ষাটোর্ধ্ব মকবুল মিয়াঁর চুলগুলো প্রায় সব শুভ্র হলেও মুষ্টি পরিমাণ লম্বা দাড়ি গুলো এখনো অনেকটাই কালচে। তাঁর বন্ধুদের অনেকেরই এই বয়সে চুল পড়ে মাথায় টাক ধরে গেছে দাড়ি হয়ে গেছে ধবধবে সাদা কিন্তু মকবুল মিয়াঁর ক্ষেত্রে ভিন্ন। তিনি সংসার জীবনে এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। পুত্র মাওলানা পাশ করেছে সাথে কোরআনে হাফেজও। শহরের বড় একটা মসজিদের ইমাম সে। পুত্রের পরিচয় দিতে মকবুল মিয়াঁ গর্ববোধ করেন কারণ তাঁর চার কুলে কোরআনে হাফেজ কোন আত্মীয় নেই। জমিজামা মোটামুটি যা আছে তাতে চাষাবাদ ও বর্গা দিয়ে ভালো ভাবেই বছর ঘুরে আবার বছর চলে আসে, মাওলানা পুত্রের কাছে তার বড় ধরনের কোন চাহিদা নেই। তবে একটা স্বপ্ন কিংবা আর আশা আছে। মৃত্যুর পর তাঁর সন্তান যেন তাঁর জানাজার ইমামতি করেন। যে পিতার জানাজায় সন্তান ইমামতি করে তাঁর থেকে ভাগ্যবান পিতা আর কেউ হতে পারে না। এ একটা স্বপ্ন লালন করেই একমাত্র পুত্রকে মাওলানা পড়িয়েছেন। মাওলানা পুত্র এখন অন্য সন্তানদের বাবাদের জানাজায় ইমামতি করেন একদিন তাঁর জানাজায়ও ইমামতি করবেন এ স্বপ্ন নিয়েই মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছেন, এরচে’ সুন্দর ও সুখের কামনা আর কী হতে পারে!
মাগরিব নামাজের পর কাচাপাতি দিয়ে এককাপ চা খাওয়াটা মকবুল মিয়াঁর এক প্রকার নেশা, চা খেতে খেতে এশার আগ পর্যন্ত বাজারে রসুলের চায়ের দোকানে আড্ডা চলে।
‘মকবুল খোঁজ খবরা কিছু রাখছ? দেশের কি অইতাছে না অইতাছে।‘ মুখভর্তি পানের পিক ফেলে আলী খাঁ বলল।
দেশের আবার কি অইছে আলী ভাই? মকবুল মিয়া চায়ে চুমুক দিয়ে কৌতূহল দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করল।
শহর থেইকা আমার ছোড পোলায় ফোন দিয়া কইল, আব্বা একটু সাবধানে থাইকেন চায়না থেইকা নাকি কারিনা ভাইরাস না কি আইছে।
পাশেই বসে থাকা কলিমুদ্দি বেপারী বলল, ‘কারিনা না করুণা (করোনা) ভাইরাস, এইডা একটা ছুত রোগ।‘
মকবুল মিয়াঁ চায়ের বাকি অংশটুকু শেষ করে বলল, ‘হ আমার পোলায়ও ফোন দিছিল, এই ভাইরাসের কথা কইল। আসলে দেশে অভিশাপ লাগছে বুঝলা আলী ভাই।‘
চায়নারা মুসলমানগো অনেক অত্যাচার করছে হেই পাপে চায়নাগো পাইছে লগে লগে আমাগোও পাইছে। অইযে কথায় আছে না, “আমার পাপে ঝড় আইছে পাশের বাড়ি কি ছাইড়া দিব নাকি?” এশারের আগ পর্যন্ত তাদের নিয়মিত এ আড্ডা চলে।
দেশে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলছে, মুসলমানদের উপর অত্যাচারের ফল হিসেবে এ গজব এ কথা মকবুল মিয়াঁ মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন। প্রতি ওয়াক্ত নামাজ শেষে তিনি আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করেন তাঁর ছেলেকে হেফাজতে রাখার জন্য। আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেছেন, মকবুল মিয়ার মাওলানা ছেলে হেফাযতেই আছেন কিন্তু মকবুল মিয়াঁর শরীরটা ইদানীং ভাল যাচ্ছে না। সদর হসপিটালে করোনার পরীক্ষা করেছেন ঢাকা থেকে রিপোর্ট আসতে সময় লাগবে।
