প্রেম ও অন্যান্য
তাহ্মিদ হাসান
১
সকালে তাড়াতাড়ি জাগবার অভ্যাস নেই প্রিয়ন্তির। তবু গত দুদিন ধরে ভোরবেলায় ঘুম ভাঙছে ওর। তিন বছর ওর সূর্যদয় দেখা হয়নি। শেষ দুদিন সকালের আলোতে ওর মনে হয়েছে এতদিন মিছেই এই অসাধারণ মুহূর্ত গুলো কেন যেন ইচ্ছে করেই হারিয়ে যাচ্ছিল। সুন্দর কোমর-পেরনো চুল দিনের প্রথম সূর্য দেখতে পেলেই ঝিকিমিকি হাসে। এই মায়া-সকালে তার প্রবল মনে হয়। নিজের চুল সবচাইতে প্রিয় তার। মনের আনন্দবোধ বা গোপন দুঃখগুলর স্পর্শ হাতের আঙ্গুলে ভরে একটু একটু করে প্রথম সংবাদ দেয় তার চুলগুলোতে। সবসময়ই মনে হয় ঘন চুলগুলো হয়তোবা হবে কোন একটা বিশাল সিন্দুক। যার রহস্য কেউ কোনদিন জানবে না। সে নিজে চেষ্টা করলেও কোনদিন কাউকে কিছু জানাতে পারবে না। আধঘন্টা চুপচাপ বসে চুল এলিয়ে সূর্য রাঙ্গা সকালটা দেখতে তার অপূর্ব লাগছে। সূর্য ছাড়ার আপাতত কোন তাড়া নেই। পুরো দিনটা কাটাতে এমন ঐকান্তিক প্রার্থনা খুব বেশী প্রয়োজন প্রিয়ন্তির।
আজকাল আয়োজন করে নিজের জন্য নতুন অভ্যাস গড়ার চেষ্টা চলছে। রাতে আগে ঘুমিয়ে ভোর সকালে ওঠা। উঠেই সাথে সাথে প্রবল শব্দে গান না বাজানো। বাসার অন্য সদস্যদের সাথে কথা যত কম পারা যায় বলা। নিজের জন্য নাস্তা বানানো এবং বাসা থেকে বের হওয়ার আগে নিজের ডায়েরীতে খুব সুন্দর কিছু লিখে রাখা। অগোচরের ভাবনাটা কিছুদিন আগে তার মাথায় এসেছিল। ভাবনাটা সুন্দর সময়ের কারণেই হয়তবা খুব ভাল লাগে। সমস্ত কাজ শেষ করে প্রিয়ন্তি তার পুরনো ডায়েরী বের করে। পাতা উল্টে শেষ লেখাটার কাছে আসে ।
“ আমি কোনদিন বিয়ে করব না। কোনদিন কাউকে ভালবাসব না। তবে আমি খুব সুন্দর একটা মেয়ের মা হব। সেই মেয়েটাকে আমি কোন ভাল এতিমখানা থেকে দত্তক নেব। কোন ছেলেকে আমি আমার এই মেয়ের কাছে ঘেঁষতে দিব না। ছেলেরা কুৎসিত একটা প্রাণী। যাদেরকে দেখলে আত্নহত্যা করতে ইচ্ছা করে।”
শেষের লাইনটা দেখে প্রিয়ন্তির প্রচন্ড হাসি আসে। নিজের ছোটবেলার এতটা ছেলেমানুষি সে বোধহয় আশা করেনি। মনে মনে এই প্রিয়ন্তি সেই ছোট্ট প্রিয়ন্তিকে খুব আদর করল। কত হবে সেই প্রিয়ন্তির বয়স তখন? বড় জোর, এগার-বার? সে স্মৃতি হাতড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু খুঁজে পায় না যে কার কারনে সেই ছোট্ট হৃদয়ে এত ছটপটানি চলছিল? চেষ্টা করছে খুব মনে করতে, কিন্তু ধুলোর স্মৃতি যেন মনেই পড়বে না। কি আশ্চর্য ! এমন ভয়ংকর দুঃখের কথা আসলেই তার মনে থাকবে না ! এটা ভাল কোন ব্যাপার হল ! বার বছর কি খুব বেশী সময় এত বড় ঘটনা ভোলার জন্য? এখন হঠাত বার বছরের বিগত স্মৃতিগুলোকে ঠুনকো মনে হয়। প্রবল ইচ্ছে করছে ফেলে আসা সেই সময়টায় ফিরে যেতে। যখন সবকিছু খুব সহজ সাধারন ছিল।
সে ডায়েরীতে লিখল, “ ফেলে আসা দুঃসময় আসলে সুসময়, যখন তুমি বার বছর পর জানবে…”
সেলফোনে রিং হচ্ছে। মশি কল করেছে। তার এই বন্ধুটির অভ্যাস ক্লাসের আগে সব বন্ধুদের লাইন ধরে কল দেয়া। যারা যারা ঘুম থেকে উঠতে সবসময় দেরী করে তাদের প্রতি এই বিশেষ দায়িত্বটি সে খুব আগ্রহ সহকারে পালন করে। কোন একজন ক্লাস মিস করলে বেচারার পুরো দিনটা তখন খুব খারাপ যায়। যায় কিনা কেউ জানে না, তবে ভাব দেখে এমনই মনে হয়। প্রিয়ন্তি কল ধরে বলে, “ হ্যাঁ দোস্ত আমি বের হচ্ছি । তুই পৌছায়ছিস ক্লাসে?”
ফোনের অপর প্রান্তে মশি বলছে, “ সকালের ক্লাসটা ক্যান্সেল হইছে। স্যার ছয়টায় নিবে বলসে, তুই ঝাড়া একটা ঘুম দে। আমিও এখন ঘুমাব।”
“ ঘুম থেকে জাগানোর মানুষ বলতেসে, ঘুম দিতে। বাহ্ ! এখন আর ঘুম আসবে বাল্ !”
“ আর কইস না, তিনটারে ঘুম থেইকা উঠায়া এই নিউজ দিছি। হালারা চিল্লায়া…… আমার বিচি পারলে ঐখানেই গালায়া দেয়। কয়, শুয়োরের বাচ্চা সাতসকালে তুই কল দিয়া কস ঘুমাইতে ! হাহা! আচ্ছা দোস্ত এখন রাখি। দুইটায় দেখা হবে। তুমি কি রাতে ঘুমাও না নাকি আজকাল? কল দেয়ার সাথে সাথে রিসিভ কর দেখি? ছ্যাক খাইছ নাকি?”
“ তোমার মুণ্ডু। ডিসিপ্লিনের মধ্যে আসার ট্রাই চলতেসে। সকালে উঠতেও ভাল লাগে আসলে।”
“ এতদিন পর বুঝলা। আচ্ছা, দুইটায় দেখা হচ্ছে তাইলে।”
“ ওকে দোস্ত। সি ইউ।”
প্রিয়ন্তির মনে হল ক্লাসে গেলেই তার জন্য ভাল হত। এখন চাইলেও ঘুম আসবে না। মাত্র সাড়ে সাতটা বাজে। বাসা থেকে ক্লাসে যেতে রিকশায় সময় লাগে বড়জোর পনের মিনিট। একটা পর্যন্ত সে কি করে সময় কাটাবে বুঝতে পারছে না। ফেসবুক, ইন্সটাগ্রামে ঢুকলেই তার মাথা ধরবে। চোখের সামনে ডায়েরীতে লেখা সে দুটো লাইন ভেসে উঠল। তার মনে কথা জমছে আপনাতে, হয়ত গুটি গুটি হরফে অনেক কিছু লিখতে চায়।
২
ক্যাম্পাস রাত আটটার দিকে নিরিবিলি থাকে। কয়েক দল দলছাড়া কপোত-কপোতী এপাশে ওপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রেম করছে। ক্যাম্পাসে রোমান্সের উপযুক্ত সময়। দিনের আলোর মত কোন অযাচিত শকুন দুর্ভাগ্য-লালসা দৃষ্টি দিয়ে এদের প্রেমে বুঁদ হয়ে থাকার সময়টায় এখন হস্তক্ষেপ করবে না। আর করলেই বা কি ! এমন স্বল্প আলোতে থোড়াই চেনা যায় কাউকে। অন্যদিকে কিছু বেচারামুখ নিতান্ত অনীহায় বসে আছে। না, অন্যদের দেখে ঈর্ষান্বিত হবার মত অবস্থা আসলে তাদের না। ক্যাম্পাসের প্রায় নিভুনিভু আলোতে এরা নিজেদের জন্ম-উদ্দেশ্যের হতাশাক্রান্ত দার্শনিক চিন্তাভাবনায় আপাতত বিপর্যস্ত। সেলফোন-ল্যাপ্টপের জ্বালানিতেও তাদের কিছুই হবে না এখন। তাদের মনস্তত্ত্বে এখন সম্পূর্ণ নতুন পৃথিবীর দাবি। পুরোপুরি নতুন ধারণার বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি এবং সম্পূর্ণ নতুন ধারণার বধুবান্ধবের দাবি। বেচারাদের স্বয়ং জানতেও হয়তোবা সম্পূর্ণ অপরিচিত কোন অবয়বের সাহায্য দরকার।
“ দোস্ত, তুই এই খাতাফাতা সব নিয়ে যা। আমি ভার্সিটি ড্রপ করব। কোন খাতারই আর দরকার নাই আমার। শুধু খাতাই ক্যান, কোন বই-শীট কিছুরই দরকার নাই আমার। আব্বু-আম্মুকে বলব আমারে যেন ভুইলা যায়। তাদের মনেই কবর দিয়ে ফেলে।” রুশো, এমনিতে সদাহাস্য আন্তরিক একটা ছেলে। তবে এ মুহূর্তে সে নিজের ব্যক্তিসত্তাকে সে পুরোপুরি অস্বীকার করছে।
“ আর পাঁচ মিনিট দোস্ত। শেষ হয়ে গেছে, মাত্র তিন পেজ আছে। এক কাজ কর, বিশ টাকা নিয়ে যা। চা আর সিগারেট খেয়ে এসেই দেখবি আমার নোট করা শেষ।”
লাইলি, চালচলনে ভাবনাহীন, কিন্তু কিছু বিশেষ সময়ে ভাবনাতীত কঠিন কেউ। বন্ধু রুশোর খাতা থেকে নোট করছে প্রায় এক ঘন্টা যাবত। দুসপ্তাহ পরে মিড টার্ম। সে পারে রুশোকে এমন পৈশাচিক যন্ত্রনা না দিয়ে আগামীকাল বা তার পরের দিন ( ছুটির দিন ) ধীরে সুস্থে নোটগুলো খাতায় টুকে রাখতে। জেনেশুনেই এই কাজ ও করবে না। রুশো পাশে অনেকক্ষণ বসে থাকলে যে তার ভাল লাগে। ছেলেটাকে জ্বালিয়ে মারতেও তার খুব ভাল লাগে।
“ ভাই, আমি পিক তুইলা পাঠাই না ! যা তোর তোলা লাগবে না। পরে দেখে দেখে লিখে ফেলবি। তেরটা ঘন্টা কেউ কাউরে এভাবে পেইন দেয় ! একটু পর মেবি আমি মারাই যাব। এখনই নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হইতেছে। আমি কি পাপ করছিলাম?”
লাইলি নোট করা থামিয়ে বলছে, “ এই আমার আঙ্গুল ব্যথা করতেছে। তুই এক কাজ কর, বাকি দুই পেজ লিখে দে।”
“ বিশ টাকা না দিবি বলছিলি? কই? দে। সিগারেট খেয়ে আসতেছি। তুই চালু শেষ কর।”
“ আমার জন্যও চা নিয়ে আসবি, ধর্। মোট ত্রিশ টাকা দিলাম। একঘণ্টা কামলা খাটা খাইটাও অনেকে ত্রিশ টাকা পায় না। তোর এই জীবন থেকে আর কি চাওয়ার আছে বল্ ?”
“ তোমার অকাল মৃত্যু। লাইলি নামের কোন মেয়েকে আমি আমার লাইফে চাই না। ইনফ্যাক্ট আমি মেক শিউর করব লাইলি নামের কোন কাজের বুয়াও যাতে আমার বাসায় কোনদিন কাজ করতে না পারে। আমি লাইলি নাম ছাড়া একটা সুন্দর এবং আদর্শের পৃথিবী চাই।”
“ ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন কামলাদের চাওয়া না-পাওয়া দিয়ে দুনিয়া চলে না। তোমার লিমিটেশন্স যেনে তারপর অ্যাক্ট করবা, ঠিক আছে? ইউ আর নো প্রিন্স চার্মিং, মফু।”
রুশো ওর শেষ কথাগুলো শুনতে না চেয়ে কানের ফুটোয় আঙ্গুল দেয়। কিছুই শোনে নাই এমন ভান করে টং দোকানের দিকে আগাতে থাকে। লাইলির কথা ধরলে যা মনে হয়, কামলা কেউ চাইলেই সহজে কান বন্ধ করে কিছু পাত্তা না দিয়ে, কোন উদ্ভট কথা সহ্য না করেই সোজা সামনের পথে এগুতে পারে। তবে যত যাই হোক, রুশোর মাঝেমধ্যে লাইলির সঙ্গ ভালই লাগে। সে ভালভাবে জানে লাইলিরও তার সঙ্গ খুব পছন্দ। কিন্তু মেয়েটার নামটা নিয়েই যত আপত্তি । এই নামের কোন মেয়ের সাথে তার কখনও বিশেষ সম্পর্ক হতে পারে এমন সম্ভাবনা মাথায় এলেই তার পানিতে ডুবে মরে যেতে ইচ্ছে করে।
লাইলির নোট করা শেষ হয়েছিল অনেক আগেই। নোটের ভান করে গত দশ মিনিট ধরে সে রুশোর খাতায় বেচারার অলক্ষ্যে পাতা ভর্তি করে হাস্যকর কাণ্ডকারখানা চালাচ্ছিল। দুর্ভাবনার খেয়ালে গত একঘন্টা যাবত রুশো অনেকটা সময় কোন কথা না চালিয়ে আশাহত চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। কোন কারণ নেই এ দৃশ্য কারও খুব হাস্যকর ভাবে নেবার। কিন্ত লাইলি খাতায় আঁকল একটা ছেলে শুয়ে আছে। পড়নের টিশার্টে লেখা ‘রুশো’। তার ওপর ডায়ালগ বক্সে লেখা, “ আমার যদি পাঁচটা বদনা থাকত, জীবন না জানি কতই সুন্দর হইত !” এরপরের কথাগুলো আরও বিভীষিকাময়। সে লাইনের পর লাইন খুব সুন্দর করে গুটি গুটি হরফে লিখেছে,
“ আমি বাবা-মার প্রিয় ছেলে । আসল নাম হাগুখোর হায়দার, হাগু আমার সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য”
“ আমি একজন পীরিতে মশগুল ‘মজনু হাগুখোর’।”
মজনু হাগুখোর লিখলে রুশো আবার অন্যকিছু ভেবে বসতে পারে। লাইলির সাথে মিলিয়ে মজনু আবার আরেকটা বিশেষ ব্যাপার হয়ে যায় কিনা ! সে লাইনটা কেটে দিয়ে লিখল,
“ আমি প্রিয়ন্তির হাগু খেতে চাই। প্রিয়ন্তি আমাকে তার গু খেতে দিলে আমার জন্ম সার্থক।”
বলাই বাহুল্য, কিছুদিন ধরে রুশোর প্রিয়ন্তি ভক্তি দেখে লাইলির গা জ্বলছিল। সুযোগ পেয়ে সে ইচ্ছেমত রাগ ঢালছিল রুশোর খাতায়। যদিও এসব কর্মকান্ড নিতান্তই কোনো ছেলেমানুষও করবে কিনা সন্দেহ।
“ প্রিয়ন্তির গু হীরার চেয়েও দামি।”
এরপর লাইনের পর লাইন ধরে আরও হাস্যকর কথাবার্তা লেখা। সবকিছু লাইলি নিজেও পড়তে চাচ্ছে না। একবার মনে হল পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলে। আবার মনে হল, না হারামি বাসায় যেয়ে পড়ে দেখুক। চেহারাটা তখন দেখাবে রাস্তার নেড়িকুত্তার মত। লাইলির ভাবতেই হাসি পাচ্ছে। নিজেকে হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসের ফানি মেয়েগুলোর মত মনে হচ্ছে তার। কিন্তু বেকুবটা তো একদিনও কিছু বলে না। এমন গা জ্বালানো কর্মকাণ্ড তার সাথে এটাই প্রথম না। লাইলির হঠাত মনটা একটু খারাপ হয়।
“ কিরে তুই একলা একলা কি কারনে হাস্তেছিস?” পেছনে মনিরা আসল কখন লাইলি টের পাইনি। শুধু মনিরা না, সাথে দেখা যাচ্ছে গ্যাং-এর বাকি সদস্যরা মশি, আবির, সামিরা এরাও আছে। যাকে সে এ অবস্থায় একেবারেই আশা করেনি সে প্রিয়ন্তি এক ফাঁকে এসে পড়ে থাকা নোটগুল হাতে নিয়ে লাইলির পাশে বসল।
“ কি খবর মজনুর বিবি?” প্রিয়ন্তি লাইলিকে ‘মজনুর বিবি’ বলে ডাকে।
“ আর্ দোস্ত। নোট করে হাত-আঙ্গুল-কোমর-মাথা সব ব্যথা করতেছে। তুই আজকে আশিস নাই কেন ক্লাসে?”
“ আর বলিস না। ক্লাস ক্যান্সেল করছে না, সকালে কিছুক্ষন ঘুমাইতে চাইলাম পারলাম না, বারটার দিকে পাইছে ঘুম। উঠে দেখি বিকাল হয়ে গেছে। মেজাজটা গেল খারাপ হয়ে। এখন আসলাম তোদের কাছে, কি নোট করতেছিলি তুই? সোশ্যাল ইকোনমিক পলিসিস এরাউন্ড দ্যা ওয়ার্ল্ড, কয় পেজ লিখসে রুশো? রুশোরই তো নোট, না?”
লাইলি এক ফাঁকে দেখে প্রিয়ন্তি হাতে রুশোর নোট নিয়েছে। অন্যদের গ্রিট করতে যেয়ে বেচারি বিপদ আঁচ করতে পারে নাই। একটু পর মনে হল ঝড় অবশ্যম্ভাবী। চিন্তা করল হেঁচকা টান দিয়ে প্রিয়ন্তির হাত থেকে খাতাটা ছিনিয়ে নেয়া উচিত কিনা। কিন্তু বিপদ যা হবার ততক্ষনে হয়ে গেছে। প্রিয়ন্তি পাতা উল্টে শেষ পাতায় লাইলির লেখাগুলো দেখে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে, কিছু বলতে চেয়েও পারছে না। হতবিহবল লাইলি হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলে। মনে মনে বলছে, “ফাক্শীট্। আল্লাহ্ কি হইল এটা !!!!”
৩
অর্নিকা সিগারেট খেতে খেতে ফোনে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিল। তার নিজের রুমে সিগারেট খাওয়া যায়না। রুমমেট নাইমা আপু সিগারেটের গন্ধ একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। তবে হ্যাঁ, বাসায় পার্টি হলে রেইভে তার কোন আপত্তি নাই। আরেকটা সমস্যাও হয়, মন খুলে কথা বলা যায় না সাইফের সাথে। প্রেমের ফিজিক্যাল ব্যাপারগুলোয় কথা বলার সময় আপু তার দিকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে থাকেন, যা খুবই বিরক্তিকর। বেশী রাত হয়ে গেলে সে প্রিয়ন্তির রুমে এসে পড়ে এবং প্রায়দিন তার সাথেই ঘুমায়। আজ অন্য কথা। প্রিয়ন্তির মন মেজাজের হিসাবকিতাব সে কিছুই মেলাতে পারছে না। বেশ নিয়ন্ত্রিত থাকে এবং থাকতে পারে প্রিয়ন্তি। সবচাইতে জঘন্য ব্যাপারগুল এ মেয়েটা খুব সহজে ডিল করে এসছে সবসময়। অথচ আজ বাসায় আসল মুখে আগুন নিয়ে। স্বাভাবিক কথা বলার সময়ও গলা চড়ে যাচ্ছিল, যা পুরোপুরি ওর স্বভাববিরুদ্ধ। অর্নিকা ভাবছিল ফোন রেখে প্রিয়ন্তির কি হয়েছে জেনে আসতে। বান্ধবীর মতিগতি কোনভাবেই ভাল ঠেকছে না ওর কাছে। মেয়েটা এখন আবার বাথ্রুমে খুব শব্দ করে হাসছে। এমন সে হাসি যার থামার কোন লক্ষনই নাই। প্রচন্ড শোকে অথবা শকে মানুষ এভাবে হাসতে পারে।
অর্নিকা ফোনে সাইফকে জিজ্ঞেশ করল, “ আচ্ছা আমি কি ফানি কিছু বলছি?”
ফোনের অপর পাশ থেকে সাইফ বলে, “কোনটা?”
“ তোমার সাথে এতক্ষন কথা বলার সময়? ফানি কিছু কি বলছি? মনে পড়ে?”
“ তুমি কি গাঞ্জা খাইছ? কি জিগাও এসব হঠাত ? আর হইছে কি? এত্ত হাসে কে?”
“ প্রিয়ন্তি হাস্তেছে। বুঝলাম না কিছু। ক্যাম্পাস থেকে বাসায় এসে ধুমধাম করে দরজা টরজা বন্ধ করল, রাইসার নরমাল একটা কথায় শাউট করে একাকার অবস্থা, এখন দেখি বাথ্রুমের মধ্যে রীতিমত অট্টহাসি দিতেছে।”
“ তাইলে ও গাঞ্জা খাইছে মনে হয়। আর ওর ইচ্ছা ও হাস্তেছে, তুমি ফিসফিস করতছ ক্যান। জোরে কথা বল।”
“ আরে কি আজব ! এতক্ষন ধরে কেউ ক্যামনে হাসে। দশ মিনিট ধরে নন্সটপ হাসতেছে।”
“ তো আমি কি করব? আমারে ক্যান বলতছ ? টপিক চেঞ্জ কর নাইলে নিজের রুমে যেয়ে কথা বল। আজাইরা নুইসেন্স। ”
অর্নিকা তার বান্ধবীকে নিয়ে একটু বেশিই বোধহয় চিন্তিত। সাইফের কথায় তার কোন সায় নেই। সে বাথ্রুমের দরজায় নক করে জিজ্ঞেশ করছে প্রিয়ন্তিকে, “ কিরে তুই ঠিক আছিস? পাগলের মত হাসতেছিস ক্যান?”
ভেতর থেকে প্রিয়ন্তি বলল, “ হাগু দেখে। তুই দেখবি?”
অর্নিকা শুনেও মনে হয় শুনল না। ফের জিজ্ঞেশ করল, “ কি দেখে?”
“ আমার গু দেখে।” কথাটা এত জোরে বলে প্রিয়ন্তি, অর্নিকা বিষম খায়।
ওদিকে সাইফ জিজ্ঞেশ করছে, “ কি দেখে হাসে?”
অর্নিকা মন খারাপের মত করে বলে, “বুঝলাম না। বলতেছে, আমার গু দেখে ।”
“ মানে, তুমি কি হেগে পেইন্টিং করে আসছ নাকি ওর বাথ্রুমে ?”
“ আরে আমার গু কেন হবে ! আমি হাগব কেন ওর বাথ্রুমে ? কি আজিব ! ও ওর নিজের গু দেখে হাসতেছে। বুঝলাম না কিসু।”
“ নিজের গু আজকেই প্রথম দেখল নাকি ? নাকি পায়খানার কালারে কিছু হইছে?”
