য এটা পে করতে পারি?’

আমি কুণ্ঠিত। ‘এ্যা মা আপনি কেন পে করবেন? আমার বাসা সামনেই! পরে একসময় এসে নিয়ে যাবো।’

‘শুধু শুধু কেন কষ্ট করবেন? আমার বাসাও সামনে। এবারে আমিই দিয়ে দিই। পরে আপনি না হয় আমাকে ফেরত দিয়ে দিবেন!’

ছেলেটা সুন্দর করে হাসলো। আমি আর আপত্তি করলাম না। আমিও একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে সেখান থেকে চলে এলাম।

 

এর প্রায় এক সপ্তাহ পরের কথা। সেদিন বিকেলের দিকে ফোনটা এলো। একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো অপরিচিত আবার খানিকটা যেন চেনা কণ্ঠস্বর। ‘হ্যালো...আপনি কি আমাদের বাসাটার দিকে তাকিয়ে থাকেন? আপনার গুঞ্জন তোলা যন্ত্রটার জ্বালায় তো ত্যক্তবিরক্ত হয়ে গেলাম!’

আমি আকাশ থেকে পড়ার ভান করলাম। তেড়েফুঁড়ে উঠে বললাম, ‘আমি কেন আপনাদের বাসার দিকে তাকিয়ে থাকবো? গুঞ্জনতোলা যন্ত্র মানে? কী বলছেন আপনি? আর আমার নাম্বার পেলেন কোথা থেকে?’

‘নাম্বার জোগাড় করা কি বড় কোনো ব্যাপার? আপনি তাহলে আমাদের বাসার দিকে তাকিয়ে থাকেন না বলছেন? আর যে ড্রোনটা চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, ওটা আপনার না বলছেন? আমি কি তবে ভুল বলছি?’

‘আপনি ভুল বলছেন নাকি ঠিক, সেটা আমি কীভাবে বলব? ভালো কথা, আপনি কে সেটাই তো বলেননি?’

‘আমাদের বাসার দিকে তাকিয়ে থেকেও এটাই জানেন না আমি কে! আমি তো ভেবেছিলাম, আমাকেই হয়ত লক্ষ করছেন!’

‘আচ্ছা তাই নাকি? আমি আপনাকে লক্ষ করছি? আপনি কে...সালমান খান টান নয় তো?’

 

এভাবেই কথায় কথা বাড়তে থাকে। মনে মনে নিজেকে তিরস্কার করতে থাকি। এত অদক্ষ কাজ কেন করলাম! খুব বেশি আত্মবিশ্বাস? 

এত কথোপকথনেও নিজের নামটাই বলে না অপরপাশের ব্যক্তি। কিন্তু আমি ঠিকই বুঝে গেলাম অপরপাশে কে কথা বলছে! ফরহাদুর রেজা সাহেবের যে একটি বছর পঁচিশ ছাব্বিশের ছেলে আছে এটা উনি আমাকে বলেননি। কিন্তু আমার কাজই তো হচ্ছে, গোপন কথা জেনে যাওয়া। ছেলেটা গত বছর ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করেছে। নাম ফয়সল। এক সপ্তাহ আগেই শপিংমলে আমার মুশকিল আসানকারী সেই ছেলে!

আমি সিরিয়াস মুখে বললাম, ‘এভাবে হেঁয়ালি না করে বলেই ফেলুন তো আপনি কে!’

এবারে হাসির শব্দ শুনলাম। ‘ঐ যে সেদিন মাত্র দুশো টাকা দিয়ে একটুখানি উপকার করার সুযোগ পেলাম। ভাবলাম সেই উপকারটুকুর বদৌলতেই বুঝি আপনার একটু দাক্ষিণ্য পাচ্ছি। অথচ আপনি বলছেন আপনি নাকি আমাকে চেনেনই না!’

