Posts

গল্প

ইন্সপিরেশন

May 27, 2024

সোহেল মাহরুফ

Original Author সোহেল মাহরুফ

58
View
বেশ আয়োজন করেই রঞ্জন আজ লিখতে বসেছে। রঞ্জন- পুরো নাম রঞ্জন চৌধুরী। ইতিমধ্যেই এ শহরে লেখক হিসেবে মোটামুটি পরিচিত। কতটা ভালো লেখে সে তা জানে না। কিন্তু একটা জিনিস প্রায়ই খেয়াল করে যে কোনো পত্রিকাই তার লেখা ফিরিয়ে দেয় না। দু’একটা পত্রিকার অতি উৎসাহী সাহিত্য সম্পাদক আবার মাঝে মাঝে নূতন লেখার জন্য ফোনও করে। মাঝে মাঝে তার ইন্টারভিউ নেয়- তাকে গোলটেবিল বৈঠকে ডাকে। এগুলো সে বেশ উপভোগ করে। যদিও এ নিয়ে সে আত্মঅহমিকায় ভোগে না। তাই লেখক হিসেবে সে নিজেকে কখনও আলাদা শ্রেণিতে ফেলতে চায় না। স্বাভাবিক জীবনযাপনেই সে অভ্যস্ত। সকাল আটটায় অফিসে যাওয়া- রাত ন’টায় বাসায় ফেরা। মাঝে মাঝে কিছু আইডিয়া আসলে কম্পিউটারে বসা- ব্যস।

