‘কলেজে তৃতীয় বৎসরে পা দিয়াছি, আমার বয়স উনিশ, এমন সময় আমার বিবাহ হইল। বয়সটা সমাজের মতে বা সমাজসংস্কারকের মতে উপযুক্ত কি না তাহা লইয়া তাহারা দুই পক্ষ লড়াই করিয়া রক্তারক্তি করিয়া মরুক, কিন্তু আমি বলিতেছি, সে বয়সটা পরীক্ষা পাস করিবার পক্ষে যত ভালো হউক বিবাহের সম্বন্ধ আসিবার পক্ষে কিছুমাত্র কম ভালো নয়।’
ক্লাসে আমাদের সবার বয়স ১৭ কি ১৮। বিয়ের সময় অপুর বয়স ছিল ১৯। হৈমন্তীর ১৭। শাহজাহান স্যার এই পর্যন্ত পড়ে আমাদের দিকে তাকান। ফরসা, চওড়া মুখ শাহজাহান স্যারের। গোঁফে তা দিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকান তিনি। ঠোঁটে তাঁর দুষ্টু হাসি খেলা করে।
আমরা উসখুস করতে থাকি। হাসব না গম্ভীর হয়ে থাকব সহসা বুঝতে পারি না। এদিক-ওদিক তাকাই। আমার চোখ পড়ে যায় ইন্দ্রাণীর চোখে। বুকটা ধক করে ওঠার আগেই চোখ চলে যায় রিনির কাছে। রিনি ডাগর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার এবার পেট মোচড় দেয়।
শাহজাহান স্যারের কথায় চমকে উঠি- ‘এই তুই দাঁড়া তো।’
আমি পেছন ফিরে তাকাই। স্যার বলেন, ‘পেছনে না, তুই।’
‘আমি!’
‘হ্যাঁ, তুই।’
আমি কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াই।
ক্লাসে স্যারদের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে আমার কোনো সংকোচ ছিল না। কিন্তু সেটা স্কুলে। কলেজ তো মহাবিদ্যালয় নয় যেন মহাসাগর। এই মহাসাগরে আসার আগে থেকেই আমি কূলকিনারা হারাতে থাকি। এসএসসি পাস করার পর প্রথম চিন্তা ছিল কী পরে কলেজে যাব। স্কুল পর্যন্ত লুঙ্গি আর চপ্পলে চালিয়েছি।
কিন্তু কলেজে? উপজেলা সদরের কলেজে নিশ্চয়ই কেউ লুঙ্গি পরে যায় না। আমাকে সত্যি সত্যি ভাবনায় পেয়ে বসল। আমাদের স্কুলে সবাই যেত লুঙ্গি পরে। এমনকি স্যারেরাও। হেড স্যার তো বাটার স্যান্ডেল আনতেন বগলে করে। স্কুলের টিউবওয়েলে পা ধুয়ে তারপর পরতেন। কাঁচা রাস্তা ছিল। তিন কিলোমিটার হেঁটে এলে যদি স্যান্ডেল ছিঁড়ে যায়! আরেক জোড়া কেনার সামর্থ্য কি হেড স্যারের আছে? এই জোড়াটা কেনার পেছনে কত গল্প আছে কে জানে?
আমরা হাসাহাসি করলেও বগলচাপা ট্র্যাজেডিটা সে সময় অত বুঝতাম না। স্কুলের পোশাক-আশাক নিয়ে আমি প্রথম সমস্যায় পড়ি ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার সময়। জিলা স্কুলে পরীক্ষা কেন্দ্র। প্যান্ট পরে যেতে হবে। কিন্তু পাব কোথায়? চিন্তায় আমার ঘুম হয় না। পরীক্ষা শুরুর এক সপ্তাহ আগে আব্বা নিয়ে গেলেন বাজারে। আব্বার কাঁধের ওপর একটা বস্তা। শুকনো সুপারির। আব্বা হাঁটছেন আর ও-হো ও-হো করে কাতরাচ্ছেন। চার কিলোমিটার রাস্তা। আমি বললাম, ‘আব্বা, আমাকে দেন। অত পথ আপনি নিতে পারবেন না।’ আব্বা বললেন, ‘আমার থেকে তোর শক্তি বেশি? মাত্র ১৩ বছর বয়স। চুপ করে হাঁট।’
বাজারে গিয়ে দর্জিকে বললেন, ‘ভাই, ছেলেটার প্যান্টের মাপ নেন। সুন্দর করে বানাবেন। মাইজদীতে বৃত্তি পরীক্ষা দিতে যাবে।’
দর্জি জিজ্ঞেস করলেন, ‘শুধু প্যান্ট? শার্ট লাগবে না?’