 

আলাপটা এভাবেই আরেকটু গাঢ় হওয়ার পথ খুঁজতে থাকে।

আমি যখন উদাসীচোখে সামনে তাকিয়ে আনমনা হওয়ার ভান করি, তখন সেও বইয়ের ভাঁজে মুখ লুকিয়ে খুব মনোযোগী হওয়ার ভান দেখায়। মায়ের সাথে বারান্দায় বসে গল্প করতে দেখি প্রায়ই। হেসে হেসে ভালোই গল্প করে দুজন। কিন্তু আমার কার্যবিধি যে সেও গোপনে গোপনে দেখছে এটা আমি জানতে পারবো কেমন করে? কথাবার্তা শুনে মনে হলো একটু যেন ফ্লার্ট করার চেষ্টা করছে। সেই সন্দেহ অবশ্য খুব তাড়াতাড়িই সত্যিতে রূপ নিলো।

ফয়সল দু’দিন পর পরই ফোন দিতে শুরু করলো। অপ্রয়োজনীয় অর্থহীন সব কথাবার্তা। আমি কে...বাসায় আর কে কে আছে...কী করি...ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি কিছু প্রশ্নের জবাব দিই...কিছু প্রশ্নকে হাসি দিয়ে উড়িয়ে দিই। মোট কথা, আমি যা খুশি তাই করতে থাকি ফয়সলের সাথে! 

 

২৫ই জুলাই’২০১৭

ফয়সলের সাথে ইদানিং রাস্তাঘাটেও বেশ দেখা হয়ে যাচ্ছে আমার। আর মাঝে মাঝেই ফোনের উৎপাত তো আছেই! ওর সাথে গল্প করতে ভালো লাগে। একটু যেন বেশিই ভালো লাগে!

গল্পে গল্পে আমরা দুজন দুজনকে অনেক কথা বলে ফেলি। সম্পর্কটা বেশ দ্রুতই ডালপালা ছড়াচ্ছে। ফয়সলের ভালোলাগা, মন্দলাগা...সবকিছুই এখন আমার জানা হয়ে গেছে। আমারও অনেক খবরই ফয়সল জানে। অবশ্য যতটুকু আমি জানার অনুমতি দিই, ঠিক ততটুকুই।

ফয়সলকে ওর মা-বাবার কথা জিজ্ঞেস করি। তারা কেমন মানুষ, কী করেন, তাদের সাথে ফয়সলের বন্ডিংটা কেমন...সবকিছুই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাই। বিশেষ করে ওর মায়ের গল্পগুলো খুব আগ্রহ নিয়ে শুনি। ওর মা কতটা ব্যস্ত মানুষ, সারাদিন কী কী করেন সবকিছুই আমার কাছে বন্ধুর মতো গল্প করে ফয়সল। ব্যস্ত মা-বাবার কাছ থেকে তাদের সময় চুরি করতে করতে এখন বড্ড ক্লান্ত বোধ করে সে। 

গল্পগুলো শুনতে শুনতে বুকের মধ্যে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। অনুভূতিটার নাম কী, আমার ঠিক জানা নেই। অবশ্য একজন গুপ্তচরীর জীবনে সেটা জানার খুব একটা প্রয়োজনও হয়ত নেই। 

 

 

১৭ই অগাস্ট’২০১৭ 

আজ রেজা সাহেব আমার কাজের ব্যাপারে খুব খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। কতদূর কী অগ্রগতি হলো, কিছু জানতে পেরেছি কী না এইসব। মনে হচ্ছিলো, ভাইভা বোর্ডের সামনে বসে আছি। একটু বুঝি নার্ভাসও ফিল করছিলাম। যদিও কাজের অগ্রগতি নিয়ে আমি অসন্তুষ্ট নই। তবু কেন যে নার্ভাস হচ্ছিলাম, ঠিক জানি না।

ম্যাডাম অর্থাৎ রেজা সাহেবের স্ত্রী নিতান্তই সাধারণ জীবন যাপনই করেন। ফরহাদুর রেজা আগেই বলেছিলেন তার স্ত্রী বেশিরভাগ কাজ বাসাতে বসেই করে থাকেন। জরুরি মিটিং জুমে সেরে নেন। নিতান্ত প্রয়োজন না পড়লে অফিসেও যান না। টেলিফোনে খোঁজখবর রাখেন। আমি তাকে বাসায় বসে এসব কাজই করতে দেখেছি। কখনো চায়ের কাপ হাতে ফাইলপত্র দেখছেন কিংবা ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ লাগিয়ে কিছু একটা করছেন। অথবা ফোন হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। অর্থাৎ কাজ নিয়েই ব্যস্ত তিনি। বাসায় অনাহুত কাউকে তেমন একটা আসতে টাসতে দেখিনি। অন্ততপক্ষে সন্দেহ করার মতো কিছু তো ঘটেইনি!

