পোস্টস

গল্প

নবনিতা

১২ জুন ২০২৪

সাফি আল মেহেদী

মোবাইলের এলার্মের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল শফিকের। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলে ভোর ৪ টা ৪১ বাজে। ১১ মিনিট হল এলার্ম বেজেছে, সে টেরই পায় নি। খাটের এক কোণে কম্বল গায়ে গুটিশুটি মেরে ঘুমোচ্ছে তার ছেলে নুহাশ। ডিম লাইটের আবছা অন্ধকারেও তার গভীর ঘুমে মগ্ন নিষ্পাপ মুখটা দেখা যাচ্ছে। আজকের মতই কুয়াশায় ঢাকা এমন এক দিনেই ৮ বছর আগে পৃথিবীতে এসেছিল সে। দেখতে দেখতেই কত বড় হয়ে গেছে, সেই পুতুলের মত বাচ্চাটা। এখন সে নিজের ব্যাগ নিজের কাধে নিয়ে স্কুলে যায়। শফিক আরমোরা দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। ব্রাশ ট্রাশ করে, ওযু করে নিল। প্রতিদিনের মত ফজরের সালাত আদায় করে, দুই পৃষ্ঠা কুরআন শরীফ পড়ল। তারপর ঘড়িতে দেখল সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। ফ্লাস্ক থেকে এক কাপ চা নিয়ে, বেলকুনিতে বসল সে। ধীরে ধীরে বাইরে আলো ফুটছে। অন্ধকার মিলিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। এ দৃশ্য দেখতে শফিকের ভীষণ ভালো লাগে। তার জানালার সামনে জারুল গাছ। জারুল গাছে একটা কাককে দেখা যাচ্ছে। কাকটা চুপ করে বসে আছে, ডাকছে না। মাঝে মাঝে শফিকের দিকে তাকাচ্ছে, কিন্তু ডাকছে না। ডাকছে না কেন কাকটা, ভোরবেলা তো এদের প্রথম কাজই হয় ডেকে ডেকে শহরের লোকজনকে জাগিয়ে তোলা। এই কাকটা তা করছে না কেন বোঝা যাচ্ছে না। শফিক এর পেছনে কি কারণ আছে ভাবতে ভাবতেই কাকটি উড়ে গেল। শফিকের চা ও শেষ। সে উঠে পড়ল। প্রতিদিন সকাল করে সে ১ ঘন্টা হাটাহাটি করে। শফিকের মা আনোয়ারা বেগম তজবি হাতে শফিকের ঘরে এসেছেন। শফিক তার মাকে বলল মা আমি বেরুচ্ছি, গেইট টা লাগিয়ে দাও। আর  টেবিলের ওপর কাচা ছোলা, ইসুবগুলের ভুসির শরবত বানিয়ে রেখে যাচ্ছি তুমি খেয়ে নিও। আনোয়ারা বেগম, তজবি গোনা বন্ধ করে বললেন আচ্ছা বাবা, আর তোর মনে আছে তো যে আজ বিশেষ দিন, আসার সময় বাজার করে নিয়ে আসিস। শফিক বলল হ্যা মা, মনে আছে। আমি গিফট আর চিরকুট নুহাশের বালিশের নিচে রেখে দিয়েছি। আজ তুমি নুহাশের পছন্দের স্পেশাল চিকেন মোগলাই ভাজো মা, আমি এসে একসাথে খাবো।

 

নুহাশের ঘুম অনেক আগেই ভেঙেছে। সে এতক্ষণ ঘুমের ভান ধরে ছিল। প্রায়ই সে এ কাজটি করে। তার বাবা হাটতে যাওয়া মাত্রই ঘুম থেকে উঠে যায়। কারন ঘুমিয়ে থাকলে তার বাবা হাটতে যাওয়ার আগে তার কপালে চুমু খায়। কিন্তু সে জেগে থাকলে এ কাজটি করে না। তাই নুহাশের অভিনয় করতে হয়, বাবার চুমুর জন্য। আজকের দিন তার জীবনে অনেক অনেক বিশেষ একটা দিন, প্রত্যেক বছর এইদিনে তার মা, তার বাবার কাছে তার জন্য গিফট আর চিরকুট পাঠায়। নুহাশ একটা একটা করে দিন গোনে এই দিনটার জন্য। হয়ত এমনই কোন একদিন তার মা নিজেই তার জন্য গিফট নিয়ে আসবে। কিন্তু এবারও তা না হওয়াতে তার মন খানিকটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু সে উঠেই তার বালিশের নিচে হাত দিল। ছোট্ট একটা ঘড়ি, তাতে বেনটেনের ছবি। নুহাশ আনন্দে লাফিয়ে উঠল, আর তার মাকে মনে মনে অনেক ধন্যবাদ জানালো। চিৎকার করে দাদিকে ডাকল, আন্না, আন্না, তাড়াতাড়ি এদিকে আসো, দেখে যাও আম্মু আমার জন্য কি পাঠিয়েছে। আনোয়ারা বেগম রান্নাঘরে ময়দা গুলছিলেন, নাতির চিৎকার শুনে, হাত ধুয়ে উঠে এলেন। নুহাশকে বললেন কি হয়েছে দাদুভাই, এত আনন্দ কিসের। নুহাশ বলল দেখো আন্না, বেনটেন ওয়াচ, আম্মু আমার জন্য পাঠিয়েছেন, অনেক সুন্দর না? আনোয়ারা বেগম বলল হ্যা অনেক সুন্দর দাদুভাই। যাও ঝটপট ফ্রেশ হয়ে স্কুল ড্রেস পড়ে আসো, তোমার হাতে ঘড়িটা পড়িয়ে দিই। নুহাশ ঝড়ের গতিতে দৌড় দিল। আনোয়ারা বেগম তার নাতির অপেক্ষায় বসে রইলেন।

 

