পোস্টস

গল্প

আজম খান একজন মুক্তমনা উঁচুমাপের মানুষ

২৪ মে ২০২৪

মিলু আমান

Imtiaz Alam Beg photography

যুদ্ধফেরত টগবগে যুবক আজম খান। মিউজিক করবেন সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এলভিস-ক্লিফ রিচার্ডদের গানের কদর থাকলেও পাশ্চাত্য ঢঙে বাংলা গানকে মনে করা হতো অপসংস্কৃতি! এ কথা আমি আজম খানের নিজের মুখেও শুনেছি। একবার আজম খানের বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সৌভাগ্য হয়। আমি সে সময় একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করতাম। আজম খান ততদিনে গুরু থেকে কিংবদন্তি। 

আজম খানের গানের জগতে আগমনের সেই গল্প নিয়ে আমরা একটি ছোট ফিল্ম বানানোর উদ্দেশ্যেই তার সঙ্গে দেখা করার সৌভাগ্য হয়। অফিস থেকে ঠিক করে দেয়া হলো, আমার সঙ্গে আমার দুই কলিগ যাবে। ক্লায়েন্ট সার্ভিস থেকে মাসুদ আর আমার সহকারী কপিরাইটার রুম্পা। আমরা বেশ নার্ভাস। এত বড় একজন মানুষের ইন্টারভিউ কীভাবে করব তা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। মাসুদ আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ভাই কী কী প্রশ্ন করবেন ঠিক করেছেন?’

উত্তর দেয় রুম্পা, ‘হ্যাঁ, মাসুদ ভাই, এই যে দুই পাতা প্রশ্ন লিখে নিয়ে এসেছি।’আমরা তার বাসায় গেলাম বিকেলের ঠিক আগের সময়টায়। বাড়ির বাইরের সিঁড়ি দিয়ে দোতলার একটি ঘরে বসলাম। ঘরে সোফা আর টেবিল ছাড়া একটি বইয়ে ভরা আলমারি আর দেয়ালে একটি পুরোনো দিনের আজম খানের কনসার্টের পোস্টার ছাড়া বিশেষ আর কিছুই নেই চোখে পড়ার মতো।

আজম খান একটু পরে এলেন। আমাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তিনি খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, ‘বসো, তোমাদের চা দিতে বলছি। তোমরা দুপুরে খাইছো তো? ভাত খাইবা?’

মাসুদ সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘না না, আমরা খেয়ে এসেছি। কিচ্ছু লাগবে না, আপনি বসেন তো!’

তিনি বসতে বসতে বললেন, ‘তোমরা কী জানতে চাও? শুনি...।’

রুম্পা ঝটপট একের পর এক কয়েকটি প্রশ্ন করে ফেলল। আজম খান বললেন, ‘বাবা, তোমাদের এসব প্রশ্ন শুনে আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম।’

আমি বললাম, ‘আসলে আমরা আপনার সঙ্গে আড্ডা দিতে এসেছি। কোনো প্রশ্ন করতে আসি নাই।’

আজম খান একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘যাক বাঁচা গেল, আমি তো বেশ নার্ভাস হয়ে গেছিলাম।’

আজম খানের মুখে একথা শুনে আমরা সবাই হেসে উঠি।

এরপর আমাদের অনেকক্ষণ সময় দিলেন তিনি। আমাদের তো ব্যাপারটা ভাবতেই স্বপ্নের মতো লাগছিল, আমরা আজম খানের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি! 

মুক্তিবাহিনীর গেরিলা কমান্ডার আজম খান দেশকে মুক্ত করার জন্য একাত্তরের যুদ্ধক্ষেত্রে দুর্ধর্ষ সব মিশনে অংশ নিতেন। শুধু তা-ই নয়, গান গেয়েও রণক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করে রাখতেন। 

আবার রাতে সবাই যখন ক্লান্ত শরীরে ক্যাম্পে ফিরে আসত, আজম খান তার গান দিয়ে তাদের অনুপ্রেরণা জোগাতো। আজম খানের ক্যাম্পে বাতি জ্বলছে এটা দেখেও অনেক মুক্তিযোদ্ধা স্বস্তি পেত। তারা একটু শান্তিতে চোখ বন্ধ করতে সাহস পেত এই ভেবে যে, আজম খান জেগে আছেন।

ভাবতে অবাক লাগে, স্বাধীনতার পর পুরো সংস্কৃতিমহল এই আজম খানকেই নিগৃহীত করে। তার গানকে ‘অপসংস্কৃতি’ আখ্যা দেয়।

আজম খান তার যাত্রা শুরু করেন ‘স্পন্দন’ ব্যান্ড দিয়ে। ব্যান্ডে অন্যান্যের মাঝে ছিলেন নাসির আহমেদ, হ্যাপি আখন্দ, জর্জিনা হক, হাবলু, ফেরদৌস ওয়াহিদ আর ফিরোজ সাঁই। পরবর্তীকালে নিজের মৌলিক গান করার উদ্দেশ্যে আজম খান ‘উচ্চারণ’ ব্যান্ড প্রতিষ্ঠা করেন। 

মুক্তিযুদ্ধের পর আজম খানের যাত্রাপথও দুর্গম ছিল। ব্যান্ড করেছিলেন ঠিকই কিন্তু কোথাও পারফর্ম করার সুযোগ হতো না। অনেক কষ্টে কোনো কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সুযোগ মিললেও সহশিল্পীরা পর্যন্ত খারাপ আচরণ করত! কিন্তু শ্রোতাদের কাছে টানতে খুব বেশি দেরি হয়নি আজম খানের। গান শুরু করে মাঝপথে থেমে গিয়ে বলে উঠতেন, ‘আমি কি আর গাইব?’