আব্বা আমার দিকে তাকালেন। আমি এদিক-ওদিক মাথা নাড়িয়ে বললাম, ‘লাগবে না। এটা আছে তো। শুধু এখান দিয়ে একটু রিপু করে দিলে হবে।’
আব্বা বোধ হয় একটা ঢোক গিললেন। ঢোক গিলে মাথা নিচু করে রইলেন। কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, ‘তুই বসে থাক। আমি সুপারিগুলো বিক্রি করে আসি।
সেই প্যান্টটা এরপর দুই বছর মাঝে মাঝে পরেছি। সেটা পরেই এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। টাইট হয়ে জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে গেছে ওটা। ও হ্যাঁ, প্যান্ট পরলেও চামড়ার স্যান্ডেল কিন্তু ছিল না। পুরোনো রূপসা চপ্পলই পরেছি প্যান্টের সঙ্গে।
আমি যেন অনন্তকাল দাঁড়িয়ে থাকি। শাহজাহান স্যারসহ পুরো ক্লাস মজা দেখতে থাকে। আমার গায়ে রং জ্বলে যাওয়া শার্ট, পরনে বড় ভাইয়ের প্যান্ট। লুজ প্যান্ট। বেল্ট লাগানোতে কোমরের দিকটা কুঁচকে গেছে। আমার পায়ে আঙুল বসে যাওয়া রূপসা স্যান্ডেল। আমাকে নিশ্চয়ই সঙের মতো দেখাচ্ছে। ঘামাতে ঘামাতে আমি শার্টের বোতামগুলো ঠিকমতো লাগানো আছে কি না দেখতে থাকলাম।
শাহজাহান স্যার বললেন, ‘বিএ পাস আর বিয়ে পাস একসঙ্গে হবে। আর দুবছর পর। মজা না?’
পুরো ক্লাস এবার একসঙ্গে হেসে উঠল। আমি টের পেলাম, আমার পিঠ বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। আড়চোখে দেখলাম, ইন্দ্রাণী শাহাদত আঙুলটা কামড়ে ধরেছে, রিনি মাথা নিচু করে মুখ টিপে হাসছে। ইন্দ্রাণীর চোখে আমার চোখ পড়ে গেল। আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। তখন মেয়েরা আলাদা বসত।
শাহজাহান স্যার বললেন, ‘তুই শার্টের হাতা গুটিয়ে রেখেছিস কেন? এটা কলেজ। এখানে ভদ্রভাবে আসতে হয়।’
আমি হাতা দুটো ছেড়ে দিলাম। ওগুলো কবজি পর্যন্ত আসে না। ছোট। হঠাৎ আমার মনে হলো আমার প্যান্টটা পড়ে যাচ্ছে। আমি দুহাত দিয়ে প্যান্টটা কোমরের কাছে তুলে আনলাম। শাহজাহান স্যার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কী যেন ভাবলেন। তারপর আমাকে বললেন, ‘হাতা টানাটানি করিস না। বসে যা।’
শাহজাহান স্যার হৈমন্তীর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন, ‘ছেলেটা লাজুক। কিন্তু ভালো। ভালো ছেলেরা লাজুক হয়।’
স্যার পড়াতে শুরু করেন; ‘আমার কাজ আমি করিয়াছি। এফএ পাস করিয়া বৃত্তি পাইয়াছি।... আমার কাজ কী বলো তো?’