সেই কথাগুলোই বললাম। কিন্তু ফরহাদুর রেজা কেমন যেন তীক্ষ্ণচোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। যাওয়ার আগে একটু থমথমে বসসুলভ গলাতে বলে গেল, ‘কাজের দিকে মনোযোগী হও। কাজ বাদ দিয়ে অন্যকিছুতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে মূল্যটাও সেভাবেই চুকাতে হবে, বুঝলে? আমি কিন্তু কাজ বুঝেই পে করি সবসময়!

একটু কি শীতল স্রোত বয়ে গেল মেরুদণ্ড বেয়ে? আমি তো নিজের কাজই করছি! অকাজের বেশে কাজ করে যাওয়াটাই তো আমার কাজ! 

তবু কেন এই অদ্ভুত শীতল অনুভূতিটা টের পেলাম? ঠিক বুঝতে পারছি না! 

 

 

১৫ই সেপ্টেম্বর ’২০১৭

ফয়সল দুদিন ধরে আমার ফ্ল্যাটে আসার জন্য খুব বায়নাক্কা করছিল।

প্রথম থেকেই বলে এসেছি যে, বাসায় আমি আর আমার মা-বাবা থাকি। কিন্তু বুঝতে পেরেছি আমার মিথ্যেটা ধরা পড়ে গেছে ওর কাছে। হাসতে হাসতেই বলেছে, ‘উঁহু তোমার ফ্ল্যাটে আর অন্য কেউ থাকে না। আমি জানি। খোঁজ নিয়েছি। কখন যাবো বলো!

আমি জোরের সাথেই বলেছি, ‘ফ্ল্যাটে আসা যাবে না। এমন করলে আর কখনোই তোমার ফোন ধরবো না!’

এরপর থেকে অবশ্য বায়নাক্কার মাত্রা কিছুটা কমেছে। কিন্তু আমার মনে ভয় ঢুকে গেছে। একইসাথে বাপ ছেলেকে হ্যাণ্ডেল করাটা তো একটু মুশকিল হয়ে যাবে! 

 

রেজা সাহেব যতই শিউলিফুলের গল্প শোনাক না কেন...তিনি তো খুঁজতে আসেন কামিনির মাদকতা। নাজুক শিউলিফুলকে ছুঁয়ে দেবার বয়স তিনি বহু আগেই পার করে এসেছেন। কিন্তু ফয়সলের কাছে তো আমি শ্বেতশুভ্র সদ্যফোটা শিউলিই! আমার গায়ে লেগে থাকা কাদামাটির পাংসুটে গন্ধটা ওর কাছে পৌঁছায় না! 

ফয়সলের সাথে টেলিফোনে জমে ওঠা সম্পর্কটা ওর কাছে প্রেম। কিন্তু আমার কাছে প্রয়োজনের চাইতে বেশিকিছু নয়। দুজন দীর্ঘসময় ধরে ফোনে কথা বলি। কথা বলতে বলতে আমরা দুজনেই ব্যালকনিতে চলে যাই। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে হাত নাড়াই। আমার চোখে অবশ্য দূরবীনটা জায়গামতই সেট করা থাকে। কাজেই ওর মা অর্থাৎ মিসেস রেজার গতিবিধি থেকে আমার চোখ সরে না। একই তীরে দুই নিশানাকেই বিদ্ধ করে চলি আমি।

তবু কোনো এক দুর্বোধ্য কারণে ফয়সলের ফোনের জন্য অপেক্ষা করাটা প্রিয়তম কিছুতে রূপ নিচ্ছে! মুহূর্তগুলোকে ভীষণ দামি মনে হয় আজকাল। এই কয়েকটি মুহূর্তের জন্যই আমি কয়েকশো বছরের মৃত্যুকে প্রতিনিয়ত আলিঙ্গন করি!

 

..................................................................

