পোস্টস

গল্প

গল্প-মিলি

৩১ মে ২০২৪

সুরভী হাসনীন

মূল লেখক সুরভী হাসনীন



#মিলি (১)

ল্যাপটপটা বন্ধ করে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে মেয়ের দিকে তাকালো মিলি। তনু স্কুল থেকে ফিরে ভাত খেয়ে ঘুমিয়েছে। হিসেব মতো, দুই ঘন্টা পর ওঠার কথা। মিলি খেয়াল করে দেখেছে, যেদিন তার কাজ থাকে সেদিনই সব অঘটন কাজ ঘটে। অন্যদিন তনু গুনে গুনে দুই ঘন্টা ঘুমোয়। কোন দিন আরও বেশি। আর আজকে এত আগে উঠে বসে আছে।

' তোমাকে এখনই উঠে আসতে হবে? আরেকটু ঘুমালে কি হতো?

' ঘুম ভেঙে গেল মা। ঘুম ভেঙে গেলে কি শুয়ে থাকা যায়? তুমি বলো?'

' না যায় না। যখন উঠে গেছো আর কি করবে। আসো, আমার মাথা খাও।'

' মানুষের মাথা কি করে খায় মা। গরুর মাথা হলে খেতে পারতাম। গরুর মাথা দিয়ে ঝাল ঝাল করে ভুনা করো যে মাংসটা খুব মজা করে বাবা খায়।'

' তোমরা মেয়ে আর বাবা মিলে আমার মাথাটা খেয়ে বসে আছো। '

'আবারো ভুল কথা বললে মা। তুমি পাঙ্গাস মাছ না, শার্ক। আর শার্কের ফিন খাওয়া যায়, মাথা না।' তনু চোখ ডলতে ডলতে বললো। মায়ের মেজাজ খারাপ সে বুঝতে পেরেছে। কিন্তু মেজাজ কেন খারাপ হবে? সে তো মায়ের কথা মতো বিকেলটা ঘুমিয়ে কাটালো।

'এদিকে চলে আসো। চুল বেঁধে দেই। '

তনু মায়ের কোলে উঠে বসে। ল্যাপটপের চার্জ চলে গেছে। মিলি অফলাইনে আবৃত্তির ক্লাস করাচ্ছিল। একসময়ের দাঁপুটে আবৃত্তিকার মিলি একগুচ্ছ শিশু, অবসরপ্রাপ্ত গৃহিনী এবং অভিবাসী বুড়ো -বুড়িদের কবিতা শেখায়। এক দুই তিন করে বাড়তে থাকা সংখ্যাটা এখন অনেক। মিলি ভালো লাগাটা শখ এবং ভালোবাসায় পরিনত করেছে। ছোট ছোট শিশুদের সাথে তার মেয়েরাও ভীষন আনন্দ পায়। তনু ও টুনুকে  নিয়ে মিলি ছাদো চলে যায়। সেখানে আবৃত্তি শেখানোর ফাঁকে ফাঁকে চলে জীবনের পঙ্কতিমালার প্রথম স্তবক পাঠ। বুড়োদের দলটার মাঝে মজার মজার ঘটনা ঘটে যায়। ছন্দহীণ জীবনে এই নিত্য নতুন ঘটনাগুলো মিলিকে ভাবায়। 

মাস শেষে রোজগার মন্দ নয়।  সংখ্যাটা পাঁচের ঘর ছুঁয়েছে।   মিলির স্বামী অনিন্দ্যর ফোনে আসতে থাকা মেসেজগুলো ফরোয়ার্ড হয় মিলির হোয়াটসএপে।  টুকটাক নিজের কেনাকাটা করা শেষে কিছু সাংসারিক খরচা করে মিলি। অনিন্দ্যর এতে কোন মাথা ব্যাথা নেই। মিলির মন চাচ্ছে, করছে। সংসারটা ঠিক করে চললেই হলো। মিলি হিসেব করে দেখেছে অনেকগুলো টাকা জমেছে। অত অর্থ মিলির প্রয়োজন নেই। সহজ সরল জীবন উপভোগ্য এবং কাম্য যে মানুষের তারে পয়সা বা সাম্রাজ্য দিয়ে কেনা যায় না। উল্টো ওই সকল জটিল উপাদান পায়ের কাছে বসতি গাড়তে চাইলে তারা পালাতে চায়। তার পালাতে চায় জটিলতা থেকে। চমৎকার সারল্য মন্ডিত জীবন যাপন করে মিলি বেচেন থাকতে চায়। পৃথিবীর কঠিন দূর্যোগে সে দেখেছে, মানুষ মরে গেলেই তার প্রয়োজন ফুরোয়। অথবা, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই মানুষ মরে যায়। 

