একরত্তি মেয়েটা কিছু বোঝে না, শুধু জানে যা হচ্ছে তা ভালো না, আনন্দের না। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কাঁদে, কেউ সেই কান্না থামাতে আসে না, বাড়ির বড়দের কথার ভিড়ে কেউ ছোট্ট মেয়েটার দিকে খেয়াল করে না। ঘরের একপাশে মেয়েটার মা শান্ত নিথর হয়ে বসে আছে। পাড়া-পড়শিরা ফিসফাস করছে।
'স্বামী মরে গেছে, অথচ অলক্ষুণে বউটার কোন শোক-তাপ নেই কেন?' নিচু গলায় কেউ একজন বলে ওঠে। ঠোঁটকাটা কেউ উত্তর দেয়, 'বউটাই যত নষ্টের গোড়া। নইলে ছেলে না হয়ে মেয়ে হবে কেন? বিয়ের দু'বছর বাদে স্বামীর মাথা খেয়েছে রাক্ষুসীটা। ওটাকে না তাড়ালে বাড়িতে আরও কত কী হবে, কে জানে!'
সবাই এই ব্যাপারে সায় দেয়। বউটা যে অলক্ষুণে এতে কারও কোন সন্দেহ থাকে না। তারা এই বিষয়ে আরও উচ্চতর আলোচনা করতে থাকে। সেই আলোচনায় এই বউটার সঙ্গে আধমরা স্বামীর বিয়ে দেয়া হয়েছিল- সেটা কেউ বলে না। কারো গলায় একবারও উচ্চারিত হয় না, মরণাপন্ন স্বামীর কী সেবাটাই না বউটা করেছিল, পেটে বাচ্চা নিয়েও বাড়ির কাজকর্ম সব নির্দ্বিধায় করে গেছে, একটা দিনও নিজের কষ্টের কথা মুখ ফুটে বলেনি। সেই নীরব মানুষটির বিরুদ্ধে সবাই ভীষণ সরব। বউটি পাথরের মতো স্থির হয়ে বসে থাকে, দূরে তার মেয়েটি কেঁদে যায়, অবিরাম।
বিজ্ঞজনেরা সিদ্ধান্ত নেয়, এই রাক্ষসীকে এই বাড়িতে আর রাখা ঠিক হবে না। তার বাপের বাড়িতে খবর দেয়া হয়। বউয়ের ভাইয়েরা আসে, তারা বোনকে নিতে প্রথমে রাজি হয় না। সংসারে একটা মুখ বেড়ে যাওয়া অনেক বড় ব্যাপার। নানা বাদানুবাদ শেষে বোনকে নিয়ে যায় বটে, কিন্তু ছোট্ট মেয়েটি মায়ের সঙ্গে যেতে পারে না। সে থেকে যায় পরলোকগত বাবার বাড়িতেই। মুরুব্বীদের সিদ্ধান্তে মা ও মেয়ে আলাদা হয়ে যায়, এই দুটো প্রাণীর সিদ্ধান্ত কেউ জানতেও চায় না। বলা বাহুল্য, দেশটির সর্বময় ক্ষমতা বহু বছর ধরে নারীর হাতে, অথচ মা-মেয়ের জীবনের মূল্য আজও কত সামান্য!
