গত তিন দিন ধরে আমাদের বাড়ি মহা উতসাহ নিয়ে পায়রা গৃহ তৈরি হচ্ছে। বাশ-কাঠ উপরে টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি ১৬ কক্ষের দ্বি-তল বিশিষ্ট এই গৃহ নির্মানের প্রধান রাজমিস্ত্রী আমার বাবা। আর তার একমাত্র এসিস্ট্যান্ট আমি। গৃহ নির্মানের কাজ শেষ হয়েছে আজ দুপুরে। বিকাল হতেই বাজার থেকে একজোড়া পায়রা কিনে বাবা বাড়িতে হাজির। একটা সাদা, একটা কালা। তবে এরা একই জোড়ার না। অনেকগুলো কবুতরের মধ্যে বেছে বেছে, এদেরকে কিনে আনা হয়েছে। অর্থাৎ নতুন ভাবে তাদের মধ্যে জানাশোনা, প্রেম-প্রণয়ন ইত্যাদি হবে। তারপর সংসার।
ব্যাপারটা নিয়ে আমি খুবই উত্তেজিত। ভালোবাসার প্রতীক কবুতর। আর সেই কবুতর জুটির মধ্যে কিভাবে প্রেম-প্রণয়ন হয়, তা কঠিভাবে পর্যবেক্ষণ করতে না পারলে, এই জীবন বৃথা। কাউকে কোন প্রশ্ন না করে, চুপচাপ ২৪ ঘন্টা পর্যবেক্ষণ করতে থাকলাম। আমার ঘরের জানালার একটু দুরেই পায়রা গৃহ স্থাপন করে হয়েছে। তাই রাতে জেগে থাকা পর্যন্ত কান খাড়া করে থাকতাম। কখনো কখনো একটু পর পর বাক-বাকুম শব্দের মধ্যে কি ধরনের কথাবার্তা? মানে তাদের মধ্যে ভাব বিনিময় হচ্ছে, সেটা আপন মনে অনুবাদ করে বুঝার চেষ্টা করলাম।
ফলাফল যা হল- দুইদিন যেতেই আমরা বুঝতে পারি, বাবাকে বিক্রেতা কবুতর দুটিকে "লাইলি - মজনু" কিউট জুটি হিসেবে ভূগোল পড়িয়ে বিক্রি করেছেন। অর্থাৎ দুজনই নায়ক(পুরুষ), আলমগীর এবং রাজ্জাক।
এই যখন ঘটনা, তখন এই দুই মহানায়কের জন্য হার্টকুইন নায়িকা শাবানা-সুচরিতাকে কিভাবে জোগাড় করবে? এই চিন্তায় আমার আব্বার মাথায় হাত। অর্থনীতির এই বাজারে শখ মেটাতে একসাথে দুটি হার্টকুইন নায়িকা যুক্ত করা আপাতত কঠিন। কিন্তু সিচ্যুয়েশন ডিমান্ডস!
শেষমেষ নায়িকা শাবানাকে কিনে আনা হল, আপাতত যে কোন একজন নায়কের সাথে জুটি বাধানোর জন্য।
হার্ট কুইন নায়িকা শাবানার উপস্থিতিতে গল্পে নতুন মোড়।
"এক ফুল দো মালি।"
পায়রা গৃহে শুরু হতে যাচ্ছে, তিনজনের ত্রিভুজ প্রেমের গল্প। ব্যাপারটা আমার কোমল হৃদয়ে ঝড় তুলল। কি হবে? কে পাবে? কে হারাবে? এই নিয়ে খুবই চিন্তায় পড়ে গেলাম।
ব্লাক স্টোন আলমগীর পুরাই নিস্পাপ looking. সে বেশ শান্তশিষ্ট Cool boy। আর ড্যাসিং হিরো রাজ্জাক over smart. যাকে বলে পাংকু বয়। অন্যদিকে হার্ট-কুইন শাবানা বেশ জেদী এবং রূপবতী হবার কারণে কিছুটা অহংকারী।
পায়রাগৃহে নায়িকা শাবানাকে দেখে তো দুই নায়কই ভেরি excited. আর এমন দৃশ্য দেখে, আমি over excited.
একদিকে রাজ্জাক,
অন্যদিকে আলমগীর।
কাহিনী জমে হবে ক্ষীর।
কি করবে শাবানা? কাকে দেবে তার ভালোবাসার মালা?
সন্ধ্যা হতেই মা-বোনেরা সব কাজ ফেলে যেমন স্টার জলসা-জি বাংলার সিরিয়াল গুলোতে চোখ ঠিকরে রাখে। আমিও ঠিক তেমনই মনোযোগ সহকারে এবং চাপা উত্তেজনা নিয়ে উত্সুক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। তিনজনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম।
নায়িকার আগমনের পর প্রথম ঘন্টা খানেক তিনজনই নিজ নিজ ঘরে বসে চুপচাপ ছিল।
এরপর জড়তা ভেঙে হঠাৎ ড্যাসিং হিরো রাজ্জাক "বাক বাকুম বাকুম" করে, feel alone শাবানার রুমের সামনে এসে কিছুক্ষণ হাংকু পাংকু করে। কিন্তু নায়িকার খুব পাত্তা না পাওয়ায়, কিঞ্চিৎ হতাশ হয়ে চামে দোতালায় এক রুমে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।
এ দৃশ্য দেখে ব্লাক স্টোন আলমগীরের মনে কুলু কুলু আনন্দের ঢেউ ওঠে। কিন্তু "ড্যাসিং হিরো রাজ্জাক যেখানে সুপার ফ্লপ। সেখানে তো আলমগীরের কোন চান্সই নাই" এমন ভাবনায় সে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা যে, "সে কি করবে?"
অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয় আপাতত নায়িকার মনের অবস্থা কেমন? সেটাও বুঝা জরুরী। তাছাড়া হার্ট-কুইন শাবানাকে একটু ভালো করে দেখার জন্য, সেও ব্যাকুল। সে নিজের রুম থেকে নেমে এসে অন্যমনস্ক ভাব নিয়ে, নিচ তলায় শাবানার রমের সামনে গিয়ে এক পা দু পা করে একটু পায়চারী করে সময় কাটানো ভান করে। আর মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকিয়ে শাবানার মনের অবস্থা বুঝার চেষ্টা করে। শাবানাও thinking about something ভাব নিয়ে আনমনা হয়ে বসে থাকে।
এমন সময় দৃশ্যপটে হাজির হয় আমার বাবা। সে শাবানা এবং রাজ্জাককে একটি কক্ষে ঢুকিয়ে সেটার দরজা লক করে দেয়। সম্ভবতঃ বাবার ধারণা, রাজ্জাক-শাবান দুজনেরই রং সাদা এবং সমানে স্মার্ট। তাই তাদেরই জুটি হওয়া উচিৎ।
আমি প্রতিবাদ করে বললাম, "কেন এটা করলে?(মানে- কে কার সাথে জুটি বাধবে, সেটা ওরা ঠিক করবে।)"
আমার কথা শুনে বাবা কিছুটা অসস্তিতে পড়ল। কি জবাব দেবে, বুঝতে পারছিল না। তাই দায়সারা হয়ে শুধু বলল, "এমনই দিলাম। দেখ্, কি হয়।"
মেজাজটা চরম খারাপ হয়ে গেল। আলমগীর বেচারাকে দেখে মনে হল, সে বিরহে মুষড়ে পড়েছে। ওর কষ্টটা যেন আমার বুকে এসে বিধল। ইচ্ছে করছিল এক্ষুনি রাজ্জাক-শাবানার ডেটিং রুমের বন্ধ লকটা খুলে দিই। কিন্তু বাবার জন্য পারলাম না। কারণ, তার ঐ শেষ কথাটা কানে ভীষণ বাজছিল "দেখ্ , কি হয়"।
আমিও অপেক্ষায় রইলাম, দেখি, কি হয়!
উঠানে দাড়িয়ে থেকে বেচারা আলমগীরের মলিন মুখখানি দেখে, মনে কষ্ট না বাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে আসলাম। চিন্তা গুলোকে ডাইভাট করার চেষ্টা করতে থাকলাম।
আধাঘন্টা মত সময় পর হঠাৎ বাবার কন্ঠে শুনলাম, "ও মা রে! দুইটাকে এক কক্ষে আটকে রাখলাম। এখন দেখি লক খোলা।"
হুড়মুড়িয়ে ঘর থেক বাইরে গিয়ে দেখি ঘটনার নতুন মোড় নিয়েছে। গ্লামার গার্ল শাবানা ড্যাসিং হিরো রাজ্জাককে ডেটিং রুমের ভেতরে এমন ছেচা দিয়েছে যে, সেই ছেচা খেয়ে রাজ্জাক পড়ি কি মরি ডেটিং রুমের লক সরিয়ে এখন দোতালায় নিজের কক্ষে গিয়ে উদ্ভ্রান্তের মত বসে আছে।
এদৃশ্য দেখে মনের মধ্যে কেন জানি খুব আনন্দ লাগলো। কিছুক্ষণ পর মনে হল, "আচ্ছা! এমন একটা ঘটনা যে ঘটে গেল। তা দেখে Cool Boy আলমগীর কি খুশী হয়েছে?"
অনেক চেষ্টা করলাম সেটা বুঝার জন্য। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। দেখলাম তিনজনই আলাদা আলাদা কক্ষে চুপচাপ হয়ে আছে।
বিকেলে বাসা থেকে গুছিয়ে বাইরে বের হওয়ার আগেও দেখলাম, অবস্থা অপরিবর্তনীয়। কেমন যেন নিস্তব্ধ ভাব। রাস্তায় হাটতে শুরু করলাম আর ভাবতে লাগলাম, আচ্ছা! শাবানা কি আলমগীরের মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরেছে? যদি শাবানা সেটা উপলব্ধি করতে পারে, তবে সে অবশ্যই সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষকে চিনে নিতে পারবে এবং আলমগীরকে তার মনে জায়গা দেবে।
আবার মনে হল, আচ্ছা! রাজ্জাক-শাবানাকে কিছু সময়ে জন্য ডেটিং রুমে আবদ্ধ করে রাখায় আলমগীর যে ধাক্কাটা খেল। সেটা কি সে তার মন থেকে মুছে ফেলে, শাবানাকে আগের মত ভালোবাসতে পারবে???
যদিও এ ঘটনার জন্য শাবানার কোন দোষ ছিল না। আবার আলমগীর কিংবা রাজ্জাকেরও কোন দোষ ছিল না। তা হলে দোষটা কার? ভাগ্য বা নিয়তির? নাকি ভাগ্য/নিয়তির নিয়ন্ত্রণকারী, তার??
চলবে……