“ আমিতো কিছুই বুঝতেছি না। রাতে আমাকে এই মেয়ে কবিতা শোনায়ে ঘুম পাড়ায়, বাসায় আসার সময় আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসে, আজকে যেটা আনে নাই। এখন এগুলা কি করতেছে, ক্যাম্পাসে কিছু হইছে শিওর। আমি তোমাকে পরে কল দেই, শুন এখনও হাসতেছে।”
“ হাগতেছে? এতক্ষন ধরে কি হাগে?”
“ আরে বাবা, হাস্তেছে ! হাস্তেছে ! আমি পরে কল দিচ্ছি। বাই।”
“ আমি বুঝলাম না, ওর হাগু ও হাগবে। তুমি আর আমি ক্যান ঝগড়া করব ! অন্যের হাগুর কারনে কল কেন কাটব?” সাইফ রসিকতা করছে।
“ তুমি কি ফাইযলামি করতছ সাইফ? আমি বারবার বলতেছি হাস্তেছে হাস্তেছে, হাগতেছে বলি নাই একবারও। তুমি ছ্যাঁচড়া ফাইযলামি গুলা না করলে শান্তি পাওনা, না?”
“ মেয়েদের হাগুর ব্যাপারটা একটু ডিফরেন্ট। এই কারণে, ইভেন পাদ ও একটু অন্য লেভেলের হাসির ম্যাটার।”
“ আমার এসব ছ্যাঁচড়া ডিবেটে যাওয়ার কোন ইচ্ছা নাই। একটা পারসোনালিটি রাখ, ঠিক আছে !” বলেই অর্নিকা লাইনটা কেটে দেয়। সে প্রিয়ন্তির বেডে বসে ভাবছে ঘটনা কি !
বাথরুম থেকে বের হওয়া প্রিয়ন্তির মুখ লাল-লাল। হাসতে হাসতে তার অবস্থা কাহিল। ক্যাম্পাসে লাইলির ফাইজলামি সে একদমই নিতে পারে নাই। বাসায় নির্ধারিত সময়ে বাথ্রুম পাওয়ার পর গোটা ব্যাপারটা ঘুরে আবার তার মাথায় আসে। দিনটাকে তখন সে রীতিমত অভিশাপ দিচ্ছে । কিন্তু এমন তো আর হতে পারে না, এসব ব্যাপারে মন খারাপ করে সে চিরতরে বাথ্রুমে যাওয়াই বন্ধ করে দেবে ! প্রকৃতির অবধারিত নিয়ম সহ্য না হলেও যে মানতেই হয়। পরিস্থিতি তখনও বেশ আবেগি। একটু পর, সশব্দে হাস্যকর টুকরোগুলো একেকটা নিম্নচাপে গুরু আকৃতি নিয়ে বের হয় আর তাতেই স্থিতি আস্তে-আস্তে হাসতে-হাসতে পুরো বিপরীতে। কে না জানে অবচেতনার এক প্রকারের পরিপূর্ণ লীলাভূমি হচ্ছে বাথরুম অথবা টয়লেট। সেখানে আপাত প্রসূত হাস্যরস অবচেতন থেকে পূর্ণ চেতনায় নিখাদ গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল। জীবনগত দৃষ্টিভঙ্গির বিবেচনায় প্রিয়ন্তিকে পাগল ভাবার তাই কারও কোন কারণ নাই। এমন অবস্থা চিন্তা করলে কারও পাগলপন্ন হাসি আসলে খুবই স্বাভাবিক।
“ তোর হইছে কি আজকে? পাগলের মত কাজ করতেছিস খালি ! ক্যাম্পাসে কিছু হইছে ?” অর্নিকার তটস্থ জিজ্ঞাসা।
“ এখন বলতে পারব না, প্লিজ। আমার অবস্থার বারটা বেজে গেছে। ঘুমানোর সময় বলব।”
“ কাহিনী কি?”
প্রিয়ন্তির কথা বলার শক্তি দরকার। বোতল খুঁজে সে ঢকঢক করে পানি গিলছে ।
রাত বাড়ে দুজনের গল্পের খোরাক ফুরায় না। কারণ এর মাঝে দুটো ঘটনা ঘটে । রুশো সদ্য জন্ম নেয়া ছাগলের মত তার ফেবু আইডি ডিএক্টিভেট করে। ডিএক্টিভেশনের আগে তার শেষ স্ট্যাটাস ছিল, “ আমি কারও বান্ধা ছাগল না, এনিওয়ে বন্ধুরা আবার দেখা হবে কিনা বলতে পারি না !” মরার উপর খাঁড়ার ঘার মত লাইলি সে স্ট্যাটাসে কমেন্ট করে, “দিনশেষে ছাগলের আস্তানা মুনিবের খোয়ারেই।”
এরপর ফোন মারফত লাইলির প্রিয়ন্তির কছে পুরো ঘটনার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা এবং সরাসরি বোল্ড স্বীকারোক্তি, “ আমি রুশোকে অসম্ভব পছন্দ করি আর ওরে জ্বালাইতে তার চেয়েও বেশী। বাট, আই হেইট টু কনফেস, দ্যাট আই আকচ্যুলি লাভ হিম।”
শুধু প্রিয়ন্তি কি তাদের কেউই কখনও খেয়াল করেনি লাইলির রুশোর প্রতি কোন দুর্বলতা রয়েছে। লাইলি আপাদমস্তক হাস্যকর একটা মানুষ। কেউই তাকে সিরিয়াসলি নেয় না। অর্নিকার ধারণা দুদিন পর ঠিকই এ মেয়ে অন্য কোন কথা বলবে। বেচারা রুশোর অবস্থা হবে তখন আরও খারাপ। প্রিয়ন্তির অবশ্য তা মনে হয় না। লাইলি হয়ত তার প্রিয় বন্ধু না, কিন্তু হিউমার সমৃদ্ধ মানুষ তার ভাল লাগে।
“ ইনফ্যাক্ট রুশোর জন্য লাইলি ইয দি বেস্ট চয়েস্। Though we don’t have to decide, আমার এমন হাস্যকর ভাবে এসব চিন্তাও আস্তেছে আবার ! এইরকম উদ্ভট কন্সিকোয়েন্সেসের পর! দোস্ত,we really need to stop thinking. like we seriously need to stop feeding shits to our brain.” প্রিয়ন্তি সিগারেট অর্ধেক টেনে অর্নিকাকে দিল। ফোন ঘেঁটে এ সমস্যা থেকে দূরে থাকার জন্য নতুন বিষয় হয়তবা খুঁজছে।
“ Yeah, dost. Maybe we should also stop living.” অর্নিকা হাসতে হাসতে বলল।
“ Living gives us laughing-out-loud moments, by the way. Maybe we should see the brighter side.”
“ After all this ! তুই এইভাবে সারভাইভও করতে চাস?” অর্নিকার টিটকারি।
“সিমস্ রিয়েল টাফ্ দো। ভাবতেছি রাজশাহি যেয়ে আব্বু-আম্মুকে দেখে আসব নাইলে এখানে আসতে বলব। তাদের জানা উচিত তাদের মেয়ে কেমনে সারভাইভ করতেছে।”
“ ওহ্ গড। স্টপ শিটিং, ইটস গেটিং হেভি অন ইউ। এত পারসনাল্যি কেন নিতেছিস? তুই জানিস যে তুই আছস একটা জায়গায়।”
“ আছস মানে? মাল বল মাল ! আমি যখন চুল পিঠ থেকে সরাই একটা লুক দেই, পোলাপানের বস্তু গরম হয়ে যায় সাথে সাথে।”
“ পোলাপান তোমার পাছা চেক আউট করে বেশী। আর আজকের পর তো আরও বেশী বেশী করবে।”
“ ও দোস্ত ! নট এগেইন ! প্লিজ !”
“ আসলেই তো ! এইটা কি মনে হইল ! ” অর্নিকার উচ্ছাস দেখে মনে হবে কেউ মাত্রই বোধহয় তার জন্য কোন গোল্ডমাইনে ডিগ করল।
“ সবাই এখন থেকে ডিফ্রেন্ট দৃষ্টিকোণ থেকে তোর পাছা দেখবে। লাইলি খাসরা স্যরি না বললে তুই হ্যারাস্মেন্টের জন্য লিগ্যাল একশন নিতে পারতি।”
প্রিয়ন্তির চোখে-মুখে মিনতি। বোঝাতে চায়, আর না ! আর না প্লিজ !
“ পুরা একটা ভরা রাত গেল আমার গু আর আমার পাছা নিয়ে। এত লাইফ্লেস ক্যান সবাই? এই দুই জিনিশ কি পৃথিবীর আর কারও নাই, নাকি আল্লাহ্ খালি আমারেই দিছে?”
“ এই ভরা বেদনা নিয়ে হয়ে যাক একটা কবিতা। ” কেউ কিছুতে মজা পেয়ে গেলে সেই বিষয়টা আর ছাড়তে পারে না। ঠিক যেমন অর্নিকাও পারছে না। সিগারেটটা এশট্রেতে ফেলে সে বান্ধবী মুখের কাছে নিরেট আগ্রহী শ্রোতার মত পুরো মনোযোগে কবিতার অপেক্ষা করছে।
বান্ধবী “ ধুর্ বাল্” বলে, ল্যাম্প অফ করে, সেলফোন বালিশের তলায় ঢুকিয়ে, ব্ল্যাঙ্কেট চাপিয়ে জোর ঘুমানোর প্রতিজ্ঞা করল। অর্নিকা এরপর আর বেচারিকে ঘাটাল না। তবে মিটিমিটি হাসির শব্দ আড়াল করার চেষ্টা চলছে তার।
বিশ মিনিট পর।
রাত পেরিয়ে ভোর হবে হবে ভাব। ঘড়িতে বাজে ৪ঃ০৯। কেউই ঘুমায়নি। প্রিয়ন্তি কিছুক্ষণ ঘুমানোর ভাব ধরে এখন ডেটিং এপ ঘাঁটছে, অর্নিকাও ফোন হাতাচ্ছে। তবে তার মাথা আসলে অন্য পায়তারা আঁটছিল।
“ হ্যালো, রুশো। আজকে হইছে কি বিষয়টা আমাকে একটু এক্সপ্লেইন করবা?”
প্রিয়ন্তি চমকে পাশ ফেরে, অর্নিকা ব্লাফ মারছে নিশ্চিত জানা সত্ত্বেও। বিরক্ত হয়ে মাত্রই বলবে কি, অর্নিকা তার মুখ চেপে ধরে ফোন লাউডস্পিকারে দেয়।
“ জি স্লামালাইকুম। কে বলছেন?”
“ আর কে বলবে? মানে কি? ওয়েইট ! আমার নাম্বার নাই তোমার কাছে? আর আজকে কান্ডটা কি করছ এইটা বলতো?”
“ কে প্রিয়ন্তি? তুমি ঘুমাও নাই এখনও? Listen, I’m really sorry about everything. Please do believe that I absolutely had no idea what just happened back then.”
প্রিয়ন্তি পারছে না খুন করে অর্নিকার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিতে। অর্নিকা মাউথ স্পিকার ঢেকে প্রিয়ন্তিকে খুঁচিয়ে বলছে “ আরে, দেখ্ না! মজাটা ।”
প্রিয়ন্তির অন্তিম চোখ রাঙ্গানি। শীতল দৃষ্টি দিয়ে বোঝানোর শেষ চেষ্টা, এসবের কোন দরকার নাই। কিন্তু কে শোনে কার কথা !
“ হ্যালো প্রিয়ন্তি, You there? Are you feeling okay?” রুশো ভাবছে প্রিয়ন্তির হয়ত এখনও মন খারাপ।
“ তুমি আইডি কেন ডিএক্টিভেট করলা ? আবার শেষে ছাগলের মত কি একটা স্ট্যাটাসও দিলা । মানে তোমার মাথার ভেতরে চলতেছেটা কি ভাই ?”
“ I don know. Maybe I’m worried about you। তখন সবাই খুব বিশ্রীভাবে হাস্তেছিল। আমি কিছুই করি নাই, তারপরও আমার উচিত ছিল মেবি তোমার হয়ে স্ট্যান্ড নেয়া, তোমাকে সেভ করা ঐ ইন্সিডেন্টটা থেকে । মানে লজ্জাও লাগতেছে, আবার আজবও লাগতেছে। মানে, কি একটা weird ব্যাপার। কিছুদিন হইছে আমরা ভার্সিটিতে ঢুকলাম। এরকম যদি সামনে আরও হয়, তাইলে তো ঝামেলা... ”
কথাটায় প্রিয়ন্তি ভীষণ অফেন্ডেড হয়। সাথে অর্নিকার হাসিতে ঝালের মাত্রা বেড়ে পুরো আকাশে পৌছয়। তার পিত্তি জ্বলছেই না শুধু, রীতিমত পুড়ছে । হাসির দমকে অর্নিকার হাত ফসকে আচমকা ফোনের হাতবদল হয়।
“ মানে? কি হাস্যকর কথা? সব তোমার মত ছাগল হইলেও আমি তো আর না। আর আমারে সেভ করার তুমি কে? আর সেভ করার মত ব্যাপারটাই বা কি? তুমি আমার গু খাইতে চাও, এমন কথায় তো তোমার খারাপ ফিল করার কথা ! কোথায় তুমি অফেন্ডেড হবা তা না! এই তুমি কি ইনসাল্টই ফিল কর না নাকি? নাকি তুমি চাও, তুমি আমার গু খাবা এটার জন্য আমার ইন্সাল্ট ফিল করা উচিত। মানে সোজা অর্থ এটা যে আমার গু খাইতে পারলে তুমি ধন্য হও, আর তোমার মত রামছাগল যে কিছু বুঝে না তারে আমি গু খাওয়াইলে আমি হই ইন্সাল্টেড !!” একনাগাড়ে ঝালের তিব্রতায় বমি যাকে বলে। নিয়ন্ত্রনের কোন তোয়াক্কাই করল না প্রিয়ন্তি । পাশে অর্নিকা হাসতে হাসতে খাবি খাচ্ছে।
“ প্রিয়ন্তি আই নো যে তুমি একটু আপ্সেট, বাট আমার জন্য কি একটু হার্শ হয়ে যাচ্ছে না কথাগুলা। আর হঠাত এমন শিফ্ট হয়ে গেলা কেন? প্রথমে তো খুব সুন্দর সফট্লি আস্ক করতেছিলা, আইডি ক্যান ডিএক্টিভেট করছি, মানে I was supposed to be glad you know…. ”
“ দোস্ত ছাগল না একটা !” প্রিয়ন্তি হোপ্লেস। বান্ধবীর প্রতি ক্লেশ দৃষ্টিতে যেখানে পুর্ভানুভিত অনুভূতি নাই। স্বয়ং পরিবেশ ও মানছে না অপরপ্রান্তের আপত্তি। দন্তবিকাশে মুখরিত হাসির মূর্ছনায় ক্লান্ত বিধ্বস্ত তরুণীটির শরীর তৎক্ষণাৎ ক্ষুদ্র শক্তিটুকুও যে যোগাতে পারছে না। মুখের ওপর বালিশ চাপিয়ে এক্তারের পরিবেশ প্রবাহিত হচ্ছে আরেক প্রকৃতির সুরে। শব্দ কারিগররা খুব খেটে যার নামকরণ করেছে “ জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরযুক্ত”। পরিপূর্ণ বিশেষনের জন্য ব্যাকরণ-গত উদাহরণ হতে পারে, “ উচিত অট্টহাসিতে আপাত অপারগ-তায় উদাসী যে জন।”
যত ঝড়ই হোক রুশো তখনও ভাবছে । অনেক কিছুই ভাবছে আর তার প্রবল হতাশাও জানাচ্ছে।
“ আর আমার তো মেইনলি খারাপ লাগছে, তুমি উঠে চলে যাওয়ার পর। সবাই ইলজোকিং করতেসিল, এবাউট ইওর দ্যাট এন হোয়াট নট। People could be so disgusting at times…”
“ Yeah, I know. Do I need to give a shit about that? I guess not. So better, তুমিও অফ যাও । কিছুই মাথায় রাখার দরকার নাই। But it’s good that you care. So….”
“ It’s not that I only cared about you, I mean I’m concerned about anyone involved with such shits you know. Sorry, I said shit …. Sorry Priyonti…”
“ Dude, you better say sorry to yourself….”
“ Yeah, I mean sorry me… But I guess I don't deserve this shit, right! People can give me better reactions…..”
“ You know, Russho. You’re a sweet person. I’m sorry আমি actually রাগে বলছি কথাগুলা। It wasn’t my intention to hurt anyone. Maybe we’re alike. We don’t want to hurt anyone…”
“ Sweet thing. Spreading sweetness.”
“ Yeah, we should… The world is so bitter. But you know, অনেক কথা বলে ফেলছি আজকে। এন আজাইরা অনেক প্যারাও নিছি। সো এখন বেটার রাখি। ক্যাম্পাসে তো দেখা হবেই। আর আইডি একটিভেট কর এন্ড ট্রাই টু বি মোর ম্যাচিউর। উদ্ভট কোন স্ট্যাটাস দিয়ে বেইজ্জত হইও না। You really have this in you. You know, a very likeable personality. ”
“ Yeah, guess It’s likeable but empty. বাট শুধু ক্যাম্পাসেই কেন প্রিয়ন্তি? আমরা চাইলে বাইরেও তো মিট করতে পারি! ”
“ What do you mean?”
“ Uhh, Nothing, Good Night. মাথায় থাকবে তোমার এডভাইস। Thanks for calling Priyonti.”
“ Good Night, sweet dreams..”
অর্নিকা প্রিয়ন্তির দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে।
“ What was that?” প্রিয়ন্তির কাছে কিছুটা বিস্ময়ে প্রশ্ন তার।
“ কোনটা?” প্রিয়ন্তির চোখে রহস্যের ভান ? হয়তোবা !
“ Do you like this Gadha Russho?”
“ I like everyone dost. It’s been a while. এখন ঘুমাও।”
কে জানে কার মনে কার ঘুড়ি ওড়ে? অর্নিকা হাই তুলতে তুলতে বলে, “ তুই কি এখন ডেটিং এপে রুশোরে খুঁজবি?”
“ খোঁজার কি দরকার? ও তো চোখের সামনেই থাকে।”
“ বাহ্। ফিলের কথা কিন্তু।”
“ বাল ! বাথরুম চাপ্ছে আবার।”
“ হাহা”
“হাহা”
শেষ হবে কি এই কাহন? এই মেয়ে দুটোর কথা টানার অভ্যাস বেশ পুরনো যদিও। বোধহয় তারা আজকে আর ঘুমোচ্ছে না। প্রিয়ন্তি অর্নিকাকে বলছে, “ একটু পর সূর্য উঠবে, হাঁটতে বের হবি? চা-টাও খাইলাম?”
৪
“ আমি পিক করতে আসছি। তুমি রেডি তো?”
“ না।”
“ কেন?”
রিপ্লাই নেই। দশ মিনিট ধরে রিপ্লাই না দেয়ার অর্থ কি ? আহ্নাফ জানে না। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে অন্য কোন কাজ করা যায় না। সে জানে প্রিয়ন্তি কিছুক্ষণ পর কল করে আসতে বলবে। কি করা যায় আপাতত? গাড়ি সাইড করে সিগারেট ধরানো যায়। আজ রবিবার। ছুটির দিন। সাপ্তাহিক স্বাধীনতার শেষ দিন। পরের পাঁচ দিন সাতটা-আট্টার আগে সময় পাওয়া যাবে না। ডেট করার জন্য এক-দু ঘন্টা সময় যথেষ্ট না আসলে। জবে ঢোকার পর থেকে সময় আলোর গতিতে এগোচ্ছে। সুন্দর আকাঙ্ক্ষিত ঘন্টা-সময় নিমিষে হয়ে যাচ্ছে পাঁচ মিনিট। সিগারেট টানছে আর ভাবছে আহ্নাফ। মেয়েটাকে এভাবে সময় নষ্ট করতে দেয়া তার সাথে যায় কিনা। প্রিয়ন্তির টেক্সট এসেছে। আহ্নাফের হাসি পেল প্রশ্নের ধরন দেখে। তার কাছে প্রিয়ন্তি জানতে চায়, “ তুমি কি করবা আজকে?” । ইঙ্গিতে অন্য কিছু জানতে চাওয়া। গত কয়েক ডেটের ভাব-প্রবাহে এই কথাটায় অন্য ইঙ্গিতই বহন করছে সম্ভবত।
“ কে জানে কি করব? ডিসাইড করা কি খুব ইম্পরট্যান্ট? আমিতো তোমাকে কিছু আস্ক করি নাই। ”
চটপটে উত্তর। যা হবার তা হলে এমনিতেই হবে। প্রিডিসিশনে তার এলারজি আছে এককথায়।
“ বাইক নিয়ে আস। আমি kecupbob এ। ”
এই মেয়ে কি খ্যাত নাকি? মনে মনে ভাবছে আহ্নাফ। গাড়িতে চড়তে পছন্দ করে না এমন মেয়ে আছে ! অফিসে যাওয়ার জন্য বাইক ইউজ করতে হয় তার। এখন গাড়ি বাসায় দিয়ে আবার বাইক বের করতে যাবে কে? তার বাসা এখান থেকে তিন মাইল দূরে, ধানমন্ডিতে। আচ্ছা, সে গাধার মতো এভাবে ভাবছে কেন? প্রিয়ন্তি তো আর জানে না সে কি নিয়ে বের হবে। এখন কল করলে কি না কি সমস্যা হবে বলল। টেক্সট লেখা তার জন্য খুব বিরক্তিকর। একটানা টেক্সট লিখলে তার মাথা ধরে। বিরক্তি কমাতে জিজ্ঞেশ করল। “ কল করা যাবে?”
প্রিয়ন্তি রিপ্লাই দেয়, “কেন? কি সমস্যা?”
আরে আজব ব্যাপার ! সোজাসুজি বলা যায় না কি হ্যাঁ অথবা না ! শুধুশুধু পেঁচানো।
“ আমি আজকে গাড়ি নিয়ে বের হইছি, এইজন্য। আর আমার গাড়িতে টিন্টেড গ্লাস। সো তুমি সেফ্। কেউ তোমার চেহারা দেখবে না।”
“ আমি গাড়িতে কি করব যে কেউ আমার ফেইস দেখলে প্রবলেম হবে?”
আহ্নাফের ভ্রূ কুঁচকে গেছে। ডেট মাস্টার বাবাজীরা বলেছেন মেয়েদের ব্যাপারে অসীম ধৈর্য ধরতে। এরা বোকা ধাঁধাঁয় ছেলেদের বেঁধে রাখতে পছন্দ করে। ধৈর্যশীল মুরুব্বীদের মত সে পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করে, “ আমি অলরেডি বনানীতে। এখন গাড়ি নিয়ে বাসায় ব্যাক করা পসিবল না। তুমি তো ডাম্ব না প্রিয়ন্তি। এটা কি বুঝলা তুমি?”
মেয়েটার ওপর নিয়ন্ত্রন নেয়ার সুক্ষ চেষ্টা করছে আহ্নাফ। বাট্হারট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এমন কথাগুলো সে যুক্তি দিয়ে ঠিক জায়গামত ছেড়ে দেয়। চালাক কেউ হলে বুঝে ফেলার কথা সে কিভাবে কি চাচ্ছে। প্রিয়ন্তি চালাক কোন সন্দেহ নাই। প্রিয়ন্তি কেন সব মেয়েদেরই তার চালাক মনে হয়। আবার এরা একই সাথে খুব ভীষণ রকমের বোকাও। সুযোগ বুঝে তাদের সেটা মনে করিয়ে দিলে তারা তখন সাজানো জালে আস্তে আস্তে আটকে পড়ে।
আহ্নাফ ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। কোন টেক্সট আসছে না। সে জানে তার আপাত চালাকির জন্য হয়ত এখন ক্ষমা চাইতে হবে। তার হঠাত মনে হল, কেন সে অন্য কোন ধারায় কমিটেড না। হাতে অপশন থাকলে এত মাইন্ড গেমের নিশ্চয়ই দরকার ছিল না। যাই হোক, তার মাথায় হঠাত আরেকটা বুদ্ধি আসে। স্যরি সরাসরি বলা হচ্ছে না, তবে তাতে সম্মান রক্ষা হয়। সে লিখল,
“ প্রিয়ন্তি, I didn’t want to reveal it for you. আসলে I bought a flower bouquet. I thought for a simple surprise, that’s why & my ride’s been turning hypersomniac. So, all this sweet-smells been waiting for her owner. Is it worth a miss ?”
