রাজীবকে নিয়া কী লিখবো? কী কী লিখবো? কী কী লিখবো না! এইটা একটা গবেষণার বিষয় আমার কাছে। তবে লিখতে যে হবে এইটা নিশ্চিত! লেখা ছাড়া যেহেতু মুক্তি নাই, কাজেই লিখতে হবে। সমস্যা হইলো, আমার কাছে গদ্যভাষারা আসতেছে না। রাজীবের স্মরণসভার দিন দুইটা ইউলিজি লিখছি, কিন্তু মঞ্চে গিয়া আর কথা বলতে পারি নাই। এলিজি পইড়া চইলা আসছি।
এখন লিখতে গিয়াও আমার কাছে আসতেছে কবিতার ভাষা। সাহিত্যের মধ্যে এখন আর জরা নিয়া তেমন রিজিডিটি নাই। ফর্ম ভাইঙ্গা যাইতেছে, এমন অনেক লেখা হয় যারা কবিতা না, কিন্তু কবিতার মতনই, মায়াময়, অ্যাবসার্ড। কিন্তু আমার কাছে আসতেছে অন্তমিলওয়ালা, ছন্দের মতন শব্দমালা।
এই যেমন এখন-
শেষতম প্রেমিককে বলি তোর কথা
সরবে প্রচার করি তোর নীরবতা-
চুপ করে কোনদিন থাকিসনি তুই
তুই চুপ- মন চায়, তোর পাশে শুই-
মন চায় মরে যাই, আর কেন বাঁচা!
তুই মরে গেলে এই দুনিয়া তো খাঁচা-
তুই ছিলি লাস্টবেঞ্চ তুই ব্যাকডোর
তবু কলরব করে কবিতারা তোর-
আমাদের বন্ধু হিমু মইরা যাওয়ার পর, আমার কবর সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হইছিলো। ও গেল এপ্রিলে, জুন না জুলাই মাসে জানি, আমি হিমুর একজন প্রেমিকার ( হিমুর মোট তিনজন প্রেমিকাকে আমি চিনতাম। তারা প্রত্যেকেই চমৎকার মানুষ। তাদের সঙ্গে আমার আর যোগাযোগ নাই, তাই নাম বললাম না) সঙ্গে লঞ্চে উইঠা বসলাম, পটুয়াখালী যাবো। হিমুর কবর হইছে বরিশালে, দাদার বাড়ী। পটুয়াখালী থাইকা বেশ খানিকটা দূর বরিশাল। প্ল্যান ছিলো আগে যাবো পটুয়াখালী, হিমুর মা বোনের সঙ্গে একদিন কাটাইয়া বরিশাল যাবো কবরের কাছে। কিন্তু যাওয়ার পর নামলো ঝুম বৃষ্টি। আমরা দুইজন তিন দিন হিমুর বাড়ীতে গড়াইয়া ঘুমাইয়া জামাই আদর খাইয়া চইলা আসলাম। কবর আর দেখা হইল না।
তখন হিমুদের বাড়ীটা নতুন হইছে। আন্টি আজীবন চাকরি কইরা নিজে দাঁড়াইয়া থাইকা বাড়ী করছেন। এত শান্তি শান্তি এই বাড়ীটা! লাল সিমেন্টের মেঝে, পুরানো দিনের বাড়ীর মতন। তার উপরে রাজীব আশরাফ আইসা মাস খানেক ছিলো এই বাড়ীতে। ফলে বাড়ীর সিঁড়িতে বারান্দায় টেরাসের দেওয়ালে মেঝেতে রাজীবের হাতে করা আলপনা আর ছবি। দেখলে মনে হয় হিমুর গায়ে হলুদ হইতেছে, কালকে হিমুর বিয়া!