তবুু আজ তার এই বিশেষ আয়োজন। তিন দিস্তা অফসেট কাগজ, চারটা দামি কলম,  দুই প্যাকেট বেনসন আর দামি অ্যাশট্রে নিয়ে ব্যাপক আয়োজন। আর এ আয়োজন করতে তাকে রীতিমতো কক্সবাজার এসে হোটেলে উঠতে হয়েছে। আসলে বাসায় এমনটি সম্ভব ছিল না। কেননা, সে সবসময় কম্পিউটারেই লেখে। তাই এত আয়োজনের কোনো সুযোগ নেই। এবং কখনও এর প্রয়োজনীয়তা সে অনুভব করেনি। তার ধারণা লেখালেখি হল ভেতরকার ব্যাপার। এটা এমনিতেই চলে আসে। এর জন্য বাড়তি কোনো আয়োজনের দরকার নেই। সে হয়তো সারাজীবন সেটাই জানতো। যদি না মেয়েটা সেদিন ওভাবে বলত। মেয়েটা মানে তার এক মেয়ে ভক্ত। একদিন ফোন করেছিল। হঠাৎ জিজ্ঞেস করল- আপনি কোন ব্রান্ডের সিগারেট খান- বেনসন নাকি কোনো বিদেশি ব্র্যান্ড?
কিন্তু সে যখন বলল যে সে সিগারেট খায় না তখন মেয়েটা রীতিমতো বিস্মিত। বিস্ময়মাখা কন্ঠে বলল- সিগারেট খান না মানে! তাহলে লেখেন কিভাবে?
-মানে, লিখতে হলে সিগারেট খেতে হয় নাকি?
-হয় না মানে!  আমরা তো জানি কবি লেখকরা সিগারেট খেলেই তাদের মাথার জট খুলে যায়। তখন তারা মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি করে। ফলাফলস্বরূপ শরীরে ক্যান্সারসহ নানা রোগ বাসা বাঁধে আর বিখ্যাত হওয়ার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। মৃত্যুর পর তারা বিখ্যাত হয়।
-বাহ্! তুমি তো খুব সুন্দর করে কথা বল। কিন্তু সব কবি লেখকরাই যে সিগারেট খায় আর সিগারেট খেয়ে ক্যান্সার বাঁধায়- এ থিওরি তোমাকে কে দিয়েছে?
-না মানে, সবাই তো সেইটা ই মনে করে।
-তাই নাকি?
-জানেন হুমায়ূন আহমেদের একটা নাটকের বইয়ের শুরুতে উনি লিখেছেন ওনাকে নাকি ভক্তরা কলম আর বিভিন্ন বিদেশি ব্র্র্যান্ডের সিগারেটের কাটন দিয়ে যায়। 
-হতেও পারে।
-আমার সেজন্য ধারণা ছিল যে আপনার মেয়ে ভক্তরাও বুঝি আপনাকে বিদেশি ব্র্যান্ডের সিগারেটের কাটন দিয়ে যায় আর সেগুলো খেয়ে আপনি এমন সুন্দর সুন্দর লেখা লেখেন।
-তাই! কিন্তু তোমার ধারণাটা একদম ভুল। 
-হুম্, বুঝতে পারছি। এতদিনে আরো একটা জিনিস জানলাম।
-কি?
-জানলাম যে আপনার গল্পের নায়কেরা এমন মাইয়া মাইয়া টাইপ কেন?
-মাইয়া মাইয়া টাইপ মানে?
-না মানে, আগে যখন ইমদাদুল হক মিলনের বই পড়তাম তখন দেখতাম ওনার নায়কেরা কি স্মার্ট, হ্যান্ডসাম। কিন্তু আপনার নায়কেরা সে রকম না।
-তাই! আগে পড়তে মানে? এখন পড়ো না?
-না। এখন এত সময় কোথায়? ভার্সিটিতে ক্লাস, পড়াশোনা, মোবাইলে আড্ডা, হিন্দি সিরিয়াল দেখা, পার্লারে যাওয়া- এত কিছুর ফাঁকে আর পড়ার সময় হয় না।
-আমার লেখা কখনও পড়েছো?
-সত্যি কথা বলতে কি আপনার বই কিনে কখনও পড়া হয়নি। তবে পত্রিকায় আপনার যে লেখাগুলো বের হয় তার একটাও মিস্ হয় না। আসলে আপনার প্রথম লেখাটা পড়ার পর কেমন মোহে পড়ে গেছি। আপনার লেখার ভেতরের ইমোশনটা, অদ্ভুত রকমের কষ্টটা আমাকে ভীষণভাবে টানে। জানেন, মাঝে মাঝে এমন হয় যে পত্রিকায় হয়তো আপনার লেখাটা দেখেছি কিন্তু সময়ের অভাবে পড়তে পারিনি। তখন রাত্রে ঘুমুতে যাওয়ার আগে হলেও ওটা পড়ে শেষ করে ঘুমুতে যাব। আপনার অনেক লেখা আমি একাধিকবারও পড়ি।
-তাই! শুনে ভালো লাগল।
-আচ্ছা আপনি এত কষ্টের লেখা কিভাবে লেখেন? আগে অবশ্য ধারণা ছিল যে আপনি বোধ হয় গাঞ্জা টাঞ্জা খাইয়া নেশায় বুঁদ হয়ে কাঁদতে কাঁদতে এমন লেখা লেখেন।
-না। কখনো না।
-তা তো বুঝলাম। কিন্তু আপনার লেখার ইন্সপিরেশনটা কি?
-জানি না।
-আপনার কি খুব বেশি কষ্ট?
-না- সেরকম কিছু না।
-তাহলে? ভন্ডামি?
-বুঝি না।
-বুঝলে বলবেন। পরে ফোন দেব। বাই।
সেদিন থেকেই ব্যাপারটা মাথায় ঢুকে গেছে। তাই অফিস থেকে রীতিমতো দশদিনের ছুটি নিয়ে কক্সবাজার এসেছে। এ দেখে অফিসের সবাই প্রথমে ভেবেছিল সে বোধ হয় এবার আইবুড়ো অপবাদ ঘুচিয়ে কোন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে দায়মুক্ত  করবে। কিন্তু যখন শুনল স্রেফ গল্প লেখার জন্য ছুটি নিচ্ছে তখন সবাই এই সিদ্ধান্তে আসল, বয়সকালে বিয়ে না করলে মাথায় এ রকম গোলমাল দেখা দিতেই পারে।