ভাইদের সংসারে বোঝা হয়ে থাকা বোনটির সদ্গতি হয় বটে, জুয়ারী মাতালের কাঁধে তাকে চাপিয়ে ভাইয়েরা দায়মুক্ত হয়। সেই মাতালও জাতে মাতাল কিন্তু তালে ঠিক। বিয়ের আগে তার সাফ কথা, আগের ঘরের মেয়েকে দেখতে যাওয়া চলবে না। তার সংসারে আপদ রাখার জায়গা নেই।
ওদিকে ছোট্ট মেয়েটা বাবার বাড়িতে বড় হতে থাকে। বাবা মারা গেছে, মা কোথায় আছে সেটা তার জানবার কথা নয়। ক্ষুধা পেলে সে কাঁদে, কেউ ফিরেও তাকায় না। একটা সময় মেয়েটা কাঁদতে ভুলে যায়। বাড়ির উচ্ছিষ্ট খেয়ে বড় হতে থাকে, একটু বড় হওয়ামাত্র বাড়ির কাজে হাত লাগাতে হয় তাকে। দূর শহরে চাচা থাকেন, চাচার ছেলেমেয়েরা ছুটিতে বাড়ি আসে, ওদের বইপত্র দেখে ও হা করে তাকিয়ে থাকে। ওদের কাপড়গুলো ধুতে ধুতে ও বইয়ের রঙিন ছবিগুলোর কথা ভাবে। কেউ একজন তাড়া দেয়, জলদি কাপড় ধুতে, হাতে এখনও অনেক কাজ।
ছোট্ট দুটো নরম হাত একের পর এক কাজ করে চলে। ক্ষমাহীন পৃথিবী তাকে থামতে দেয় না।
একসময় দুরন্ত কৈশোর তার মনের আঙিনায় পা রাখে। ফুললিত সৌরভ ছড়িয়ে রংধনুর সাতরং ছড়িয়ে তাকে ডাকতে থাকে, সে সাড়া দেয় না, দিতে পারে না। বাড়ির কাজের মানুষ সে, তার জীবনের গান শোনবার সময় কোথায়?
শহর থেকে খবর আসে। চাচার বাসায় কাজের লোক দরকার, পয়সা দিয়েও বিশ্বস্ত লোক পাওয়া কঠিন, সেখানে বিনে পয়সায় এমন মানুষ হাতছাড়া করা যায়?
মেয়েটা শহরে আসে। কত আলো! কত শব্দ!
কাজের ধরণ বদলায়। চাপ বাড়ে। সব কাজ সেরে বড়োজোর টিভি দেখবার একটু অবসর, সিরিয়াল কিংবা বিজ্ঞাপন দেখার মধ্যেই কাজের হুকুম আসে। সময় পেলে কালেভদ্রে বারান্দার জানালায় এসে দাঁড়ায়। ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে ছোট্ট পার্কের মতো জায়গায় ওর বয়সী ছেলেমেয়েরা খেলে, হাসে, সেই আনন্দে ওর কোন অধিকার নেই। ও ফিরে যায় রান্নাঘরে।
একদিন বাসায় কেউ থাকে না, চাচী অফিসে, ছেলেমেয়েরা স্কুলে। চাচা অফিস থেকে ফিরে মেয়েটাকে খাবার দিতে বলেন। খাওয়া শেষে নিজের ঘরে ডাকেন। মেয়েটার মুখ হাতে চেপে ধরেন, যাতে মেয়েটা চিৎকার করতে না পারে। বাবার মতো মানুষটি মুহূর্তে এক ঘৃণ্য জানোয়ারের রূপ নেয়। অনাহারে অনাদরে টিকে থাকা মেয়েটির পুরো অস্তিত্ব যেন খানখান হয়ে যায়। মেয়েটাকে সেই জন্তুটি সাবধান করে দেয়, চুপ না থাকলে রাস্তায় নামিয়ে দেয়া হবে। এই ভুবনে যার কেউ নেই, তার পক্ষে ওটুকু কথার কোন উত্তর খুঁজে পাওয়া কঠিন।
হুট করে যেন মেয়েটার বয়স বেড়ে যায়। আগে যাও একটু আধটু কথা বলত, সেও বন্ধ হয়ে যায়। বাসায় কেউ না থাকলে তার পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে আসে, কালবৈশাখীর ঝড়ে উড়তে থাকা খড়কুটোর মতো সে এলোমেলো ভেসে বেড়ায় সময়ের স্রোতে। যার কোন অবলম্বন নেই, নেই কোথাও থামার সুযোগ।
একদিন সুযোগ আসে। দুপুরের সময়টাতে কেউ থাকে না বাসায়। জন্তুটা আসে বিকেলের দিকে। শান্ত ভঙ্গিতে মেয়েটা রান্নাঘরে ঢোকে, দরজাটা বন্ধ করে দেয় ভেতর থেকে। থালাবাসন সব ধোয়া আছে, বেসিন মেঝে সব পরিষ্কার, কোন কাজ বাকি নেই।
মেয়েটা চুলার নব ঘুরিয়ে দেয়।
একটা দেশলাই হাতে সে রান্নাঘরের মেঝেতে বসে পড়ে। জগতের বোঝা হয়ে বেড়ে ওঠা একটি প্রাণ দেশলাইটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
যন্ত্রণা শেষ হতে খুব বেশি দেরি নেই।
'স্বামী মরে গেছে, অথচ অলক্ষুণে বউটার কোন শোক-তাপ নেই কেন?' নিচু গলায় কেউ একজন বলে ওঠে। ঠোঁটকাটা কেউ উত্তর দেয়, 'বউটাই যত নষ্টের গোড়া। নইলে ছেলে না হয়ে মেয়ে হবে কেন? বিয়ের দু'বছর বাদে স্বামীর মাথা খেয়েছে রাক্ষুসীটা। ওটাকে না তাড়ালে বাড়িতে আরও কত কী হবে, কে জানে!'