চমৎকার সংসারে দুটো মেয়ে, ভদ্রলোক স্বামী অনিন্দ্য   একটা মানুষ। মিলির শ্বশুর-শাশুড়ির সাথেই ছিলেন। তারা এখন কেউ নেই। মিলির মাথার উপর আছে এখন তার মা।চরম খিটখিটে মেজাজের একজন মানুষ। যার মেজাজের কোন তাল পাওয়া যায় না। মিলির মায়ের অবস্থা এরকম, যেনো চুলোয় বসানো গরম তাওয়া। তাতে এক ফোটা পানি পরলেই শব্দ হবে, ছড়িয়ে পড়বে, এবং তাওয়াটা চিৎকার দিয়ে বলব, ' তোরা জানোস না যেন।  তারপরেও আমার নিচে আগুন দিয়ে আমাকে গরম কইরা তার মধ্যে পানি ফেলা কি সুখ পাস, কি মজা লাগে?  '

'মা নাস্তা খাব '। তনু হাতের খেলনা ফেলে মায়ের গলা জড়িয়ে নেয়। মিলি এবার একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকায়। তারপর ভাবে বাচ্চার দোষ নেই। এ বয়সটা বারবারই ক্ষুধা লাগার। বাচ্চারা কিছুক্ষণ পর পর একটু একটু করে খায়। তার দুটো মেয়ে মুরগির বাচ্চা।  ঠিক মতন খেলেও একটু পর পর কিছু খাওয়া লাগে।  যদিও ফ্রিজ বোঝাই থাকে নানা রকম বিস্কিট, চকলেট আর দুধ দিয়ে। ওগুলো এখন খেয়ে নিলে হয়। মিলি তনুকে শক্ত করে বলল,

 'ফ্রিজের খাবার খাচ্ছো না কেনো।'  

তনু নিজের মাথা ধরে বলল, 'আমার মাথায় ফ্রিজের খাবার খাওয়ার সিগনাল পাচ্ছি না।'

'খাবার খাওয়ার জন্য সিগনাল লাগে?'

'মা, তুমি এমন ভাবে বলছো যেন ফ্রিজ খুললেই খাবার আমার গায়ের উপরে এসে পড়বে। সেগুলো তুলে নিয়ে আমি টপটপ করে খাব। '

 মেয়ের কথা বলার ভঙ্গিমায় চমৎকৃত হলো মিলি৷  এতোটুকু ছোট্ট মেয়ে কথা বলে যেনো পাকা বুড়ি। মিলি মেয়েকে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়।

'টপটপ করে খেতে হবে কেনো মা। আস্তে ধীরে খাবে। এত খাবার রয়েছে। কিছু একটা খেয়ে নাও। 

'না আমি নাগেটস খাব। নাগেটস ভেজে দাও।  '

মিনি প্রবল হতাশা নিয়ে ঘড়ি দেখে। বিকাল পাঁচটা ৫:১০ থেকে তার আরেকটা ক্লাস শুরু করার কথা। প্রবাসীরা চলে আসবেন। তাদের বিভিন্ন জনের নানা রকম সমস্যা লেগেই থাকে। কিন্তু তারপরও মিলি ক্লাসগুলো করতে বসে, কারন তার এই বৃদ্ধ মানুষগুলোর সাথে সময় কাটাতে, তাদোর কথা শুনতে ভালো লাগে। বেঁচে থাকার অন্যতম আনন্দময় উপকরণের মধ্যে একটি হচ্ছে কবিতা এবং আবৃত্তি। মিলি একে ভালোবাসে। মিলি হিসাব করে এখনই উঠে যদি নাগোটস ভাজতে যায় এবং টুনুর জন্য শশা কাটে তাতেও পাঁচটা বিশের আগে কাজ শেষ হবে না। ল্যাপটপ অন করে ক্লাসে কানেক্ট হতে গেলে আরও মিনিমাম ১৫ মিনিট লাগবে। সুতরাং ক্লাসটা শুরু করতে হবে ৫ঃ৩৫ এ।  এদেশে হলে এক কথা ছিল। যারা দেশের সাথে সংযোগ করে তাদের কাছে প্রতিটা মিনিট মূল্যবান। বিদেশের মাটিতে বসে তাদের কারো কাছে স্বামী আসবার সময় হয়ে যায়। সন্তান ফিরে আসলে তারা সন্তানের সামনে বুড়ো বয়সে কবিতা পড়তে লজ্জা পান। মিলি তাই বুড়ো বুড়ির দলটাকে ভীষণ ভালোবাসে। বয়স হয়ে গেলেও তাদের মন মরে যায়নি।