রাজীব নামের ঠিক কয়টা ছেলেকে আমি চিনি, সেটা গুইনা বলা খুব মুশকিল। এই নামের মানুষদের প্রতি সকল সম্মানসহই বলা যায়, রাজীব নামের ছেলে বাংলাদেশে গিজগিজ করতেছে। কিন্তু রাজীব আশরাফ আসলে একজনই। আমরা যারা রাজীবকে ছোটবেলা থাইকা চিনি, তারা জানতামই রাজীব অনেক প্রতিভাধর। রাজীবের সঙ্গে আমার পরিচয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমরা ব্যাচমেট ছিলাম। জীবনের এই পর্যায়ে আইসা ওইটাকে ছোটবেলাই মনে হয়, স্কুল কলেজ তো দুধভাত, মনেই নাই।
রাজীবের মৃত্যু সংবাদ ছিলো খুব এক্সপেক্টেড, অন্তত আমার কাছে। কাছের আরও দুই একজনের কাছেও। রাজীব যে বড় হইয়া বুড়া হইতে পারলে আর একটা হুমায়ূন আহমেদ হইতো, এই বিষয়ে যেমন কোন সন্দেহই আমার নাই, সেই রকমই ফুসফুস কাইটা জোড়া দেওয়ার ওই অপারেশনে রাজীবের জায়গায় আর কেউ হইলে ওই সময়ই মইরা যাইতো এই বিষয়েও আমি নিশ্চিত।
রাজীবের মেধা যেমন তুখোড়, ওর জীবনীশক্তিও ছিলো ভয়াবহ! ও বাঁচতে ভালোবাসতো। যে ভয়াবহ শারিরীক কষ্ট নিয়া ও হা হা হো হো হি হি কইরা হাসতে পারতো, সেই ক্ষমতাটাকে বলা যায় আসুরিক। ও মইরা যাওয়ার পরে, কিছু লোকজন বলতে চেষ্টা করতেছে যে রাজীব একটা রেকলেস কবিসুলভ জীবন কাটাইয়া, দ্রুত মইরা গিয়া হিরো হইতে চাইছিলো। অনেকে এরকমও শুনতেছে যে, অর্থের অভাবে ওর যথাযথ চিকিৎসা হইতে পারে নাই বা ও কাজ পায় নাই, চাকরি পায় নাই ইত্যাদি।
বলা বাহুল্য নয় যে এইসব তথ্য সত্য নয়।
রাজীবের মতন গুরুত্বপূর্ণ একজন কবি ও শিল্পীর জীবন নিয়া এরকমের আলাপ হইতেই পারে, এইটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সত্যটা হইলো রাজীবের কোন কিছুর অভাব হয় নাই। না কাজ, না সঙ্গ, না অর্থ, না নারী, না নেশা। সম্ভাব্য সকল সাফল্য পাওয়ার যোগ্যতা ও সামর্থ্য ওর ছিলো। রাজীবকে করুণ, দুঃখী, বেচারা ইত্যাদি বলার স্পর্ধা কারো থাকা উচিৎ না।
কিন্তু কিছু বিদ্বেষবাক্য ঠোঁটের ডগায় আইসাই যায়। সানজানা (সিফাত বিনতে ওয়াহিদ) একটা কথা বলে, রাজীব যত লিখছে, যত কাজ করছে, এবং সেইসব কাজ যত সুন্দর হইছে, ওই রকম যদি আর কেউ পারতো, তাদের আর মাটিতে পা পড়তো না।
সানজানার এই কথার সাথে আমি শতভাগ সহমত। রাজীবের মতন নিরহংকার মানুষ হয় না। ও এত ডাউন টু আর্থ, এত বিনয় ওর মধ্যে! এই মানুষটাকে নিয়া যখন কেউ বলে কাজ না কইরা খালি তাফালিং কইরা ও বিখ্যাত হইছে, কিম্বা ওর বন্ধুবান্ধবের শোকের মাতম দেইখা যখন বলে, বন্ধুরা ওকে গ্লোরিফাই করতেছে, তখন আসলে পায়ের রক্ত মাথায় উইঠা যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায়ও থাকে না।
মানুষের রিপু বা শত্রু হইলো ছয়টা। কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য। মাৎসর্য বা পরশ্রীকাতরতা আবেগ হিসেবেও নিম্ন শ্রেণির, রিপু হিসেবেও নিচের দিকের। যারা নিম্নশ্রেণির মানুষ তারা এই নিম্ন শ্রেণির শত্রু দ্বারা আহত থাকে। এনভি বা হিংসা থেকে এরা এই ধরণের কথাবার্তা বলে।