আহ্নাফের এখন বনানীতে bouquet খুঁজতে হবে। সে গুগলে সার্চ করছে। এরমাঝে প্রিয়ন্তি আরেকটা উদ্ভট রিপ্লাই দেয়।
“ বাইকে It could’ve been looked much more prettier & romantic (Disappointed face). Don’t you think?”
হাতে সময় কম আহ্নাফ bouquet কেনার জন্য গাড়ি স্টার্ট দেয়। দুষ্টুমি বুঝেও ভান করা রাগের ইমোজি মুহূর্তেই পাঠিয়ে দেয়।
প্রিয়ন্তি আর মশি রেস্তরাঁয় বসে আসন্ন ট্রিপের প্ল্যান করছিল। এক্সাম শেষ। এখন জীবন দেখার সময়। মজা করার সময়। মোটামুটি ভাল লাগার মত একটা প্ল্যান হয়েছে। দুজন ভালই এক্সাইটেড ট্রিপের প্ল্যান নিয়ে। আবির আর নুজ্হাত পথে। একটু পর এসে তাদের জয়েন করবে। সামিরা এতক্ষন এখানে থেকে গেছে হসপিটালে। তার বয়ফ্রেন্ডের ডেঙ্গু। সামিরার উঠে যাওয়ার পর প্রিয়ন্তি মন সায় দিচ্ছে না আজকের ডেটে যেতে। সকাল থেকে কেমন যেন বাজে ভাইব পাচ্ছে সে। খালি মনে হচ্ছে একটা কিছু হবে খুব খারাপ। তার মাথায় কনফিউশান নামক একসূতার বিবিধ প্যাঁচ। এখনও ডিসাইড করতে পারছে না ,যাবে কি যাবে না। আহ্নাফ আবার ফেলে দেয়ার মত ছেলে না। খুব কনফিডেন্ট এবং স্টেবল একটা ছেলে। ডেটিং এপ থেকে তাদের পরিচয়। এখানে কাউকে সিরিয়াসলি নেয়া যায় না বলা যেতে পারে এটা একটা অলিখিত রুল। সাথে নিজের আজকের ইন্টিউশনকেও সে অস্বীকার করতে পারছে না। খারাপ কিছু ঘটতে পারে এমন ইঙ্গিত সে পায় চারপাশে কালো রঙের ছড়াছড়ি দেখলে। আর আজই তার চারপাশের সবকিছুতে কালো রঙের কম্বিনেশন থাকতে হবেই যেন! মাথার উপরের সিলিঙে কালো জালি দেয়া। রিকশাওয়ালারা কেন যেন কখনও কালো কিছু পড়ে না। তার আসার পথের রিকশাওয়ালার গায়ে ছিল কালো রঙের ছেঁড়া গেঞ্জি। খারাপের উপর খারাপ। সময় দেখতে গেলে খেয়াল হয় ঘড়ির ডায়াল বেল্ট সব কালো। অবচেতনে আজকে কালো গেঁথে গেছে। না চাইলেও সবখানেই থাকবে। খারাপ কিছুর পূর্বাভাস এভাবেই আসে।
“ মশি মশি, তোমার টি-র কালারটা অনেক সুন্দর।”
“ সাদা রঙ্গে আলাদা কি পাইলি। খুবই কমন একটা কালার।”
মাথার দুশ্চিন্তাটার বিপরীতে চিন্তা করতে চাচ্ছে প্রিয়ন্তি।
“ এই কালারটার নাম আছে। মোস্ট প্রব্যাব্লি ওটমিল।”
“ কি মিল? ওটস এর ওটমিল? ভাল। নতুন কিছু জানাইলি। বাট এলাস ! আমি চাই এক্ষনই এই নাম ভুইলা যাইতে। আজাইরা ইনফরমেশনে মাথার ডিস্ক ভর্তি।”
“ তুমি দুইদিন ধরে এলাস এলাস করতছ? কত্থেইকা পাইছ এই ফ্রেইস?”
“ ব্রেথলেস দেখছস?”
“ মেবি, দেখছি। মনে নাই, কত কিছুই তো দেখি সব মনে থাকে না।”
“ ওটফোট কালারের নাম মনে থাকে, এইসব থাকে না ! হায়রে আল্লাহ্ ! আর এই মুভি দেখলে মনে থাকবেই মাস্ট।”
প্রিয়ন্তিকে আহ্নাফ হোয়াট্সএপ করেছে “ বসুন্ধরার বিখ্যাত জ্যামে বন্দি। আসতে কিছু দেরী হবে।”
“ তুমি কি গুগল করে চাপা ছারবা যে দেখছ এই মুভি?”
“ ভাই এত ইম্পরট্যান্ট না আমার কাছে মুভি যে চাপাও মারতে হবে। মুভি মুভি করছ ক্যান এত? বাচ্চা বানায়ে রাখছে তোদেরকে এখনও।”
“ এইটা তো ভাল কিছুই। আর কোন কিছু কাউকে এত পিউরলি প্যাশনেট করে? মনে হয় না।”
“ তুই পোয়েট্রি পড়িস? আরও অনেক কিছু আছে যা পিওর এন্ড মিনিংফুল।”
“ এভ্রি নাও এন দেন্।”
“ আচ্ছা !” প্রিয়ন্তি অবাক হয়। “ দেখি শোনাও দেখি তোমার কোন প্রিয় কবিতার দুইটা লাইন?”
“ রিয়েলি? আচ্ছা শোন তাহলে।” মশি প্রিয়ন্তির দিকে একপলকে তাকিয়ে শোনায়,
“ আমি বিশ্বাস করি আমাতে কেউ নেই
কারণ বনের জোছনা আছে,
আমার মন-তীর্থে আসলে বিশ্বাসই নেই
হয়ত শুভ্র কালিতে লেখা অবাক জোতস্নার ইচ্ছে আছে”
“ কবিতাটি বিশিষ্ট সুপারহট কবি প্রিয়ন্তি সেনের।” বন্ধুকে চমকে দেয়ার উদ্দেশ্যে মশি বললেও প্রিয়ন্তির শুনতে আরাম লাগে। মশি চেহারার সাথে লাইনগুলো খুব মানিয়ে গেছে। প্রিয়ন্তির মন চাচ্ছিল আরেকবার শুনতে।
“ খুব সুন্দর লিখেছ তুমি। কিন্তু শেষের লাইনটা একটু এডিট করলে আরও ভাল হইত।”
“ রুইনার।” প্রিয়ন্তির লাল গালে অভিযোগের তৃপ্তি । সুন্দর মুহুরতগুলয় মাঝেমাঝে এমন আহ্লাদ ঝড়ে পড়ে তার।
দুজন প্রায় একসাথেই বলে, “ হয়ত ওটমিলের অবাক জ্যোৎস্নার ইচ্ছে আছে।”
মশির হাতে পোলারয়েড ক্যামেরা ছিল। হাস্যরত প্রিয়ন্তির সুন্দর দুটো ছবি তুলল সে। ছবি দুটো দেখে খুশীতে প্রিয়ন্তি তৈরি হচ্ছিল আরও কিছু তুলতে, কিন্তু মশি ক্যামেরা রেখে দেয়।
“ ক্যামেরা রাখলি ক্যান? মিস্ট্রি চলে গেছে ফেইস থেকে?”
মশি কিছুটা অবাক হয়ে তাকায়। বলে, “ না”। এরপর পটপট আরও দুটি ছবি তোলে।
হাতচালানোর একাগ্রতা বোঝায়, পারলে সে সারাজীবন এখানে থেমে থেকেই ছবি তুলত।
ছবি বের হলে প্রথমে মশি মুগ্ধ হয়ে তাকায়। প্রিয়ন্তি ওকে দেখে ভাবছে সে কি কোন “ গার্ল উইথ আ পার্ল ইয়ারিং?”
“ তুমি অসম্ভব সুন্দররে ভাই। নো ওয়ান্ডার রুশো মাদারি পাগল হইছে তোমার জন্য।”
“ আ পিস অফ আর্ট?” কোন সুন্দর পোরট্রেট দেখে হয়তবা সেই সাব্জেক্টের এমন মনে হয়।
“ ফ্র্যাঙ্কলি…… আই নিড টু সি মোর অফ ইউ। ফুলের পাপড়ি গোনার মত অনেকটা।”
“ মেবি আজাইরা, বাট এডিক্টিভ্।”
“ আজাইরা ক্যান হবে ! পাগল, সি দিস্,” রুশো হাতের ছবিটা দেখায়। প্রিয়ন্তির সম্মোহনে সেথায় পৃথিবীটা বড্ড ছোট।
“ এমন সুন্দর তো পালতে ইচ্ছা করে।”
“ আমি কারও পোষ মানি না।” ছবির দিকে তাকিয়ে বলল প্রিয়ন্তি।
পাশের টেবিলে মার্কার দিয়ে কমিক আঁকছিল একটা মেয়ে। মশি মেয়েটার মার্কারের দিকে তীব্র অনুনয়ে তাকায়। দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হয় এবং মেয়েটা মুচকি হেসে মশিকে মার্কার দেয়। এই বাতাসে এখন মিষ্টি ভেসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। কে দেখাচ্ছে প্রিয়ন্তি জানে না। মশি নিশ্চুপেই মার্কার এগিয়ে দেয় প্রিয়ন্তির দিকে।
“ আমি কারও পোষ মানি না, এইটাই ক্যাপশন দিব?” প্রিয়ন্তির লাজভাঙ্গা জিজ্ঞাশা।
মশি নিজের মধ্যে নাই। তবে সে যা জানে তা হচ্ছে, এই ছবিটায় শুধু তারই অধিকার। খারাপও লাগছে জেনে, কোন এক ফাঁকে ছবিটা প্রিয়ন্তির কাছ থেকে তার চুরি করতে হবে।
পাশের টেবিলের আঁকিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখ দিয়ে একঘেয়ে একটা শব্দ অজান্তে বেরিয়ে পড়ে, “ ওয়াও।”
মশি আঁকিয়েকে গ্রিট করে, ’হাই আমি মশি’। মেয়েটা জানায় তার নাম সাদিয়া। আই. ইউ. বি-তে বিবিএ পড়ছে। প্রিয়ন্তি তখনও ক্যাপশন দিতে মগ্ন। সাদিয়া প্রিয়ন্তিকে একটু পরপর দেখছিল। ভাবছে এই মেয়ে এখনও ইন্ট্রো দিচ্ছে না ! এত আত্নমগ্ন ! মশির ফেবু আইডি চাওয়াটা অভদ্রতা হবে কিনা সাদিয়া বুঝছে না। ইতস্তত করতে করতে তবুও মুখ দিয়ে বেড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞাশা।
“ Are you on Facebook?”
“ সারহান যাবের দিয়ে সার্চ করলে পাবা।”
মাত্র চেনা পরিচয়ে আইডি দেয়া কতটুকু যৌক্তিক? তবে ভাল, সুন্দর মুহূর্তে একটা সুন্দর সমাধান পাওয়া গেল এই মেয়েটার জন্য। সবসময় জটিল মুহূর্তেরই সমাধান লাগে না, অনেক সময় সুন্দর মুহূর্তগুলো তৈরি করতেও ভাল কিছু সমাধান লাগে। প্রিয়ন্তি চাচ্ছিল না ধন্যবাদ জানাতে। মেয়েটা নিশ্চয়ই ধন্যবাদের স্বার্থে এই উপকারটা করে নি। সে চারটা ছবির ক্যাপশনগুলয় চোখ বুলাচ্ছিল।
“ ধুর্! এখন আরেকটা ক্যাপশন মনে ধরছে !”
“কি?” মশি সাদিয়ার সাথে কথা বললেও মনোযোগের তৃতীয় চোখ কিন্তু প্রিয়ন্তির দিকেই।
“ From Sadia To Her… এই পিক্টায় দেয়া উচিত ছিল।” প্রিয়ন্তি প্রথম ছবিটা দেখিয়ে বলে।
সাদিয়া চেনে না প্রিয়ন্তিকে। এতক্ষন সবকিছুতে কিছুটা সারপ্রাইজড সে ছিলই, তবে অবশ্য এক্সপেক্টও করছিল প্রিয়ন্তির ধন্যবাদের ।
“ অও… সুইট অফ ইউ। আমার কাছে মাস্কিন টেপ আছে। ইউ ক্যান ইউজ দ্যাট।”
“ তোমাকে তো লাইফের সব যায়গায় লাগবে। এই তোমাকে কিনব আমি। কত আদর করলে খুশী হবা বল?”
পারফেক্ট হ্যাপি আওয়ারস যাকে বলে আর কি ! এখানে কারও থাকলে মনে হবে না পৃথিবীতে দুঃখ বলে কিছু আছে। মশি খুশী বাড়াতে তিনটা ডেজার্টের অর্ডার করে। এরপর পোলারয়েডে আরও সুন্দর কিছু স্মৃতি ধারণ হল।
আবির আর নুজ্হাত চলে এসেছে। আহ্নাফের কল আসছে ক্রমাগত। প্রিয়ন্তির মন এখন ভাল। তার খারাপ ইনট্যুশন কেটে গেছে। ভাবছে আহ্নাফকে এদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে ভালই হয়। তার বন্ধুরা অসাধারণ, এটা আহ্নাফের নিশ্চয়ই জানা উচিত। আর ট্রিপেতো কাপলস এলাউড। ইচ্ছে করলে আহ্নাফকেও নিয়ে যাওয়াই যায়। বেচারা অফিস করে করে খুব বোর হয়ে আছে। ভিন্ন বাতাসে থাকতে তার নিশ্চয়ই ভালই লাগবে।
“ ভ্লগ বলতছছ ক্যান, বল ফিল্ম বানাব। এক কাজে দুই কাজ। ওইখানে গেলে একটা সারপ্রাইজ আছে সবার জন্য।” আবির বলছিল।
“ তোমার ঐ ভুতের বাড়ির কোন প্ল্যান- এ আমি নাই।” নুজ্হাত আবিরের জিএফ। কিছু ইঙ্গিত করছিল।
“ হন্টেড হাউসটাই ভুয়া। কিছুই নাই ওখানে। আমি যা বলছি সব শোনা কথা। দিনে রাতে কুত্তা-বিলাই যাওয়া আসা করতেছে, থাক্তেছে।”
“ তুই না বলছিলি মাঝরাতে শিয়াল পাহাড়া দেয় ঐ বাড়িটা। আবার এখন কুত্তা- বিলাই বলতছছ ক্যান? চাপা যে জীবনে কত ছাড়লি !” মশি খোচা দিচ্ছে।
“ শিয়াল ও আসে প্রায় সময়। তবে ওরা আসে মেট করতে। কুত্তি লাগাইতে।”
“ হাহা।”
“ তোমাকে কে বলছে এইসব আজাইরা কথা? প্রিমিটিভ যুগে হইত এসব। এখন আর শিয়াল-কুকুরের ব্রিড পসিবল না। নেচার রিজেক্ট করছে।”
“ দিনের বেলায়ও দেখা গেছে এমন কাহিনী। মেল ফক্স এসে একটা বিচ সিলেক্ট করে, দেন শুরু করে।” আবিরের উদ্ভট গল্পের লজিক খুঁজতে শুরু করে সবাই।
মশি বলে- “ ও ক্যামনে আমার দিকে চোখ টিপে কি বুঝাইতে চাইছে কিছু বুজছ নুজ্হাত?”
“ না, তুমি বুঝ নাই। ওইটা যেটা হয় সেটা হচ্ছে এক কথায় রেপ্। শিয়ালের প্রভিন্সে কুকুর ঢুকলে ওরা এটা করে। ফর ফান্। ও আমাকে রেপ করসে এইটা……”
“ হইছে থাক্ থাক।” মশির আপত্তি শুনতে।
“ আমার তো মনেই হয় আমি রেপ করি। নাইলে এমনে চিল্লায় কেউ?” আবির অন্য কিসিমের। চিন্তা লুকাতে যার ভীষণ অনীহা।
“ শভেনিস্ট। দিলো ঢাইল্যা পুরুষত্ব।” সাদিয়ার কটূক্তি।
“ হ, পারেই তো ঢালতে, অসময়ে। বুঝেন না? চিৎকার কি সুখে দেই? চিৎকার দেই আফসোসে।”
“ আর কিছু ! এখন আমি কিছু বলব?” আবীর উত্তেজিত।
“ না।” জায়গামত পেয়ে মুখে বত্রিশ-কলা ধরিয়ে দেয় সবাই। আবিরের অপ্রস্তুত ভঙ্গির ছবি তুলতে মশি এক মুহূর্তও দ্বিধাবোধ করল না।
“ দাঁড়া ! ক্যাপশন দেই… করতে পারলাম না…. স্যাড ইমোজি ।”
আবীর মশিকে কিছুতেই লিখতে দিবে না। মশিও নাছোড়বান্দা। একেবারে টয়লেট পর্যন্ত দৌড়ে ঢুকে সে। লিখেই ছাড়বে!
আহ্নাফ এসেছে। সে দূর থেকে দেখল প্রিয়ন্তি বন্ধু-বান্ধবের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে । ফুল নিয়ে ঢোকা ঠিক হবে কিনা চিন্তা করছে। প্রিয়ন্তি হয়ত সময় বেশী নেবে না। ফুল গাড়িতে রাখাই ভাল। প্রিয়ন্তি এসে দেখবে তার সামনের সিটে ফুল। সেটাই মানাবে বোধহয়। হটাৎ করে বন্ধুদের সামনে ফুল নিয়ে উপস্থিত হলে বেচারি অন্যকিছু ভেবে বসতে পারে। হাজার হোক তারা প্রিয়ন্তির বন্ধু, কিন্তু মানুষ তো অপরিচিত।
প্রিয়ন্তি আহ্নাফের হাতের দিকে তাকাল। দেখল কিছু নেই। তার একটু মন খারাপ হলো। কিন্তু মন খারাপ ভাব যে দেখাতে নেই সবসময়।
“ হ্যালো, আমি আহ্নাফ।” প্রিয়ন্তি পরিচয় করিয়ে দেবার আগেই আহ্নাফ নিজ থেকে গ্রিট করে সবাইকে।
“ও হাই।” সবাই একে একে পরিচিত হয়। মশি বলে বসে, “ আমি দেখে চিন্তা করতেছিলাম, এটা কে প্রিন্স লাইক? আমার বন্ধুর দিকে তাকায়ে টাঙ্কি মারতেসে ! এখন বুঝলাম, ও আচ্ছা !”
“ ও! আচ্ছার! কিছু হয় নাই। We’re friends.” প্রিয়ন্তি আহ্নাফের দিকে ভালভাবে তাকায়। না তার পরনে কালো তো কিছুই নাই। কালো খুঁজে না পেয়ে চুলের দিকে চোখ যায়। ধুর্, চুল তো কালই থাকে সবার ! হয়ত চোখজোড়া ও কাল। কাল না হলে প্রিয়ন্তির কিছুটা-মন-খারাপ ভাব বুঝে ফেলার কথা।
আহ্নাফের কিচ্ছু এসে যায় না। এয্ লং তারা দুজন একসাথে সময় কাটাবে। এসব বাড়তি চিন্তা মাথায় রেখে লাভ কি। তাকে কিভাবে প্রেজেন্ট করা হচ্ছে একটা সার্কেলের সামনে, এতকিছু ভাবলে শুধু ঝগড়াই হবে। প্রিয়ন্তি কোন ঝগড়া করলে দূরত্ব কমবে টাইপ মেয়ে না। এই মেয়ের সাথে দেনা পাওনার ভাগ বাটোয়ারা এখনও ঠিক হয়নি যে!
“ আমরা একটা ট্যুর প্ল্যান করতেছি ভাইয়া। Why don’t you join us!” নুজ্হাত ঠিক ভদ্রতার খাতিরে অফার করেছে তা বলা যাবে না। কবুতরের জোড় চাবেই তাদের দল ভারী করতে, কিন্তু মশির সেটা ভাল লাগবে কেন? সে সরাসরি বলে, “ I hate to be with couples on any tour. Sorry, I wouldn’t risk my patience.
You’re not welcome বড় ভাই.”