এই প্রথম মকবুল মিয়াকে মৃত্যুভয় পেয়ে বসল, ভয় মৃত্যুর জন্য না ভয় স্বপ্নভঙ্গের।করোনায় যারা মারা যায় তাদের নাকি তেমন আয়োজন করে জানাজা হয় না, আত্মীয় স্বজন দেখতে আসে না। লাশ সরকার নিয়ে যায় এবং সরকারের পক্ষ থেকেই দাফন করা হয়। এ কথা তিনি হাট বাজারে শুনেছেন।
ওজু করে নফল নামাজ পড়তে বসে পরলেন মকবুল মিয়াঁ, নামাজ শেষে দু হাত তুলে আল্লাহর নিকট কান্নাকাটি করতে লাগলেন। “আল্লাহ আপনি আমার যেভাবে মৃত্যু লিখছেন অইভাবেই হবে এতে আমার কোন আফসোস নাই কিন্তু আমার সারাজীবনের আশা আমার মরার পর আমার ছেলে যেন আমার জানাজা পড়ায় এ একটা কামনাই আপনার কাছে সারাজীবন কইরা আসছি। আল্লাহ যে মৃত্যুতে আত্মীয় স্বজন গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায় এমন মৃত্যু আমাকে দিয়েন না। যে মৃত্যুতে আমার ছেলে আমার জানাজা পড়াতে পারবে না এমন মৃত্যু আমাকে দিয়েন না……”
মকবুল মিয়াঁর বাড়ীর সামনে এম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে, তাঁকে ঢাকায় কোন একটা হসপিটালে আইসিলেশনে রাখা হবে। মকবুল মিয়াঁর খবর পেয়ে তাঁর ছেলে শহর থেকে আসতে আসতে এম্বুলেন্স চলে গেল। বাড়ি এসে বাবাকে দেখতে পেলনা মকবুল মিয়াঁর একমাত্র ছেলে হাফেজ মাওলানা জুবায়ের আহমেদ। তিনি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলেন আল্লাহ যেন তাঁর পিতাকে সুস্থ করে দেন।
মকবুল মিয়াঁ একটা বেডে শুয়ে আছে তাঁর চারিদিক পলিথিন দিয়ে ঘেড়া, সে বুঝতে পারতেছে এ কক্ষে আরো রোগী আছে। সবাই নির্দিষ্ট দূরত্বে। কারো সাথে কথা বললে জোরে জোরে বলতে হয়। মকবুল মিয়াঁ জোরে কথা বলার এত শক্তি পান না। সারাদিন একটা বেডে শুয়ে থাকতে থাকতে আরো অসুস্থ লাগছে তাঁর, এমন একটা রোগ বিঁধেছে কেউ আসতে পারছে না তাঁর সাথে দেখা করতে। অথচ অসুস্থ মানুষের শরীরে ঔষধের চেয়েও বেশী কার্যকর হয় আত্মীয় স্বজন দেখতে আসলে। মনে তখন একটা শক্তি লাগে, আমরা সবাই আপনার পাশে আছি নামক একটা মহৌষধ। মকবুল মিয়াঁর পাশে কেউ নেই এখন, কারো পাশেই কেউ নেই। শরীরটা দুদিন ধরে দূর্বল লাগছে, জ্বরের মাত্রাও কমছে না। তিনি বুঝতে পারছেন হয়তো আল্লাহ তাঁকে কবুল করে নিয়েছেন। একটু পর নার্স আসল।
‘মা আমি যদি মইরা যাই আমার জানাজাটা যেন আমার ছেলে দেয়, আমার ছেলে মেলাবড় মওলানা সাথে হাফেজও। অনেক সুন্দর করে কোরআন তিলওয়াত করে হুনলে কইলজ্বাডা জুড়ায়া যায়। আমার একটাই স্বপ্নগো মা আমার ছেলে আমার জানাজা দিব, তুমি আমারে কথা দেও আমি মইরা গেলে তুমি এই ব্যবস্থাডা কইরা দিবা?”