আমরা সমস্বরে বললাম, ‘পড়াশোনা করা।’
‘ঠিক ধরেছ। পড়াশোনা করতে হবে। বিকল্প নেই। এখন রবীন্দ্রযুগ নয় যে ১৭ আর ১৯ বছরে বিয়ে হয়ে যাবে। তোমাদের বিয়ে হতে এখনো ঢের দেরি। সুতরাং বাবারা, সব ভাবনা বাদ দিয়ে পড়াশোনা করো। আমি এখন যাই। কাল আবার দেখা হবে।’
কলেজে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে আমার একটা নতুন শার্ট পাওয়ার কথা ছিল। রহমান চাচা আমাদের প্রতিবেশী। বড়লোক তিনি। চট্টগ্রামে কী চাকরি করেন আমি ঠিক জানি না। তবে তিনি বাড়িতে এলে আব্বাকে খুশি হয়ে উঠতে দেখি। আব্বা বারবার বলতে থাকেন- রহমান এসেছে, রহমান এসেছে। আব্বার এই খুশির কারণ আমি জানি। রহমান চাচা এলে আমাদের ঘরে কিছু জিনিসপত্র আসে। দুটো কমলা, এক প্যাকেট গ্লুকোজ বিস্কুট, দু-এক চাক মিছরি ইত্যাদি। রহমান চাচা আব্বাকে মাঝে মাঝে টাকা-পয়সা দেন চা-পানি খাওয়ার জন্য।
গতবার রহমান চাচা ফেরার সময় আব্বা আমাকে বললেন, ‘তোর চাচাকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আয়।’
এই এগিয়ে দেওয়ার মানে আমি বুঝি। আমাদের বাড়ি থেকে বাসস্ট্যান্ড তিন কিলোমিটার। কাঁচা রাস্তা। এই পুরোটা পথ রহমান চাচার ব্যাগ বয়ে নিয়ে যেতে হবে আমাকে। বিনিময়ে তিনি আমাকে দশটা টাকা দেবেন। সেই টাকাটা আমি আব্বার হাতে দেবো। আব্বা দুকেজি আটা কিনতে পারবেন।
ব্যাগ মাথায় নিয়ে আমি রহমান চাচার পেছন পেছন হাঁটছি। পথে তিনি পরিচিত এক লোকের সাথে কথা বলার জন্য দাঁড়ালেন। আমাকে বললেন, ‘তুই হাঁট, আমি আসছি।’
আমি কিছুটা পথ এগিয়ে গেলাম। পেছন থেকে একটা রিকশা এসে থেমে গেল। রিকশাওয়ালা বলল, ‘যাবি নাকি রে?’ দ্বিধায় পড়ে গেলাম আমি। চাচার অনুমতি ছাড়া রিকশা কীভাবে নিই? রিকশা নিলে বলবে- সামান্য এটুকু পথ হাঁটতে পারিস না? শুধু শুধু আমার টাকা নষ্ট করলি।
আমি রিকশা নিলাম না। রহমান চাচা কিছুক্ষণ পর এসে গেলেন। আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘রিকশাটা নিলি না কেন?’
আমি বললাম, ‘আমি পারব চাচা। এই তো আর একটুখানি পথ।’
‘তুই না হয় পারবি। কিন্তু আমি? আমার কষ্ট হচ্ছে না?’
গজরাতে থাকলেন রহমান চাচা। এরপর বললেন, ‘রিকশা নিলেও আমি তোকে দশ টাকা দিতাম। ছোটলোক কোথাকার!’
আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমার তো এত কিছু মনে ছিল না। আমার শুধু মনে হয়েছে রিকশা নিলে চাচা রাগ করবেন।
বাকি পথ রহমান চাচা আমার সাথে কোনো কথা বললেন না। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে আমার হাতে দশ টাকা দিয়ে বললেন, ‘বাড়ি যা।’
আমি দাঁড়িয়ে থেকে উসখুস করতে লাগলাম। চাচা বললেন, ‘কী হলো, চলে যা।’
আমি কি আব্বার কথাটা চাচাকে বলব? কীভাবে বলব? চাচা যে আমাকে অপমান করলেন!
বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে আব্বা আমাকে চুপি চুপি বলেছিলেন, ‘তোর রহমান চাচাকে বলিস তোর জন্য একটা শার্ট আনতে।’ আমি বললাম, ‘আমি পারব না। আমার ভয় করে।’
‘ভয়ের কিছু নেই। রহমান ভালো মানুষ। দেখিস না, তোদের জন্য কত কিছু আনে? বিস্কুট, কমলা; কত কিছু।’
আমি মাথা নাড়তে থাকলাম। আব্বা বললেন, ‘শার্ট না পেলে কলেজে যাবি কী পরে? এত শরম পেলে তো ঠকবি।’
রহমান চাচা বাসের পাদানিতে ডান পা রাখলেন। আমি ডাকলাম, ‘চাচা’
‘পেছন থেকে ডাকিস কেন অলক্ষ্মীর মতো? দেখছিস না আমি যাচ্ছি, শুভ কাজে যাচ্ছি? বল, কী বলবি বল।’
‘একটা শার্ট যদি আনতেন।’
‘শার্ট? কার জন্য?’
‘আমার জন্য। কলেজে যাব তো। শার্ট নেই।’
রহমান চাচা কী রকম একটা মুখভঙ্গি করলেন। এই ভঙ্গিমার মানে আমি বুঝতে পারিনি। আমাকে কিছু না বলে উঠে গেলেন বাসে।
১৫ দিন পর রহমান চাচা এলেন। রাস্তার মাথায় নেমে খবর পাঠালেন বাড়িতে। তাঁর সঙ্গে দুটো ব্যাগ। আনবার জন্য আমি আর তাঁর ছেলে আরিফ গেলাম। আরিফের থেকে আমি দুবছরের বড়। তাই হয়তো আমাকে বড় ব্যাগটা দেওয়া হয়েছে। এত ভারী ব্যাগ, মাথায় নিয়ে আমি তাল সামলাতে পারছিলাম না। তবু উৎসাহ নিয়ে আমি বাড়ির দিকে চললাম। এই ব্যাগের ভেতরেই হয়তো আমার জন্য কেনা নতুন শার্টটা আছে। আমি কল্পনা করতে লাগলাম, কী রং হতে পারে শার্টটার? নীল হলে ভালো হয়। আর ছাপার হলে তো আরও ভালো।
কিছুক্ষণ পর যথারীতি বিস্কুট, কমলা, মিছরি এলো আমাদের ঘরে। সবাই আগ্রহ নিয়ে খেল। কিন্তু আজ আমার ভালো লাগছে না। আমার উৎকণ্ঠা শার্টের জন্য।
সন্ধ্যা গেল, রাতও পার হলো। শার্ট নেওয়ার জন্য আমার ডাক পড়ল না। সারা রাত আমি ঘুমে-তন্দ্রায় শার্ট দেখেছি। সকালটাও যখন পেরিয়ে গেল, আমার উৎকণ্ঠা মনখারাপে পরিণত হলো। আব্বার জন্য। রহমান চাচা আমার জন্য শার্ট আনবেন, আব্বা বড্ড আশা করেছিলেন।
সাড়ে ৯টার দিকে রহমান চাচা আমাকে ডাকলেন। আব্বা বললেন, দেখেছিস, ঠিকই এনেছে। আমি লাফাতে লাফাতে গেলাম। রহমান চাচা আরিফকে বললেন, শার্টটা নিয়ে আয়। আরিফ শার্ট এনে দিল। রহমান চাচা বললেন, ‘পরে দেখ।’
আমি পরলাম। শার্টটা ছোট। নিচের দিকেও, হাতাও। রংজ্বলা। এটা আরিফের পুরোনো শার্ট। আব্বা আমাকে দেখে ঘাবড়ে গেলেন মনে হলো। আব্বার চোখ ছলছলে হলো। আরিফ আমার সামনে দিয়ে স্কুলে গেল নতুন শার্ট পরে। নীল রঙের।
ক্লাস থেকে বেরিয়ে শাহজাহান স্যার আমাকে ডাকলেন। ডেকে হাঁটতে শুরু করলেন। আমিও স্যারের পেছন পেছন হাঁটছি। অনেকটুকু হেঁটে গিয়ে কিছুটা নির্জনে থামলেন তিনি। আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘শার্ট কি তোর এই একটাই?’