“ আর আপনি কোন গিফটও আনেন নাই। Worse of the worst, আপনি এখনও পর্যন্ত কোন ফুড অফার করেন নাই। আপনি না ম্যারিকোতে জব করেন? বড়লোক মানুষ, কিপটামি ক্যান করতেছেন?” আবীর মশির দিকে তাকিয়ে ইশারায় বুঝতে চাইল ঘটনাটা কি। তার আগে বল অন্য কোর্টে ঠেলে দেয়া গেল। নতুন এসেছে বেচারা, তাকে অফেন্ডেড হতে তো আর দেয়া যায় না।
আহ্নাফ ভীষণ এম্ব্যারেস্ড হোলো। ওদিকে সাদিয়া তখনও যায়নি। ছবি আঁকছিল কফি খেতে খেতে। কেউ হাসছিল না, সে একলাই উচ্চস্বরে হাসতে থাকে।
“ এই তোরা এত ছ্যাঁচড়া ক্যান। সারাক্ষন খালি গিফট গিফট। নিজেরা যে দশটার সাথে ডেট কর, তখন কিছু খাওয়াও! এই আহ্নাফ তাড়াতাড়ি সবার জন্য একটা বিফ স্টু আর বারবিকিউ চিকেন অর্ডার কর তো। দেখায়ে দাও আমি কত্ত বড়লোকের সাথে ঘুরি। ” প্রিয়ন্তি ফাজলামো করলেও, খাবার সময় খাবে কিন্তু ঠিকই।
“ হ্যাঁ খাওয়াইলে মাইন্ড চেঞ্জ করতে পারি। ট্যুরে আপনার চৌদ্দ গুষ্টি থাকলেও সমস্যা হবে না কোনো।” মশির ঝটপট সিদ্ধান্ত প্রিয়ন্তিকে খুশী কবার জন্যই বলা।
“ এসব মানুষ তো নিমক হারাম হয়। এদের সাথে তো ট্যুর তো দুরের কথা, এদের চেহারাই দেখা উচিত না। এনিওয়ে আমি এক্সপেক্ট করি নাই, প্রিয়ন্তি এমন টাকা পয়সা ভেঙ্গে খাওয়ার মত মেয়ে হবে। নেন্, কি নিবেন আপনারা।” কথাগুলো হেসে বললেও আহ্নাফ কি মাইল্ডে মাইন্ড গেম খেলার চেষ্টা করছে না? এই ছেলে এই কাজটা প্রতিনিয়তই করছে। প্রিয়ন্তি এখন নিশ্চিত হোলো। কেন করে প্রিয়ন্তি জানে না। বোধহয় স্বভাবই এমন। প্রিয়ন্তির আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
“ ম্যানার মনে করায়ে দেয়া দোষের কিছু না ভাইয়া। এটা পার্ট অফ দ্যা প্ল্যান। আপনাকে দেখতে স্মার্ট লাগে দেখে পার্ট নিবেন এটাত ঠিক না। আপনি একলাই স্মার্ট না, আরও অনেক স্মার্ট মানুষ আছে কিন্তু !” সাদিয়ার চমকপ্রদ উত্তর।
“ Sorry, but you guys’re getting rude to me. Come on, সিনিয়ররা জুনিয়রদের র্যাগ দেয়। জুনিয়ররা সিনিয়রকে না। আফটার অল, আমার চুল কিন্তু উঠছেও আগে, পাকবেও আগে।”
বাহ্! কি দুর্দান্ত ট্যাকল দেয়ার ক্ষমতা। প্রিয়ন্তি মনে মনে অবাক না হয়ে পারে না।
ছেলেটাকে সে চিনে বলতে পারবে না। কিন্তু আসলেই স্মার্ট তা অস্বীকার করার উপায় নাই। তবে মনে মনে সাদিয়াকে সে কয়েকশবার ধন্যবাদ দিল। আর্টিস্ট মেয়েরা একটু অন্যরকম হয়। সোজা মুখের উপর বলে দিতে পারে যে কোন কথা।
“ আমার কিন্তু পেট ভরে নাই। কে কি খাওয়াবা তাড়াতাড়ি খিলাও।” পরিস্থিতি হালকা করতে আসলে খাবারের জুড়ি নেই, নুজ্হাতের ধারণা এমনই। চিরাচরিত যেসব ধারণায় মানুষ খুশী থাকতে পারে, সেসব ধারণাসকলেই তার বসবাস। তার ধারণাতে কারও কোন আপত্তিও নাই এ মুহুর্তে। সবাই হেসে হেসে খাবার অর্ডার করছে।
“ আমি একটা রামেন টেস্ট করতে চাই, কোনটা ভাল হবে?” আহ্নাফ ওয়েটারকে জিজ্ঞেশ করছে।
“ বিয়েবাড়িতে কি হয় জানিস, প্রিয়ন্তি !” নুজ্হাত গল্প বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
“ তোমার মাথা হয় !” আবীর কথা থামায়।
“ এই তোর সমস্যা কি ! তোকে কিছু বলছে? বলতেছে তো আমাকে।”
“ সে যে খাবারকে ঈশ্বরের ডিরেক্ট আশীর্বাদ বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলবে, এটাই হচ্ছে ঘটনা। নতুন কিছু না, লক্ষ কোটিবার শুন্ছস এসব ছাতা-মাতা।”
আবীর কিছুটা ক্লান্ত। খাবারের জন্য না এখানে বসে থাকার জন্য, তা বলা যাচ্ছে না।
“ আমার এক রিলেটিভ আছে গ্রামের বাড়ির। মা’র হাতের রান্না খুবই পছন্দ করে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে খাবার খেয়ে ভাল লাগে দেখে সে প্রতিবার বাসায় আসলে একটা লুঙ্গি নিয়ে আসে। বলে, “এর আগে আইস্যা খাইছিলাম, তখন খুব ভাল লাগছিল আপনাগো ব্যবহার। এই ধরেন আপা একটা লুঙ্গি আনছি। গরিব মানুষ, কি আন্মু বুইঝ্ঝা পাই না।”
“ কেন আহ্নাফ ভাই? আন্টি কি লুঙ্গি পড়ে?” নুজ্হাতের হাস্যকর জিজ্ঞাসা।
“ তোমার মাথা দেখি ঐ মামার চেয়ে ডাবল খারাপ। লুঙ্গি ক্যান পড়বে? সে নিজের ইচ্ছায় নিয়ে আসে।”
“ আমাদের হাসার জন্য আর কোন নতুন ঘটনার দরকার নাই, ভাই। এটাই এনাফ্। সারা জীবন হাসতে পারব।” কথাটা আবিরের। ঘটনার সুন্দর উদাহরণে আপাতত সে মুগ্ধ।
এ ধরনের উদ্ভট ঘটনা কি আসলেই ঘটে? নাকি বানিয়ে বলে জাহির করা হচ্ছে নিজেকে । কি আশ্চর্য ! মশি এভাবে ভাবছে কেন? তাও প্রিয়ন্তির হাসির দিকে তাকিয়ে। সে তো কারও হাসি কিনতে পারে না। কত উদ্ভট মানুষ তো আছেই পৃথিবীতে। বানিয়ে বানিয়ে এমন কিছু বলার তো কারণ থাকতে পারে না। না ! মেয়েটা চিনেছে ভালই। একইসাথে স্মার্ট, দেখতে ভাল এন্ড চার্মিং। ব্যাপার কি? মন নিজ থেকে প্রতিযোগিতা শুরু করল নাকি? তার নিজের ঈর্ষান্বিত চাহনি এভাবে ভেসে উঠছে তারই বা কারণ কি ! নিজের চেহারা এই বোধে মনে করিয়ে দেয়াটা কি অবচেতনের অপ্রাসঙ্গিকতা না?
খাই-দাই-আড্ডা-দেই পর্ব শেষ হলে পর সবাই নিজ নিজ গন্তব্যমুখি। গাড়িতে ওঠার আগে মশি সিগারেট ধরিয়ে আলাদা করে আহ্নাফকে সেধে পাশে নিয়ে কি যেন বলে। প্রিয়ন্তির জোর কৌতূহল চাপে। আবির-নুজ্হাত চলে গেছে। একলা প্রিয়ন্তি কি আর করবে ভেবে তাদের দিকে এগোয়। দেখল মশির চেহারাটা হঠাৎ মলিন দেখাচ্ছে। এগিয়ে সিগারেট চাইতে যাবে, তখন মশি বলল, ”চল তোর বাসার ওদিকে একটু কাজ আছে। একটা লেন্স নিতে যাব।” বলে সে বাইক স্টার্ট করে।
“ আরে সিগারেট দে একটা, খালি নিজেরাই খাবা।”
“ প্যাকেট খালি, আর নাই। চল্ বাসার সামনে। যেয়ে কিনে দিচ্ছি।”
প্রিয়ন্তি গাড়ির ভেতর ঢুকে কিছুটা চমকে যায়। লিলির তোড়া সে আশা করেনি। আহ্নাফ কিছুটা সারপ্রাইজ দেয়াতে সাক্সেসফুল বলা যায়। ড্রাইভিং সিটে বসে প্রিয়ন্তির গোলাপি তোড়ার দিকে মুখ এলানো মিষ্টি চাহনি দেখে তার অসম্ভব ভাল লাগে। না তার ফুল খোঁজার পরিশ্রম একেবারে বৃথা যায়নি।
“ তোমাকে মশি কি বলছিল তখন?”
“ ও বলছিল, ভাইয়া, কিছু মনে কইরেন না, I was kidding back then. আপনি অবশ্যই প্রিয়ন্তির সাথে আসবেন।”
“ He’s a good guy. As you said, র্যাগ দিচ্ছিল তখন।”
“ ভাল লাগে নাই ব্যাপারটা। আমি ইউজড টু না এসবে।”
“ জব করলে কেমন একটা পারসোনালিটি আসে মানুষের। Come on, আমরা এখনও বাচ্চা। আমরা মজা করবই। এটা বুঝতে হবে আহ্নাফ।”
“ মেবি।”
কিছুক্ষন চুপ করে থাকে দুইজন। আহ্নাফ নীরবতা ভেঙ্গে প্রশ্ন করে, “ তুমি কি বাসায় ঢুকবা এত তাড়াতাড়ি। তোমাদের তো এক্সাম শেষ। মাত্র নয়টা বাজতেছে, আমরা আরও কিছুক্ষন ঘুরতে পারতাম।”
“ তুমি মশিকে কি বলছ? যাবা ট্যুরে আমার সাথে?”
“ কেমন প্রম ডেট সাউন্ড করতেছে ব্যাপারটা। না। বলছি যাব না।”
প্রিয়ন্তি তাকিয়ে দেখে মশি ওদের পাশাপাশি বাইক চালাচ্ছে। বাইক ছেড়ে হাতে হার্শেটপ করে প্রিয়ন্তিকে ইশারা করছে আর প্রিয়ন্তি হেসে কুটিকুটি।
“ কেন? একটা সেকেন্ড থট দাও।” আহ্নাফ ভেবেছিল প্রিয়ন্তির তার কথায় মনযোগ নেই। মনোযোগ ভালমতই আছে এবং কেমন একটা সুর ও যেন মেশানো আছে।
“ রাতে কিভাবে থাকব? কাপলদের জন্য এরেঞ্জমেন্ট কি? ”
“ ওদের কি যেন এক্টিভিটি প্ল্যান আছে। বলতেছে না। আই গেস, ঘুমানোর টাইম পাব না আমরা। আসার পথে গাড়িতে ঘুমাতে হবে।”
“ ও।” সিগন্যালে গাড়ি থামে। মশি স্ট্যান্ড ফেলে বাইক থেকে নেমে ওদের গাড়ির সামনে আসে। হাতে দূরবীন আছে এমন ভাব করে সে প্রিয়ন্তির সাথে মজা করছে। আহ্নাফের এই অতি নাটুকেপনা সহ্য হচ্ছে না। সে প্রিয়ন্তিকে প্রশ্ন করে,
“ তোমার বাসায় ছেলেরা যেতে পারে? বা রাতে থাকতে পারে?”
“ পাগল নাকি তুমি? নতুন বাসা। এসব কিছু করা যায় না। আর এরকম সুবিধা থাকলে আমি অবশ্যই বলতাম, তোমাকে।”
“ বলতা নাকি?”
“ হ্যাঁ কেন না।” প্রিয়ন্তি আহ্নাফের দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায়।
“ তুমি তো বাসার বাইরে থাকতে কোন সমস্যা ফিল কর না।”
“ এই ফুট্ তুই। অসহ্য।”
“ কি?”
“ আরে দেখ না মশি কি বিটলামি করতেছে !”
“ ও, আমি কিছু আস্ক করসিলাম।”
“ হ্যাঁ, আমি তোমার সাথে বাইরে থাকব না। তুমি খুবই ডেসপো সাউন্ড করতছ। আমার এলারজি আছে ডেস্পোগিরিতে।”
“ তোমরা মেয়েরা যে কি আমি বুঝি না। একটু আগে কি বললা, আর এখন কি বলতছ! ”
“ আমরা মজা নেই আর কিছু না। এইটা বুঝলেই অনেক কিছু বুঝে ফেলবা।”
আহ্নাফ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। ভাবতে অবাক লাগছে মেয়েটা কি ভীষণ স্মার্ট! রূপের মন্ত্র সহ্য করতেই প্রাণ প্রায় নিভে যায়, এখন দেখা যাচ্ছে কথার মন্ত্রে সে আরও বেশি পারদর্শী।
“এই ডানে যাও। কই যাচ্ছ? আমার বাসা ভুলে গেছ। দেখছ এভাবেই মানুষ ভুল ডিরেকশনে হারায়ে যায়।”
মশি তাদের সামনে ইছে করে ব্রেক কষে, আবার ধুমধাম টেনে রীতিমত যা-তা কাজ করছে।
“ তুমি অনেক ম্যাচিউর আহ্নাফ। আমি ড্রাইভ করলে হালার এতক্ষনে খবর হয়ে যাইত।”
“ বাইকারদের সাথে কিছু করতে গেলেই বিপদ। এক্সিডেন্ট করলে?”
“ হ্যাঁ সেটাই। বুঝলাম তোমার মাথা অনেক পরিষ্কার। আমার বাসা এসে গেছে। থ্যাংকস ফর দ্যা রাইড। ” প্রিয়ন্তি তড়িঘড়ি করে চুল পোশাক ঠিক করছে। পড়নে আলখাল্লা টাইপ কিছু একটা চাপানো। রাস্তা ঘেঁষে বালুর টুকরো কুড়ায় এসব পোশাক। আহ্নাফের পছন্দ না হলেও সে দেখল মেয়েটাকে কোন কিছুতে খারাপ লাগে না।
গাড়ি থামে। আহ্নাফ প্রিয়ন্তিকে বলে, “ তোমার বন্ধুর সাথে মজা করতেছিলাম তখন। ওকে বইল, আমাকে বাদ দিয়ে যাতে প্ল্যান না করে।”
“ আচ্ছা, এইজন্য বেচারার মন খারাপ মনে হইছিল। কি মজা পাও এসব ছোট বাচ্চাদের হাসিমুখ পেইল করতে?”
“ পেইল হয়ে গেছিল নাকি? নোটিস করি নাই। তোমার অবজারভেশন স্কিল ভাল কিন্তু ম্যাডাম, হেয়ার স্টিকটা নিতে ভুলে যাচ্ছন যে!”
“ ও হ্যাঁ, খাবার সময় চুলে দিছিলাম, পরে খুলে ফেলছি।” ফুল হাতে নিয়ে প্রিয়ন্তি দরজা খুলে।
“ থ্যাংকস আহ্নাফ। এই জিনিষটা খুব হারায়। পেইন দেয় খুব।”
“ মাই প্লেজার, প্রিয়ন্তি।” আহ্নাফ গাড়ি ঘুড়ায়। দিন্টা কি অসমাপ্ত লাগছে না? নিজেকে জিজ্ঞেশ করে সে। মশি পেছন থেকে এসে গাড়ির সামনে ব্রেক করে, ‘বাই’ দিল। মশি পেছনে গেল কখন? প্রিয়ন্তির ভাবনায় সে খেয়াল করেনি। সে খেয়াল করে না অনেক কিছুই, প্রিয়ন্তি যা নিখুঁতভাবে খেয়াল করে।
“ ফুল নিবি না, সিগারেট নিবি বল্। দুইটা কিন্তু একসাথে যায় না।” মশি প্যাকেট বের করে হস্তান্তর করার আগে বলল।
“ ফুল তোর জন্য। Cuz, you’re a real sweetheart তখন। আমার উচিত ছিল তোকে হাগ্ করা।”
“ আরে এটা কোন ব্যাপার! আমার তো দিল খোলাই।” মশি হাত ছড়িয়ে দেয় দুপাশে।
“ না ধর, লিলি নাও। বেটার দেন হাগিং। এটা আমার লাইফের নতুন সেগমেন্ট। ‘লাভ ফর দ্যা ডে’। আজকেরটা তোর পাওনা।”
“ তুই কখন করলি এই কাজ? ভাইয়াকে টেক্সট করে আনতে বলছিলি?”
মশি তো বোকা না। এভাবে ভাবছে কেন? তার এই কাজ করাটা কি ঠিক হচ্ছে? কিন্তু বলে ফেলার পর যে আর কথা উইথড্র করা যায় না। ফুলের সাথে যে প্রতিজ্ঞা জড়িত। প্রিয়ন্তির নিজেকে খুব উদ্ভট মনে হয়।
সে কিছুক্ষন ঠায় দাঁড়িয়ে দেখছে, মশির কালো ক্যাফে রেসার বাইকটার পিছনে একগুচ্ছ সাদাপদ্ম। অন্ধকারে দূর থেকে গোলাপি রংটা চেনা যাচ্ছে না। আচ্ছা! আহ্নাফের গাড়ির রংটা কি যেন? সাদাই তো…
বাসায় এসে জার্নালে প্রিয়ন্তি কালো কালি দিয়ে লেখল, “ My love for the day goes to you, Ahnaf. Thanks for everything.”
প্রিয়ন্তির হাসি পাচ্ছে এমন উদ্ভট দোলাচলে। সে কিছুক্ষন পর মশিকে টেক্সট পাঠায়, “ মশি আহ্নাফ যাচ্ছে আমাদের সাথে।”
৫
বিড়াল হাতে নিয়ে রুশো দাঁড়িয়ে আছে। ঘটনা চমকপ্রদ। সিএনজি-তে ভোর বেলা উঠতে গেলে সে দেখে পায়ের কাছে একটা ঝুড়ি পড়ে আছে। ভেতরে একটা বিড়ালের বাচ্চা অস্ফুট স্বরে ম্যাও ম্যাও করছিল। এক্কেবারে দুধের বাচ্চা না, দুধ ছাড়বে ছাড়বে এমন বাচ্চা। ঘটনা কি মামার কাছে জানতে চাওয়ার আগেই মামা বলে, “ কোন্ প্যাসেঞ্জারে জানি রাইখ্যা গেছে। আহারে! বাচ্চাটা ঘুমাইতাছিল। কেমনে পারে মানুষ এমন করতে!” রুশো তাকিয়ে দেখে বাচ্চাটা রীতিমত কাঁদছে। ভয়ংকর নিষ্ঠুর দৃশ্য সহ্য করবার আগেই রুশো তাকে নিজের কোলে নিয়ে আদর করতে শুরু করে। নিষ্পাপ বাচ্চাটা রুশোর দিকে তাকিয়ে বোধহয় অনুরোধ করছে, “ তুমি কি আমাকে রাখবা ! নাহলে আমাকে বাবা-মার কাছে নিয়ে যাও !” রুশো ঝুড়ি খুঁজে আর কিছু পায় নি। হতে তো পারত ভুলে কেউ রেখে গেছে। সে ছবি তুলতে নেবে তখন মামা তাকে নিরাশ করে বলে, “ লাভ নাই মামা। ফেসবুকে দিবেন তো, যে মেয়েটা রাইখ্যা গেছে হেয় কানতে কানতে গেছে সিএনজি থেইকা। কষ্ট পাইলে মাইনসের মাথায় কি জানি হয়। ভাড়াও দিল বেশী। বুঝছেন মামা !” রুশোর বাকি কথা শুনতে আর ইচ্ছা করে নাই। সে ভাড়া মিটিয়ে এখন বিড়ালটাকে আলগোছে ধরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। বাকিদের জন্য অপেক্ষার আগে সময়টা তার খারাপ কাটছে না। ছোট একটা বাচ্চার শক এবসরপশনের ক্ষমতা দেখে সে রীতিমত বিস্মিত। তার চাইতে বেশী আনন্দের সাথে সে বিড়ালটাকে বলছিল, “একটু পর বালিগাঁও যাচ্ছি আমার ফ্রেন্ডদের সাথে। দেখ্বা তোমার ট্রমা এক্কেবারে গায়েব হয়ে যাবে।” বিড়ালছানাটি তাকিয়ে শুধু বলল, “ ম্যাও”। কি সুন্দর একটা ঘটনা, সাথে ভোরের আলোতে কি সুন্দরই না লাগছে বাচ্চাটাকে। শুধু মানুষকেই সুন্দর দেখা যায় না, ভোরের আলো আসলে অকৃপণ। এই আলো সবকিছুকে সুন্দর করে ফেলে।
লাইলি কিছুটা দূর থেকে তার গাড়ির ভেতর বসে রুশোকে ফোনে কল দিয়ে যাচ্ছে। হাতে বিড়ালের বাচ্চাসহ ছেলেটাকে আগের চেয়ে আরও অদ্ভুত দেখতে লাগছে। দেখছিল রুশো বাচ্চাটকে নিয়ে ভীষণ মগ্ন, ফোন ধরার কথা তার মাথাতেই আসে নাই । তার আচ্ছন্নে মনে হল এদের দুজনের ছবি রাখা দরকার।
“ নেন্ ধরেন, ভাইয়া। চকলেট খান।”
“ না আপা, আমিতো চকলেট খাই না।” লাইলির ড্রাইভার কিছুদিনের। এখনও তার লজ্জা ভাঙ্গে নাই। লজ্জা পাওয়ার ক্লাসপর্ব চলছে তার। ক্লাসপর্ব শেষে কিছুদিন পর সে বিমর্ষ মুখে সবই গ্রহণ করবে।
“ লজ্জা পাচ্ছেন ক্যান? আমি প্রতিদিন চকলেট দিব না আপনাকে। নেন্, ধরেন এটা।”
লাইলি গাড়ি থেকে খুব সুন্দর করে বের হয়। প্রতিদিন সে হিজাব পড়ে। চুল মেলে আজ সে খুব সুন্দর সেজেছে। তাকে দেখলে এখন যে কারোরই মন তড়িৎ ভাল হতে বাধ্য। মেয়েটার তাড়াহুড়োর সাজে একটা মিষ্টি গন্ধ আছে। যেন প্রকৃতিকে বলা, “তুমি অপেক্ষা কর, আর বাতাসটা রেখ। দেখ, সবাই একটা মিষ্টি গন্ধ পাবে।”
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির ফোটা পড়ছে। লাইলি দেখল রুশো দৌড়ে একটা ঝুড়ি নিয়ে সোজা যাত্রী ছাউনির নীচে আশ্রয় নিল। সে দৌড়তে সবসময় অসস্তি বোধ করে। পড়নে জাফরান রঙের খুব দামি একটা টপ। সামনে রুশো পর্যন্ত যেতে আরও কিছুটা পথ হাঁটতে হবে। পেছনে তাকিয়ে দেখে গাড়ি চলে গেছে। যেতে যেতে ভিজে গেলে সব বিচ্ছিরি দেখা যাবে। চিকন হিলের জুতো নিয়ে দৌড়নোও বিপদ। সে ডাক দেয়, “এই রুশো !”
“ তোর বিড়াল চকলেট খাবে?” ব্যাগ থেকে একগাদা চকলেট খুঁজে খুঁজে টব্লারন এগিয়ে লাইলি রুশোকে জিজ্ঞেশ করল।
“ বাহ্। দেখছ কুটি, তোমার জন্য চকলেট আন্ছে।” রুশো ভেঙ্গে-ভেঙ্গে চকলেট খাওয়ানোর চেষ্টা করছে।
“ এই সুন্দর বাচ্চাটকে তুমি কোথায় পাইছ?”
“ পাই নাই। আমার কাছে আসছে এটা। যন্ত্রণারে লাইলি ! বাবাগিরি করব ক্যামনে ! আমি এর আগে একটা মশাও পালি নাই।”
“ পাল্বা, আমি দিয়ে গেছি, তুমি পাল্বা।” লাইলির কথা শুনে রুশো চমকে যায়।
“ তুমি দিয়ে গেছ মানে? বুঝি নাই !” রুশো পুরো ব্যাপারটা একবার চিন্তা করে। তার কাছে লাইলিকে অসম্ভব লাগছে।
“ আরে হইছে তো, এমনে তাকাচ্ছিস কেন? একই তো কথা। কেউ না কেউ তো তোমার কাছে রেখে আসছে। সেটা আমিই রাখি বা যেই রাখুক।” লাইলি রহস্য করছে।
রুশো কোন কথা খুঁজে পায় না। সে সত্যিই জানে লাইলি মিথ্যা বলছে। তার ইচ্ছে করছে না এখন সত্য-মিথ্যা উদ্ঘাটন করতে। ওর মজা ওই ভাল বুঝুক।
ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। কিন্তু রুশোর মনে কোন ভাবান্তর নেই। তার পুরো মনোযোগ বিড়ালের দিকে। লাইলি বুঝছে না তার মনের কেন এত বারবার শুধুমাত্র এই ছেলেটারই একটা দৃষ্টির আকুতি ! ছাউনিতে বসে আছে দুজন। কিন্তু বৃষ্টি টপটপ পড়ছে শুধু লাইলির দিকে চেয়ে।
প্রিয়ন্তি আর অর্নিকা মহাখালী থেকে রিকশা নিয়ে সাতরাস্তার মোড়ে যাচ্ছে। শহর অন্ধকার করে এমন ঝুম বৃষ্টি পড়বে সকালে কে জানত ! অর্নিকা মুখে একগাদা মেকআপ মেখে বের হয়েছে। প্রিয়ন্তি বান্ধবীর সাথে খুনসুটি করে দুবার ঝপাট করে রিকশার হুড খুলে দেয়। তার নাকি কোন মেয়ের সাথে হুড তোলা রিকশায় গেলে লেসবো ভাইব আসে। গালে ওয়াটারপ্রুফ মেকাআপ থাকা সত্ত্বেও অর্নিকা কোন ঝুঁকি নিতে রাজী না। কুসুম-রঙ্গা মনের মত একটা সুন্দর সিল্ক শাড়ি খুঁজে পেতে মেয়েদের প্রায় দু’শ বছর লাগে। আধা ভেজা হয়ে অর্নিকার মন তখন জোর চাচ্ছে প্রিয়ন্তির চুলের গোছা ধরে জোরে একটা টান দিতে। পারছে না মামা আবার হুড তুলে দিল বলে। তাছাড়া প্রিয়ন্তির ইদানিং শক্তি হয়েছে বেশ। মারামারি করে অর্নিকা আজকাল ওর সাথে পেরে ওঠে না।
“ আর একবার এই কাহিনী করবি তো তোরে রিকশা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফালায়ে দিব বিচ্।”
প্রিয়ন্তি এরপর আবার রিকশার হুড খুলে দেয়। অর্নিকা চিৎকার দিতে যেয়ে বৃষ্টির ঝাপের পানি প্রায় মুখে গিলে ফেলে। “ইউক্। থু।”
“ আরে দোস্ত, সেক্সি লাগতেছে তো।”
“ এটা কোন কামশট না বিচ্, যে সেক্সি লাগবে !” অর্নিকা নিজের কথা শুনে নিজেই হাসে। প্রিয়ন্তি আগে থেকেই হাসছিল।
“ তুমি পুরা চাল্লু চিয। ওখানে যেয়ে মেকআপ নিবা ! মানে ! তোর মাথার একটু বুদ্ধি যদি এই সকালে আল্লাহ্ আমারে ধার দিত, তাইলে এখন এই বিশ্রী পেইন আর নেয়া লাগত না।”
“ শুন্ । তুই চোখ-মুখ বন্ধ করে আহ্নাফের পাশে বসে যাবি। আমার জন্য ওয়েইট করবি না। তোর সিল্কটা হালকা সি-থ্রু আসে। দেখিস ওর চোখ যাবেই জিনিশ গুলার দিকে।”
“ Do you also want him to be horny as well?” রিকশাওয়ালার দিকে ইঙ্গিত করে অর্নিকা বৃষ্টির ঠাণ্ডায় কেঁপে কেঁপে বলছিল। হাস্যকর শুনতে লাগছে প্রিয়ন্তির।
“ Haha ! Yeah.” প্রিয়ন্তির স্বভাবসুলভ রসিকতা।
প্রিয়ন্তি ক্যাজুয়াল পড়েছে। ভোর সকালে কোন বাড়তি ঝামেলায় যায়নি। ডেনিমের লং টপে সে সহজ, সুন্দর এবং স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গীতে বসে বৃষ্টিতে ভিজছিল।
“ তুমি কি রুশোর পাশে বসবা?” অর্নিকা ওর ‘বৃষ্টি-ভোজে’ বাদ সাধে।
“ আবার ডায়পার জোকস শুরু করছস, এক জিনিশ আর কত বাল্?”