শফিক বাসায় আসার সময় পোলাওয়ের চাল, দুইটা পাকিস্তানী মুরগি, আড়াই কেজি খাসির মাংস, একটা বড় সাইজের ইলিশ, দই, বুটের ডাল নিয়ে বাসায় আসল। নুহাশ স্কুল ড্রেস পড়ে টেবিলে বসে আছে, আনোয়ারা বেগম খাবার সাজাচ্ছিলেন। ছেলেকে বাজার আনতে দেখে ব্যাগ থেকে বাজার বের করার জন্য রান্নাঘরে গেলেন। নুহাশ উঠে গিয়ে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, বাবা দেখ ঘড়িটা অনেক সুন্দর লাগছে না? শফিক বলল হ্যা বাবা খুবই সুন্দর, তুমি তোমার মায়ের চিঠিটা পড়েছ। নুহাশ বলল না বাবা এখনও পড়লেই তো শেষ, তাই রাতে পড়ব। শফিক আর কিছু বলল না। এর মধ্যে আনোয়ারা বেগম বাজার রেখে চলে এসেছেন। প্লেটে মোগলাই বেড়ে দিলেন। বাটিতে আলাদা করে চিলি সস, টমেটো সস ঢাললেন। শফিক বলল মা দুপুরে পোলাও রান্না করিও, সাথে ইলিশ মাছ ভাজি করিও, খাসির মাংসের রেজালা, মুরগির রোস্ট, আর খাসির তেল কলিজা আলাদা করে ওটা দিয়ে বুটের ডাল রান্না করো। নুহাশ বলল আন্না আমি কাবাব খাবো। শফিক বলল ও হ্যা ভুলেই গেছি, মাংস দিয়ে কয়েকটা জালি কাবাব ও বানিও। নুহাশ বলল ইয়াহু, আজ আমার প্রিয় সব খাবার রান্না হচ্ছে। নুহাশের আনন্দ দেখে শফিকের মন ভালো হয়ে গেল। নয়টা পাচ বেজে গেছে। শফিক নুহাশকে বলল চল বাবা, তোমার স্কুলের সময় হয়ে যাচ্ছে। নুহাশ তার আন্নাকে বাই বাই জানিয়ে বের হয়ে গেল। শফিক গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করল। আনোয়ারা বেগম বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে রইলেন, শফিকের গাড়িটি চোখের আড়াল হওয়া পর্যন্ত তিনি দাঁড়িয়েই থাকেন এভাবে।

 

গাড়িতে যেতে যেতে নুহাশ তার বাবাকে বলল বাবা আমাকে কয়েকটা চকলেট কিনে দিবে? আজ তো আমার জন্মদিন, আমি আমার তিন বন্ধু সাকিব, রাফি আর এলেক্সকে চকোলেট দিব। শফিক বলল অবশ্যই বাবা কেন দিব না। শফিকে এক সুপার শপের কাছে গাড়ি থামিয়ে বলল বাবা তুমি দাড়াও আমি চকলেট নিয়ে আসি। নুহাশ বলল আচ্ছা বাবা। শফিক পুরা দুই বক্স চকলেট নিয়ে আসল। নুহাশ বলল বাবা এতগুলো চকলেট কেন, শফিক বলল তোমার বন্ধুদের পাশাপাশি, ক্লাসে সবাই তো তোমার বন্ধু, পুরো ক্লাসের সবাইকে চকলেট দিও বাবা। তোমার টিচারদেরকেও দিও। আর সবাইকে তোমার জন্য দুয়া করতে বলিও। নুহাশ বলল আচ্ছা বাবা। নুহাশকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে সে অফিসের দিকে রওনা হল। আজ তাড়াতাড়ি ছুটি নিতে হবে। পাশের সিটে হাত রাখতেই দেখল একটা চকলেট পড়ে আছে। নুহাশের থেকে পড়েছে হয়ত। শফিক ভাবনার মধ্যে ১৫ বছর আগের সময়ে ডুব দিল। যখন সে মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট স্কুল এন্ড কলেজে ক্লাস টেনে পড়ত। কম্বাইন্ড স্কুল হওয়া সত্বেও, সে একটু লাজুক প্রকৃতির ছিল, মেয়েদের সাথে কথা বলতে পারত না, মিশত না। সে সচারাচর ছেলেদের সাইডে, ফার্স্ট ব্রেঞ্চে বসত, কিন্তু ওইদিন দেড়ি হয়ে যাওয়াতে, অন্য কোন সিট ফাকা না থাকাতে,  পেছনের বেঞ্চে বসতে হয়েছিল তাকে। তাও একটা মেয়ের পাশে। পুরো ক্লাস সে অস্বস্তির মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছে। সেদিন বৃহস্পতিবার ছিল বলে রক্ষা, হাফ স্কুল ছিল। ছুটি হওয়ার সাথে সাথে সে উঠে তাড়াহুড়া করে বাসায় চলে এসেছিল। তারপর শনিবারে যখন সে স্কুলে যায়, ক্লাসে ঢোকার সাথেই, একটা মেয়ে তাকে নাম ধরে ডাকল। বলল তুমি কি কানে কম শোন, পরশুদিন যে এত করে তোমায় ডাকলাম, তুমি শুনলেই না, হন হন করে চলে গেলে। এই নাও এই চকোলেট, তুমি ওইদিন বেঞ্চে ফেলে চলে গিয়েছিলে। শফিক হাত বাড়িয়ে চকলেট নিল। আর একটা টু শব্দও করল না। একটা থ্যাংকস ও দিল না, ওখান থেকে চলে গেল। পরে বাসায় এসে এই ঘটনা তার মাকে খুলে বলল। তার মা বলল, তুমি এই কাজটা মোটেও ঠিক করনি। মেয়েটাকে অন্তত থ্যাংকস দেয়া উচিৎ ছিল। আর চকলেট টা মেয়েটাকে গিফট করতে পারতে। যাই হোক ভুল যেহেতু করেই ফেলেছ, শুধরাতে তো হবে। কাল এক বক্স চকলেট তুমি মেয়েটিকে দিবে, এবং তাকে একসাথে সরি এবং থ্যাংকস বলবে। পরের দিন শফিক স্কুলে গিয়েই, মেয়েটাকে খুজল, মেয়েটার নাম পর্যন্ত সে জানে না। অন্য আরেকজনকে বলে নাম জিজ্ঞাসা করল, তখন বলল ও তুই নবনিতার কথা বলছিস, ওরা তো বদলি হয়ে কুমিল্লায় চলে গেছে, কাল বিদায় নেয়ার জন্যই স্কুলে এসেছিল। শফিক একটু ধাক্কার মত খেল। চকলেটের বক্স টা সে যত্ন করে অনেকদিন তুলে রেখেছিল। কোনদিন যদি নবনিতার সাথে তার দেখা হয়, সেদিন বক্সটি সে নবনিতাকে দেবে। গাড়ির হর্ণে তার চেতনা ফিরে এল, ১০ টা পার হয়ে গেছে। সে অফিসের সামনে গাড়ি নিয়ে বসে আছে, পিছন থেকে আরেকটা গাড়ির ড্রাইভার হর্ণ দিচ্ছে, সে অফিসে ঢুকে পড়ল, গাড়ি পার্ক করে হন্ত্যদন্ত হয়ে অফিসে ঢুকল।