সবাই এই ব্যাপারে সায় দেয়। বউটা যে অলক্ষুণে এতে কারও কোন সন্দেহ থাকে না। তারা এই বিষয়ে আরও উচ্চতর আলোচনা করতে থাকে। সেই আলোচনায় এই বউটার সঙ্গে আধমরা স্বামীর বিয়ে দেয়া হয়েছিল- সেটা কেউ বলে না। কারো গলায় একবারও উচ্চারিত হয় না, মরণাপন্ন স্বামীর কী সেবাটাই না বউটা করেছিল, পেটে বাচ্চা নিয়েও বাড়ির কাজকর্ম সব নির্দ্বিধায় করে গেছে, একটা দিনও নিজের কষ্টের কথা মুখ ফুটে বলেনি। সেই নীরব মানুষটির বিরুদ্ধে সবাই ভীষণ সরব। বউটি পাথরের মতো স্থির হয়ে বসে থাকে, দূরে তার মেয়েটি কেঁদে যায়, অবিরাম।
বিজ্ঞজনেরা সিদ্ধান্ত নেয়, এই রাক্ষসীকে এই বাড়িতে আর রাখা ঠিক হবে না। তার বাপের বাড়িতে খবর দেয়া হয়। বউয়ের ভাইয়েরা আসে, তারা বোনকে নিতে প্রথমে রাজি হয় না। সংসারে একটা মুখ বেড়ে যাওয়া অনেক বড় ব্যাপার। নানা বাদানুবাদ শেষে বোনকে নিয়ে যায় বটে, কিন্তু ছোট্ট মেয়েটি মায়ের সঙ্গে যেতে পারে না। সে থেকে যায় পরলোকগত বাবার বাড়িতেই। মুরুব্বীদের সিদ্ধান্তে মা ও মেয়ে আলাদা হয়ে যায়, এই দুটো প্রাণীর সিদ্ধান্ত কেউ জানতেও চায় না। বলা বাহুল্য, দেশটির সর্বময় ক্ষমতা বহু বছর ধরে নারীর হাতে, অথচ মা-মেয়ের জীবনের মূল্য আজও কত সামান্য!
ভাইদের সংসারে বোঝা হয়ে থাকা বোনটির সদ্গতি হয় বটে, জুয়ারী মাতালের কাঁধে তাকে চাপিয়ে ভাইয়েরা দায়মুক্ত হয়। সেই মাতালও জাতে মাতাল কিন্তু তালে ঠিক। বিয়ের আগে তার সাফ কথা, আগের ঘরের মেয়েকে দেখতে যাওয়া চলবে না। তার সংসারে আপদ রাখার জায়গা নেই।
ওদিকে ছোট্ট মেয়েটা বাবার বাড়িতে বড় হতে থাকে। বাবা মারা গেছে, মা কোথায় আছে সেটা তার জানবার কথা নয়। ক্ষুধা পেলে সে কাঁদে, কেউ ফিরেও তাকায় না। একটা সময় মেয়েটা কাঁদতে ভুলে যায়। বাড়ির উচ্ছিষ্ট খেয়ে বড় হতে থাকে, একটু বড় হওয়ামাত্র বাড়ির কাজে হাত লাগাতে হয় তাকে। দূর শহরে চাচা থাকেন, চাচার ছেলেমেয়েরা ছুটিতে বাড়ি আসে, ওদের বইপত্র দেখে ও হা করে তাকিয়ে থাকে। ওদের কাপড়গুলো ধুতে ধুতে ও বইয়ের রঙিন ছবিগুলোর কথা ভাবে। কেউ একজন তাড়া দেয়, জলদি কাপড় ধুতে, হাতে এখনও অনেক কাজ।
ছোট্ট দুটো নরম হাত একের পর এক কাজ করে চলে। ক্ষমাহীন পৃথিবী তাকে থামতে দেয় না।
একসময় দুরন্ত কৈশোর তার মনের আঙিনায় পা রাখে। ফুললিত সৌরভ ছড়িয়ে রংধনুর সাতরং ছড়িয়ে তাকে ডাকতে থাকে, সে সাড়া দেয় না, দিতে পারে না। বাড়ির কাজের মানুষ সে, তার জীবনের গান শোনবার সময় কোথায়?