 

ব্যস! ডায়েরিটা এই পর্যন্তই! পুলিশ ইন্সপেক্টর শামিম আহমেদ পুরোটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললেন। তারপর এসিস্টেন্ট মাহবুবের দিকে ডায়েরিটা এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘নাও, পড়ে দেখো। যা ভেবেছিলাম তাই। আশ্রয়দাতার সীমানার বাইরে পা দেওয়াটাই কাল হয়েছে মেয়েটার। তাও আবার সীমানার বাইরে একেবারে তার নিজস্ব গন্ডীর সীমানাতেই পা বাড়িয়ে বসেছিল বেচারী। চড়ামূল্য তো চুকাতেই হবে! চলো, ফরহাদুর রেজার সন্ধ্যানে মাঠে নামা যাক। উনি কি জানেন, আমরা তার ফ্ল্যাটে এভাবে ঢুকে পড়েছি?

বলতে বলতেই সামনে পা বাড়ালেন শামিম আহমেদ। বাসাটা আরো একবার ভালোমত ঘুরে দেখতে হবে। আর কোনো আলামত যদি চোখে পড়ে! বাথরুমের বেসিনে একটা শেভিং ক্রিম আর আফটার শেভ লোশন পেয়েছেন। বাথটাবের পাশে পেয়েছেন সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার। বেডরুমের দরজার সাথে লাগানো হ্যাঙ্গারে ক্যাটস আইয়ের অ্যাশ কালারের একটা সাড়ে ষোল কলার সাইজের ফুলহাতা শার্ট পেয়েছেন। সবকিছুই জব্দ করা হয়েছে। আলামত হিসেবে এটুকু প্রমাণ নেহায়েত কম মনে হচ্ছে না! সিয়েনা গ্রুপের এমডি ফরহাদুর রেজার এবার লোহার গরাদের ওপারে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এসেছে!

 

আজ সকালে তার এসিস্টেন্ট মাহবুবের ফোন পেয়েই ঘুমটা ভেঙেছে শামিম আহমেদের।

‘স্যার, ধানমণ্ডি লেকের পাশে একটা মেয়ের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। বয়স আন্দাজ পঁচিশ ছাব্বিশ। সকালে মর্নিং ওয়াক করতে আসা লোকজন মৃতদেহটি আবিষ্কার করেছে। মেয়েটিকে মাথায় শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে। মার্ডার উয়েপন উদ্ধার হয়নি। এলাকার একটা এপার্টমেন্টের দারোয়ান মেয়েটাকে শনাক্ত করেছে। নাম, মেঘনা নুর। ঐ এপার্টমেন্টেরই একটা ফ্ল্যাটে একা থাকতো!’

‘কী করতো মেয়েটা? প্রস্টিটিউট ফিউট না তো?’

‘তা না সম্ভবত স্যার। তবে তার বাসায় বড়সড় একজনের আসা যাওয়া ছিল। সিয়েনা গ্রুপের এমডি ফরহাদুর রেজা।’

‘আচ্ছা! খোঁজ নাও, ফ্ল্যাটটি কে কিনেছে। কাগজপত্র বের করো। আমি আসছি!’

 

ফ্ল্যাটটি ফরহাদুর রেজা সাহেবই কিনেছেন। তবে তিনি নিজে থাকতেন না। এই মেঘনা নুরকে এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কী জন্যে দিয়েছিলেন, সেটা ডায়েরি পড়ে কিছুটা জানা গেল। মেয়েটা নিজেকে গুপ্তচর বলছে। রেজা সাহেবের স্ত্রীর দিকে নজরদারি করার কাজে নিয়োগ করা হয়েছিল তাকে। কিন্তু সেটার পাশাপাশি ফরহাদুর রেজা সাহেবের রক্ষিতার ভূমিকাতেও নেমে পড়েছিল সে। ওদিকে আবার উনার ছেলেও এই মেয়ের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল। ডায়েরি পড়ে বোঝা যাচ্ছে, ফরহাদুর রেজা সাহেব সেটা বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন। কাজেই বাকিটুকু অনুমান করে নিতে আর কাঠখড় পোড়াতে হয় না। বিশ্বাসভঙ্গের কড়ামূল্য চুকাতে হয়েছে মেয়েটিকে।

শামিম আহমেদ ওপরের অনুমতি নিয়ে নিলেন। এসব রাঘববোয়ালদের ধরার সময় নানাদিক থেকে চাপ আসতে থাকে। প্রত্যেকেই চেষ্টা করে যার যার মতো করে টুঁটি চেপে ধরার। নীচে নেমে গাড়িতে বসেই ড্রাইভারকে হুকুম দিলেন, ‘সিয়েনা গ্রুপ অফ কোম্পানিজ!’

