পোস্টস

বাংলা সাহিত্য

নজরুলের প্রেমপত্র

১ জুন ২০২৪

জিসান আকরাম

মূল লেখক জিসান আকরাম

‘বিদ্রোহী কবি’ কাজী নজরুল ইসলামের প্রধান পরিচয় হলেও তিনি একজন প্রেমিক কবিও বটে। নজরুল সাহিত্যধারায় দ্রোহের পাশাপাশি প্রেমের অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে যে তারুণ্যের জোরে তাঁর শির চির উন্নত-চির দুরন্ত দুর্মদ সেই তারুণ্য বন্ধনহারা ষোড়শী কুমরারীর প্রেমেও উদ্দাম, চঞ্চল মেয়ের ভালবাসায় মুখর।

নজরুল জীবনে প্রেমের প্রথম কলিটি হচ্ছে নার্গিস- যার প্রকৃত নাম সৈয়দা খানম (নজরুল তাকে নাম দেন নার্গিস- সৈয়দা নার্গিস আসার খানম, ফার্সি ভাষায় নার্গিস অর্থ গুল্ম, নার্গিস একটি ফুলের নামও বটে। নার্গিস পুস্তক প্রকাশক আলী আকবর খানের বিধবা বোনের মেয়ে। ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পরিষদে’ থাকাকালীন কলকাতায় ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে আলী আকবরের সাথে পরিচয় ও সখ্যতার সূত্রে নজরুল তার সাথে ১৯২১ সালের মার্চে কুমিল্লা বেড়াতে যাওয়ার সুবাদে নার্গিসের সাথে পরিচয় ও প্রণয়।


কিন্তু কাবিননামা সম্পাদনার সময় কবিকে ঘর জামাই হয়ে থাকতে হবে- কৌশুলী আলী আকবরের জুড়ে দেয়া এমন একটি শর্তে ক্ষেপে গিয়ে কবি বিয়ের রাতেই নার্গিসকে ছেড়ে চলে যান । নার্গিসকে ছেড়ে চলে আসার পর আলী আকবর খান কবিকে ফেরানোর জন্য আর্থিক প্রলোভন দেখানোসহ নানাভাবে চেষ্টা করেন।

এতে নজরুল আরও ক্ষিপ্ত হন। এরপর দীর্ঘ ১৬ বছর নজরুলের সাথে নার্গিসের আর কোন যোগাযোগ হয় নি। ১৯৩৭ সালে নজরুলকে নার্গিস একটা চিঠি লেখেন। চিঠি প্রাপ্তির সময় সেখানে কবি বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। নজরুল তাকেই চিঠি পড়তে বলেন। চিঠি পড়া শেষে শৈলজানন্দ নজরুলকে উত্তর লিখতে বলেন। নজরুল একটি গান লিখে দেন-

‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই/কেন মনে রাখ তারে/ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে।/আমি গান গাহি আপনার দুখে,/তুমি কেন আসি দাড়াও সুমুখে,/আলেয়ার মত ডাকিও না আর/নিশীথ অন্ধকারে….।’

১৯৩৭ সালের ১ জুলাই নজরুল নার্গিসকে আর একটি চিঠি লেখেন। এর প্রায় বছর খানেক আগেই শিয়ালদহতে নার্গিস ও নজরুলের উপস্থিতিতে উভয়ের আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। কিন্তু প্রথম প্রণয়ী নার্গিস কবির অন্তরে দারুণভাবে রেখাপাত করেছিল। তাকে ত্যাগ করার পরে কবি মনে অপরাধবোধ ও বিষাদ ছিল। নার্গিসকে উদ্দেশ্য করে কবি চক্রবাক কাব্যে বেশ কয়েকটি বিরহের কবিতা লিখেছিলেন। নার্গিসকে উদ্দেশ্য করে কবি লিখেছিলেন, ‘হার-মানা-হার’। নার্গিসের কাছে কবির লেখা একটি চিঠি- 



 কল্যাণীয়াসু,

           তোমার পত্র পেয়েছি সেদিন নব বর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে। মেঘ মেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝরছিল। পনের বছর আগে এমনই এক আষাঢ়ে এমনই এক বারিধারায় প্লাবন নেমেছিল– তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পারো। আষাঢ়ের নবমেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার। এই মেঘদূত বিরোহী যক্ষের বাণী বহন করে নিয়ে গিয়েছিল কালিদাসের যুগে, রেবা নদীর তীরে, মালবিকার দেশে, তার প্রিয়ার কাছে। এই মেঘপুঞ্জের আশীর্বাণী আমার জীবনে এনে দেয় চরম বেদনার সঞ্চার। এই আষাঢ় আমায় কল্পনার স্বর্গলোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্ত স্রোতে। যাক, তোমার অনুযোগের অভিযোগের উত্তর দিই। তুমি বিশ্বাস করো, আমি যা লিখছি তা সত্য। লোকের মুখে শোনা কথা দিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা করে থাকো, তাহলে আমায় ভুল বুঝবে- আর তা মিথ্যা।

