পোস্টস

গল্প

যে গল্পের কোনো শেষ নেই

৬ মে ২০২৪

এইচ এম নাজমুল আলম

মূল লেখক এইচ এম নাজমুল আলম

পরীবাগ থেকে টিউশন শেষ করে হলে ফিরছিল মতিন। কাটাবন সিগনালে এসে দাঁড়াতে হলো ওকে, রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম, মাথার ওপর তীব্র রোদ। রাস্তা ক্রস করে ওপারে যেতে হবে। পুলিশ বক্সের পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট জ্বালাতে না জ্বালাতেই পিছন থেকে ঘাড়ে হাত দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল কেউ! বিরক্তি নিয়ে তাকায় মতিন। মানুষটা ওর ছেলেবেলার বন্ধু জামিল! 

"কি খবর বন্ধু? সিগারেট ছাড়িস নাই এখনো!"

"আরে জামিল! তোর কি অবস্থা? এইখানে তুই! কত বছর পর তোর সাথে দেখা!"

"মতিঝিল গিয়েছিলাম একটা কাজে, সেখান থেকে আজিজ মার্কেটে একজনের সাথে দেখা করলাম।"

"তুই কি করছিস এখন? ঢাকায় কই থাকিস?"

"পড়াশুনা তো আমারে দিয়া হইল না, একটা বায়িং হাউজে কাজ করি। সেখানকার মালিকের আরেকটা ফার্ম আছে-বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লোন, এলসি খোলা এইগুলা ডিল করে, আমি সেইসব দেখাশোনা করি। আমার অফিস ঝিগাতলায়।"

"তুই তো আর ইন্টারের পর পড়াশুনা করলি না, পড়াশুনাটা চালিয়ে যেতে পারতি।"

"আরে পড়াশুনা করে কি হয়, আমি যে লাইনে আছি সেইখানে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার ডিল হয়, কয়দিন পর আমার আন্ডারেই ভার্সিটির ছেলেমেয়েরা কাজ করবে৷"

মতিন বেশ বিরক্তই হলো, কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করল না।

"দোস্ত, তোর ফোনটা একটু দেয়া যাবে? আমার ফোনের চার্জ শেষ, একটা ক্লায়েন্টের সাথে কথা বলা দরকার, খুব আর্জেন্ট।"

মতিন অতশত না ভেবে তার মোবাইলটা এগিয়ে দেয়। জামিল ফোনটা নিয়ে একটু পাশে সরে গিয়ে কাকে যেন ফোন দেয়। কিছু সময়ের মধ্যেই কথা শেষ করে সে ফোন ফেরত দিয়ে দিল। জামিলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হলের দিকে হাটা শুরু করল মতিন।

হলের ক্যান্টিনে খেতে বসতে না বসতেই মতিনের ফোনে হঠাৎ অপরিচিত একটা নম্বর থেকে ফোন আসে। 

"হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?"

"হ্যালো! কে জামিল?"

"জ্বি না, আপনি রং নম্বরে ফোন করেছেন।"

"না না, এটা তো জামিলেরই নম্বর, আমার সাথে ঘন্টাখানেক আগেই কথা হলো।"

"কোন জামিলের কথা বলছেন আপনি?"

"আপনি কে বলেন তো? আপনি বাটপার জামিলের কে হন? আমি কিন্তু আপনাদের সবকিছু ডিবি পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছি।"

"দেখুন আপনি ভুল করছেন, আমার নাম মতিন, ঢাকা ভার্সিটিতে পড়াশুনা করি, জহুরুল হক হলে থাকি, আপনি আমার ব্যাপারে খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন। কি হয়েছে বলুন তো!"

"ও আচ্ছা, বাবা তুমি ঢাকা ভার্সিটির স্টুডেন্ট? আমিও তো ঢাকা ভার্সিটিতেই পড়াশুনা করেছি৷ আমার মতিঝিলে একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে, দিলকুশাতে অফিস। এই বাটপার জামিল ব্যাংকের লোন পাইয়ে দেবার কথা বলে আমার অফিসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফাইল নিয়ে এখন গড়িমসি করছে। তাকে আমি ফোনে পাই না, ঘন্টা খানেক আগে এই নম্বর থেকে ফোন দিয়ে দেখা করার কথা বলেও আসে নাই। আমার ভাগ্নে একজন ডিবি পুলিশে আছে, ওকে সব জানিয়ে নম্বর ট্রেসিং এ পাঠাব ভাবছিলাম।"

"দেখুন, জামিল নামে আমি একজনকে চিনি, আমার স্কুলের বন্ধু, ওর সাথে রাস্তায় দেখা হয়, তার ফোন নাকি অফ হয়ে গেছে, তাই আমার ফোন দিয়ে কাকে যেন ফোন দেয়৷ আমি এতোটুকুই জানি।"

"আচ্ছা বাবা বুঝতে পেরেছি, কিছু মনে করো না, ওর কাছে আমার প্রতিষ্ঠানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফাইল। সাথে লাখ লাখ টাকার মামলা। আমি তোমার এই নম্বরটা ডিবির কাছে ট্রেসিং এ পাঠালাম। তুমি সত্যি হয়ে থাকলে তো হলোই! আমারও তো একটা নিরাপত্তার ব্যাপার আছে।"

মতিনের মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। একি মহাবিপদে পড়ল সে। যেখানে তার কোন দোষই নাই৷ সে শুধু একজনকে একটা ফোনই করতে দিয়েছিল৷ ফোন বের করে দেখল-জামিল সেই নম্বরে মাত্র ৫৩ সেকেন্ড কথা বলেছিল। মাত্র ৫৩ সেকেন্ডের জন্য সে পুলিশি ঝামেলায় আটকে যাবে! একবার ডিবি পুলিশ তুলে নিয়ে গেলে কোন অপরাধ না করলেও আইনের প্যাচে আটকে যাবে সে!