“ হিহি! মজাই তো লাগে।”
“ তুমি না দুইদিন সাইফের বাসায় হানিমুন চোদায়া আসছ! বিয়া যে করস্, এই খবর যদি খালি একবার মাইকে দেই, তাইলে কিন্তু সব যাবে ! মনে রাইখ কিন্তু ! ঠিক আসে বাবু !”
“ এই খবরদার ! এইসব ব্ল্যাক্মেইল করবি না। একদম জানে মাইরা ফালামু তোরে।”
“ প্রিয়ে, ঘুমায় দিক্বালারা সবে— ঘুমায় জগৎ যত।
বলিতে মনের কথা, সখী, এমন সময় কোথা।”
কবিগুরু যথার্তই বলেছেন। শুধু প্রসঙ্গটা ভিন্ন ছিল।
৬
সাল ২০১৮। মার্চের সাতাশ তারিখ। তারিখ বড় ব্যাপার না। তবে ঋতু গুরুত্ব পূর্ণ সবসময়। এ ঋতু ক্ষণে ক্ষণে উৎসব করে হঠাৎ উদাসী হয়ে যায়। গভীর কিছু বুঝতে চায় না। প্রকৃতি এই ‘ঋতু-আবেগ’ সামলাতেও হিমসিম খায়। বসন্তের মোহ কাটার পর যেজন্য ক্ষণকালের নির্দিষ্ট আমেজ সৃষ্টি করে তার হঠাতই উপস্থিত হতে হয়, আবার হঠাতই হারিয়ে যেতে হয়। মশির আপাত মোহ এমনই, নিষ্ক্রিয়। সে কোনকিছু ভাল লাগাতে উৎসাহ বোধ করছে না, কিন্তু হাতে তার অনেক কাজ। আর সাথে মাথায় একগাদা অলস চিন্তা।
পেছনের আট সিটে তিনজন ঘুমাচ্ছে। আবীর, নুজ্হাত আর সেই বিড়ালছানা। লাইলি আর রুশো ঘুমন্ত দুজনের পেছনে বসে গল্প করছে। প্রিয়ন্তির ঘুম ঘুম ভাব। শেষ সিটে বসে ঘুমানো যাচ্ছে না আর তা না হলে আহ্নাফকে একটু পর পিক করার অপেক্ষার চিন্তায় সে ঘুমোতে চাচ্ছে না। অর্নিকা উদাসী, শুধুশুধু ফোন স্ক্রল করছে। সম্ভবত সাইফকে মিস করছিল। সবার কোলে লাইলির দেয়া চকলেট। এখনও কেউ খাওয়া শুরু করেনি।
মশি ক্যামেরা অন করে পেছনে ফিরে ধরে। ছবি ওঠাচ্ছে না, ভিডিও করছে। সবার আলাদা আলাদা ক্লোজ শট নিচ্ছে। লাইলি আর রুশো এসব লক্ষ্য করছে না। দেখতে পেলে হয়ত কথা বন্ধ করে পোজ দিত। আর এমনিতেও এরা নিজেদের মাঝে নেই। রুশোর ছোট মামাতো বোন কীভাবে কীভাবে যেন লাইলির ছোট ভাইয়ের স্কুলমেট। কেউই কাউকে দুইচক্ষে সহ্য করতে পারে না। কেন পারে না, কার দোষে পারে না এ নিয়ে দুজনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। মশি এদের কথা এড়াতে চেষ্টা করছে । এদের কথা ধরার চাইতে উইন্ডোতে এদের রিফ্লেকশন ধরতে মশির বেশী আগ্রহ। রিফ্লেকশনে লাইলিকে লাগছেও দেখতে ভয়াবহ সুন্দর । অর্নিকা এর ঠিক পেছনেই বসে চুলে খোঁপা করছিল। আজ সবাইকে এত অসম্ভব সুন্দর লাগছে কেন? মশি জানেই ক্যান্ডিডে মানুষ ধরা খায়। এই সেই ধরা না, একেবারে আধো সৌন্দর্য সৃষ্টির ধরা। প্রিয়ন্তির আবার কল এসেছে মাঝে।
“ হ্যাঁ, এইতো চলেই আসছি। তুমি বোট ট্রিপ দিছ? এত সকালে ওরা যায়! বাহ্।”
“হ্যাঁ আমরা রামপুরার কাছাকাছি।”
“ প্রাণের অফিসের সামনে দাঁড়াব? ওকে।”
“ ভাইয়া, আর এফ এলের সামনে দাঁড়াবেন।”
প্রিয়ন্তি ফোন কাটে।
মশি জুম করে প্রিয়ন্তির ঠোঁট নাড়ানো দেখছিল। মেয়েটার চোখে কিছু একটা আসি আসি করতে করতে হারিয়ে যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে জেনেও সরল বুঝ নিতে চায় না মশি । সে শ্বাস বন্ধ করে সব রেকর্ড করে। এখনও করছে। প্রিয়ন্তি খেয়াল করার পরও করছে এবং আরও অনেকক্ষন করবে। তার নিশ্বাসের সাথে জেদ মেশানো। প্রিয়ন্তি কি যেন বুঝে বাইরে তাকিয়ে একটা গোলমেলে হাসি দেয়। মশির হাত কাঁপা শুরু করে কিন্তু তারপরও রেকর্ড করা থামায় না। বৃষ্টির শব্দ বাড়ছে। প্রিয়ন্তি কানে হেডফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে।
গাড়ি থামে। প্রিয়ন্তি আড়চোখে মশির দিকে তাকাল। না তার হাতে আর ক্যামেরা নেই। কিন্তু এই মুহূর্তেই শব্দ করে গান ছাড়ার কারণ কি সে বুঝতে পারল না। আবীর আর নুজ্হাতের এই আচমকা শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। লাইলি আর রুশোও চমকায়, তবে তারা নিজেদের চেয়ে বেশী উদ্বিগ্ন তাদের ছোট্ট বিড়ালটাকে নিয়ে। না, তারা আশস্ত, পিচ্চির ঘুম ভাঙ্গে নাই। অর্নিকা কিছু একটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছে। সে ঠিক ছিল, আহ্নাফ উঠে প্রথমে তাকেই দেখল। প্রিয়ন্তিকে তার পাশে দেখে বোধহয় এইদিকেই বসতে চাচ্ছে।
আহ্নাফ একটু ইতস্তত করে পরে রুশোর পাশে বসল। গাড়ির এই সিটটা আলাদা থাকে। সে মোটামুটি ভিজে গেছে গাড়িতে উঠতে যেয়ে। তো আলাদা বসাই শ্রেয়। প্রিয়ন্তি ব্যাগ বের করে তাকে ট্যিসু দেয়। আহ্নাফ সুন্দর করে হেসে তার দিকে তাকিয়ে বলে, “ থ্যাঙ্কস”।
“ ভাইয়া অফিসে কি বলছেন? আপনি সিক?” আবীর জিজ্ঞেশ করল।
“ আর কি বলব ! এরা তো মানুষ না। ছুটি কি দিতে চায় !”
“ ভাইয়া শুনি নাই। এই মশি ভলিউম কমা না !”
“ হ্যাঁ ওইটাই বলছি। সিক আজকে।”
“ আরে বালডা দেখি ভলিউম আরও বাড়াইছে।”
“ কমাইতে যেয়ে বাড়ায়ে ফেলছি। স্যরি।” মশি ভলিউম ইচ্ছা করেই বাড়িয়েছিল। মিথ্যা বলতে আজকে তার সারাদিন অসাধারন লাগবে।
“ ভাই এবার বলেন, আপনার দিনকাল কেমন যায়?” আবীরের প্রশ্নে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত অন্যকিছুর।
“ হাচ্ছিহইই”
মশি আর লাইলি হেসে দেয়।
“ আররে, বিড়াল কোত্থেকে আসল, কার এটা ?” আহ্নাফ আবীরের প্রশ্নের উত্তর দিল না।
“ দুইজনের” রুশোকে দেখিয়ে লাইলি বলে, “ আমার আর ওর।”
“ ইন্টারেস্টিং”।
“ তুই এত জঘন্য ক্যান ?” রুশো লাইলিকে আরও কিছু কথা বলতে যাবে পরে থেমে যায়।
“ তুমি এটার গু সাফ্ করবা না, টাইমমত খাওয়াবা না দেখে বল্লাম। তুমি পশ মানুষ ! আয়রন ছাড়া ড্রেস দেখলে ইস্ ইস্ কর। ”
“ কথায় লজিক আছে। ঐদিন বিএম স্যারের ক্লাসের পর কি বলছিল মনে আছে?”
প্রিয়ন্তি থেমে থেমে হেসে আগে ঘটা একটি হাস্যকর ঘটনা মনে করিয়ে দিতে চাইল। আহ্নাফ তার দিকে তাকায়। খুব কৌতূহল নিয়ে শুনতে চাচ্ছে এমন ভাব।
“ আমার বোর্ডের দিকে তাকায়ে মনে হইসিল বোর্ড বটা বটা।” রুশো নিজেই বলে।
“ কেন? এইটা আবার কেমন ফিলিং?” আহ্নাফকে জিজ্ঞেশ করতেই হয়।
“ ভাই, স্যারের প্যান্টটা খুব খাসরা ছিল। পাছার দিকে তাকায়ে মনে হইছে দুনিয়া বটে গেছে।”
“ চোখের চশমা খুলে ফেলতা, তাইলেই আর দেখতে হইত না। আর নাইলে হট কোন মেয়ের দিকে তাকাইলেও পারতা। অর্নিকার দিকে তাকাইতা পারতা।”
“ইয়াক্ ! থু ! প্লিয্ ম্যান। ইস্ ! দিলে ভাল করেই কমপ্লিমেন্টটা দিতেন !” অর্নিকার গা গুলিয়ে আসে।
“ তুই তো ভালই হটি। ঢং করতছস ক্যান? ইশশ !” লাইলি সত্যি জেনেই বলল।
“ আরে বেকুব! বটা সটা দেখার পর আলাদা করে কাউকে নোটিস করা… হাজার হোক একটা বিশ্রী আনওয়ান্টেড ডিস্ট্র্যাকশন... বুঝছ নাই ছাগল ! যতই কোন মেয়ে হট হোক।”
প্রিয়ন্তির কথায় সবাই হেসে দেয়।
“ আমারে ঘুমের মধ্যে একটা বিশ্রী ভিয্যুয়াল দিলা, বাল!” নুজ্হাত হঠাৎ চেতেমেতে বলে।
“ রুশো আর আহ্নাফ ভাই-এর ফেইস দেখ্ এখন। ঝামেলা কাটাকাটি।” মশি বুদ্ধি বাতলে দেয়। আবীর চোখ বন্ধ অবস্থাতেই হাসতে হাসতে শেষ।
আহ্নাফের নিজেকে অপরিচিত মনে হয়। প্রিয়ন্তি বলে, “ তোরটাও দেখুক না ! আরও সুন্দর মুখ !”
“ ভাই, যা, আমি সবার মুখই দেখতেছি। চুপ কর তোরা। কি আজিব কথাবার্তা ।” বলার জন্য বলা। বাধভেঙ্গে হাসছে সবাই। তাতে আহ্নাফ অবশ্য কিছুটা হালকা হয়।
“ আমরা করব টা কি আবীর তোমার নানাবাড়িতে?”
“ হ্যাঁ কি কি করব আসলে?” সবার কৌতূহল।
“ যেয়েই প্রথমে বাল ফালাবি, তারপর কি করবি ঘুম থেকে উঠে বলতেছি।”
“ এইখানে আরও লোকজন আছে কিন্তু, সো বুঝে…...” আহ্নাফ ওঠার পর নুজ্হাতের ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। এখন রাগত দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে।
আহ্নাফ প্রসঙ্গ সরাতে চায়। প্রিয়ন্তির সাথে কথা বলতে অনেকক্ষণ থেকেই ইচ্ছে করছিল। ইচ্ছা করবে কি! কথা বলার জন্যই এখানে আসা।
“ প্রিয়ন্তি কাজটা কইর না। শালা লোক ভাল না। লুইচ্চা কিসিমের।”
মশির কান খাড়া। তার কেন যেন মনে হচ্ছে ইশারা ইঙ্গিতে কিছু চলবে।
“ আমার কাজ করে আমি চলে আসব। ওর লুইচ্চামি দিয়ে আমার কিসু যায় আসে না।”
“ আচ্ছা কর। কিন্তু আমি ওয়ার্ন করে দিলাম। পরে আমাকে দোষ দিতে পারবা না।”
“ ভাইয়া, হোস্টিং অনেক এট্রাক্টিভ। সহজে কেউ এই কাজ ‘না’ করবে না।” অর্নিকা বান্ধবীর হয়ে ব্যাট চালায়।
“ ঠিক আছে। কিন্তু উইয়ারড লাগবে না প্রিয়ন্তি তোমার? ফেক কতগুলা কথা বলতে সবসময় ।”
“ ফেক্ কেন হবে ! আমি জানি না...” প্রিয়ন্তি নার্ভাস। মনে হচ্ছে একটু পরেই হয়ত শো শুরু হচ্ছে।
কি ভেবে যেন মশির দিকে আড়ালে তাকায়। মশি চুপ থেকে ক্যামেরায় সেটিং ঠিক করছে। একপাশ থেকে প্রিয়ন্তি পুরোপুরি তাকে দেখতে পায় না। কিন্তু সে বুঝে মশি শুনছে ঠিকই। না শুনেও তো উপায় নেই। আর কেউ কোন কথা বলছেও না।
রুশো দ্বিধা ভেঙ্গে জিজ্ঞেশ করে, “ ও কি শো হোস্ট করবে? কথাই তো বলে না ঠিকমত। সিরিয়াস ইন্ট্রোভার্ট একটা মেয়ে।”
“ আমার ইচ্ছা হোস্টিং এর। এইজন্য করব। ট্রাভেল শো। এইজন্য আরও বেশী ইন্টারেস্টেড।”
সবার হিংসা হচ্ছে। লাইলি মুখ উজ্জ্বল করে বলল, “ ওয়াও ! লাকি ইউ ! কনগ্র্যাট্স দোস্ত।”
আবীর নুজ্হাত পেছনে ফিরে তাকিয়ে একই শব্দ করে। এরপর এদের চাহনি দেখে প্রিয়ন্তি নিজ থেকেই বলে, “ দিব দিব ট্রিট দিব। পেমেন্টের টাকা থেকে দিব। এখন ফকিরনী সিজ্জত আমার, কিছু চাইছ না।”
বৃষ্টি থেমে এখন কড়কড়া রোদ। একটু আগে হোটেলে নাশতা সেরে ওরা এখন মুন্সিগঞ্জ হাইওয়েতে। বালিগাও আর বেশী দূরে নয়। বিষদ আলোচনা চলছে। বড় লিস্ট হয়ে গেছে। প্রথমে মাথাপিছু চারটা ডাব খেয়ে পুকুরে নামা হবে, ছেলেরা পট করে শুয়োরের পাল দেখবে, সম্ভবত লাইলিও থাকবে তাদের সাথে। মেয়েরা কারণে অকারণে ছবি তুলবে। রাতে ক্যাম্পফায়ার হবে, মদ-বিয়ার খাওয়া হবে এবং সবশেষে মাতাল হয়ে আগে থেকে ঠিক করা একটা ভ্যানে ঘুরতে ঘুরতে আকাশ বাতাস যা দেখার দেখা হবে।
“ এইটা বেশী ইন্টারেস্টিং লাগতেছে। কার প্ল্যান?” আহ্নাফ প্রিয়ন্তি দুজনই জিজ্ঞেশ করে।
আবীর দুহাত বাড়িয়ে মশিকে সম্মান-পূর্বক ক্রেডিট দেয়। আহ্নাফ ভান করা আগ্রহ দেখায়।
“ সারপ্রাইজ ফারপ্রাইজ কি জানি দিবি বললি?” অর্নিকা খুশীও হয় আবার মনও খারাপ করে। নিজের এক্সপ্রেশন লুকোতে পারে না। পার্টনার ছাড়া কোথাও গেলে এই একটা সমস্যা। মজার সবকিছুতে তাদের আসলেই মিস করা লাগে। আবার নিয়ে গেলেও ঝামেলা। বাকিদের সাথে ব্লেন্ড করা না করা নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকে।
“ আস্ক হিম।” আবীর আবারও একই ভঙ্গীতে মশিকে দেখিয়ে দেয়।
“ কি করবা, মশি বাবু। তুমি আজকে এত চুপচাপ কেন?” অর্নিকা সাইফকে খুব মিস করছে, দুষ্টুমির আড়ালে মশির ভেতর থেকে নিজের জন্য কমফোর্ট তৈরি করছিল।
“ পরে বলতেছি ছবিটা তুলে নেই।” মশি কুটিকে ড্যাশবোর্ডে রেখে তার দার্শনিক ভঙ্গিমার বিচিত্র সুন্দর সব ছবি তুলছে।
ছবি তোলার পর বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে ছবি দেখতে দেখতে তার নিজের জন্য উপলব্ধি আসে। পারসোনালিটিতে বেশ সুক্ষ একটা পরিবর্তন এসেছে কিছুদিনে। স্পষ্ট মানতে হচ্ছে, খুব চোখে পড়ার মত। নিজের কাছেই যা আর লুকোনো যাচ্ছে না। এত সুন্দর ক্যাপচার গুলোও তাকে এখন আকর্ষিত করছে না ! চিন্তাগুলো থেমে যাচ্ছে, শরীরও আগের মত সক্রিয় নেই! কিছুক্ষন ফটোগ্রাফি-ভিডিওগ্রাফি করে তার এখন ঘুম ঘুম লাগছে। পাত্তা দিবে কি দিবে না এই ভাবনায় সে হেড-রেস্টে মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কিছুক্ষন পর ফোনে নোটিফিকেশন আসে। “Priyontina tagged you in her story”
সবাইকেই একে একে দেখা যাচ্ছে। শেষে সুপারজুমে মশি। বিড়ালকে মডেল বানিয়ে এপাশ ওপাশ রেখে ছবি তুলছে। মশি পাশ ফিরে দেখে সবাই চেক করছে যার যার ফোন। সে প্রিয়ন্তির দিকে তাকিয়ে দেখে আলতো হেসে মেয়েটা কি যেন পড়ছে।
প্রিয়ন্তিকে তার খালাতো বোন ডিএম করেছে, “ Moshimushi কে? ভাল সুন্দররে ভাই।”
“ হ্যাঁ হট। কিন্তু লাভ নাই। Engaged.”
