লেডিজ হোস্টেলের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন জীবনযুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত বছর তিরিশের যুবক। সামান্য কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে এখন পর্যন্ত। বেশিরভাগই পেয়ে গেছে 'দুর্বোধ্য' তকমা। সহজ শিশুবোধক কবিতা তিনি একদমই লিখতে পারেন না, বা লিখতে চান না।
ধীরে ধীরে তাঁর প্রত্যয় হল লেখার সাথে সাথে তিনিও সবার কাছে দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছেন। কাকে বলবেন তিনি এই মনোবেদনা! তাঁকে বুঝতে পেরেছিল শুধু "নাটোরের বনলতা সেন"। কিন্তু সে কোথায়! কোথায় গেলে পাবেন!
ঘন্টার পর ঘন্টা বেজে যায়, ফেটে যায় শিরা ধমনীর দেয়াল। উশৃংখল হয় রক্তের স্রোত।
দারোয়ানকে পরিচয়ের স্লিপ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। বারবার উপরের দিকে তাকাচ্ছেন। কখন, কোন শুভক্ষণে একরঙা শাড়িতে আবৃত হয়ে নীচে নামবেন এই জগতের সবচেয়ে অপূর্বদৃষ্ট একটা মানুষ।
কবিতার বনলতা সেনকে তিনি চেনেন। তিনিই তো তার নির্মাতা, চেনা স্বাভাবিক, তাঁর হৃদয়ের আবেগ দিয়ে তৈরি করেছেন তাকে। বলা যায় তারই শরীরের একটা বিকল্প অংশ যেন বনলতা সেন। যার সঙ্গে বাইরের কোনো কিছুর সম্পর্ক নেই। কিন্তু এতদ সত্ত্বেও কেন তাকে ওভাবে উঞ্ছবৃত্তি করতে হয়, একটা মানুষকে শুধুমাত্র একবার দেখার জন্য!
তিনিই তো ব্রহ্মা, তিনি তো আত্মভোলা শিব, তিনিই তো স্বয়ংভূ! স্বয়ংক্রিয় স্রষ্টা! যাকিছু তাঁর নিজের সবই ঢেলে দিয়েছেন অক্ষরের কালিতে! বেদনা পেয়ে পেয়েই তো লাল রক্ত কালো হয়ে অক্ষরে জমাট বেধে আছে! তো তাহলে বাইরে বেরিয়ে আসা সেইসব লেখাগুলোতে তিনি তৃপ্ত নন কেন! তাঁর মেসের তেলচিটচিটে বালিশ, সামান্য খোঁড়া চেয়ার, শূন্য টেবিল, এসবও তো তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত শরীরের অংশ!
দাঁড়িয়ে আছেন এখনো সেই যুবক। ভাবছেন, একটা বাইরের মানুষকে কেন এত আপন মনেহয়! এর সঙ্গে খাতার বনলতার কতটা মিল বা অমিল। কে আসল সত্য! আর দুজনের মধ্যে আদৌ কী কোনো সম্পর্ক আছে! তার এত দেরি হচ্ছে কেন!
এবার ধমনীর শিরা ফেটে হয়ত বাইরে বেরিয়েই আসবে ক্লান্ত বটফলের মত রক্ত। পলাশের তীব্র রঙ, মচকা বা পারিজাতের নুইয়ে পড়া পাপড়ির মত হেলে থাকা বিষণ্ণ জীবন। যেখানে কোনো আনন্দ নেই। সত্যি নেই!
এটা ভুল। কেউ কোনো সৃজনশীল কাজের মাধ্যমেই পারে তার যন্ত্রণাকে আনন্দে রূপান্তরিত করতে। এটাই বিজ্ঞান, সূত্র এটাই। এই কারণে মানুষ লেখে, গান গায় সাঁতার কাটে, ক্ষুদ্র বলটাকে তীব্র গতিতে পাঠিয়ে দেয় দেয়ালের পলেস্তারা চুরমার করে।
তিনি হয়ত জানেন এইসব, কিন্তু মানতে পারছেন না। তাই তারই সৃষ্টি করা অস্তিত্বের দর্শন করতে দাঁড়িয়ে আছেন অন্তহীন সময়। হয়ত সারা জীবন, সমস্ত আনন্দ চুরমার করে দাঁড়িয়েই থাকবেন। আর হয়ত একদিন সত্যি সত্যি জেনেও যাবেন, যার জন্য তিনি দাঁড়িয়ে আছেন আসলে সে আছে তাঁর নিজেরই ভিতরেই।