 

খাবার টেবিলে বসে আছে শফিক আর নুহাশ। আনোয়ারা বেগমের সব রান্না হয়ে গেছে, শুধু বুটের ডাল টা হলেই খেতে দিবেন তিনি। নুহাশের মন আজ বেশ ভালো। বন্ধুরা তাকে বেশ কিছু উপহার দিয়েছে। তার ইংরেজি মিস তাকে একটা সুন্দর কলম গিফট করেছে। পরশু দিন ২৫শে ডিসেম্বর, বড়দিন, সে উপলক্ষে ওর বন্ধু এলেক্স ওদের সবাইকে ওদের বাসায় ইনভাইট করেছে, ফ্যামিলি সহ। নুহাশ বলল বাবা তুমি কি আমাকে এলেক্স দের বাসায় নিয়ে যাবে? আমার বন্ধুরা সবাই যাবে। শফিক বলল অবশ্যই বাবা, কেন নিয়ে যাব না। এর মধ্যে আনোয়ারা বেগম সব খাবার টেবিলে দিয়ে দিয়েছেন। নিজেই ছেলে আর নাতিকে সব তুলে দিচ্ছেন। শফিক বলল মা তুমিও বসো। আনোয়ারা বেগম বসলেন। নুহাশ খেতে খেতে বলল, খাসির রেজালাটা খুবই মজা হয়েছে। তারা তৃপ্তি নিয়ে আরাম করে খাচ্ছিল। আনোয়ারা বেগমের কি যে ভালো লাগে এ দৃশ্য দেখতে। খাসির রেজালা শফিকের বাবার ও খুব প্রিয় ছিল। প্রায়ই রাত করে সে, খাসির মাংস কিনে নিয়ে আসত আর বলত, আনোয়ারা নাও তো টুক করে পোলাও রান্না কর, আর খাসির মাংস দিয়ে রেজালা কর। ঝোল একটু ঘন করিও। আর পোলাওয়ের মধ্যে হাল্কা ঘি দিও। সাথে পেয়াজের বেরেস্তা করিও। মানুষটা বেহেস্তে গিয়েও নিশ্চয়ই পোলাও আর খাসির রেজালা খাচ্ছেন। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন তাকে সুখের চাদড়ে জড়িয়ে রেখেছেন।

 

সন্ধ্যায় শফিক বেলকুনিতে বসে ছিল। অন্যমনস্ক ভাবে আবার ফিরে গিয়েছিল অনেক শীত বসন্ত আগের সে দিনে, যেদিন দ্বিতীয়বার তার নবনিতার সাথে দেখা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। ক্যাফেটারিয়ায় বসে কলিজা সিঙারা খাচ্ছিল শফিক। পেছন থেকে কেউ একজন ডাক দিল। শফিক ফিরে তাকিয়ে দেখল একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। প্রথমে চিনতে না পারলেও, পরে ঠিকই চিনতে পারল, নবনিতাকে। নবনিতা তার পাশে বসল। কিভাবে এখানে সব খুলে  বলল। ছয় মাস তারা একই ক্যাম্পাসে পাশাপাশি বিল্ডিং এ ক্লাস করেছে, তাদের কখনো দেখা হয় নি, আজ হয়ে গেল। শফিক পড়ত ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে আর নবনী পড়ত ফিলোসোফিতে। তারা গল্প করল, একসাথে কিছুক্ষণ হাটল, টিএসসিতে চা খেল, নবনিতা নিজে থেকেই মোবাইল নম্বর দিয়ে বলল, একই জায়গাতেই তো থাকি, মাঝে মাঝে খোজ নিও। এতদিনে শফিক বেশ কিছুটাই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। খুব বেশি ক্লোজ না হলেও বেশ কয়েকজন বন্ধু হয়েছিল তার, মেয়েদের সাথে মিশতেও আগের মত ইতস্তত করত না। সে মনে মনে ভাবল, নবনিতার সাথে দেখা হওয়াই ভালো হয়েছে, তার জিনিস তাকে বুঝে দেয়া যাবে। পরের দিন শফিক ক্যাফেটারিয়ায় অপেক্ষা করছিল, নবনীকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালো, ব্যাগ থেকে সেই চকলেটের বক্সটি বের করলে, ভেতরের চকলেট হয়ত সবগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছে, কিন্তু যার জন্য রাখা জিনিস, তার কাছে পৌছাতে পেরে শফিক মনে মনে গভীর প্রশান্তি অনুভব করল। নবনী বলল চকলেট কেন? শফিক তাকে সব খুলে বলল যে এতদিন সে চকলেটের বক্সটি তার জন্য তুলে রেখেছিল। সব শুনে নবনিতা ফিক করে হেসে দিল। এর পর তাদের মাঝে মাঝে খোজ নেওয়াটা, প্রায় প্রতিদিন খোজ নেওয়াই রুপান্তরিত হল। তাদের বন্ধুত্বের গল্পটা বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় ঘটল বিপত্তি। হঠাত আনোয়ারা বেগমের ডাকে শফিকের ভাবনায় বাধা পড়ল। আনোয়ারা বেগম বললেন আয় বাবা খেতে আয়। শফিক হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত ৯ টা ২১ বাজে। এতক্ষণ পার হয়ে গিয়েছে সে খেয়াল ই করেনি। শফিক বলল মা তুমি খাবার রেডি কর, আমি সালাত আদায় করে নেই, নুহাশ কি করে? আনোয়ারা বেগম বললেন ওই যে ওর বন্ধু ভিডিও গেমস দিয়েছে, ওটা নিয়েই পড়ে আছে, গেইম খেলছে।