চিরাচরিত গ্রামবাংলার অপরূপ দৃশ্য ছুটে বেড়াচ্ছে তো ছুটেই বেড়াচ্ছে। মশি এখন আয়োজন করে কল্পনা করবে। সে এসব গাড়ি-রাস্তা-সুন্দর গ্রাম, কিছুর মধ্যেই থাকবে না।
আহ্নাফ অনেকক্ষণ ধরে খুব সুন্দর আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে Ukelele বাজাচ্ছিল। তার চোখে-মুখেও কোন একটা স্বপ্ন ঘুরছে। তার ভাল লাগাটা আজ একেবারে নিখাদ ভাললাগা। অন্য যাবতীয় বিষয়গুলোর মত যা শুধু ‘ইন্টারেস্টিঙেই’ আটকে থাকছে না।
৭
সবাই গাছের নীচে বসে আম খাচ্ছে। আবীরের নানাবাড়ী থেকে প্রায় দু-মাইল আগে। ইছামতি নদীর পাশ ঘেঁষা মাটির পথে। এদের নাদান কিচ্ছাকাহিনি আবীর একেবারেই সহ্য করতে পারছে না। আর একটু পথ পেরলেই যে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য, তার নানাবাড়ী। গাড়ি পিচের রাস্তা থেকে অনেকখানি নামিয়ে এই হালচাষের ক্ষেতে এখন যথেচ্ছা বাঁদরামো না করে বাড়ীতে বসে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে তারপর ইচ্ছামত মত যা করা যেত। কমনসেন্স সব বাসায় রেখে যে যার যার বুঝে ইচ্ছেমত এ গাছে ও গাছে ঢিল ছুঁড়ে আম পেড়ে পেড়ে খাচ্ছে। কার গাছের আম, কি আম কিছু না জেনেই রীতিমত আম-ডাকাতি চালাচ্ছে। তাগাদা দিতে দিতে তার জীবন প্রায় বিপন্ন হতে চলল। নিজেরও যে এক-আধবার ঢিল ছুঁড়তে একেবারে মন চাচ্ছে না তা না। কিন্তু মামা ফোন দিতে দিতে অবস্থা খারাপ করে ফেলছিল। বাড়ীতে এলে যা সচারচর যা হয় আর কি। তাছাড়া মাও দুশ্চিন্তা করবেন। অনেকদিন পর সে মাকে দেখতে এসেছে। এত কাছে এসে এখানে বসে বসে কতক্ষন ছাগল-পাগলের বাঁদরামো সহ্য করতে ইচ্ছে হবে ! এদেরকে সব বুঝিয়েও মানানো যায় না। তাই তার ওদিকে মানাতে হয়।
একটু পরপর সাইকেলে, বাইকে, হেঁটে, গরু নিয়ে মানুষ যাচ্ছে। আগে গ্রামের মানুষের বিনোদন ছিল সীমিত। শহর থেকে সুন্দর কিছু ছেলে মেয়ে এসে ফুর্তি করছে, এ বাড়ী ও বাড়ী ছড়িয়ে গোটা পাড়াগাঁয়ে অল্পের মধ্যে খবর হয়ে যেত। এখন এমন দৃশ্যে কারও মাথাব্যথা নেই। এখানকার মানুষগুলো বরঞ্চ শহরের মানুষদের চাইতে বেশী শহুরে। এদের ভাষায়, “ আপডেট জনগণ”। একটু আগে দেখা গেল এক উঠতি টিক্টকার সাইকেলে চড়ে টিকটক ভিডিও বানাচ্ছে । ভিডিওর বিষয়বস্তু কি বোঝা গেল না। দেখা গেল কয়েক মুহূর্ত পর তাকে সাইকেল ছেড়ে দিয়ে পাশের ফাঁকা ক্ষেতের মাঝে লাফিয়ে পড়তে। পনেরো সেকেন্ডের মধ্যে পৃথিবীবাসিকে এর চেয়ে বেশী চমৎকৃত করা হয়ত তার পক্ষে সম্ভবও না। খুব-আমখেকো-প্রমাণে-ডেস্পারেট-পোলাপান গ্রাম-বাংলায় এসে এমন স্টান্টম্যান দেখে বিমুগ্ধ। কারও কারও চোখে পানি চলে আসল। না, ভুল বোঝার কোন কারণ নাই, কাঁচা আমের টকের ঝাঁঝে অনেকের চোখেই অশ্রু চলে এসেছিল।
দুর্ধর্ষ কিশোর সেই স্টান্টম্যান একটু পর তাদের দিকে ধেয়ে আসে। আজকালকার কিশোর টিকটকাররা অনেক বেশী স্বতঃস্ফূর্ত। অপরিচিত যে কারও কাছে লাইক চাইতে এদের কোনই সমস্যা হয় না। লাইকের রিকোয়েস্টের পর তাদের সাথে ভিডিও বানাতে চাইতেও এদের কোনরকমের অস্বস্তি বোধ হয় না।
“ আচ্ছা ভাই, আপনার আইডিয়াটা কি শুনি?” আহ্নাফ জিজ্ঞেশ করছে।’
“ আপনি আপুকে নিয়ে হেঁটে যাবেন, আমার আপুর ওড়নার সাথে ধাক্কা লাগবে।”
“ একসাথে চারটা আপুর ওড়নার সাথে ধাক্কা খাইতে পারবেন? নতুন কিছু হবে। চিন্তা করে দেখেন।” আহ্নাফের অদ্ভুত আইডিয়ায় স্টান্টম্যানের চোখ তারার মত জ্বলজ্বল করছে। সে ধাঁধাঁয় পড়ে গেছে। কীভাবে কি করা যায় এটা চিন্তা করার জন্য সে একটু সময় নিল। মশি একটু দূরে রুশো আর মেয়েদের নিয়ে আম-ঘটিত বিবিধ এক্টিভিটির বি-রোল শ্যুট করছিল। এদের সবাইকে হাঁক ছেড়ে ডাক দেয়া হয়। কেউ পাত্তা দিল না। যে যার মত ব্যাস্ত।
স্টান্টম্যান অনেক চিন্তা-ভাবনা শেষে আহ্নাফকে জানায়, “ ভাই পাইছি। চারটা আলাদা ভিডিও শ্যুট করে এরপর পরপর পরপর জোড়া লাগায়ে দিমু। পরে ইফেক্ট মাইরা আরও সেই বানায়া হালামু। লাইক পড়ব চব্বিশ হাজার।”
এদের সাথের ড্রাইভার ভাই টিকটকার ছেলেটার এমন রগরগে ভাবনা-দর্শন দেখে শিহরিত। একটু পর তাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। যাওয়ার আগে একপাশে বসে সে আবীরের দেয়া একটা ছোট মামের বোতলে একটু একটু করে মদ গিলছিল। সারাটা পথ একবাক্য কথা ছাড়া এসে এখন এই সুন্দর আমগাছ তলার ছায়ায় বসে নির্ভেজাল বাতাস খেয়ে তার মাথায় আরও চমকপ্রদ একটা আইডিয়া আসে।
“ আমি গাড়ি চালামু আর আপুরা গাড়িতে থাকব। তুমি আইয়া গাড়ি দেইখা ফাল দিয়া আয়া ডাইভ দিবা। ও আরও ভাল, ভাইয়রাও থাকল। তাইলে আমারে সহ গাড়ি সহ একলগে নয়জনের সাথে বারি খাইতে পারবা।”
“ ভাই, আপনি দেখি সায়েন্টিস্ট।” আবীর প্রশংসা না করে পারল না।
“ সাথে বিড়ালের বাচ্চা আছে একটা। ওয়ার্ল্ড রেকর্ড না হইলেও টিকটক রেকর্ড হয়ে যাবে, ইনশাল্লাহ ! ড্রাইভার ভাইয়ের আইডিয়া আসলেই চমৎকার। আপনি ওইপাশে যেয়ে আরেকটা চিন্তা দিয়ে দেখেন, আমরা আসি।”
“ হ, ধাক্কার ওজনটাও বাড়তেছে সাথে। চিন্তা করেন!”
“ আরে ভিডিওর ওজনও তো বাড়তেছে, মিয়া।” আবীর চোখের ইশারায় স্টান্টম্যান্কে দুর্ধর্ষ ব্যাপারটা গুরত্বসহকারে ভেবে দেখতে বলে।
স্টান্টম্যান বুঝতে চাচ্ছে এরা কি তার জীবনকে কোন ছোট-খাট তামাশা ভেবে মজা করছে কিনা। দৌড়তে দৌড়তে নুজ্হাত এসে বলে, “ এই তাড়াতাড়ি উঠ সবাই। টয়লেটে যাইতে হবে।”
আবীর ঠায় বসে থাকার আদেশ দিল সবাইকে। ড্রাইভার-আহ্নাফ কেউ নড়ল না।
“ আরে কি সমস্যা, গাড়ি ছাড়ে না কেন?” ততক্ষনে বাকিরা গাড়িতে এসে বসল।
“ গাড়ি নষ্ট। যাবে না। মিস্ত্রি আস্তেছে ঠিক করতে। ক্ষেতের মধ্যে নিয়া ঢাল্ছ, ইঞ্জিনে মাটি ঢুকছে।”
“ আবীর ফাইযলামি কইর না বাবু। বাড়ীতে চল। স্যরি, এরপর তোমার সব কথা শুনব।” নুজ্হাত কাতর কন্ঠে সুধাচ্ছে।
“ এই আসলেই কি গাড়ি নষ্ট?” অর্নিকার শাড়ি বদলাতে হবে। আমের রস পড়ে আঁশটে গন্ধ বেরুচ্ছিল ওর শাড়ি থেকে।
“ ভাই চাবিটা দেনতো, আমি একটু দেখি।” মশি ড্রাইভারকে বলে। জানে আবীর ইচ্ছা করেই মজাটা করছে। ড্রাইভার আবীরের দিকে তাকায়। তার জন্য একই আদেশ বহাল থাকে। তার খারাপ লাগছে না মেয়েমানুষের সাথে মজা নিতে। বরঞ্চ মদের সাথে ভালই যাচ্ছে ব্যাপারটা।
“ এই ছেলেটা কি দেখে?” রুশোর কৌতূহল স্টান্টম্যান্কে নিয়ে।
দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। স্টান্টম্যান চোখ নামাচ্ছে না, খুটিয়ে খুটিয়ে রুশোকে গভীর দৃষ্টিতে দেখছে। রুশো ফিসফিস করে বলছে, “ So gay, dude!”
“ এই ভাইয়া, আমার নাম অর্নিকা। আমি কি দেখতে জোস্ না?” অর্নিকার হাত-মুখে অঙ্গভঙ্গি যেন না ঠিক, নৃত্যভঙ্গির হাস্যরস। স্টান্টম্যান লজ্জা পেয়ে শেষমেশ সাইকেল নিয়ে চলে যায়। আহ্নাফ তার এমন মধুর গমন উপলক্ষে মিষ্টি সুরে ইউক্যালেলে বাজায়।
“ কিরে আবীর ! কতক্ষণ লাগবে? গাড়িতো এতক্ষন ঠিকই ছিল, কি ঝামেলা হইছে?”
“ লাইলি, চুপ থাক। ও মজা নিতেছে। দেখি কতক্ষণ পারে।” নুজ্হাত সহ্যের খেলায় জিততে আগ্রহী। যেমন কুকুর তেমনি মুগুর।
“ তুই পাদ খাবি আমার? আমার পায়খানার চোদনে পাদ্ আস্তেছে ভাই।”
“ইসস্ লাইলি! খাসরা! যা বাইরে যায়া পাদ দে।”
“ ভাই কেউ হাসিস না, হাসলে কিন্তু পাদ ছুটে। লাইলি তুই আস্তে-আস্তে নাম, সাবধানে।” প্রিয়ন্তি ফোনের ক্যামেরা অন্ করল, সম্ভবত লাইভ করছে। পুরনো শোধ নেয়ার এখনি সুবর্ণসময়।
“ বুঝলাম না, কেউই দেখি হাসির কথায় হাসে না। সবার ক্রনিক পাদ আস্তেছে নাকি?” মশির জোকে প্রিয়ন্তির লাইভ মুহূর্তের মধ্যে জমে গেল।
নুজ্হাতের চোখে-মুখে রক্ত জমাট চাপ। “মাদারচ্যুত আবীর। তোর নানাবাড়িতে যায়া তোর ইজ্জত যদি না খাইছি, তাইলে তোর বাপ্রে আমি চুদি !”
আবীর নির্বিকার। ফোনে ছবি ওঠাচ্ছে না ভান করছে দূর থেকে জানা যাচ্ছে না। আহ্নাফ এই বৈরাগী রাগের সাথে জুড়ে গান গাচ্ছে, “ তুমি যে আমার কবিতা, আমারই হাগুর রাগিণী… আমার স্বপন আধো-জাগরন, চিরদিন তোমারে চিনি।”
“ দিছে কাম সাইরা।” না এদের কেউ না। কুটি রুশোর পাঞ্জাবীতে বসে চারপাশ অতি-নিষ্পাপ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিল। যেন তার পেছন থেকে মাত্রই কোন ভাজা-ভাজা নিরেট দর্শন নির্গত হল। “দেখি লাইলি সর, নামতে হবে।”
“ না, বসে থাক্। সবাই ভাইয়ার গাড়িতে আজকে হাইগ্যা ভাসায়া দিব।”
“ এই আবীর ! এগুলা গাড়িতে হাগার প্ল্যান করতেছে।”
আবীর গাছের আড়ালে চলে যায়। সম্ভবত ইয়ে করছে। মুখ দিয়ে কোন কথা না বললেও ইয়ে করতে যাওয়ার ভঙ্গিমায় ‘শো-অফ টেণ্ডেন্সি’ প্রবল।
মশি উপায় না পেয়ে এদের বুঝাতে গাড়ি থেকে নামে। “ এইডা কি করতছছ তুই ! মান-ইজ্জত খাবি নাকি বাল্ ! এই ভাই আপনার গাড়ি নোংরা হইলে কি সমস্যা হবে না?”
“ ভাই, আপনারা তো জামা-প্যান্ট খুইলা হাগবেন না। হাগ্লে আপনাগো পাছাতেই লাইগ্যা থাকব। বসেন বসেন শক্ত হইয়া বসেন। যাইতেও তো সময় লাগব। খিচ খায়া বইসা থাকেন।”
“ আপনি কি কিছু খাইছেন?”
“ নাহ্ ! কি খামু? খাওয়ার মত কিছু আসে আপনাগো লগে?”
মশি আবীরের দিকে তাকায়। পেছনে হাসাহাসির ঝড়তুফান বয়ে যাচ্ছে। এতদুর থেকে আইডিয়া করা যাচ্ছে না, সম্ভবত পাদের ধুম পরে গেছে।
“ মিয়া চাবি দেন্। নাইলে কাপড়চোপড় খুইল্লা রাইখ্যা দিমু সব। আমারে চিনেন না, এখানে কেউ আপনারে বাঁচাইব না।”
“ আমার ভাই আছে এইখানে দুইটা। আপনে কেডা মিয়া বাল্ ! আমনেরে আমি অক্ষন থেইকা চিনি না।”
“ মশি চলো,এইখানেই ক্যাম্প করি। জায়গাটা ভালই সুন্দর। এক্কেবারে কবি জসিম উদ্দিনের বর্ণনার মত। কত সহস্র গান যে মাথায় ঘুরতেছে।” কেউ কারও চাইতে কম না। আহ্নাফও কম যায় না।
“ ওকে। ওকে। অনেকক্ষণ ওয়েট করাইছি আপনাদের। স্যরি, আসলেই স্যরি। এবার চলেন ভাই।”
“ স্যরি কেন? তোমার ছবি তোলা শেষ না হইলে আমরা যাই কীভাবে? প্লিজ ক্যারি অন্।”
“ ভাই আমরা এখানে ঝগড়া করতে আসি নাই।”
“ না আমরা তো ভ্লগ করতে আসছি। এখনও অনেক সুন্দর লাইট পাওয়া যাচ্ছে। একটু পর তো অন্য লাইটে সবাইকে ভুত-পেত্নির মত দেখা যাবে। এগারোটার রোদ তো মহাপ্রাণ সূর্যের আশীর্বাদ। একটা ভ্লগার এটা মিস্ করবে কেন?”
মশি ফিরে আসে। গাড়িতে মুখ থমথম করে বসে আছে। প্রিয়ন্তি জিজ্ঞেশ করে, “ মশি আহ্নাফ কি বলছে তোকে?”
“ চুপ করে আছছ ক্যান বল?”
“ এই প্রিয়ন্তি থাক্। এখন না। পরে…” নুজ্হাত ব্যাপারটা আপাতত মাথায় নিতে নিষেধ করছে।
“ ড্রাইভারের কি হইছে ? হালারে কি মাল-সাল খাওয়াইছে? ঢুলতেছে দেখ্ কেমনে!”
“ রুশো এইটারে এভাবে ছাড়া তো সেফ্ না। এক্সিডেন্ট করতে পারে।”
“ মরুক যায়া বাইনচোদ ! তারে দিছে পরে খাইতে, নাটকির ছেলে এখনই মাইরা দিছে। কমনসেন্স নাই, কিছু নাই….”
“ আরে সে যে নিজেই মরবে এটার কোন গ্যারান্টি আছে ! মারবে তো ভাল একটারে।”
“ রুশো তুই একটু যা। যেয়ে আবীরকে কোনভাবে ধইরা নিয়া আয়। হালায় মা’র বাড়ীতে আইসা গুষ্টির সামনে মাইর খাইলে সিধা হবে।”
“ না। হ্যাভ পেশেন্স।” মশি অবশেষে কিছু বলে।
“ তোমার পেশেন্সের মারে বাপ ! আমারও হাগা আসছে। ইনফ্যাক্ট সবারই আসছে। একটু আগে পাদ দিয়ে একাকার অবস্থা করছি সবাই…
ভাই থাক্ না! বলার কি দরকার। পারফিউমের স্মেল থেকে টের পাওয়া যায় ভাই।”
“আশেপাশে কোন বাড়িঘরও দেখতেছি না। নাইলে এতক্ষন বসে থাকে কে !” অর্নিকা ইতিউতি তাকিয়ে আশা খুঁজছে। যেন কাউকে পেলেই সাথে সাথে ধরবে।
“ আহ্নাফ! তুমি ওইখানে কি করতছ !” প্রিয়ন্তির মাথার তার ছিঁড়ে গেছে। এরকম মেজাজ তার জীবনকালে উঠে নাই। ফোনে স্বাভাবিক স্বরে বলে নি কথাটা, চিৎকার দিয়েছে প্রায়। আশপাশে সবাই কানে হাত দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।
আবীর মুচকি হেসে ধীরেপায়ে এগোচ্ছে। ড্রাইভার ভবের সাগরে এমন চাছাল হস্তক্ষেপ মেনে নিতে পারছে না। তার কোনরকম হেঁটে আসার ভঙ্গীতে অপমানের ভাব স্পষ্ট। আহ্নাফ আসছিল মাথা নিচু করে। লাইলি বলল, “ ঝাড়ি খায়া এখন বান্ধা রামছাগলের মত সিধা আসতেছে। কি লাভটা হইল !”
“ থাক বেচারা। চিনে না কাউকে। আস্তে আস্তে ঠিক হবে। একটু টাইম লাগবে।” অর্নিকা এ বিষয়স্ত মনস্তত্বের ভাবি-শিক্ষিকা।
“ আমরা এখানে মজা করতে আসছি প্রিয়ন্তি, এগুলা এখন পাত্তা দিস না, পরে ঠিক টাইমে ঠিকমত সুদে আসলে বুঝে নিবি।” নুজ্হাতও স্বর মিলায়, তাতে অবশ্য ছাড়ের সুর নেই।
“ ইয়া, হ্যাভ পেশেন্স, মাই ফ্রেন্ডস।”
“মশি স্যরি”। প্রিয়ন্তি মিষ্টি করে বলে। মশি এখানে কোন ছক কষে নি। সবে শুরু কিন্তু তার প্রবল মনে হচ্ছে একটা কিছু আগে থেকেই একদিক থেকে মেলা আরম্ভ করেছে।
“ তোমার স্যরি বলার মত কিছু হয় নাই। আমরা টাইম ওয়েস্ট করছি দেখেই ওরা পেইন খাইছে। আজাইরা পেইন কেউ কাউরে দিব না আর। ঠিক আছে?
৮
তারা বিশ্রামের জন্য যে ঘরটায় এসে উঠেছে এটা প্রায় ষাট বছর পুরনো। দোতলা কাঠের বাড়ি। চারপাশে কোন জংলা নেই। পরিকল্পিত সুপারি বাগান আর তার পেছনে বিশাল কুমড়োর ক্ষেত। আবাদি জায়গা। গ্রামের নাম যে চাষী বালিগাও। আবীরের নানা একসময় চাষী বালিগাও-এর সবচেয়ে বড় আড়তদার ছিলেন। ধানের মৌসুমে ঢাকা থেকে বড় আরতদারেরা নৌকা বোঝাই করে বস্তার পর বস্তা বেঁধে ইছামতির রুট ধরে বন্দরে নিয়ে যেত। ঝড়ের সময়ে প্রায়দিন এ বাড়ীতে আশ্রয় নিতে হত তাদের । অদুরে ইছামতি। বর্ষার সময় উথাল নদী তার পাড় ঠেলে পানি উঠিয়ে দিত। এক এক করে বিশাল আবাদি জমিগুলো পরিণত হত বড় বড় একেকটা বিলে। অনেকে তখন বন্দুক টন্দুক নিয়ে আয়োজন করে সারস শিকার করতে বের হত। যার নমুনা আজঅব্দি এ বাড়ীতে সংরক্ষিত। বাড়ীতে উপরে ওঠার সিড়ি আছে দুটো। ঘরের শেষমুখে কাঠের সিলিং লাগোয়া একটা, অপরটা বাড়ির পেছন থেকে উঠে দোতলার দশ-হাত বারান্দায় এসে থেমেছে। দুটো হেক্লার রাইফেল ঘরের সিঁড়িটার পাটাতনের খাঁজে বেঁধে রাখা ছিল। আবীর সেই খাঁজ থেকে ভাত্রি প্রতিম হন্তারকদ্বয়ের আলগা অংশগুলো বের করে জোড়া লাগিয়ে বন্ধুদের দেখাচ্ছে। তার ছোট ভাগ্নেদের এ ব্যাপারে আগ্রহ তার চাইতে কয়েকগুণ বেশী। আগ্রহের ওজন বুঝতে না পেরে বিচ্ছু দুটা হুমড়ি খেয়ে উপরের বারান্দার দরজার পাশে ঝোলানো ভারী হেক্লারটা নামিয়ে, হাতে রাখতে না পেরে ধপাস করে পড়ে যায়। পুরো ঘর মৃদু শব্দে কেঁপে ওঠে। আবীর আশ্বস্ত করে বলে, সিলিং এত সহজে ভাঙবে না। একেকটা তক্তা চল্লিশ কেজি ভারী। সেসময় বড় বড় মেহগনি গাছের শক্ত গোঁড়াগুলো দুভাগ করে কেটে বাধানো হয়েছিল।
“ তোর নানারা জমিদার ছিল?” রুশো জানতে চায়।
“ নামকরা।”
“ কতবড় পাল্লা রেখে দিছে দেখছস্?” দোতলায় কেউ থাকে না। সন্ধ্যার পরে এখানে জালালি কবুতরের ঝাঁক এসে ঘুমায়। এই ঘরটার একপাশে পুরনো আসবাব ঠেশে রাখা। বড় একটা পাল্লা তার মধ্যে জলচৌকির সাথে পড়ে আছে।
“ এইটা দিয়ে সোনাদানা ওজন করত আমার নানা।” আবীর গর্ব করে বলছে।
“ আমার বাল্। তোমার নানা শাউয়ার আওরঙ্গজেব আসছে ! এইডায় চালের বস্তা ওজন করে, শালা চাপাবাজ।” মশির কথায় না হেসে উপায় নেই।
“ তোমার নানা ছিল আড়তদার, সে মাপত চাল। আমার নানা ছিল জমিদার সে মাপত সোনাদানা।” আবীরের বড়াইের পারদ ওই পাল্লা দিয়ে মেপে কেনা।
“ মামা, এইদিকে আস তো একটু।” ভাগ্নে দুটা পিঠাপিঠি। জন্মেও, কাজেও। একজন আরেকজনকে ছাড়া বোধহয় নিশ্বাস নিতে পারে না। মশি কাছে ডাকতেই দুজন ছন্দের মত তাল মিলিয়ে ছোট ছোট পা ফেলে কাছে আসে।
“ তোমার দাদা কি করত? জান?”