শ্রোতারা ফেটে পড়ত, ‘আপনি গেয়েই যান, গুরু।’ 

বাংলার শ্রোতারা তাকে ঠিকই চিনে নেয়। আজম খান কখনো থেমে যাননি। ‘সালেকা মালেকা’ দিয়ে শুরু, তারপর একে একে গাইলেন, ‘আলাল ও দুলাল’, ‘এত সুন্দর দুনিয়া’, ‘জ্বালা জ্বালা’, ‘বাংলাদেশ’। নয়নের অনবদ্য গিটার আর আজম খানের চড়া কণ্ঠ, খুব দ্রুতই এসব গান যেন বাংলার প্রাণের গানে পরিণত হলো। 

নয়ন একসময় কানাডায় পাড়ি দেন। স্টুডিও মিউজিশিয়ান হিসেবে অনেকের সঙ্গে কাজ করেন। সেখানে সোলো শো করেন কিছুদিন। দেশে আর কখনোই ফিয়ে আসা হয়নি, এক গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান নয়ন মুন্সী। 

তবে দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে তৈরি করে দিয়ে যান রকেটকে। রকেট আগে থেকেই আজম খানের সঙ্গে বাজানোর সুযোগ খুঁজছিল। দায়িত্ব পেয়েই রকেট নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে। ‘অভিমানী’, ‘আমি যারে চাইরে’, ‘বাধা দিয়ো না’, ‘জীবনে কিছু পাবো না’, ‘এ কী জীবন এর চেয়ে ভালো মরণ’, ‘ও চাঁদ সুন্দর’- এসব গানে গিটার বাজায় রকেট। আজম খান ধীরে ধীরে গুরু থেকে হয়ে ওঠেন ‘রক সম্রাট’।

আজম খানের কনসার্ট হলেই সবাই ছুটে যায়। আর সে সময় কনসার্ট মানেই মারামারির জন্য প্রস্তুত থাকা, অথবা কোনো দুর্ঘটনা! টিএসসিতে আজম খানের কনসার্ট। মারামারি হতেই পারে, পরিস্থিতিও সেরকম। 

কনসার্টটা বাদ হয়ে যেতে পারে সবাই যখন সেরকম ভাবছে, ঠিক সে সময়ই আজম খান স্টেজে। তিনি শুধু হুংকার দিয়ে বললেন, ‘এই তোরা একটু শান্ত হ’ তো, না হলে কিন্তু 

গাইব না।’

সঙ্গে সঙ্গে সবাই সবকিছু ভুলে একসঙ্গে বলে ওঠে, ‘না গুরু, শুরু করেন।’

গুরু শুরু করলেন, ‘আসি আসি বলে তুমি আর এলে না...’ ।  

দর্শক সবকিছু ভুলে গিয়ে গানে মেতে ওঠে।

ফিল্ম বানানোর জন্য আমাদের যা প্রয়োজন ছিল তার সবই আড্ডার ছলে হলো। তিনি একসময় বললেন, ‘তোমাদের যা দরকার ছিল তা কী তোমরা পাইসো? নাকি শুধু শুধুই আমরা আড্ডা দিয়া সময় নষ্ট করলাম?’

আমি বললাম, ‘নিশ্চয়ই পেয়েছি! অনেক নতুন কিছুও পেয়েছি।’

আমি রুম্পাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘রুম্পা, কী মনে হয়?’

রুম্পা দ্রুত তার প্রশ্নগুলো দেখে বলে, ‘হ্যাঁ ভাই, অল কভারড।’

আজম খান উঠে দাঁড়ালেন, ‘তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে আমারও খুব ভালো লাগছিল। কিন্তু আমার একটু এক জায়গায় যেতে হবে। প্রতিদিন এই সময় পাড়ার মাঠে কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করে। আমাকে না দেখলে ওদের খুব মন খারাপ হয়।’


একথা শুনে আমরাও উঠে পড়ি। আজম খান একে একে আমাদের জড়িয়ে ধরে বিদায় জানালেন।

আমরা তিনজন বাইরে বেরিয়ে আসি। কেউ কোনো কথা বলছি না। বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল আমাদের ধাতস্থ হতে। এত বড় একটা ঘটনার এতটাই সহজভাবে হবে, সেটা আমরা কেউই আশা করিনি। 


আজম খানের আন্তরিকতা আর সরলতা আমাদের সত্যি সেদিন মুগ্ধ করে। তিনি যে একজন ‘রকস্টার’ সে বিষয়ে আমাদের কখনো কারও মনে সন্দেহ ছিল না, কিন্তু উনি যে একজন মুক্তমনা উঁচু মাপের মানুষ, সেটা আমরা সেদিন অনুভব করি।