          তোমার ওপর আমি কোনো ‘জিঘাংসা’ পোষণ করি না –এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কী গভীর ক্ষত, কী অসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি —তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না—আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। তোমার যে কল্যাণরূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার অঞ্জলি দিয়েছিলাম, সে রূপ আজও স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মতো চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে। অন্তরের সে আগুন- বাইরের সে ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি।

        তুমি ভুলে যেও না আমি কবি—আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। অসুন্দর কুৎসিতের সাধনা আমার নয়। আমার আঘাত বর্বরের কাপুরুষের আঘাতের মতো নিষ্ঠুর নয়। আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কী জান বা শুনেছ জানি না) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোনো অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবিও নেই।

          তোমার আজিকার রূপ কী জানি না। আমি জানি তোমার সেই কিশোরী মূর্তিকে, যাকে দেবী মূর্তির মতো আমার হৃদয়বেদীতে অনন্ত প্রেম, অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ করলে না। পাষাণ দেবীর মতোই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদিপাঠ …জীবন ভরে সেখানেই চলেছে আমার পূজা আরতি। আজকার তুমি আমার কাছে মিথ্যা, ব্যর্থ; তাই তাকে পেতে চাইনে। জানিনে হয়তো সে রূপ দেখে বঞ্চিত হব, অধিকতর বেদনা পাব,-তাই তাকে অস্বীকার করেই চলেছি।

         দেখা? না-ই হলো এ ধূলির ধরায়। প্রেমের ফুল এ ধূলিতলে হয়ে যায় ম্লান, দগ্ধ , হতশ্রী। তুমি যদি সত্যিই আমায় ভালোবাস, আমাকে চাও ওখান থেকেই আমাকে পাবে। লাইলি মজনুকে পায়নি, শিরি ফরহাদকে পায়নি, তবু তাদের মতো করে কেউ কারো প্রিয়তমাকে পায়নি। আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরাতন কথা হলেও প্রেম সত্য। আত্মা অবিনশ্বর, আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারে না। প্রেমের সোনার কাঠির স্পর্শ যদি পেয়ে থাকো, তাহলে তোমার মতো ভাগ্যবতী আর কে আছে? তারই মায়াস্পর্শে তোমার সকল কিছু আলোয় আলোময় হয়ে উঠবে। দুঃখ নিয়ে একঘর থেকে অন্য ঘরে গেলেই সেই দুঃখের অবসান হয় না।

      মানুষ ইচ্ছা করলে সাধনা দিয়ে, তপস্যা দিয়ে ভুলকে ফুল রূপে ফুটিয়ে তুলতে পারে। যদি কোনো ভুল করে থাকো জীবনে, এই জীবনেই তাকে সংশোধন করে যেতে হবে; তবেই পাবে আনন্দ মুক্তি; তবেই হবে সর্বদুঃখের অবসান । নিজেকে উন্নত করতে চেষ্টা করো, স্বয়ং বিধাতা তোমার সহায় হবেন। আমি সংসার করছি, তবু চলে গেছি এই সংসারের বাধাকে অতিক্রম করে ঊর্ধ্বলোকে সেখানে গেলে পৃ্থিবীর সকল অপূর্ণতা, সকল অপরাধ ক্ষমা-সুন্দর চোখে পরম মনোহর মূর্তিতে দেখা যায়।

         হঠাৎ মনে পড়ে গেল পনের বছর আগের কথা। তোমার জ্বর হয়েছিল, বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল; তোমার তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজও অনুভব করতে পারি। তুমি কি চেয়ে দেখেছিলে? আমার চোখে ছিল জল, হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা, অন্তরে শ্রী বিধাতার চরণে তোমার আরোগ্য লাভের জন্য করুণ মিনতি। মনে হয় যেন কালকের কথা। মহাকাল যে স্মৃতি মুছে ফেলতে পারল না। কী উদগ্র অতৃপ্তি, কী দুর্দমনীয় প্রেমের জোয়ারই সেদিন এসেছিল। সারাদিন-রাত আমার চোখে ঘুম ছিল না।

           যাক আজ চলেছি জীবনের অস্তমান দিনের শেষে রশ্মি ধরে ভাটার স্রোতে, তোমার ক্ষমতা নেই সে পথ থেকে ফেরানোর। আর তার চেষ্টা করো না। তোমাকে লিখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক। যেখানেই থাকি বিশ্বাস করো আমার অক্ষয় আশীর্বাদ কবচ তোমায় ঘিরে থাকবে। তুমি সুখী হও, শান্তি পাও— এই প্রার্থনা। আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস করো, আমি তত মন্দ নই –এই আমার শেষ কৈফিয়ত।

ইতি

নিত্য শুভার্থী-

নজরুল ইসলাম