আমার লজ্জা লেগে উঠল। মাথা নিচু করে ফেললাম। স্যার বললেন, ‘মন খারাপ করিস না। তোর তো তবু একটা আছে। আমার একটাও ছিল না। একটাও শার্ট না থাকলে আমি কী পরতাম, সে গল্প তোকে আরেকদিন বলব। মাথা তোল।’
আমি বললাম, ‘জি স্যার।’
‘হাতা নিয়ে টানাটানি করিস না। টানলে তো আর বড় হবে না। তুই বরঞ্চ হাতা গুটিয়ে রাখিস।’
আমি আবারও বললাম, ‘জি স্যার।’
ক্লাসে আমাদের সবার বয়স ১৭ কি ১৮। বিয়ের সময় অপুর বয়স ছিল ১৯। হৈমন্তীর ১৭। শাহজাহান স্যার এই পর্যন্ত পড়ে আমাদের দিকে তাকান। ফরসা, চওড়া মুখ শাহজাহান স্যারের। গোঁফে তা দিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকান তিনি। ঠোঁটে তাঁর দুষ্টু হাসি খেলা করে।
আমরা উসখুস করতে থাকি। হাসব না গম্ভীর হয়ে থাকব সহসা বুঝতে পারি না। এদিক-ওদিক তাকাই। আমার চোখ পড়ে যায় ইন্দ্রাণীর চোখে। বুকটা ধক করে ওঠার আগেই চোখ চলে যায় রিনির কাছে। রিনি ডাগর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার এবার পেট মোচড় দেয়।
শাহজাহান স্যারের কথায় চমকে উঠি- ‘এই তুই দাঁড়া তো।’
আমি পেছন ফিরে তাকাই। স্যার বলেন, ‘পেছনে না, তুই।’
‘আমি!’
‘হ্যাঁ, তুই।’
আমি কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াই।
ক্লাসে স্যারদের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে আমার কোনো সংকোচ ছিল না। কিন্তু সেটা স্কুলে। কলেজ তো মহাবিদ্যালয় নয় যেন মহাসাগর। এই মহাসাগরে আসার আগে থেকেই আমি কূলকিনারা হারাতে থাকি। এসএসসি পাস করার পর প্রথম চিন্তা ছিল কী পরে কলেজে যাব। স্কুল পর্যন্ত লুঙ্গি আর চপ্পলে চালিয়েছি।
কিন্তু কলেজে? উপজেলা সদরের কলেজে নিশ্চয়ই কেউ লুঙ্গি পরে যায় না। আমাকে সত্যি সত্যি ভাবনায় পেয়ে বসল। আমাদের স্কুলে সবাই যেত লুঙ্গি পরে। এমনকি স্যারেরাও। হেড স্যার তো বাটার স্যান্ডেল আনতেন বগলে করে। স্কুলের টিউবওয়েলে পা ধুয়ে তারপর পরতেন। কাঁচা রাস্তা ছিল। তিন কিলোমিটার হেঁটে এলে যদি স্যান্ডেল ছিঁড়ে যায়! আরেক জোড়া কেনার সামর্থ্য কি হেড স্যারের আছে? এই জোড়াটা কেনার পেছনে কত গল্প আছে কে জানে?
আমরা হাসাহাসি করলেও বগলচাপা ট্র্যাজেডিটা সে সময় অত বুঝতাম না। স্কুলের পোশাক-আশাক নিয়ে আমি প্রথম সমস্যায় পড়ি ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার সময়। জিলা স্কুলে পরীক্ষা কেন্দ্র। প্যান্ট পরে যেতে হবে। কিন্তু পাব কোথায়? চিন্তায় আমার ঘুম হয় না। পরীক্ষা শুরুর এক সপ্তাহ আগে আব্বা নিয়ে গেলেন বাজারে। আব্বার কাঁধের ওপর একটা বস্তা। শুকনো সুপারির। আব্বা হাঁটছেন আর ও-হো ও-হো করে কাতরাচ্ছেন। চার কিলোমিটার রাস্তা। আমি বললাম, ‘আব্বা, আমাকে দেন। অত পথ আপনি নিতে পারবেন না।’ আব্বা বললেন, ‘আমার থেকে তোর শক্তি বেশি? মাত্র ১৩ বছর বয়স। চুপ করে হাঁট।’
বাজারে গিয়ে দর্জিকে বললেন, ‘ভাই, ছেলেটার প্যান্টের মাপ নেন। সুন্দর করে বানাবেন। মাইজদীতে বৃত্তি পরীক্ষা দিতে যাবে।’
দর্জি জিজ্ঞেস করলেন, ‘শুধু প্যান্ট? শার্ট লাগবে না?’