সে যে হোটেলটাতে উঠেছে সেটা আসলেই অসাধারণ। একেবারে সাগরের কাছে। রুম থেকে সাগরের গর্জন শোনা যায়। জানালা দিয়ে তাকালে সাগর দেখা যায়। সাথে সাগরমুখী ছোট্ট বারান্দা। সেখানে বসলেই সাগরের শীতল হাওয়া শরীর আর মনকে স্পর্শ করে যায়। এমন পরিবেশে এমনিতেই ভাব চলে আসে। লেখার জন্য আর আলাদা আয়োজন দরকার হয় না। তবুও রঞ্জন সিগারেটের প্যাকেট খোলে। একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটের কোণে রাখতেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা লেখার কথা মনে পড়ে।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক জায়গায় লিখেছিলেন যে, সেদিন সকাল থেকেই মাথায় লেখাটা চেপে বসেছিল। তাই সকালে মা বাজারে যেতে বললেও আর যাননি। বিশেষ করে লেখার চেয়েও বেশি ভাবনা ছিল কড়া রোদ নিয়ে। ফিরতে ফিরতে রোদ চড়ে যাবে সেই ভয়েই বাজারে যাননি। কিন্তু বেলা বারোটায় যখন সিগারেটের প্যাকেট এর শেষ কাঠিটায় আগুন ধরালেন তখন তার মাথায়ও যেন আগুন ধরল। লেখা আর এগোয় না। তখন তিনি সেই কড়া রোদ মাড়িয়ে গিয়ে সিগারেট আনতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি।

অতএব, নিশ্চয়ই এর ভেতরে কিছু একটা ব্যাপার আছে। ভাবতেই তার আরো অনেক কিছু মনে পড়ে। সেদিন তার আর এক মেয়ে ভক্তও তাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করেছিল। মেয়েটা ভালো রবীন্দ্র সংগীত গায়। একদিন তার বাসায় রবীন্দ্র সংগীত শুনতে দাওয়াত করল। নাস্তাটাস্তা সারার পরে মেয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল- দাদা কোন ব্র্যান্ড? সে তো প্রথমে বুঝতে পারেনি। জিজ্ঞেস করলো- মানে?
-না মানে সিগারেট কোনটা খান?
সে যখন বললো সিগারেট খায় না। তখন তো মেয়ের বিস্ময়ের সীমা থাকে না।
-মানে, আপনি সিগারেট খান না! সত্যিই! আপনার মতো এত বড় একজন লেখক- এও সম্ভব!
তারও আগে- অনেক আগে- সে তখন কলেজে। তখনও লেখক হিসেবে সে এত পরিচিতি পায়নি। কিন্তু পরিচিত সবাই তার লেখালেখির ব্যাপারটা জানতো। তখন সে প্রায়ই তার এক মেয়ে সহপাঠীর বাসায় যেত। আরো কয়েকজনসহ তারা প্রায়ই সেখানে যেত। আড্ডা দিত। মেয়েটার মাও মাঝে মাঝে তাদের সাথে যোগ দিতেন। তিনিও সাহিত্য টাহিত্য পড়তেন। একদিন চা নিয়ে এসে যখন জানলেন সে চা খায় না তখন  তিনি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন- চা খাও না- সিগারেট খাও?
এ শুনেতো রঞ্জন ’থ। বলে- না আন্টি।
-তুমি লেখক না? চা সিগারেট খাও না তো কি লিখ?
সেদিনের পরও ব্যাপারটা অনেকদিন তার মাথায় ঘুরছিল। কিন্তু পরে ভুলে গেছে। ইদানিং আবার ঘুরছে। ভাবছে আসলেই কি এটা সম্ভব? একজন লেখক সিগারেট খেলেই কি ভাল লিখতে পারে? আচ্ছা একজন লেখকের ইন্সপিরেশন কি? ভালো লিখতে তো নিশ্চয়ই কোন ইন্সপিরেশন লাগে। সেটা কোত্থেকে আসে? তার লেখার ইন্সপিরেশনই বা কি? ভাবতেই তাল হারিয়ে ফেলে। সেদিন এক সাংবাদিক একটা ইন্টারভিউতে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- আপনার লেখার ইন্সপিরেশন কি? সে উত্তর দিতে পারেনি। আসলে সে কখনও সেভাবে ভাবেনি। যখনই বসেছে কিছু না কিছু লিখেছে। কেন লিখেছে- কি উদ্দেশ্যে এগুলো কখনও ভাবেনি। তবু সেদিন ঐ সাংবাদিকের সামনে নিজেকে বোকা বোকা মনে হচ্ছিল।