আমার প্রধান রিপু হইলো ক্রোধ। আমি ক্রোধে অন্ধ হইয়া যাইতে যাইতে ভাবি, রাজীবের তো কোন রাগ ছিলো না। ওকে রাগানো খুব কঠিন ছিলো। গত একুশ বছরের পরিচয়ে আমি কখনও ওকে রাগতে দেখি নাই। ঝগড়া করার সময়ও ও রাগ করতো না, ইমোশনাল হয়ে যাইতো। রাজীবের কথা ভাইবা আমি নিজের রাগ কমাইতে চাই। রাজীবের মতন ক্ষমাশীল হইতে চেষ্টা করি। এদের সম্পর্কে বলি, এদের জ্ঞান দাও প্রভু, এদের ক্ষমা করো।
রাজীবের মানবিক দোষগুণ আমরা বন্ধুরা জানি আর সব সময় বলাবলি করি, ও বাঁইচা থাকতেও করতাম, আজীবনই করবো। কিন্তু ওর লেখালেখির শক্তি নিয়া মনযোগ দিয়া আলাপ করাও জরুরি মনে করি। মানুষ যবে থাইকা কবিতা লেখে তবে থাইকাই জীবন,ঈশ্বর, প্রেম, কাম, যৌনতা ইত্যাদি নিয়া কবিতা লেইখা আসতেছে। রাজীবও এর বাইরে না। ওর কবিতায় যৌনতা, প্রেম, কাম মাখামাখি হইয়া থাকে। কিন্তু আমি কব্জি কাইটা ফালামু, যদি কেউ দেখাইতে পারে রাজীব তার কোন লেখায় নারীকে মায়াবিনী কুহকিনী বানাইছে বা নারীদেহকে ব্যবচ্ছেদ কইরা ইরোটিসিজমের নামে, কামের নামে বিদ্বেষ আর তাচ্ছিল্য প্রচার করছে, নারীর দ্বিতীয় মাত্রার অবস্থান ঘোষণা করছে।
জেন্ডার জিনিসটা যে স্ট্যাটিক না, এটা যে একটা লিকুইড জিনিস, এই কথা আমরা তত্ত্বে পড়ি, ইউরোপ আমেরিকার কবি শিল্পীদের পড়ি, শুনি, দেখি যারা আসলে জেন্ডারলেস। আমাদের সময়ে কেউ যদি নিজের যাপনে এর চর্চা কইরা থাকে, সেটা রাজীব আশরাফ। ও নারীও না, পুরুষও না, ও শিল্পী। শিল্পীদের কোন জেন্ডার থাকে না।
রাজীবের ঈশ্বর চিন্তা, রাজনীতি, পুঁজিবাদ, নারী,পুরুষ, প্রেম, কাম,যৌনতা, নেশা, কবিতা, ছবি, সিনেমা,গান এই সমস্ত কিছু নিয়া যে সমস্ত বোঝাপড়া তা দিয়া আমরা বন্ধুরা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত তো বটেই, আমার ছেলের প্রজন্মের বাচ্চারাও রাজীব আশরাফকে জানে। আমার এক বান্ধবীর ছেলে সৌম্যদীপ, আমার ছেলে প্রভুর চেয়ে কিছু বড়, সে তার মাকে বলে, রাজীব আশরাফ তোমার বান্ধবীর এত ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলেন! বান্ধবী বললো, তুমি তাকে কিভাবে চেন? ছেলে রাজীবের লেখা কোন একটা গান দুই লাইন গেয়ে মাকে শুনায় দিলো।
এই জনপ্রিয়তা সস্তা না। পর পর কয়েকটা প্রজন্মের ওপর এমন ব্যাপক প্রভাব রাখা এত সহজ না, এত যেন তেন না। রাজীব বিখ্যাত তার কাজ দিয়া, নিজের পকেটের পয়সায় ঝা চকচক গিমিকবাজি বই বাইর কইরা না, টেকাটুকা দিয়া সহমত ভাই পুইষা না, লোককে দামী মদ খাওয়াইয়াও না। নারীর বুক পাছা তিল ব্রণ পিম্পল ব্ল্যাকহেডস আঁচিল জরুল ইত্যাদি সুড়সুড়ি দিয়াও না। রাজীব একটা কুত্তার মতন কবি আর আর্টিস্ট। ওকে নিয়া গল্প শেষ হবে না। রাজীব তো আছেই, ওকে নিয়া বহুত লেখা যাবে বাঁইচা থাকলে। আপাতত ক্ষ্যামা দেই।