আব্বা আমার দিকে তাকালেন। আমি এদিক-ওদিক মাথা নাড়িয়ে বললাম, ‘লাগবে না। এটা আছে তো। শুধু এখান দিয়ে একটু রিপু করে দিলে হবে।’
আব্বা বোধ হয় একটা ঢোক গিললেন। ঢোক গিলে মাথা নিচু করে রইলেন। কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, ‘তুই বসে থাক। আমি সুপারিগুলো বিক্রি করে আসি।
সেই প্যান্টটা এরপর দুই বছর মাঝে মাঝে পরেছি। সেটা পরেই এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। টাইট হয়ে জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে গেছে ওটা। ও হ্যাঁ, প্যান্ট পরলেও চামড়ার স্যান্ডেল কিন্তু ছিল না। পুরোনো রূপসা চপ্পলই পরেছি প্যান্টের সঙ্গে।
আমি যেন অনন্তকাল দাঁড়িয়ে থাকি। শাহজাহান স্যারসহ পুরো ক্লাস মজা দেখতে থাকে। আমার গায়ে রং জ্বলে যাওয়া শার্ট, পরনে বড় ভাইয়ের প্যান্ট। লুজ প্যান্ট। বেল্ট লাগানোতে কোমরের দিকটা কুঁচকে গেছে। আমার পায়ে আঙুল বসে যাওয়া রূপসা স্যান্ডেল। আমাকে নিশ্চয়ই সঙের মতো দেখাচ্ছে। ঘামাতে ঘামাতে আমি শার্টের বোতামগুলো ঠিকমতো লাগানো আছে কি না দেখতে থাকলাম।
শাহজাহান স্যার বললেন, ‘বিএ পাস আর বিয়ে পাস একসঙ্গে হবে। আর দুবছর পর। মজা না?’
পুরো ক্লাস এবার একসঙ্গে হেসে উঠল। আমি টের পেলাম, আমার পিঠ বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। আড়চোখে দেখলাম, ইন্দ্রাণী শাহাদত আঙুলটা কামড়ে ধরেছে, রিনি মাথা নিচু করে মুখ টিপে হাসছে। ইন্দ্রাণীর চোখে আমার চোখ পড়ে গেল। আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। তখন মেয়েরা আলাদা বসত।
শাহজাহান স্যার বললেন, ‘তুই শার্টের হাতা গুটিয়ে রেখেছিস কেন? এটা কলেজ। এখানে ভদ্রভাবে আসতে হয়।’
আমি হাতা দুটো ছেড়ে দিলাম। ওগুলো কবজি পর্যন্ত আসে না। ছোট। হঠাৎ আমার মনে হলো আমার প্যান্টটা পড়ে যাচ্ছে। আমি দুহাত দিয়ে প্যান্টটা কোমরের কাছে তুলে আনলাম। শাহজাহান স্যার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কী যেন ভাবলেন। তারপর আমাকে বললেন, ‘হাতা টানাটানি করিস না। বসে যা।’
শাহজাহান স্যার হৈমন্তীর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন, ‘ছেলেটা লাজুক। কিন্তু ভালো। ভালো ছেলেরা লাজুক হয়।’
স্যার পড়াতে শুরু করেন; ‘আমার কাজ আমি করিয়াছি। এফএ পাস করিয়া বৃত্তি পাইয়াছি।... আমার কাজ কী বলো তো?’