নার্স মকবুল মিয়াঁর মাথায় হাত রেখে বলল “আচ্ছা।“ আজ কয়েকদিন হয়ে গেল মকবুল মিয়ার মানুষ দেখা হয় না, কোন মানুষের স্পর্শ নেয়া হয় না। নার্স ডাক্তার যারাই তাঁর কাছে আসে সবাই পিপিই না কি যেন পড়ে আসে। চেহারা দেখা যায় না, হাতে সুই দেয় অথচ আঙুলের স্পর্শ লাগে না। মকবুল মিয়াঁর মানুষের স্পর্শ পেতে মন চাচ্ছে, মন চাচ্ছে রসুলের দোকানে কড়া লিকারে এক কাপ চা খাইতে। জুবায়েরের শইলের গন্দ নিতে মন চাইতাছে, পোলাডারে অনেকদিন ধইরা কুচি দিয়া ডইলা গোসল করাই নাই, হেই ছোড বেলায় গোসল করাইছি। এখন বাইত থাকলে পোলাডারে নিজ হাতে গোসল দিতাম, পোলাডার শইলের গন্দ নিতাম। বাপ বেডা এক লগে নামাজ পইড়া পোলাডার মুহে তেলওয়াত শুনতাম। পোলাডা সুরা ইয়াসিন অনেক মধুর কইরা তেলওয়াত করে। মকবুল মিয়াঁর ঘুম পাচ্ছে দুই চোখের পাতা এক হয়ে আসতেছে। ঘুম চোখে সে দেখতেছে তাঁর পাশে হাফেজ মাওলানা জুবায়ের দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর সন্তান, ঔরসজাত সন্তান! জুবায়ের তাঁর বাবার মাথায় হাত দিয়ে সুরা ইয়াসিন পাঠ করতেছে, মুকবুল মিয়াঁ ভাঙা গলায় শুনতেছে সে বলতে চাচ্ছে, ‘এত দূরে কেন কিছুই হুনতে পারতাছি না আমার কানের কাছে আইসা তেলওয়াত কর।‘ দূর থেকেই কানে তেলওয়াতবাজতেছে। মকবুল মিয়াঁর চোখ বেয়ে পানি আসল, তাঁর ছেলের কণ্ঠ। হাফেজ মাওলানা জুবায়ের আহমেদ।
মকবুল মিয়াঁ মারা গেল ফজরের ওয়াক্তে।তাঁর বাড়িতে খবর পৌছাল দুপুর বেলা। লাশ সকাল বেলা সরকারের পক্ষ হতে দাফন করা হয়েছে। মাওলানা জুবায়ের জিজ্ঞেস করলেন, “আমার বাবার কি জানাজা হয়েছে?”
হ্যাঁ। একজন ডাক্তার ও তিনজন দাফন কার্যক্রমে সহযোগিতা করা লোক মিলে জানাজা পড়িয়েছে।
যিনি ইমামতি করেছেন তিনি কি সঠিকভাবে জানাজার নিয়মাবলী জানেন?
ওপাশ থেকে ফোন কেটে গেল। হাফেজ মাওলানা জুবায়ের ওজু করে একটা খোলা মাঠে কেবলামুখি হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন।জীবনে অনেক মৃত মানুষের জানাজা পড়িয়েছি কিন্তু নিজের বাবার জানার ইমামতিটা করতে পারলাম না, আমার থেকে বড় অভাগা আর কে হতে পারে! জানাজায় লাশ সামনে রেখে ইমামতি করতে হয় এটাই নিয়ম। বাবার লাশ কোথায় আছে জানি না। এই ছাপ্পান হাজার বর্গমাইল জুড়েই আমার বাবার লাশ শুয়ে আছে। হাফেজ মাওলানা জুবায়ের আহমেদের বাবার লাশ।
মাওলানা একা একাই নিয়াত বাঁধলেন।আল্লাহ্ আঁকবর।