 

রাতের খাবার খেয়ে নুহাশ নিজের রুমে এসে টেবিলে বসল। সারাদিন সে তার এই ঘরেই থাকে। শুধু রাতে ঘুমানোর সময় বাবার ঘরে যায় আর মাঝে মাঝেই তার আন্নার ঘরে যায়। নুহাশ বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই তার দাদিকে আন্না বলেই ডাকে। এখন তার আজকের দিনের সবচেয়ে প্রিয় সময়। সে তার মার চিঠি পড়বে। টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়েছে সে। আলতো করে চিঠির খাম থেকে বের করল চিরকুট। ছোট একটা কাগজে, কিঞ্চিৎ অগোছালো গোটা গোটা হাতের লেখা,

 

প্রিয় নুহাশ,
আজ তোমার অষ্টম জন্মদিন। তুমি অনেক বড় হয়ে গিয়েছ, স্কুলেও যাচ্ছ। স্কুলের বন্ধুরা মিলে অনেক মজা কর তাই না। তোমার আম্মু তোমাকে অনেক মিস করে। ঠিক ঠাক মত খাওয়া দাওয়া করবে, নিজের যত্ন নিবে, মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করবে, আর বাবার কথা সবসময় মেনে চলবে। জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা, আর ভালোবাসা তোমার জন্য আমার লক্ষ্মী বাবাইটা।
ইতি
তোমার আম্মু

 

চিঠি পড়ে নুহাশের মন একই সাথে আনন্দে ভরে উঠল আবার গভীর বিষাদে তার চোখে পানিও চলে আসল। সে চিঠিটি তার সিক্রেট ড্রয়্যারে রেখে দিল। তারপর চোখ মুছে বাবার ঘরে গেল ঘুমাতে। শফিক শুইয়ে শুইয়ে বই পড়ছিল। নুহাশ তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল। শফিক কম্বল জড়িয়ে দিল নুহাশের গায়ে। শোয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়ল নুহাশ। ছেলেটা তার মায়ের স্বভাব পেয়েছে। নবনিতাও এমন শোয়া মাত্রই গভীর ঘুমে তলিয়ে যেত। শফিক এক মনে তাকিয়ে থাকত নবনীর দিকে। তাদের বিয়ের দিনের ঘটনা মনে পড়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয় এ তখন তারা ৩য় বর্ষে পড়ে। তাদের বন্ধুত্ব বেশ ভালোই চলছিল। এমন সময়েই হঠাত নবনিতার নানি বাড়ির এক আত্মীয় খুবই ভালো একটা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসল। নবনিতার বাবা মা সব খোজ খবর নিয়ে রাজি হয়ে গেল। নবনিতারও মনে হল, ছেলে সবদিক দিয়ে বেশ ভালো তাই সেও আর আপত্তি করল না। কিন্তু বিয়ের আগের দিন হঠাত করেই তার মনে হল, সে শফিক ছাড়া অন্য কারো সাথে ঘর করতে পারবে না। সে রাতে শফিককে ফোন করে তার বাসার সামনে ডাকল। আর বলল, তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে? শুধু হ্যা কিংবা না অন্য কোন উত্তর শুনতে চাচ্ছি না। শফিক একটা ধাক্কার মত খেল। সে কোন কিছু ভাবতেও পারছিল না। সে না বুঝেই হ্যা বলে দিল। ঐ রাতেই নবনিতা শফিকের হাত ধরে কাজি অফিসে নিয়ে গেল, দুই চারজন বন্ধুকে ডাকল, তাদের  সাক্ষি বানিয়ে বিয়ে করে নিল। রিক্সায় করে বাসায় ফেরার সময় তুমুল বৃষ্টি। দুজনের কাপড় কাদায় মাখামাখি হয়ে গেল। আনোয়ারা বেগম ছেলে আর তার বউকে দেখে ভুত দেখার মত চমকে উঠলেও পরক্ষনেই সামলে নিয়ে, তাদের ঘরে নিয়ে গেলেন। বললেন আমি গরম পানি করছি তোমরা গোসল করে নাও। গোসল করে এসে দেখল আনোয়ারা বেগম, সাদা ভাত, চিংড়ির মালাইকারি আর মসুরের ডাল রান্না করেছেন। তারা তৃপ্তি করে খেল। কেউ কোন কথা বলল না। শুধু নবনিতা লজ্জা পাওয়া মুখে বলল চিংড়ির মালাইকারি টা অসাধারণ হয়েছে আন্টি। আন্টি বলে সে আবার খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। খেয়ে দেয়ে তারা শফিকের ঘরে এসে দেখল এর মধ্যেই আনোয়ারা বেগম শফিকের ঘর অনেকটাই গুছিয়ে ফেলেছেন। বিছানায় নতুন চাদড় পেরেছেন। নবনিতা বিছানায় শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়ল। রিক্সায় করে আসার সময় মনে মনে অনেক কথা জমা করেছিল শফিক। তার কোনটাই বলতে পারল না। সে রাতে সারারাত তুমুল বৃষ্টি হল। বিদ্যুৎ অনেক বার যাওয়া আসা করল। শফিক মুগ্ধ হয়ে নবনিতার দিকে তাকিয়ে সারারাত পার করে দিল। হালকা কমলা রঙের ডিম লাইটের আলোতে নবনিতাকে যেন অন্যজগতের কেউ মনে হচ্ছিল।