আমরা সমস্বরে বললাম, ‘পড়াশোনা করা।’
‘ঠিক ধরেছ। পড়াশোনা করতে হবে। বিকল্প নেই। এখন রবীন্দ্রযুগ নয় যে ১৭ আর ১৯ বছরে বিয়ে হয়ে যাবে। তোমাদের বিয়ে হতে এখনো ঢের দেরি। সুতরাং বাবারা, সব ভাবনা বাদ দিয়ে পড়াশোনা করো। আমি এখন যাই। কাল আবার দেখা হবে।’
কলেজে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে আমার একটা নতুন শার্ট পাওয়ার কথা ছিল। রহমান চাচা আমাদের প্রতিবেশী। বড়লোক তিনি। চট্টগ্রামে কী চাকরি করেন আমি ঠিক জানি না। তবে তিনি বাড়িতে এলে আব্বাকে খুশি হয়ে উঠতে দেখি। আব্বা বারবার বলতে থাকেন- রহমান এসেছে, রহমান এসেছে। আব্বার এই খুশির কারণ আমি জানি। রহমান চাচা এলে আমাদের ঘরে কিছু জিনিসপত্র আসে। দুটো কমলা, এক প্যাকেট গ্লুকোজ বিস্কুট, দু-এক চাক মিছরি ইত্যাদি। রহমান চাচা আব্বাকে মাঝে মাঝে টাকা-পয়সা দেন চা-পানি খাওয়ার জন্য।
গতবার রহমান চাচা ফেরার সময় আব্বা আমাকে বললেন, ‘তোর চাচাকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আয়।’
এই এগিয়ে দেওয়ার মানে আমি বুঝি। আমাদের বাড়ি থেকে বাসস্ট্যান্ড তিন কিলোমিটার। কাঁচা রাস্তা। এই পুরোটা পথ রহমান চাচার ব্যাগ বয়ে নিয়ে যেতে হবে আমাকে। বিনিময়ে তিনি আমাকে দশটা টাকা দেবেন। সেই টাকাটা আমি আব্বার হাতে দেবো। আব্বা দুকেজি আটা কিনতে পারবেন।
ব্যাগ মাথায় নিয়ে আমি রহমান চাচার পেছন পেছন হাঁটছি। পথে তিনি পরিচিত এক লোকের সাথে কথা বলার জন্য দাঁড়ালেন। আমাকে বললেন, ‘তুই হাঁট, আমি আসছি।’
আমি কিছুটা পথ এগিয়ে গেলাম। পেছন থেকে একটা রিকশা এসে থেমে গেল। রিকশাওয়ালা বলল, ‘যাবি নাকি রে?’ দ্বিধায় পড়ে গেলাম আমি। চাচার অনুমতি ছাড়া রিকশা কীভাবে নিই? রিকশা নিলে বলবে- সামান্য এটুকু পথ হাঁটতে পারিস না? শুধু শুধু আমার টাকা নষ্ট করলি।
আমি রিকশা নিলাম না। রহমান চাচা কিছুক্ষণ পর এসে গেলেন। আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘রিকশাটা নিলি না কেন?’
আমি বললাম, ‘আমি পারব চাচা। এই তো আর একটুখানি পথ।’
‘তুই না হয় পারবি। কিন্তু আমি? আমার কষ্ট হচ্ছে না?’
গজরাতে থাকলেন রহমান চাচা। এরপর বললেন, ‘রিকশা নিলেও আমি তোকে দশ টাকা দিতাম। ছোটলোক কোথাকার!’
আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমার তো এত কিছু মনে ছিল না। আমার শুধু মনে হয়েছে রিকশা নিলে চাচা রাগ করবেন।
বাকি পথ রহমান চাচা আমার সাথে কোনো কথা বললেন না। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে আমার হাতে দশ টাকা দিয়ে বললেন, ‘বাড়ি যা।’
আমি দাঁড়িয়ে থেকে উসখুস করতে লাগলাম। চাচা বললেন, ‘কী হলো, চলে যা।’
আমি কি আব্বার কথাটা চাচাকে বলব? কীভাবে বলব? চাচা যে আমাকে অপমান করলেন!
বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে আব্বা আমাকে চুপি চুপি বলেছিলেন, ‘তোর রহমান চাচাকে বলিস তোর জন্য একটা শার্ট আনতে।’ আমি বললাম, ‘আমি পারব না। আমার ভয় করে।’
‘ভয়ের কিছু নেই। রহমান ভালো মানুষ। দেখিস না, তোদের জন্য কত কিছু আনে? বিস্কুট, কমলা; কত কিছু।’
আমি মাথা নাড়তে থাকলাম। আব্বা বললেন, ‘শার্ট না পেলে কলেজে যাবি কী পরে? এত শরম পেলে তো ঠকবি।’
রহমান চাচা বাসের পাদানিতে ডান পা রাখলেন। আমি ডাকলাম, ‘চাচা’
‘পেছন থেকে ডাকিস কেন অলক্ষ্মীর মতো? দেখছিস না আমি যাচ্ছি, শুভ কাজে যাচ্ছি? বল, কী বলবি বল।’
‘একটা শার্ট যদি আনতেন।’
‘শার্ট? কার জন্য?’