পাশের ঘর থেকে মিলির মায়ের চিৎকার শোনা গেল। পাঁচটা বেজে গেছে তাকে এখনো চা দেয়া হয়নি। সব মরে গেছে। বাড়ির লোকজন তাকে একদম পাত্তা দেয় না। 
মিলি হাতের ফোনটা নিল। whatsapp গ্রুপে 'আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী 'নামে বিদেশি স্টুডেন্টদের গ্রুপে মেসেজ পাঠিয়ে রাখল, 'ক্লাস উইল স্টার্ট ফ্রম ফাইভ ফর্টি '। মিলি জানে এটা চরম অপেশাদার সুলভ আচরণ। কিন্তু, কিচ্ছু করার নেই কারণ পরিবার তার কাছে অনেক বড়। মিলি উঠে হাত খোপা টেনে বেঁধে নেয়। অনিন্দ্য এখনো ফেরেনি। বড় মেয়েটা কোচিংয়ে গেছে। সে ফিরে এসে নাগেটস খেতে না চাইলে তাকে অন্য নাস্তা দিতে হবে। কি দেয়া যায়? মিলি ফ্রিজ থেকে নাগেটস বের করতে করতে ভাবতে থাকে, একটু চিড়ার পোলাও করে রাখবে বা সবজি দিয়ে চাও নাকি মিট বল। মিলির মা আবার চিৎকার করেন, 'শুধু শুকনা চা খায় মানুষ? পিঠা, মুড়ি চানাচুর কিছু দেয়া লাগে না? লোকজন আমাকে বান্দীর মতন ট্রিট করে। তারা ভুলে যায় আমার পেনশন থেকে ১৫ হাজার টাকা সংসারের যে খরচ করার জন্য দেই।' 

মিলি রান্নাঘর থেকে জবাব দেয়, 'দেয়া মাত্র সেই টাকা তোমার একাউন্টে ট্রান্সফার করা হয়, আম্মা। আমি তোমাকে খাওয়ানোর খরচ নেই না। বাজে কথা বলো না। '

 মিলি চুলা ধরায়। ফ্রাই প্যানে তেল ঢেলে গরম করতে দিয়ে চুলার আঁচ কমিয়ে রেখে মায়ের রুমে আসে।

' আম্মা তুমি শুরুটা করছো কি। বাড়িতে কি আর লোকজন থাকে না? এটা ফ্ল্যাট বাড়ি ভুলে যাও কেনো। 

মিলির মা কাপ ঠাস করে নামিয়ে রাখে।  মিলির বুক ধপ করে ওঠে। মৃত্যুর আগে তার নানাজানের মেজাজ এরকম জঘন্য হয়ে গিয়েছিল। আম্মাও সেদিকে টান নিচ্ছেন? ঘটনা কি খারাপ! খুব খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে বুঝতে পারে না মিলি। তার মা পেছন থেকে  কি যেনো জবাব দিলো। মিলি দাঁড়িয়ে শুনলো না। তেলের গন্ধ এসেছে। নাকে লাগা মাত্র মনে হলো তেল গরম হয়েছে। সে যেতে যেতে বললো,

'তোমার জন্য কিছু চিনাবাদাম চিড়া মাখা পাঠিয়ে দিচ্ছি। '

'টুনুরে দিয়া পাঠাবি না। সে আসতে আসতে চিড়ার থেকে খাইতে থাকে।'

' টুনুকে দিয়েই পাঠাবো। তাতে যদি এক মিনিটের রাস্তায় কিছু কম পরে আম্মা, তোমাকে এক গামলা চিড়া মেখে দিব। সারারাত কুটকুট করে মুটমুট করে ভুত ভুত করে চিড়া  খাবা কেমন।

মিলি চলে গেলে মিলির আম্মা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকেন। তার এই মেয়েটা ভালো ছিল বেশ ভালো ছিল দুইটা নাতনি হওয়ার পর মাথায় কিঞ্চিৎ সমস্যা দেখা দিয়েছে। পাঁচখানা ছেলে মেয়ের জন্ম দেয়ার পর তিনিও পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। মেয়েরা একটা বয়সে গেলে এরকম পাগল হয়ে যায় এটা মেয়ে ধর্ম।