 

আজ ২৫ শে ডিসেম্বর, নুহাশের স্কুল আর শফিকের অফিস দুইটাই বন্ধ। সকালে হেটে এসে শফিক আর বাইরে যায় নি। কম্বল মুড়ি দিয়ে বাংলাদেশ আর ইন্ডিয়ার ওয়ানডে ম্যাচ দেখেছে। তামিম সাকিবে ভর করে ম্যাচটি জিতে গেছে টাইগাররা। এজন্য শফিকের মনটা বেশ ভালো। সন্ধ্যায় আবার দাওয়াত আছে নুহাশের বন্ধুর বাড়িতে। নুহাশকে বলেছিল নিয়ে যাবে, তাই যাওয়ার ইচ্ছে না থাকা স্বত্তেও রেডি হচ্ছে শফিক, নুহাশ তার ব্লেজার পড়েছে। ছেলেটা হয়েছে তার মায়ের মত দেখতে, ঠিক যেন রাজকুমারের মত লাগছে। শফিক তার মাকেও বলেছিল যেতে, কিন্তু আনোয়ারা বেগমের মাথা ব্যাথা করছে, তাই তিনি যাবেন না বললেন। শফিক গাড়ি বের করল। যাওয়ার সময় সুপার মার্কেট থেকে কিছু গিফট নিতে হবে, নুহাশের বন্ধুর জন্য। এলেক্সদের বাসা বেশি দূরে নয়, ২০ মিনিট এর পথ হয়ত, কিন্তু ঢাকা শহরের জ্যামের কারনে আর গিফট কিনতে গিয়ে বেশ দেড়ি হয়ে গেল। এলেক্সদের বাসার সামনে বিশাল ফাকা জায়গা জুড়ে অনেক সুন্দর করে লাইটিং করা হয়েছে। এক পাশে ক্রিসমাস ট্রি লাগানো হয়েছে। খুবই সুন্দর লাগছে দেখতে। এলেক্সের বাবা মা আন্তরিকভাবে নুহাশদের দিকে এগিয়ে এল, স্বাগতম জানালো তাদের। শফিক গিফট গুলো এলেক্সের হাতে তুলে দিল। বেশির ভাগ ছেলে-মেয়েরাই তাদের মা বাবা দুজনকেই নিয়ে এসেছে। এটা দেখে নুহাশের মন অনেকটাই খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু ওর বন্ধুরা ওকে এসে নিয়ে গেলে, সবাই মিলে খেলার মধ্যে ডুবে গেল। এমন সময় ওর এক বন্ধু ওকে বলল কিরে নুহাশ তোর মা এবারো তোর সাথে দেখা করতে আসে নি? আসবে না? নুহাশ প্রশ্নটা শুনে চমকে গেল, দৌড়ে গিয়ে ওর বাবাকে গয়ে জিজ্ঞাসা করল, যে বাবা, আজ তোমাকে বলতেই হবে, আমার মা কোথায়? কেন সে আমার সাথে দেখা করতে আসে না? শুধু জন্মদিনে চিঠি আর পুরষ্কার পাঠায়। শফিক হতচকিত হয়ে গিয়েছিল, ছেলের প্রশ্নে ছেলেকে কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে বলল বাবা তোমার মা সান্টা ক্লোজের সাথে কাজ করে। সান্টা ক্লোজের সাথে সবাইকে গিফট দিয়ে বেড়ায়। এজন্যই তো প্রতিবছর তোমাকেও গিফট পাঠায়। আর সব শিশুদের গিফট পৌছে দেয়। ওখান থেকে চাইলেও সে ফিরে আসতে পারে না। আর সান্টা ক্লোজের সাথে থাকলে যে পরিবারের সাথে দেখা করার নিয়ম নেই বাবা। এজন্যই তো আম্মু তোমার কাছে আসতে পারে না বাবা। তুমি কি চাও তোমার বন্ধুরা সবাই গিফট না পাক? নুহাশ বলল কিন্তু আর কারো আম্মু সান্টাকে হেল্প করে না কেন, আমার মাই কেন স্যান্টা কে হেল্প করে। শফিক বলল সবাই তো স্যান্টাকে হেল্প করতে পারে না বাবা, তোমার মা যে অনেক বেশি ভাল মানুষ, তাই সে সান্টার সাথে থাকার সূযোগ পেয়েছে। নুহাশ কিছুটা কনভিন্সড হল। তার বন্ধুদের কাছে গিয়ে গর্বের সাথে তা শেয়ার করল। এলেক্সদের বাসায় খাবারের এলাহী আয়োজন ছিল তারা ভরপেট খেয়ে রাত দশটায় বাসার পথে রওনা দিল।

 