‘আমার জন্য। কলেজে যাব তো। শার্ট নেই।’
রহমান চাচা কী রকম একটা মুখভঙ্গি করলেন। এই ভঙ্গিমার মানে আমি বুঝতে পারিনি। আমাকে কিছু না বলে উঠে গেলেন বাসে।
১৫ দিন পর রহমান চাচা এলেন। রাস্তার মাথায় নেমে খবর পাঠালেন বাড়িতে। তাঁর সঙ্গে দুটো ব্যাগ। আনবার জন্য আমি আর তাঁর ছেলে আরিফ গেলাম। আরিফের থেকে আমি দুবছরের বড়। তাই হয়তো আমাকে বড় ব্যাগটা দেওয়া হয়েছে। এত ভারী ব্যাগ, মাথায় নিয়ে আমি তাল সামলাতে পারছিলাম না। তবু উৎসাহ নিয়ে আমি বাড়ির দিকে চললাম। এই ব্যাগের ভেতরেই হয়তো আমার জন্য কেনা নতুন শার্টটা আছে। আমি কল্পনা করতে লাগলাম, কী রং হতে পারে শার্টটার? নীল হলে ভালো হয়। আর ছাপার হলে তো আরও ভালো।
কিছুক্ষণ পর যথারীতি বিস্কুট, কমলা, মিছরি এলো আমাদের ঘরে। সবাই আগ্রহ নিয়ে খেল। কিন্তু আজ আমার ভালো লাগছে না। আমার উৎকণ্ঠা শার্টের জন্য।
সন্ধ্যা গেল, রাতও পার হলো। শার্ট নেওয়ার জন্য আমার ডাক পড়ল না। সারা রাত আমি ঘুমে-তন্দ্রায় শার্ট দেখেছি। সকালটাও যখন পেরিয়ে গেল, আমার উৎকণ্ঠা মনখারাপে পরিণত হলো। আব্বার জন্য। রহমান চাচা আমার জন্য শার্ট আনবেন, আব্বা বড্ড আশা করেছিলেন।
সাড়ে ৯টার দিকে রহমান চাচা আমাকে ডাকলেন। আব্বা বললেন, দেখেছিস, ঠিকই এনেছে। আমি লাফাতে লাফাতে গেলাম। রহমান চাচা আরিফকে বললেন, শার্টটা নিয়ে আয়। আরিফ শার্ট এনে দিল। রহমান চাচা বললেন, ‘পরে দেখ।’
আমি পরলাম। শার্টটা ছোট। নিচের দিকেও, হাতাও। রংজ্বলা। এটা আরিফের পুরোনো শার্ট। আব্বা আমাকে দেখে ঘাবড়ে গেলেন মনে হলো। আব্বার চোখ ছলছলে হলো। আরিফ আমার সামনে দিয়ে স্কুলে গেল নতুন শার্ট পরে। নীল রঙের।
ক্লাস থেকে বেরিয়ে শাহজাহান স্যার আমাকে ডাকলেন। ডেকে হাঁটতে শুরু করলেন। আমিও স্যারের পেছন পেছন হাঁটছি। অনেকটুকু হেঁটে গিয়ে কিছুটা নির্জনে থামলেন তিনি। আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘শার্ট কি তোর এই একটাই?’
আমার লজ্জা লেগে উঠল। মাথা নিচু করে ফেললাম। স্যার বললেন, ‘মন খারাপ করিস না। তোর তো তবু একটা আছে। আমার একটাও ছিল না। একটাও শার্ট না থাকলে আমি কী পরতাম, সে গল্প তোকে আরেকদিন বলব। মাথা তোল।’
আমি বললাম, ‘জি স্যার।’
‘হাতা নিয়ে টানাটানি করিস না। টানলে তো আর বড় হবে না। তুই বরঞ্চ হাতা গুটিয়ে রাখিস।’
আমি আবারও বললাম, ‘জি স্যার।’