“ চালের ব্যবসা করত।” পিচ্চি দুটোর সহজ স্বাভাবিক উত্তর।
“ জমিদারের পোলারা জমিদারির পর কি করছে আগে জানিস্। সবাই চালের আড়ত দিত।”
“ আচ্ছা। ‘জমিদারপিডিয়ার’ ফাউণ্ডার। তোর একটা কথাও আমি জীবনে ঠিক হইতে দেখি নাই, সত্যি হইতেও শুনি নাই। তোর নানা হইতে পারে জমিদার ছিল। কিন্তু যেমনে বলতছস ওইরকম যে না এইটা ভালমত জানা আছে।”
“ তুমি তোমার কাম কর। বাল্ বেশী পকপক চুদাইও না।”
“ হ্যাঁ, ভাল কাজ কর। গ্রামীণ আবহে সাজ-সজ্জার এসথেটিক শট নাও।” আহ্নাফ ইয়ারকি করা থামায়নি মশির সাথে। মেয়ে বলতে নুজহাত আর প্রিয়ন্তি এখানে। নুজহাত খাটে বসে আরাম করছে আর প্রিয়ন্তি হালকা সাজ নিচ্ছে। ওর সাজে কখনো আয়োজন বোঝা যায় না। দেখে মনে হবে সেজেছে, কিন্তু কীভাবে সেজেছে ধরতে ধরতে বেলা ফুরিয়ে যাবে।
“ তোমার গ্রামের রাস্তায় শাড়ি পড়ে মদ খাওয়ার ফ্যান্টাসি নাই প্রিয়ন্তি?” আহ্নাফ তখনও চেষ্টা করছিল ওর রাগ ভাঙাতে। কিন্তু প্রিয়ন্তি গা করছে না। “ না” । ভিন্টেজ আয়নাটার সামনে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল।
“ওড়না কি পড়ব?” আয়নার দিকে তাকিয়ে সে কিছুটা দ্বিধায় আক্রান্ত।
একসাথে চারটা ছেলে তড়তড় করে তাকিয়ে আয়নার সামনে মেয়েটার সাজভঙ্গিমা দেখছে। প্রিয়ন্তির লাজ নেই, মোহও নেই এসবের প্রতি। যেন ও পুরনো আয়নাটার মধ্যে ঢুকে গেছে। আয়নার একপাশ থেকে গাড় নীল ব্রকেডের ওড়না সরিয়ে সে নিজের সাদা গায়ে আলতো করে জড়াল। জানালা থেকে মন উদাস করা শুভ্র আলোর বিচ্ছুরণ প্রিয়ন্তির সারা শরীর ভেদ করে সবার চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে মহুর্মুহ। এরা আত্নগোপনে লক্ষ্য করছিল কোন মখমলের ছবির নিখুঁত কারুকার্য। তাদের মন জানাচ্ছে এক অশুভ অপ্সরীর সাদা কামিজে চিকন জরি সুতোর এম্ব্রয়ডারি লক্ষ-লক্ষ ভিনগ্রহের জোনাকের মত নিভুনিভু জ্বলছে, ভাসছে। নুজ্হাতের ইচ্ছা করছে নিজের চোখ গেলে ফেলতে। তা সে করতে পারছে না। তাই বলে আবীরের তাকিয়ে থাকাও কি সহ্য করতে হবে এভাবে! প্রেমিকের চোখজোড়া সে হাত দিয়ে ঢাকতেই সবার ধুন কেটে যায়। ছেলেরা একেকজন একেক বাহানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে তখন। মশি সিগারেট নিয়ে যায় বারান্দায়। রুশো লাইলি-অর্নিকার খোঁজে যায় নীচে। গিয়ে দেখে দুজন সোফায় হাঁ করে দুপাশ নিয়ে ঘুমাচ্ছে। খারাপ লাগছে না রুশোর এই রূপসীদের এমন অন্য আলোয় দেখতে। তবে এদের ভাগ্য ভাল যে কিছুক্ষণ আগের দৃশ্যটা তাদের সহ্য করতে হয়নি। আহ্নাফের ভাগ্য সম্ভবত সবচেয়ে ভাল কারণ সে দেখল গোটা দৃশ্যটা খালি পায়ে হেঁটে আলো জড়িয়ে তার পাশে এসে মুখের কোনায় মিষ্টি হাসি ধরে বসে পড়ল।
বারান্দায় জালালি কবুতরগুলো জোড়ায় জোড়ায় বাক্বাকুম করছে। কার খুশীতে কে জানে? মশির কাছে কোন উত্তর নেই।
৯
লাইলি অসুস্থ। পট করে শুয়োরের পাল দেখতে যেয়ে প্রচন্ড দুর্গন্ধে সে সেখানেই বমি করে ফেলে। এরপর থেকে শরীরের অবস্থা খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে জ্বর আসবে। সুস্থ মাথায় থাকলে সে জ্বর-টর বিশেষ একটা পাত্তা দেয় না। নেশাগ্রস্ত মাথার ধরনই ভিন্ন। ক্রমাগতে বাড়ি খেতে থাকা ধারণাগুলো সেখানে একান্তের আত্নিয়ের মর্যাদা পেয়ে যায়। জ্বর আপাতত সরাসরি না এলেও তার মন নিশ্চয়ই জ্বর বাঁধিয়ে ফেলবে।
“ রুশো তুই কেন ছ্যাবলার মত আমার জন্য দাঁড়ায়ে আছিস। তুই ওদের সাথে যেয়ে শুয়োর পিটা, যা। যা…”
“ আম্মাজান, ওইটা আবীর। আমার ছোট ছেলে। রুশো তোমার বন্ধুদের সাথে আছে। তুমি ঘুমাও তো আম্মা। আমি আছি এইখানে।” আবীরের মা লাইলির মাথায় হাত বুলোতে-বুলোতে বলছে।
“ আপনি ঢাকা থেকে চলে আসছেন আন্টি ?”
“ নাগো আম্মা। আমিতো এই বাড়ীতেই থাকি সবসময়। এই আবীর, তাড়াতাড়ি যা। ধীরেন বাবুরে ধরে নিয়ে আয়। কি অবস্থা মেয়েটার! গা সাংঘাতিক গরম। আসছে, মজা করতে, হয়ে গেল অসুস্থ। ইশ্। তাড়াতাড়ি যা।”
“ আম্মা মাথায় পানি ঢেলে শোয়ায়ে দাও। ঘুম থেকে ওঠার পর দেখ কি অবস্থা দাঁড়ায়। আমার মনে হয় ঠিক হয়ে যাবে। কি লাইলি? ভুল কিছু বলছি?”
“ নাহ,। আন্টি কিছু হয় নাই। আপনি টেনশন কইরেন না। কিন্তু এখনও শুয়োরের গন্ধ পাচ্ছি কেন? কে গোসল করে নাই, আন্টি আপনি?”
আবীরের মা লজ্জায় তার আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে। পরে মনে হল মেয়ে জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে। অসুস্থ হলে এমন হতেই পারে। আবীরের দিকে রাগী ভঙ্গিতে তাকিয়ে বললেন,
“ এই যা, নাসিমারে গরম পানি বসাইতে বল চুলায়। খায়ে দায়ে কাম পায় না। ঢাকা থেকে আসছে শুয়োর দেখতে। শুয়োর কোন দেখার জিনিষ হইল? আমার তো তোরে বাসায় ঢুকতে দেয়াই উচিত হয় নাই। অশুচি পোলা কোনহানকার! এক্ষন পানি গরম করে গোসল দে। আসলেই বিচ্ছিরী গন্ধ আসতেছে গায়ের থেকে! ”
“ আম্মা, আমি কয়বার গোসল করব?”
“ শুয়োর দেখাইতে নিয়ে যাওয়ার সময় মনে ছিল না ? সুন্দর পাখি থাকে না এ গ্রামে! নদীর ধারে কি পাখি দেখানো যাইত না?”
“ শুয়োর দেখলে হাসি আসে আম্মা, মজার জন্য গেছিলাম। সবাই বলছে দেখে, নাইলে আমি যাইতাম নাকি? আর মেথরপট্টিতে মশি ভিডিও করব কইল দেইখা নিয়া গেলাম। পাখি দেখাও প্ল্যানে ছিল। কিন্তু লাইলির বাচ্চা তো দিল সব বিগড়াইয়া।”
“ ভিডিও এগুলা কারা দেখব?”
“ দেখে তো অনেকেই। ইউটিউবে ছাড়ে। বাইরের দর্শকও দেখে।” আবীর উৎসাহ নিয়ে বলে।
“ আন্টি আংকেল কি ঢাকায় আরেক্টা বিয়ে করছে?” লাইলি এই জ্বরের ঘোরে কখন যেন আবীরের ফেসবুক প্রোফাইল ঘেটে কিছু পুরনো ছবি বের করে। প্রশ্নটা তার মাথায় উচ্চারিত হচ্ছে। এসব প্রশ্ন পুরোপুরি পাগল অবস্থায় চলে গেলে কারও কারও মুখে এসে পড়ে। তার নিজেকে বোঝাতে হয় অমন পরিস্থিতি এখানে তৈরি হয়নি। অনেক কষ্টে লাইলি নিজেকে সংযত করে। ভীষণ অবাক চোখে আবীরের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন অনেক কিছু বোঝার ইচ্ছে হচ্ছিল লাইলির। আচ্ছা এমন ভাবলে কি হয়? যে সে ঘুমরত এবং যা দেখছে, ভাবছে সব তার স্বপ্নে ঘটছে! ঘোর যখন পিছু ছাড়ছে না, তাহলে একে স্বপ্নে ছেড়ে দিলে কেমন হয়? ঘোর-স্বপ্নে অন্য কারও বাম হাত সে থাকতে দেবে না। সবাই বিশ্বাস করে বানিয়ে দেখা স্বপ্ন নাকি অসাধারন হতে হয়। চেনা-পরিচিত মানুষদের নিজের সাধারণ স্বপ্নে বেঁধে রাখা কি সৃষ্টির জন্য অপরাধ? মানুষ এমনিতেই একটা অদ্ভুত সত্ত্বা। তার অদ্ভুত সময়ে অদ্ভুত কিছু প্রবল ইচ্ছে জন্ম নেবে, এটাই কি স্বাভাবিক নয়?
“ আবীর উনি কি তোর সৎ মা?”
আবীর চুপ করে আছে । লাইলি তার সামনে যেয়ে ওর চেহারাটা দেখতে চাচ্ছে, পারছে না। সে উল্টো ফিরে যেভাবে শুয়ে আছে সেখান থেকে আবীরকে আবার দেখার চেষ্টা করল। তার মাথা লাটিমের মত ঘুরছে। সেই একই চিত্র ঘুরে আবার ডান পাশেই আসল। ডান-বাম দেখার চেষ্টায় একটা ইনফিনিটি লুপের ধাঁধার ভেতর নিজেকে দেখতে পায় সে। মনে হচ্ছে এই বিশেষ পরিস্থিতির কোন শেষ নাই। চোখের পর্দার ভেতর থেকে রুশোর সাদা ছায়া বলছে, “ এটা জেনে কি হবে?”
“ কারণ আমার রুশোর জন্য খারাপ লাগতেছে।” আচ্ছা রুশো আসল কোথা থেকে? সে দেখি সত্যিই ছেলেটাকে ভালাবাসে ! কি আজব ! এত গোপন কল্পনাতে অজান্তেই যে বিচরন করতে পারে তাকে নিয়ে সে কি করবে? নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারবে তো কিছুদিন পর?
“ লাইলি তুই এত অদ্ভুত কেন? তখন শুয়োরের পাছাতে পারফিউম মেরে দিতেছিলি?” রুশো আবারও প্রশ্ন করছে।
“ আমি খুব হাসতে চাচ্ছিলাম, এজন্য।”
“ হাসতে হাসতে মাথা ঘুরায়ে বমি করে ফেলছ, ভাল হইছে। আচ্ছা তোর কল্পনায় আমার এত ফালতু কাজ কেন? আমি কি মানুষ হিসেবে এতটাই সহজ? অন্যকিছু কি ভাবতে পারিস না? ”
“ তুই এক্ষণই এমন একটা মানুষ হবি, ওয়েইট...এমন একটা কাজ কর যাতে আবীরের মন খুব ভাল হয়ে যায়। এই ছেলেটা আমাদেরকে ওর কষ্টের কথা কিছু বলে না। ও অনেক কিছু হাইড করে সবার থেকে।”
“ নুজ্হাত ওকে ডাম্প করছে আর আমি সাথে সাথে নুজ্হাতকে প্রোপোয করছি। গেস হোয়াট ! শি সেইড ইয়েস টু মি।”
“ মানে?”
“ তুমিই তো বললা আবীরকে খুশী করতে। আমি করলাম।”
“ এইটা খুবই লেম ছিল।”
“ তোর কি আবীরের আম্মুকে হাগ্ করতে ইচ্ছা করতেছে?”
“ না। নিজের মাকে হাগ্ করতে ইচ্ছা করতেছে।”
“ কোথায় করবি?”
“ একটা বিদেশী মা’র টুম্বস্টোনের সামনে দাঁড়ায়ে।”
“ কেন?”
“ কারণ আমার মাথায় এই সাররিয়েল ইমেজটা আপনাআপনি এসে পড়ছে।”
“ তোর কি ধারণা তোর মা বেঁচে আছে?”
“ আম্মু মারা যাবে কেন? লাস্ট উইকে একটা পোস্ট দিলাম না, দেখিস নাই?”
রুশোকে সে আর দেখতে পারছে না। তার চোখ জুড়ে অন্ধকার। সে অবচেতনে নিজের গোপন দুঃখ গাঁথা গুলিয়ে ফেলেছে। যে সত্য কেউ জানে না। সুস্থ হয়ে রুশোকে দেখলে হয়ত লাইলির এখন লজ্জাই লাগবে। তার মমতার কোষটায় হঠাৎ এই ছেলের এত উপস্থিতি কেন, বুঝতে কিছু দেরী হয়। কাঁধ ধরে হাত ধরে পরম স্নেহে তাকে বাড়ী পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে আসাই কি কারণ? নাকি অন্য কোন বন্ধু তার খোঁজটিও এখন পর্যন্ত নেয় নি দেখে সেই কারণে ?
“ তুমি ঠিক আছো বন্ধু?”
“ কে এটা?”
“ নুজ্হাত। বেশী খারাপ লাগলে বল আমরা ঢাকায় ব্যাক করব। ”
“ আররে পাগল নাকি তোরা।” লাইলি ধুপ করে উঠে বসল।
“ আমাদের ভূত ধরার কথা না। চল এখনই উঠ ! ভূত ধরব আর আরও মাল খাব।”
সামনে থাকা লাইলীর বায়বীয় বন্ধুরা এই কথা শুনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মশি আবীরকে উদ্দেশ্য করে বলছে, “ মামা, গাঞ্জার সাথে কি মিশাইছস, শালি তো এখনও পিনিকে!”
এই গল্পে লাইলির আর অংশগ্রহণ নেই। অন্যদের এখনও কিছুটা যাত্রা বাকি। তবে সে আধো ঘুম-আধো জাগরণে বাকি সবার সাথেই ছিল। কীভাবে ছিল তা শুধুই লাইলির একান্তের গল্প। বাকিরা জানলেও তাদের বোধগম্য হবে না। আনন্দের সময়গুলো নির্বিঘ্নে কাটাতে মানুষ স্বার্থপর আচরণ করে। কারও জানার ইচ্ছা হয় না অন্যরা কেন তাদের গল্পে নেই।
১০
নদীর পাড়ে জোছনার আলো নেই। আসবার আগে অনেকের ধারণা ছিল এদিকে দল বেঁধে জ্যোৎস্না-স্নান করা হবে। বেরসিক মেঘ গোটা আকাশ ঢেকে রেখেছে। মনে হচ্ছে কেউ নিড়ানি দিয়ে পরতের পর পরত ধরে স্নেহের আকাশে কালো মেঘের দেয়াল সাজাচ্ছে। মানুষ সূর্যের আলো থেকে হয়তবা বাঁচতে চায়। কিন্তু অসীম নক্ষত্রের বিকীর্ণ প্রতিফলন গায়ে লাগিয়ে রাখতে চায়। চাঁদ ধরাধামের এমন প্রাণীদের জন্য একমাত্র উপলক্ষ হয়ে আছে। আজ চাঁদ দেখার ছুটি নেই, তাই কারও মন ভিজছে না। গুমোট বাতাসে হালকা বোধের উপকরণে তাদের গোপন রস খুঁজতে হয়। বোধকরি এ অসহায়দের মনের গোপন অবস্থা বলতে কিছু নেই। একজন আরেকজনের দিকে তাকাতেই সব পড়ে ফেলতে পারছে। ক্ষেত্রবিশেষে দু-একজন ছাড়া বাকিদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তাদের অনুভুতিগুলো আড়ালে বিসর্জনের জন্য একটা নির্দিষ্ট সময়ের দরকার।
“ এখানে কতক্ষণ থাকব?” রুশো ,মশি অন্যদের থেকে একটু দূরে যেয়ে পাড়ের কিনারে বসে গল্প করছে।
“ আটটা বাজে। আর এক ঘন্টা ম্যাক্স।” মশি ঘড়ি দেখে বলল। নদীর ঢেউতে প্রাণ নেই। শব্দহীন আছড়ে পড়ছে। একটু আলো পড়লে হয়ত পুরো অবস্থাটায় একটু প্রাণ পেত।
“ বারবিকিউ শেষ হবে এর মধ্যে?”
“ কয়টা হইছে?”
“ চারটা।”
“ যে কয়টা হয় এরমধ্যে। বেশিক্ষন থাকলে অন্য প্ল্যান গুলা মিস করব।”
“ অর্নিকা, আবীর,নুজ্হাত এরা তো এখান থেকে যাবে না বলতেছে। অনেক টায়ার্ড নাকি।”
“ ও আচ্ছা।” মশির বিরক্ত লাগছে।
“ ধর, বিয়ার খা। আমার গলায় আর ঢুক্তেছে না।”
“ তোর বিড়াল কই?”
“ কে জানে? মেবি লাইলির সাথে ঘুমাচ্ছে। বাচ্চা তো, সারাদিন খালি ঘুমায়।”
“ আমিতো মনে হয় এইদিকেই দেখছি। প্রিয়ন্তি হাতে করে নিয়ে আসছিল।” মশি একবার পেছনে তাকায়। প্রিয়ন্তি শিক ঘুরোচ্ছে, ব্যস্ত। আহ্নাফ ওর ছবি তুলছে। একটা মানুষের কয় হাজার ছবি দরকার ! ওদের ক্লান্ত লাগে না?
“ ওই বুমার তো প্রিয়ন্তির সাথে ঘুমানোর প্রিপারেশন নিতেছে।”
এই অন্ধকারেও মশির চেহারার রাগটা ধরা যায়।
“ ওইটারে মদের মধ্যে ভাং গুলায়ে দেই। পিনিকে দাঁড়াইব না কোনকিছু !”
“ দে। তোরে গিফট করমু কিছু একটা।”
“ আমার বিচ্ছিরী লাগে এই বালের পেইন। আসছ ফ্রেন্ডস সাথে নিয়ে। এখানে লাগালাগি করলে অন্যরা পেইন খায় না !”
“ একসাথে ঘুমাইলেই কি সেক্স হয়ে যায় নাকি?”
“ ভাই ! তুমি এত পবিত্র মন কবে থেকে নিয়ে ঘুরতস? They already made out, dude!”
“ When?”
“ A while ago. ক্যাম্পের ভেতরে ছিল দশ মিনিটের মত।” রুশো কিছুক্ষন থেমে আবার বলতে শুরু করে, “ আমার মেয়েটাকে মার্ডার করতে ইচ্ছা করতেছে। এত সুন্দর একটা বেব্, মাঝে মাঝে ডলের মত লাগে দেখতে। চোখের সামনে ফাতরামি করলে কি করতে মন চাবে, বল।”
“ ওর পারসনাল ম্যাটার। Why should we care? অন্যচিন্তা কর।” মশি মন থেকে বলছিল কি না বোঝা গেল না।
“ ধুর্বাল। I want to fuck, I mean need to… অর্নিকাকে কিন্তু হট লাগতেসে আজকে। Maybe I’ll give her a try… See through lemonish Saree, পড়ছে। আহ, মামা ! জমবে, কি বলছ? ”
“ Dunno dude. Do whatever you wish to do….”
“ পুরা ইয়েলো টোনের বেলী দোস্ত্। মানে মজায় মজায় জীবন চলে যাবে, এটারে বিয়ে করলে…”
মশি চুপ করে শুনছে। কোন কথা বলতে ইচ্ছা করছে না তার। রুশোকে মাতলামিতে পেয়ে বসেছে। অনর্গল মুখে যা আসছে বলেই যাচ্ছে। মাথার ভেতরে উন্মুক্ত নগ্নবোধ। অর্নিকা সেখানে আস্তে আস্তে কাপড় খুলছে।
“ এই মশি ! শুনে যা।” কে যেন ডাকল। দূর থেকে আসছে বলে মশি গলার স্বর চিনতে পারে না। পেছনে ঘুরে দেখতেও ইচ্ছা হয় না, কার স্বর বা কেন তাকে ডাকছে? তার আর কাজ কি এখানে? রোবটের মত অন্যদের ইচ্ছা জানতে হবে, সম্ভাবনার আওতাধীন হলে ইচ্ছাপূরণের দায় নিতে হবে। ফ্ল্যাশব্যাকে মশির ভার্সিটিতে নিজের প্রথম দিক্কার হালচিত্র ভেসে ওঠে। হারেরেরে করে সবাইকে মাথায় তুলে রাখা ছাড়া তার আসলে কোন অংশগ্রহণের জায়গা ছিল না। তার মত ছেলেরা একটা ‘টাইপো’ বিশেষ। এরা মেয়েদের উপকার করে বেড়াবে, নিজের জন্য কখনও আলাদা কিছু দাবি করতে পারবে না। আর এদের গার্লফ্রেন্ড হতে পারবে না বিশেষ কাঙ্খিত কোন সুন্দরী। খুব করে চাইলেও প্রিয়ন্তির মত কোন মেয়ে তো হতেই পারবে না।
আহ্নাফ কিছুতেই প্রিয়ন্তির আড়াল হচ্ছে না। এই অপ্সরীর ছায়ার পিছু পিছু যেন তার পথবাস। প্রতি মুহূর্তে মন বলছে এখনই পুরো বিশ্বকে জানিয়ে দেয়া উচিত যে সে এই মেয়েটির সাথে অতি-আগ্রহে ও অতি-আয়োজনে সারাটা জীবন কাটিয়ে ফেলতে চায়। প্রেমে পড়া ঠিক না, এতদিন এমনই জানত সে। একটু আগ থেকে সব উল্টো মনে হচ্ছে। লুতুপুতু প্রেমিকের মত সেধে-পড়ে চুমু খেতে খেতে তার জগতটাই যে দিশেহারা! কারও জন্য কিছু না করেও তার মনে হচ্ছে সে সবকিছু পেয়ে গেছে। আসলেই কি? এই অসাধারণ রাতটাই তো এখনও শেষ হয়নি। ঢেউয়ের লজ্জা পেয়ে মিইয়ে যাওয়া শব্দতে আর আগুনের প্রেমশিখায় এখনও ভালবাসার অনেক পথ দেখা যে বাকি। কবিরা সার্থক কথা বলেছেন। প্রেম মানুষকে পুর্ণ করে। হাজার হাজার মুহুর্তের অপেক্ষারত আবেগ, সুন্দরের শৌর্যে মহাকাল দেখতে চায়। কে কি ভাবছে তাতে প্রেমিকমনের কিচ্ছু আসে যায় না। ভেবে-ভেবে, নিশ্চুপে, ঐশ্বরিক রোমন্থনে সময়,কাল নির্বিশেষে স্থান-পাত্র, একেক করে হাওয়া হয়ে যেতে থাকে।
প্রিয়ন্তির মনে হচ্ছে এমন আয়োজন করে তার প্রেমিকা হতে চাওয়ার কি দরকার ছিল! চুমু খেতে ‘ভাললাগা’-টারই যত দোষ। এখনই এখান থেকে পালিয়ে তার অন্য কোন প্রেমে পড়তে ইচ্ছা করছে। এই প্রেম, হোপলেস্ রোমান্টিকদের আবেগ তার এক মুহূর্তেই মন থেকে গোসল করে নামিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। এসবে লাভ কি হয় মানুষের? পড়ে পড়ে শরীর ‘লাল’ করা ছাড়া? এমন কিছু দরকার, যেখানে সে ইচ্ছেমত সব অবাধ্য প্রেমগুলকে নিয়ন্ত্রন করতে পারবে। কিংবা শুধুই নিমন্ত্রন করতে পারবে। বাহ! খারাপ তো না হয় না ব্যাপারটা, “নিমন্ত্রনে নিয়ন্ত্রন”!
অন্য তিনজন এতক্ষন এদের নিয়ে মজা করে মোটামুটি ক্লান্ত। ‘লাইফ-টক’ নামক সাময়িক দর্শনে আপাতত তাদের চিন্তা আটকে গেছে।
“ নদীর লাইফ আর মাঝিদের লাইফ একই, রেস্টলেস্। একটা রাত আমাদের মত আজাইরাদের নিয়ে তাদের থাকার কোন মানে আছে!”