শফিকদের বাসা টা মেইন রাস্তা থেকে একটু ভেতরে। ৫ তলা বাসার ৩ তলায় থাকে শফিকরা। বাসার সামনে অল্প একটু ফাকা জায়গা। দুই পাশে বকুল ফুল, আম, জারুল কৃষ্ণচূড়ার গাছ। শফিক এপার্টমেন্টটি কিনে নিয়েছে। তাদের এপার্টমেন্টে ৩ টা বেডরুম, একটা ডাইনিং রুম, একটা কিচেন, একটা ড্রইং রুম, একটা কমন ও ২টা এটাচ্ড বাথরুম। আর তিন রুমের সাথে তিনটা বেলকুনি। শফিকের রুমটা দক্ষিন মুখী। বেলকুনিতে বসে পাশের বাসার সাথের লাগয়া একটা পুকুর দেখা যায়। ঢাকা শহরে এরকম দৃশ্য খুব কমই দেখা যায়। শফিক এপার্টমেন্ট টা কিনেছিল বিয়ের তিন বছর পর। নবনিতার পছন্দেই কিনেছিল সে বাড়িটা। যদিও তুলনামুলক দাম বেশি পড়েছিল, তবুও। নবনিতার এত ভাল লেগেছিল, যে টাকা  ধার করেই এপার্টমেন্টটি কিনে নিয়েছিল শফিক। বিয়ের প্রথম বছর তাদের বেশ সমস্যা হয়েছিল। শফিক তখনও ইউনিভার্সিটির ছাত্র, ওইদিকে নবনিতার বাবা মা তাদের সম্পর্ক মেনে নেন নি। সংসার সাজানোর সরঞ্জাম কেনা, নতুন সংসার গোছানো, সংসার চালান সব দিক ম্যানেজ করতে হাপিয়ে উঠেছিলেন আনোয়ারা বেগম। শফিকের বাবার রাখা পেনশনের টাকা আর জমানো কিছু টাকা দিয়ে চলতে হচ্ছিল তাদের। নবনিতাও বুঝতে পারছিল বিষয়টা, তাই খুব বেশি আবদার ও করত না সে। এদিকে শফিক টিউশনি করিয়ে যেটুকু পারে সংসারে সাহায্য করছিল। সাথে পড়াশুনাও একসাথে চালাচ্ছিল তারা দুইজন। এরই মাঝে অনেক কিছুর অভাব তাদের ছিল, কিন্তু ভালোবাসার কোন অভাব ছিল না। এর মধ্যে থেকেই শফিক প্রায়ই নবনিতাকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যেত, একসাথে ফুচকা খেত, বুড়িগঙ্গার পাড়ে হাত ধরে হাটত, রাতের বেলা তাদের পুরাতন বাড়ির ছাদে বসে জোছনা দেখত। একবার তারা এক পাগলামি করেছিল। রাতের বেলা হাটতে হাটতে পৌছে গিয়েছিল কমলাপুর স্টেশনে। তারপর নবনিতা বলেছিল, চল ট্রেনে উঠে বসি। শফিক বলল ট্রেনে উঠে কি করবে? নবনিতা বলল যেকোন এক স্টেশনে নামব, সে গ্রাম ঘুরে ফিরে দেখব, অচেনা কারো বাসায় থাকব, পরের দিন আবার ট্রেনে চড়ে ঢাকায় ফিরে আসব। শফিক এক কথাতেই রাজি হয়ে গেল। তার আগে ফোন করে তার মাকে জানিয়ে দিল যে ওরা আজ আর বাসায় ফিরবে না, কাল ফিরবে, তিনি যেন রাতে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। তারপর তারা ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্টে উঠে বসল। শরতের ঝকঝকে রাত ছিল, আকাশে অনেক বড় চাঁদ। ট্রেন ধীরে ধীরে আওয়াজ করে সামনে যাচ্ছে। দমকা হাওয়া গায়ে লাগছে দুজনের। শফিক শক্ত করে নবনিতার হাত ধরে রেখেছে, নবনিতা শফিকের কাধে মাথা রেখে বসে আছে। বগীতে আরো অনেক মানুষ। ট্রেন কয়েক স্টেশন পার হওয়ার পর আনন্দপুর নামে এক স্টেশন আসল, স্টেশন টা অনেক বড়, সবাই বলছে আনন্দপুর জংশন এসে গেছে। তা শুনে নবনিতা বলল চল এই স্টেশনেই নামি। তখন বাজে রাত ৯টা। স্টেশনে নেমেই নবনিতা বলল এক কাপ চা খাওয়াবে। শফিক বলল, হ্যা আমারো চা খাইতে ইচ্ছে করছে রে, চল সামনে যাই। সামনে একটা টঙ এর দোকান দেখা যাচ্ছে, দোকানে বৃদ্ধ মত লোক চা বিক্রি করছেন। তার রেডিও তে পুরাতন আমলের গান বাজছে, ‘’ দুয়ারে আইসাছে পালকি নাই ডোবাও তোল রে তোল, মুখে আল্লাহ রসুল সবে বল।’’ দোকানে অন্য কোন মানুষ ছিল না, তারা বসল। শফিক বলল চাচা দুটা কড়া লিগারের চা দেন। বুড়ো লোকটা আন্তরিকতার ভঙিতে বলল, দিতাছি বাবা, একটু বসেন। তারপর তিনি চা বানাতে লাগলেন। শফিক বলল, আপনার দোকানে বেচা কেনা কেমন চাচা। লোকটা বলল, যেটুকু আল্লাহ মাপাই বাবা, আলহামদুলিল্লাহ চলে যায়। বলে তাদের দিকে চা বাড়িয়ে দিল। তারা দুজন হাত বাড়িয়ে নিল। বৃদ্ধ বলল আপনারা কই থেকে আইছেন, বাপজান, আর যাবেন কই? শফিক বলল, আমরা ঢাকা থেকে আসছি চাচা আপনাদের গ্রামটা ঘুরে দেখার জন্য, ঘুরে ফিরে কালকে চলে যাব। এখানকার কিছু তো চিনি না, আপনি যদি বলতেন এখানে গেস্ট হাউজ আছে কোথায়। বৃদ্ধ বললেন বাবা এইহানে তো ওরকম কিছু পাইবেন না, তই আপনারা যদি চান এই গরীবের বাড়িতে মেহমান হইতে পারেন। শফিক আর নবনিতা একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। শফিক বলল, না চাচা, অযথাই আপনি কেন কষ্ট করবেন, অসুবিধা হবে না আপনার? বৃদ্ধ বলল, না বাবা,আমাদের বুড়াবুড়ির সংসার, ঝামেলার কিছু নাই, আপনারা চলেন তো আমার সাথে। বৃদ্ধ বলল কাপ দুইডা দেন, আজ আর বেচাকেনা হইব না, দোকান বন্ধ করে হাটা দেই চলেন। শফিকরা চা শেষ করে কাপ ধরেছিল। গল্প করতে করতে ভুলেই গিয়েছিল, যে চা টা অসাধারন হয়েছে। তারপর তারা বৃদ্ধের সাথে রওনা হল। স্টেশন ছেড়ে তারা মাটির রাস্তায় নামল, বৃদ্ধের হাতে একটা টর্চ লাইট। শফিক তার মোবাইলের আলো জ্বালালো। আরেক হাতে সে নবনিতার হাত ধরে ছিল। রাস্তার দুধারে গাছপালা, ঝোপঝার । ঝোপের মধ্যে এক গুচ্ছ জনাকি জ্বলছে নিভছে। নবনিতা জোনাকি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। আবার যেতে যেতে , পথের এক পাশে দিঘী, দিঘীর জলে জোছনার ছায়া পড়েছে। কতক্ষন তারা ঘোরের মধ্যে পথ চলতে চলতে বৃদ্ধের বাড়িতে পৌছে গেল। দরজা দিয়ে ঢুকতেই বিরাট উঠান, উঠান পেড়িয়ে কয়েক পা যেতেই টিনের তৈরি ঘর। বৃদ্ধ ডাক দিলেন, কই গো জরীর মা, বাইরে আসো দেখো, মেহমান নিয়াইছি। জরীর মা বাইরে আসলেন, শফিক ও নবনিতা তাকে সালাম জানালো। বৃদ্ধ তার বউকে সব বলল, তিনি বলল আসেন আপনারা ঘরে আসেন, বাইরে দাঁড়ায় থাইকেন না। এক ঘরের ভেতর দিয়ে তাদের আরেকটা ঘরে নিয়ে গেলেন বৃদ্ধা। ঘরে টিমটিমিয়ে হ্যারিকেন জ্বলছে, তখনো গ্রামটিতে বিদ্যুতের ছোয়া লাগেনি। বৃদ্ধা তাদের বলল আপনারা হাত মুখ ধুয়ে নেন, বাইরে কল আছে। ওরা মোবাইল টোবাইল ঘরে রেখে, বাইরে এসে হাত মুখ ধুল। বৃদ্ধা বলল ঘরে আপনাদের গরম লাগব, আমি এই উঠানে পাটি পাড়ে দেই আপনারা বসেন। বৃদ্ধ বলল, জরীর মা মেহমান দের জন্যি চাইড়ডা ডাইল ভাত রান্না কর। ওনারা রাইতে খাবেন। শফিক আর নবনিতা, পাটিতে বসল। মাঝেই বৃদ্ধ ও একটা পিড়ি নিয়ে তাদের পাশে বসল। বাড়িতে কে কে আছে, তারা কি করে সব শুনল। তাদের একমাত্র মেয়ে জরীর বিয়ে হয়েছে, শশুর বাড়িতে থাকে। গল্প করতে করতেই বৃদ্ধা বলল, জরীর বাপ, ঘরের হ্যারিকেনডা জ্বালাও মেহমানদের খাইতে দিই। বৃদ্ধা বললেন, রাইতের বেলা দেইখা আপনাগো জন্যে বেশি কিছু আয়োজন করবার পারলাম না বাজান, আপনাগো খাইতে কষ্টই হয়ে যাইব মনে হয়। শফিক বলল না চাচী, এত রাতে আপনি কষ্ট করে এত কিছু রান্না করলেন, এটাই তো অনেক বড় ব্যাপার। আপনাকে রাত বিরাতে কষ্ট দিলাম। বৃদ্ধা কিছু বলল না। শফিকরা ঘরে ঢুকল। নিচে পাটি পেড়ে খাবারের আয়োজন। তারা বসে পড়ল, ক্ষুধায় তাদের পেট চো চো করছে। খাবারের আয়োজন কম বললেও, এর মধ্যেই বৃদ্ধা অনেক কিছু রান্না করে ফেলেছেন। আলু ভর্তা, বেগুণ ভাজি, ডিম ভাজি, মসুরের ডাল ভর্তা, আর পটল ভাজি। গরম ভাতের উপর আগে ঘি ছিটিয়ে দিয়ে তারপর, তরকারি পাতে তুলে দিল বৃদ্ধা। নবনিতা বলল আপনারাও আমাদের সাথে খান চাচা চাচি। তারাও বসল। শফিক আর নবনিতা  পেট পুড়ে খেল, বৃদ্ধার হাতের সামান্য আয়োজন তাদের কাছে অমৃত মনে হল। খেয়েদেয়ে তারা আবার উঠোনে এসে বসল। আকাশ ভরা জোছনা, চারদিক আলোতে পরিপূর্ন। আকাশ পরিষ্কার থাকাই অনেক তারা দেখা যাচ্ছে। অচেনা একটা গ্রামে শফিক আর নবনিতা হাত ধরে বসে আছে। এর চেয়ে সুখের দৃশ্য তাদের জীবনে কি এসেছিল?