মতিন খাওয়া শেষ করতে পারল না৷ প্রচন্ড দুশ্চিন্তায় সে রুমে চলে আসল। রুমমেট বড়ভাইকে সব বিস্তারিত খুলে বলল। উনি পরামর্শ দিলেন থানায় একটা জিডি করে রাখতে যেন ডিবি পুলিশ আসলে সে নিজের পক্ষে নিরাপত্তার জন্য কোন ডকুমেন্টস দেখাতে পারে৷ 

মতিন তখনই ছুটল নিউমার্কেট থানায়। নিউমার্কেট থানার একজন এসআই কে সে ঘটনা খুলে বলে। এসআই সাহেব সব শুনেটুনে হাই তুলে বললেন, "দোষ তো আপনার, আপনি ফোন দিছেন ক্যান? যাই হোক দিছেন যখন ভুল একটা করে ফেলছেন, কি আর করার। ঘটনা কোথায় ঘটছে?"

"জ্বি কাটাবন সিগনালে।"

"কাটাবনের কোন সাইডে? রাস্তার এপারে না ওপারে?"

"রাস্তার ওপারে।"

"আপনি তো মিয়া ঝামেলায় ফেলে দিলেন। ঘটনা যা ঘটছে তাতে তো কোন জিডি হয় না। আমি কোন এখতিয়ারে কারে দায়ী করে জিডি নেব? এক কাজ করেন, আপনি তো ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র, শাহবাগ থানায় চলে যান। আপনাদের সব কিছু ওরাই দেখে।"

নিউ মার্কেট থানায় জিডি করতে না পেরে মতিন রিকশা নিয়া সোজা ছুটল শাহবাগ থানায়। সেখানে গিয়ে সে ঘটনা আবারো বিস্তারিত বলল। যিনি জিডি নেয় উনি সব শুনে মতিনকে একটা ধমক দিয়ে বলল,
"দোষ তো আপনার, আপনিই তো এখন ফেঁসে যাবেন, আমরা কি করতে পারি, ডিবি পুলিশের ঝামেলায় আটকাইছেন, এখন ভোগেন।" 

মতিন থতথম খেয়ে গেল। তবে দমে গেল না। সে বলল "দেখুন আমি যদি অপরাধীই হই তবে নিজে থেকে থানায় আসতাম না। আপনাদের ওসি সাহেবের সাথে একটু কথা বলতে চাই।"

জিডি নেয়ার দায়িত্বে থাকা পুলিশ মতিনকে তদন্ত অফিসারের রুমে পাঠাল। তদন্ত অফিসার সব শুনে একটা জিডি লিখতে বলল। জিডি লিখে তদন্ত অফিসারকে দিয়ে মতিন অপেক্ষা করতে থাকে। তদন্ত অফিসার ওসিকে ফোন দিয়ে ঘটনার সারসংক্ষেপ জানায়, ওসি জিডি নিতে নিষেধ করল। বলল, এই সব ব্যাপারে জিডি লাগবে না।

শাহবাগ থানা থেকে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে বের হয়ে টিএসসির দিকে হাটতে থাকে মতিন। তার ফোনে বেশ কয়েকটা নম্বর থেকে ফোন আসতে শুরু করল ইতিমধ্যে। মতিন ফোন রিসিভ করে কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ কথা বলছিল না। টিএসসির কাছাকাছি আসতেই একটা সাদা মাইক্রোবাস বেশ দ্রুত গতিতে মতিনের পাশে এসে হার্ড ব্রেক করে। গাড়ি থেকে চার-পাঁচজন নেমে ওর মুখ চেপে ভিতরে তুলে নিলো। এরপর আর কিছুই মনে নেই তার....

"স্যার! স্যার! ঘুমিয়ে পড়লেন?"

ধড়মড় করে উঠে পড়ল মতিন! সারাদিন ভার্সিটিতে ক্লাস শেষে পরপর দুইটা টিউশনি করে বেশ ক্লান্ত ছিল সে৷ স্টুডেন্টকে লিখতে দিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল!

"আকিব, ঠান্ডা পানি নিয়ে আসো তো।"

মুখে খানিকটা পানি দিয়ে স্টুডেন্টকে পড়া বুঝিয়ে সেদিনের মত বের হয়ে গেল মতিন। হলে ফিরবে সে৷ কাটাবন এসে সিগনালে দাঁড়াতে হলো ওকে, রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম, মাথার ওপর তীব্র রোদ। রাস্তা ক্রস করে ওপারে যেতে হবে। পুলিশ বক্সের পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট জ্বালাতে না জ্বালাতেই পিছন থেকে ঘাড়ে হাত দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল কেউ! বিরক্তি নিয়ে তাকায় মতিন। মানুষটা ওর ছেলেবেলার বন্ধু জামিল!