শহর থেকে খবর আসে। চাচার বাসায় কাজের লোক দরকার, পয়সা দিয়েও বিশ্বস্ত লোক পাওয়া কঠিন, সেখানে বিনে পয়সায় এমন মানুষ হাতছাড়া করা যায়?
মেয়েটা শহরে আসে। কত আলো! কত শব্দ!
কাজের ধরণ বদলায়। চাপ বাড়ে। সব কাজ সেরে বড়োজোর টিভি দেখবার একটু অবসর, সিরিয়াল কিংবা বিজ্ঞাপন দেখার মধ্যেই কাজের হুকুম আসে। সময় পেলে কালেভদ্রে বারান্দার জানালায় এসে দাঁড়ায়। ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে ছোট্ট পার্কের মতো জায়গায় ওর বয়সী ছেলেমেয়েরা খেলে, হাসে, সেই আনন্দে ওর কোন অধিকার নেই। ও ফিরে যায় রান্নাঘরে।
একদিন বাসায় কেউ থাকে না, চাচী অফিসে, ছেলেমেয়েরা স্কুলে। চাচা অফিস থেকে ফিরে মেয়েটাকে খাবার দিতে বলেন। খাওয়া শেষে নিজের ঘরে ডাকেন। মেয়েটার মুখ হাতে চেপে ধরেন, যাতে মেয়েটা চিৎকার করতে না পারে। বাবার মতো মানুষটি মুহূর্তে এক ঘৃণ্য জানোয়ারের রূপ নেয়। অনাহারে অনাদরে টিকে থাকা মেয়েটির পুরো অস্তিত্ব যেন খানখান হয়ে যায়। মেয়েটাকে সেই জন্তুটি সাবধান করে দেয়, চুপ না থাকলে রাস্তায় নামিয়ে দেয়া হবে। এই ভুবনে যার কেউ নেই, তার পক্ষে ওটুকু কথার কোন উত্তর খুঁজে পাওয়া কঠিন।
হুট করে যেন মেয়েটার বয়স বেড়ে যায়। আগে যাও একটু আধটু কথা বলত, সেও বন্ধ হয়ে যায়। বাসায় কেউ না থাকলে তার পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে আসে, কালবৈশাখীর ঝড়ে উড়তে থাকা খড়কুটোর মতো সে এলোমেলো ভেসে বেড়ায় সময়ের স্রোতে। যার কোন অবলম্বন নেই, নেই কোথাও থামার সুযোগ।
একদিন সুযোগ আসে। দুপুরের সময়টাতে কেউ থাকে না বাসায়। জন্তুটা আসে বিকেলের দিকে। শান্ত ভঙ্গিতে মেয়েটা রান্নাঘরে ঢোকে, দরজাটা বন্ধ করে দেয় ভেতর থেকে। থালাবাসন সব ধোয়া আছে, বেসিন মেঝে সব পরিষ্কার, কোন কাজ বাকি নেই।
মেয়েটা চুলার নব ঘুরিয়ে দেয়।
একটা দেশলাই হাতে সে রান্নাঘরের মেঝেতে বসে পড়ে। জগতের বোঝা হয়ে বেড়ে ওঠা একটি প্রাণ দেশলাইটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
যন্ত্রণা শেষ হতে খুব বেশি দেরি নেই।