 

শফিক ভার্সিটি থেকে বের হওয়ার দুই মাসের মধ্যে চাকুরি পেয়েছিল। তার রেজাল্ট ছিল ভালো। আর প্রথম ভাইভাতেই কিভাবে যেন টিকেও গিয়েছিল সে। বিরাট মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার। ইংরেজি ভাষায় খুবই ভালো দক্ষতা আর স্মার্ট এটিটিউড তাকে এই চাকুরি পেতে সাহায্য করেছিল। ওদিকে নবনিতাও একটা এনজিওতে চাকুরি পেয়ে গিয়েছিল আর তিন মাস পরে। এরপর আর তাদের পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তারপর ফ্ল্যাট কেনা, আসবাবপত্র গুছিয়ে নেয়া, সময়ের সাথে নবনিতার বাবা মার সবকিছু মেনে নেয়া। স্বপ্নের মত সময় কাটছিল তাদের। এমন সময় আরেক স্বপ্ন নিয়ে নবনিতার পেটে এল নুহাশ। তাদের আনন্দের সীমারেখা ছিল না। বাচ্চার নাম ঠিক করা, কাপড় চোপড় কেনা, খেলনা কেনা সব করে রেখেছিল দুজন। আবার কার মত দেখতে হবে তা নিয়ে খুনসুটি। সব মিলিয়ে সুখের সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছিল দুজন। কিন্তু তীব্র সুখের মাঝে, হঠাতই যে দুঃখের বীনা বেজে ওঠে মানুষের জীবনে, তাই তো নিয়ম। সাত মাসের মাথায় , চেকাপ করাতে গিয়ে ধরা পড়ল নবনিতার দেহে লিম্ফোমা ক্যান্সার বাসা বেধেছে। বাচ্চা হওয়ার সময় যদি বাচ্চাকে বাচাতে চায় তবে, নবনিতা বাচবে না। নবনিতাকে বাচাতে বাচ্চাকে নষ্ট করতে হবে। তার পরেও নবনিতার ক্যান্সার থার্ড স্টেজে আছে। সে এমনিতেও আর বেশিদিন সার্ভাইভ করতে পারবে না। নবনিতার জন্য ডিসিশন টা সহজ ছিল, সে নুহাশকে অবশ্যই পৃথিবীর আলো দেখাবে। শফিক কিচ্ছু কল্পনা করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। সে ডাক্তার কে বলছে, বাইরে চিকিৎসা করতে নিয়ে গেলে ভালো হবে না। ডাক্তার আমি সবকিছু করতে রাজি, কিন্তু আমার নবনিতাকে ঠিক করে দেয়ার ব্যবস্থা করুন প্লিজ। ডাক্তার বলল তা যদি সম্ভব হত আমি করতাম। শফিক নবনিতাকে নিয়ে ঢাকার অনেক বড় ডাক্তার দেখালো, ইভেন নিজেকে শান্তনা দেয়ার জন্য তাকে সিঙ্গাপুরেও নিয়ে গেল। কিন্তু কেউ ই কোন কিছু করতে পারল না। নবনিতা শফিকের হাত ধরে বলল, দেখ আমার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। তুমি আর কিছু করেই কিছু হবে না। কিন্তু আমাদের বাচ্চা টা আসলে তুমি ওর মধ্যে আমাকে খুঁজে নিয়ে, ওকে আকড়ে ধরে বাচতে পারবে। শফিক বলল, আমি তোমাকে হারাতে চাই না। আরো এক মিনিট বেশি ও যদি তোমায় পাই, আমি তাই করব। নবনিতা বলল দেখ শফিক পাগলামি করো না। আমাদের ছেলেটা কত বড় হয়েছে, দেখো আমার পেটে লাত্থি দিচ্ছে। হাসপাতালের বেডে পড়ে থেকেই নবনিতা তাদের অনাগত সন্তানের উদ্দেশ্যে অনেক গুলো চিঠি লিখল। শফিক কে বলল, তুমি ওর জন্মদিনে এই চিঠিগুলো ওকে ধাপে দিবে। ওর ১৩ বছর হওয়ার আগে পর্যন্ত ওকে বুঝতে দিবে না যে আমি নেই। কোন ভাবে বুঝিয়ে রাখবে। আর আমার জন্য দুয়া করবে সবসময়। শফিক নবনিতার পাশেই ঘুমাত, ওর হাত ধরে বসে থাকত, রাত জেগে মাথার কাছে বসে থাকত। নবনিতার যখন যা লাগত তাই করত। এর মধ্যে হঠাত ১০ মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই। একদিন সকালে নবনিতার পেটে ব্যাথা শুরু হল। শফিক তড়িঘড়ি করে ডাক্তার কে ডাকল। নবনিতা শফিক কে বলল তুমি কোথাও যেও না, আমার হাত ধরে থাকো প্লিজ। ডাক্তার বলল, আপনি থাকুন সমস্যা নেই। সোমবার তীব্র শীতের মধ্যে, নবনিতা জন্ম দিল ফুটফুটে নুহাশকে। এরপর নুহাশকে তার বুকের ওপর শুয়ে দিল ডাক্তার। নবনিতা পরম ভালোবাসায় তার ছেলেকে জড়িয়ে ধরল, তার চোখ থেকে টপ টপ করে পানি ঝরল, কিছুক্ষণের মধ্যেই সে বেহেশতের পথে পাড়ি জমাল। শফিক অনেক কথা জমা করে রেখেছিল কিছুই বলা হল না। হঠাতই চলে গেল নবনিতা।

 

আজ নুহাশের জন্মদিন। সে ভোর বেলায় উঠে গেছে। তার বাবার সাথে ফজরের সালাত আদায় করেছে। বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। তার আজকে অত্যন্ত খুশির দিন। কারন তার বাবা বলেছে আজ নুহাশ তার মার কাছে নিয়ে যাবে সে। নুহাশ সুন্দর করে সেজেছে। মনে মনে অনেক কথা জমা করেছে। দেখা হলে তার মাকে বলবে। তার আম্মুর প্রতি প্রচুর অভিমান জমা। কেন এত দিন তিনি তার ছেলের সাথে দেখা করল না। ভাবতে ভাবতেই শফিক বলল চল বাবা, বের হই। নুহাশ বলল আসছি বাবা, ঘড়িটা পড়ে। তারা হেটে হেটে বেশ কিছুদূর চলে এসেছে। সামনে একটা মসজিদ। তার পাশে একটা ছোট্ট পুকুর। আর পুকুরের পাশে গাছঘেরা একটা জায়গা। শফিক প্রতিদিন ভোর ভেলা এই রাস্তা দিয়ে হাটে। নুহাশ বলল, বাবা আম্মু কোথায় আছে? শফিক মুখে কিছু বলল না, তাকে নিয়ে একটা কবরের সামনে দাঁড়ালো। নুহাশ যথেষ্ট বড় হয়েছে তাকে আর কিছু বলতে হয় না। এই ডিসেম্বর মাসেও আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। শফিক দাঁড়িয়েই আছে, নুহাশ ও তার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। তার বাবার দিকে তাকালো। শফিকের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, বৃষ্টির পানির মধ্যেও তার চোখের পানি আলাদা করা যাচ্ছে। নুহাশ নিজেকে সামলাতে পারল না, তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিল। বৃষ্টি থেমে গেছে, তার দুইজন সেখান থেকে নড়ছে না। নুহাশ শীতে কাপতে আরম্ভ করল, তখন শফিক বলল, ঠান্ডা লেগে যাবে, বাবা চল বাসায় যাই।