ফরহাদুর রেজাকে তার অফিসেই পাওয়া গেল। পালানোর চেষ্টা করেনি লোকটা। অবশ্য এদের খুঁটির যে জোর! পালানোর দরকার পড়বে না, এমন আত্মবিশ্বাস হয়ত আগাগোড়াই ছিল! কিন্তু বার বার একই কথা বলে চলেছে ব্যাটা! 

‘আমি কাউকে খুন করিনি! আপনারা ভুল জায়গায় সময় নষ্ট করছেন! খুনিকে ফাঁকতালে পালাতে সাহায্য করছেন!’

শামিম আহমেদ হাসলেন। সব পাগলই বলে, আমি পাগল নই! এ আর কী এমন বেশি কথা!

...................................................

 

ফয়সল উদ্ভ্রান্তের মতো নিজের ঘরে বসে আছে। মিসেস ফরহাদুর রেজা কয়েকবার এসে ঘুরে গেছেন ছেলের ঘরে। ফয়সল কোনো কথা বলছে না। 

সকালে জগিং করতে বেরিয়ে ধানমণ্ডি লেকের কাছে শোরগোল শুনে কাছে এগিয়ে যেতেই ভয়ে আর শকে স্তব্ধ হয়ে যায় ফয়সল। তারপর ধীরে ধীরে জানতে পারে, মেঘনা নুরের আসল পরিচয়...যে ফ্ল্যাটে থাকতো সেই ফ্ল্যাটের প্রকৃত মালিকের পরিচয়। 

 

গরম দুধে হাল্কা ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে ছেলের ঘরে ঢুকে চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন মিসেস রেজা। 

গ্লাসটা নামিয়ে রাখেন বেডসাইড টেবিলে। ছেলের এক মাথা কোকড়ানো চুলে কিছুক্ষণ বিলি কেটে নিজের ঘরের রকিং চেয়ারটাতে গিয়ে বসেন। বিছানার গুপ্ত কুঠুরি থেকে বের করে আনেন একটা ডায়েরি। অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে লিখতে থাকেন,

‘আরেকটা উইকেটের বিদায়। ফরহাদুর রেজা...আর কত? এবার তো ক্ষ্যান্ত দাও! তোমার বিশ্রী অসুখটা কাকে কাকে দিচ্ছো তা নিয়ে আমার মোটেও মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আমার ছেলেটাকেও যে এই চক্রে প্রায় ঢুকিয়ে ফেলেছিলে সেটা আমি মা হয়ে কেন মেনে নিব?

তোমার ব্যবসা আর তোমার ব্যাপারে গুপ্তচরবৃত্তি করতে গিয়েই তো এই নয়া আপদের সন্ধ্যান মিললো। গুপ্তচর লাগিয়েছিলে আমার পেছনে! বোকাসোকা একটা মেয়ে যে কী না নিজেকে ঘোড়েল গুপ্তচর মনে করতো! ড্রোন দিয়ে ছবি তুলে আর সটান তাকিয়ে থেকে বেচারি নিজেকে জেমস বণ্ড ভাবতে শুরু করেছিল! 

ওকে নিয়ে আমার আদৌ মাথাব্যথা ছিল না। ওর চোখকে ফাঁকি দেওয়া কী আর এমন শক্ত কাজ! কিন্তু তুমি নিজের স্বভাবটা লুকাবে কোথায়, বলো দেখি? সেই স্বভাবের পিছে ধাওয়া করতে গিয়েই তো আমিও সবকিছু জেনে গেলাম!

পরিণামটুকু তো তোমাকেই ভুগতেই হবে!