“আবীর আমরা নিজেদেরকে এখনও ছোট ভাবতেছি। কারণ কি? তুমি এভাবে চিন্তা কর আমাদের সুন্দর মোমেন্টসের জন্যই ওরা এই কষ্টটা করত। আমরা কি নিজেদের লাইফে সেইম কাজটাই করব না। একটা সময় নিজেদের চাইতে বাচ্চা-কাচ্চারা বেশী ইম্পরট্যান্ট হবে।”
“ নুজ্হাত, প্লিজ। তুমি মাথার থেকে একটা সেকেন্ডের জন্য হইলেও বিয়ে, বাচ্চা, কান্নাকাটি, আব্বু-আম্মু এসব চিন্তা থেকে একটু টাইম নাও। মানে আমি তো একটা ছেলে, পরে মানুষ। এখনও পুরুষ হই নাই।”
“ আবীর, লাভলাইফে থাকলে মেয়েরা মাথার থেকে এসব চিন্তা ফালায়ে দিতে পারে না।”
“ তোরা চাস্ না, অর্নিকা। চাইলে অন্যদের জন্য লাইফটা অনেক ইজিয়ার হইত। কাম অন্, আমি তোমাকে হার্ট করতে চাই না নুজ্হাত। ফেইস বানায়ো না প্লিজ। কিন্তু ইট ইয হোয়াট ইট ইয। আমি চাইলেও সারাক্ষন এসব ফ্যান্টাসিতে পারটিসিপেট করতে পারব না!”
“ এটা কোন ফ্যান্টাসি না ষ্টুপিড। এইটা ডেস্টিনি।” দুই বান্ধবি সমস্বরে বলল।
“ ভাই, আমি বাইরে ভাগমু। এত Liable হইতে কার ঠেকা পরছে?”
“ তোর বাপের, হারামজাদা। খাড়ানোর টাইমে খেয়াল থাকে না?” নুজ্হাত অর্নিকার কানে ফিসফিস করছে, “ শালারে পেইন কেমনে দেই দেখ্।” অর্নিকা মুচকি হাসছে।
“ এই মশি ! শুনে যা……” প্রিয়ন্তি আর আহ্নাফ খালি পায়ে নদীর সাদা বালুতে হাত ধরে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। তেমন কোন কথা হচ্ছিল না দুজনের মধ্যে। শুধু আহ্নাফ গুনগুন করে কিসব আনকোরা গান গেয়ে যাচ্ছিল। অবশ্য প্রিয়ন্তির মাথা হালকা হয়েছে তাতে। সে আহ্নাফকে ছেড়ে সামনের আধ-ভেজা পাড়টার কাছে এসে বসে। চাঁদ ফুটেছে। পানিতে একটু পর নীল আলোর রোশনাই ধরা পড়বে। মুহুর্তটা মশির হাতের ক্যামেরার জন্য নিশ্চয়ই বিস্ময়কর !
“ প্রিয়ন্তি, তুমি কি বোর হচ্ছ? আমি সারাদিন চিপকু হয়ে আসি দেখে? কি করব বল তোমাকে অতিরিক্ত সুন্দর লাগতেছে।”
“ প্লিজ আহ্নাফ। আমি বুঝতে বুঝতে টায়ার্ড হয়ে যাচ্ছি। তুমি অন্যদের সাথে যেয়ে একটু সময় কাটাও না কেন? আর তোমাকে দেখি কেউ কল ও দেয় না। তোমার কি পাত্তা-টাত্তা একেবারেই নাই।”
“ As your খায়েশ। আমাকে সারারাত আর তুমি আশেপাশে দেখবা না। আমি গন উইথ দ্যা উইন্ড হয়ে যাব।” আহ্নাফ সেপাইদের মত আদেশ অনুসরনের ভঙ্গি করে বিদায় নিচ্ছে। প্রিয়ন্তি মুখ ফিরিয়ে হাসছে। ছেলেটা মজার আছে। শুধু গা থেকে ‘চাকরী -মার্কা’টা ওঠানো যাচ্ছে না। দেখলেই মনে হয় দাসত্বের ফাঁক দিয়ে দু-চারদিন ভালবাসাবাসি করা এদের জন্মগত উদ্দেশ্য। ছেলেরা হবে সাগরের মুক্ত গাংচিলের মত। তবেই না জানতে ভাল লাগে। হিসেব করা জীবনে বড় আপত্তি তার।
“ কি জন্য ডাকলি?” মশি এসে পড়েছে।
“ তোকে আদর করতে ইচ্ছা করতেছে। এইজন্য ডাক্লাম। আধাঘন্টা আগে তিনবার ডাকলাম, তখন আসিস নাই কেন?”
“ মশকরা ভাল লাগেনা প্রিয়ন্তি। ছবি তোলার জন্য ডাকছিস না ! বসে থাক নিজের মত। ছবি নদীর পানির মত উঠবে।”
“ ও আল্লাহ্। এত সুন্দর করে ছবি তুলতে পারবি তুই!”
মশির খারাপ লাগছে না। মেয়েটার মতি-গতি অনেক খানি বোঝা সত্ত্বেও। ও নিজের প্রেম আড়াল করতে পারে নাই। এখন মনটা আরও ঢেকে রেখে কি লাভ ! উজাড় করে নাটক করাই তো ভাল।
“ মশি মেঘ সরে গেছে দেখ। কত্তগুলা তারা একসাথে দেখা যাচ্ছে!”
“ যা। আমি ‘স্টার-ট্রেইলের’ ছবি তুলে দিচ্ছি।” মশি ব্যাগ থেকে লেন্স বের কর করছে। “কিন্তু…...তুই তিনদিনের ‘মেক-আউট’ পে করবি আমাকে। ডিল?”
“ অন্য কিছু হইতে পারে না। লাইক তিনটা ‘মেক-আউট’ কন্টেন্টের কবিতা? হাহা!”
মশির আবেগের নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু কিছুটা থাকলে ভাল হত।
১১
রুশো বিড়াল হারিয়ে ফেলেছে। তার জন্য রাস্তায় ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ওদের সাথে ঘুরতে এমুহুর্তে মন চাচ্ছে না তার। ‘কুটি’ ‘কুটি’ করে ডেকে আশপাশের সব পাড়া ডেকে তুলেছিল প্রায়। কিন্তু প্রিয় বিড়ালখানার কোন সাড়াশব্দটি নেই। এখন ক্যাম্পফায়ারের সামনে মন খারাপ করে বসে আছে। ওকে ফেলে রেখে কেউ যেতেও পারছে না। প্রিয়ন্তির মন এতক্ষন খুব ভাল ছিল দেখে এখন হয়তবা বেশি খারাপ, জানে না কিসের দোলাচলে! গত কিছুদিন ধরে মুডসুইং এর এমন ওঠানামায় সে বিষন্ন। আর ভাবতে ভাল লাগছে না, তার হাত ধরে কেন নিষ্পাপের ভাগ্যে কেন আচমকা দুর্গতি লেখা হবে?
“ মশি ওকে জোর করে টেনে নিয়ে আয়। বল যে ভ্যানে ঘুরে ঘুরে খুঁজব।”
অর্নিকা উপায় বাতলে দেয়।
“ অর্নিকা তুই যা। একটু মায়া দেখায়ে বলবি, রুশো আমারও ইচ্ছা করতেছে না ঘুরতে, কিন্তু কি করব বল, দুই ঘন্টা বসে ছিলাম সবাই। কুটি তো আসে নাই,”
“ দাঁড়া, আমার সাথে কি? আমি মিথ্যা বলি না, দেখ যায়া ওই শয়তান বিলাই পাইছে কোন পার্টনার!”
“ আহা, যা নারে বাপ্। বইসা বইসা পেইন খায়া লাভ আছে? ও তোরে এমনিতেও লাইক করে। তুই বললে আসবে।”
সবাই অর্নিকার দিকে তাকায়। নুজ্হাত হাসছে। বলে,“ ও কারে লাইক করে না ! এই পর্জন্ত সব কয়টা ফ্রেন্ডরে লাইক করে বসে আছে। দুইদিন আগে প্রিয়ন্তির নাম শুনলে হার্ট বন্ধ কইরা বইসা থাকত। আজকে লাইলির সাথে সুন্দর করে চান্সে ইটিশপিটিশ করতেছে। এখন আবার অর্নিকা, দোস্ত তুই মরছস?”
পরিস্থিতি হাসতে বারন করলেও, আজকালকার ছেলেমেয়েরা এসব নিষেধ মোটেও কেয়ার করে না। মশি মাথা নিচু করে হাসছে। মনে হচ্ছে সে নিজের অনুরোধের জন্য লজ্জিত।
“ আমি যাব না, বাল। প্রিয়ন্তি তুই যা। তোর কাছে ছিল শয়তানটা, এটা তোর রেস্পন্সিবিলিটির মধ্যে পড়ে।”
“ আচ্ছা আমি যাচ্ছি।” আহ্নাফ দায়িত্ব নিতে চাইল। প্রিয়ন্তির পাশে খালি জায়গাটায় টুপ করে মশি বসে পড়ল। আহ্নাফ খেয়াল করে ব্যাপারটা। কিছু মনে করল না। প্রিয়ন্তির বন্ধুরা এমন মজা করলেই ভাল তার সাথে। হিমহিম ভাবটা তাহলে ধেয়ে বন্ধুযোগে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
“ রুশো আস। আমরা ভ্যানে কিছুক্ষন খুঁজে দেখি। তারপর না পাইলে কি আর করা! সকালে আবার আসব এদিকে। কুটিকে না নিয়ে আমরা এলাকা ছাড়ব না। অন্ধকারে বিড়ালটাও হয়ত পথ হারায়ে ফেলছে। এই এলাকা তো ওর জন্যও নতুন।”
“ না আমাকে বুঝান, আপনাদের কি দরকার, এখন এসব ভূতপ্রেত দেখার। এইখানেই তো আসবে আসলে। সবসময় সব কিছু করতেই হয় না ভাই। মনুষ্যত্ব বলেও একটা ব্যাপার আছে।”
রুশোর রাগ আরও বেড়েছে। বেশিরভাগ বান্দাই প্রথমে চাচ্ছিল না এখান থেকে উঠে যেতে। আরাম করে নদীর বাতাস খাবার ইচ্ছাই ছিল সবার। কিন্তু মশি আর প্রিয়ন্তি গোঁ ধরে বসে আছে। ওরা নাকি ভূতের বাড়ীতে তড়িৎ কাহিনী সাজিয়ে ফিক্শ্যনাল ডক্যুড্রামা বানাবে।
আহ্নাফ কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। এমন সময়ে আসলে কি করা উচিত? ‘ভুত-মেন্টারি’র ব্যাপারটাও তো ইন্টারেস্টিং। এমন কিছু ওরা আগে করেনি। আগে কেউ যেতে না চাইলেও আইডিয়া শোনার পর বলতে গেলে সবার আগ্রহই বেড়েছে। ও , ‘ভুত-মেন্টারি’ নামটা আহ্নাফের দেয়া। সবাই একবাক্যে পছন্দ করেছে নামের ধরনটা।
অর্নিকার এখন মায়া লাগছে রুশোর জন্য। হাজার হোক ছেলেটা একটু বাচ্চা রয়ে গেছে এখনও। আজকে সকালে পাওয়া একটা বিড়ালের জন্য মন খারাপ করে সব আনন্দ থেকে দূরে সরে থাকতে চাচ্ছে। কোন উপায় না দেখে সে নামে রুশোকে বোঝাতে।
সবাই একটু পর দেখে রুশো অর্নিকার হাত ধরে হেঁটে হেঁটে ভ্যানের দিকে এগোচ্ছে। হাসির দৃশ্যে হাসবে না কেন সবাই ! সুন্দরীরা তড়িৎ মানাতে পারে না বলতে গেলে এমন কিছু বোধহয় এই পৃথিবীতে নেই। আবীর হেসে হেসে বলছে,
“ রুপের পাওয়ার আছেরে ভাইলোগ।”
ভ্যান গ্রাম ছেড়ে অনেক দূরের রাস্তা ধরে এগোচ্ছে। সব মাতালের দল নিখোঁজ বিড়ালছানা খোঁজা বাদ দিয়ে হাঁ করে জোছনা গিলছে। মশি নিজের হাত অনেকক্ষণ ধরে প্রিয়ন্তির হাতের উপর রেখে দিয়ে জোছনা-গেলা মাটির রাস্তায় চোখ বেঁধে রেখেছিল। কোন সাড়া না পেয়ে তার শরীর,মন ক্রমশ অবশ হয়ে পড়ছে, তীব্র হাহাকারের আর্তিতে। প্রিয়ন্তির কি মনে হল জানে না,আচমকা কোনকিছুর তোয়াক্কা না করে মশির হাত শক্ত করে ধরে বসে। দুজন দুজনের দিকে অবাক তাকায়। ভাসাভাসা চোখে তারা দেখছে, নিজেদের চোখজোড়ায় রাতের নীল আলো তারার অশ্রু সেজে টলমল টলমল করছে। কিছুটা অপ্রকাশ্য সংযম সেখানে কোনো বাঁধা মানছে না।
১২
জোছনার আলোতে পরিষ্কার দেখা যায় সবকিছু। সামনের বিশাল ফাঁকা বাড়িটা রাতের রহস্যের আলোতেও খুব স্পষ্ট। এখনও কেউ ভেতরে ঢুকে দেখে নি বাড়িটা। হয়ত তারা আশংকায় অপেক্ষমাণ কোন অশরীরী শব্দের কিংবা কোন অশরীরীর আগমনের। মশি চুপচাপ, তার পুর্বপরিকল্পনা এখনও কাউকে জানায় নি। আশংকা, পরম আরাধ্য যদি হাতছাড়া হয়ে যায়? পেটে সারা সন্ধ্যা হতে তরল জমেছে। উত্তেজনা বোধের প্রয়োজনিয়তাটাও কেউ সেধে দেখাচ্ছে না। কারও যেন কিছুই মনে নেই। সব নিজের জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
প্রিয়ন্তি ফিসফিস করে জিজ্ঞেশ করছে, “মশি প্ল্যান কি?”
“ বাড়িটার ভেতরে ঢুকব।”
“ আচ্ছা, দুর্দান্ত ! এ বাড়ীতে সাপ থাকবে নির্ঘাত। তোমার সাথে কার্বলিক এসিড আছে?”
“ হ্যাঁ।”
“এরপর?”
মশি একনজর সবার অবস্থা দেখে। সাপের কথা শুনে কারও না তো কারও প্রতিক্রিয়া দেখানোর কথা। কিন্তু কেউ দেখাচ্ছে না। মদ এদের ভয় নিয়ে গেছে।
“আমরা সবাই একটু বসি।” যে যার যার দাঁড়িয়ে থাকা জায়গায় বসে পড়ে।
“ এটেনশান এভ্রিওয়ান।” কেউ কিছু বলল না। সবাই মশির দিকে তাকায়।
ব্যাপার কি? এদের উপর কিছু ভর করল নাকি? মুখে কোন জিজ্ঞাশা নাই। মশি ভাবতে ভাবতে কথা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
“ আমরা এখানে সাতজন আছি। তাইতো?”
“ হুম।” কেউ কেউ ইশারায় সম্মতি দেয়।
“ দুইটা লটারি করব। প্রথম লটারিতে সাতটা কাগজের ভেতর চারটায় কোন নাম লেখা থাকবে না, বাকিগুলয় যেকোন তিনজনের নাম লেখা থাকবে। যার কাছে যে নাম থাকবে তাকে তার সাথে এই বাড়ির একটা নির্দিষ্ট রুমে সারারাত থাকতে হবে। টোকেন পড়ার পর কেউ কারও দিকে তাকাতে পারবে না, কিছু বলতে পারবে না। তাকাইলে সোজা বাড়ির পথ ধরতে হবে। কেউ কারও ফোন নিয়ে যেতে পারবে না, কোন ম্যাচ লাইটার কিচ্ছু না। শুধু পানির বোতল ছাড়া আর কিচ্ছু না।”
“ আচ্ছা। একটু রিস্কি, কিন্তু এইখানে ফিল্মিং-এর ব্যাপারটা কোথায়?” অর্নিকা জিজ্ঞেশ করছে।
“ ফিল্মিং চলছে। তোমাদের ভাবতে হবে না। লোকজন এসে জায়গামত সেট করে গেছে সব।”
“ শুধু এটাই? সকাল পর্জন্ত যেকোন একজনের সাথে থাকতে হবে?”
“ না। আরও কিছু মজা আছে। বাকি চারজনের জন্য আরেকটা লটারি হবে। সেই লটারিতে তাদের জন্য একটা ডেয়ার থাকবে। আর সাথে তার ডেয়ার্ড পার্টনারের নাম। নাম দেখে সোজা বাড়ির ভেতর চলে যেতে হবে।”
“ ভাল কথা। কিন্তু আমার পার্টনার যে এমন অন্ধকারে একই রুমে আসবে এটার গ্যারান্টি কি? আমরা কেউই তো এই বাড়ির কিছুই চিনি না।” আহ্নাফ জানতে চাইছে।
“ সামনে তাকিয়ে দেখেন।” বাড়ির ভেতর অনেকগুলো মোমবাতি হঠাৎ আলো জ্বলছে।
“ টোকেনের পেছনে একটা ম্যাপ আছে, ঘরগুলোর নাম্বারও দেয়া আছে। খুঁজে বের করে একেকজন সেই ডিরেকশনে চলে যাবে।”
আশপাশের ছোট জঙ্গল নেমে চাঁদের আলো রহস্য বৃত্তের মত ঘিরে রেখেছে বাড়িটা। ভেতর থেকে জাদুর আবহের মত আসলে পরিকল্পনা মত পথ দেখাচ্ছে আবার মোমের আলো। আবহটায় অন্যরকম ভাব আছে। কেউ কিছু বলছে না মুখে, কারণ মস্তিষ্ক এমন অভুতপুর্ব আয়োজনের পেছনে যুক্তি খুঁজে ফিরছে। সাথে চোখে ধাঁধাঁ লাগানো নিখুঁত সময়ে অমন আলো জ্বলে ওঠার ব্যবস্থা তাদের অন্যকিছু চিন্তা করতে বাধ্য করছিল।
“ আচ্ছা। টোকেন রেডি কর তাইলে?” প্রিয়ন্তি খানিকটা উত্তেজিত।
“ আছে রেডি আছে।”
“ আমাদের সামনে লিখলে বোধহয় ভাল হয়। কারও নাম যদি দুবার লেখা থাকে বা ডেয়ার্ড পার্টনার আগে থেকেই যদি সিলেক্ট করা থাকে তাহলে আবার চিটিং হয় কিনা !” আহ্নাফও উত্তেজিত, তবে মনে সংশয়ের কাঁটা।
“ আমি এমনিতেই খুলে দেখাতাম, আপনার বলতে হইত না।” মশি জাস্টিফাই করছে।
“ আরও একটা কথা। থাক বাদ দেই, লাভ নাই।”
“ কি বলে ফেল?” রুশো আশ্বাস দিতে চাইল।
“ মানলে ভাল, কিন্তু আরেকটা রুল হচ্ছে, কেউ কাউকে টাচ করতে পারবে না। শুধু কথা বলা যাবে আর কিছু না।” মশি আহ্নাফের দিকে তাকিয়ে বলল কথাগুলো। আহ্নাফ খেয়াল করল, মশি লেখার ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে। খুব দ্রুত অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছে।
“ ভিতরে যদি ক্যামেরা থাকে, তাহলে ঐসব কিছু হবেও না। বাট্ কেউ যদি সিক্ হয়ে যায়, তখন কি ব্যাবস্থা?” অর্নিকার সাধাসিধে কৌতূহল।
“ ব্যবস্থা থাকলেও মনে কর ব্যবস্থা নাই। সবাই এগ্রি করেই আসছ, সো কেউ যদি যাইতে না চাও, নিজ দায়িত্বে এই মাঝরাতে আবীরের বাড়ীতে চলে যাবা।”
“ ভ্যানও আছে, ড্রাইভার কামালও আছে। সো চিন্তা নাই। কিন্তু আমরা কেউ কেন জানি ভয় পাচ্ছি না।” আবীর বলেই ফেলল কথাটা, এতক্ষন অনেকেই যা ভাবছিল।
সবার হাতে নিজ নিজ টোকেন। নিয়ম ভেঙ্গে আবীর আর নুজ্হাত একজন আরেকজনের দিকে তাকায়। তারা চালাক, নিবিড় রাত কাটাতে চেয়ে এই কাজ করেছে।
“ শাস্তি স্বরূপ, তোমাদের সবার আগে……” মশির কথা শেষ হবার আগেই দুজন পেছনের পথ ধরে।
“ ওয়েইট গাইজ।”
“ তোমরা খেল, আমরা তো ডিস্কোয়ালিফাইড।” নুজ্হাত বিজয়ীর বেশে বলল।
“ না। আমি জানতাম, তোমরা এমন কিছু করতে পার। এইজন্য…”
“ দুইজন সবার আগে একজন একজন হয়ে ভেতরে যাবা।” আহ্নাফ মশি কি বলতে চায় তার অর্ধেকটা জেনে বলে।
“ সবার আগে গেলে খুঁজে খুঁজে একসাথে একই রুমে ঢুকবে। সেটা হবে না। ক্রনলজিক্যালি যাবা, দেখ টোকেনে নাম্বার দেয়া আছে।” মশি শেষ করল।
“ শালা মাদারচ্যুত ! কয় বছর ধরে প্ল্যান করছস তুই এগুলা?” নুজ্হাত বিস্মিত।
“ আরে ও বললেই হবে না কি। রুল তো রুলই। চল্।” আবীর নুজ্হাতকে তাড়া দেয়। তার স্পর্শে গোপন আহ্বানের ইঙ্গিত।
“ তুমি কি ভোটাভুটি করতে চাও, আবীর?”
আহ্নাফের এ কথার বিপরীতে আবীরের কোন যুক্তি আর যুক্তি হয়ে ওঠে না।
প্রথমে রুশো যায়। এরপর……… কে? আরও অনেক কিন্তু এখনও রয়ে গেছে। সেটা বলা বোধহয় এখনই ঠিক হবে না।
১৩
মাত্রই কোন রাজকন্যা ভুতুমপুরী তে প্রবেশ করল। প্রিয়ন্তির কেবলই মনে হচ্ছে কোন গোপন চোখ তাকে পেছন থেকে অনুসরন করছে। ভাবতে মজা লাগছে, গা চমকায় না। গা না চমকালে নিজেকে এ বাড়ির পুরনো জন্মের রাজকন্যা ভাবার কোন কারণ আছে কি? না। পা সুন্দর করে মাটিতে ফেলে হাঁটায় তাই বাড়তি কোন তাৎপর্য নেই। সাধারন কোন মেয়ের মত দেয়াল ধরে ধরে হেঁটে আসাটাই উত্তম।
ওর সঙ্গে থাকবে মশি। জানা কথা, মশি ডেয়ারে ওর সাথে আহ্নাফের নাম ভুলেও লিখবে না। ছেলেটা পটানোর জন্য কি বিশাল আয়োজনই না করল ! প্রিয়ন্তি কি এসবের যোগ্য? টোকেনের পেছনে লিখে রেখেছে, “রাজকন্যার জন্য দুটা আস্ত সাদা আলো।”
এর মানে কি? ধাঁধাঁর যদি উত্তর না মেলে? সারারাত এই মস্ত বাড়ির ভেতরে হারিয়ে থাকতে হবে! কি ভীষণ যন্ত্রণা প্রিয়ন্তির। হারিয়ে যেতে তার সবসময় ইচ্ছে হয়। কিন্তু কিছু পাবার থাকলে হারিয়ে যাবার যন্ত্রনা নেবে কোন ছাই?
প্রথম লটারিতে আহ্নাফের টোকেনে ‘প্রিয়ন্তি’ লেখা ছিল। এখন প্রিয়ন্তির জন্য অপেক্ষা। ভূতের বাড়িতে বসে রোমান্সের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা। রুমে কোন জানালা নেই। দরজার বাইরে এতক্ষন মোমবাতির আলো জ্বলছিল। কিছুক্ষন আগে সেটা ধুপ করে নিভিয়ে দিয়ে গেল কে যেন। এখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। অন্ধকারে কিছুক্ষন স্থির থাকলে চোখ অন্ধকার সয়ে নেয়। ওর চোখ এই অন্ধকার সহ্য করতে পারছে না। কিছুক্ষন পরপর অফ-হোয়াইট রঙের জুতোর দিকে চোখ যাচ্ছে।