তার কয়েকদিন পরেই কবি নির্মলেন্দু গুণের একটা সাক্ষাৎকার পড়েছিল। তিনি কি সুন্দর অকপটে বলেছেন- বিশেষ বিশেষ নারীকে সন্তুষ্ট করার জন্য কবিতা লিখেন। কবিতা লেখার জন্য তার নারী মডেল দরকার হয়... এসব, এসব। কিন্তু অনেক ভেবেও রঞ্জন সেরকম কিছু খুঁজে পায় না। সে হঠাৎ ভাবে আচ্ছা তার প্রথম লেখাটা সে কখন কিভাবে লিখেছে। অনেক ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে- কলেজে পড়া অবস্থায়ই লিখেছিল। কেন লিখেছিল তাও মনে পড়ে যায়। কলেজে প্রথম দিনেই একটা মেয়েকে ভালো লাগে। তার প্রতি একটু দুর্বলতাও বোধ করে। সেই মেয়ে একদিন তার সামনেই তাকে অবজ্ঞা করে আরেকটা ছেলের সাথে কথা বলেছিল। সে ভীষণ কষ্ট পায়। বাসায় ফিরেই সে কাগজ কলম নিয়ে বসে যায়। এক বসাতেই কয়েক পৃষ্ঠা লিখে ফেলে। তারপর সেই অগোছালো লেখা বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠায়। কিন্তু কোন পত্রিকাতেই ছাপা হয় না। তারপর একদিন তাকে অবাক করে দিয়ে একটি বিখ্যাত পত্রিকা তাদের বিশেষ সংখ্যায় তার সে লেখা ছাপে। বন্ধুরা দেখে খুব প্রশংসা করে- ইভেন সেই মেয়েটাও। তারপর থেকে সেই আনন্দেই যেন সে লেখালেখি চালিয়ে যায়। এর মাঝে কখনও ভাবার অবকাশ হয়নি যে কেন লিখে, কি জন্য লিখে। তারপর তো আজকের এই অবস্থানে। আজ এসব ভাবতে ভাবতেই সেই মেয়েটার ছবি তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়। সেই নিষ্পাপ কিশোরী মুখ। যদিও সে জানে ও মুখ এখন হয়ত মোটেই সেরকম নেই। শুনেছে, মেয়েটার খুব বড়লোকের সাথে বিয়ে হয়েছে। সে কি সত্যিই সুখী হয়েছে? ভাবতেই তার বুকে এক ধরনের কষ্ট অনুভব করে। মেয়েটার ছবিটা সে মুছে ফেলতে চায়। কিন্তু পারে না। আরো স্পষ্ট হয়। ভারী দুটি চোখ তুলে যেন বলে- এত অভিমান কেন তোমার?

রঞ্জন ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে রাখে। বাইরে তাকায়। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছু দেখা যায় না। দূরে তাকাতেই দেখে সাগরের সাদা ফেনিল ঢেউগুলো তীরে আছড়ে পড়ছে। তার শব্দ যেন রঞ্জনের বুকের ভেতর বিরতিহীন কথা বলে যায়। তাকে আর সিগারেট ধরাতে হয় না- ভাবতেও হয় না। সাদা কাগজের ওপর কলমটা এগিয়ে চলে।

Comments

    Please login to post comment. Login