পোস্টস

নন ফিকশন

থরোর “নাগরিক অবাধ্যতা” ও সমকালীন বাস্তবতা

১৩ জুন ২০২৪

রাশিক তাহির

আজ থেকে প্রায় ১৭৫ বছর আগে, ১৮৪৯ সালে, মার্কিন প্রাবন্ধিক, কবি ও দার্শনিক হেনরি ডেভিড থরো লিখেছিলেন তার বিখ্যাত প্রবন্ধ “On the duty of Civil Disobedience”, অর্থাৎ নাগরিক অবাধ্যতার কর্তব্য। থরোর সামাজিক-রাজনৈতিক ও দার্শনিক চিন্তাধারার প্রভাব বৈশ্বিকভাবে বিস্তৃত। তিনি যেমন লিও টলস্টয়, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, জর্জ বারনার্ড শ ও হাওয়ার্ড জিনের মত সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদদের প্রভাবিত করেছিলেন, তেমনি প্রভাবিত করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী ও মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের মত প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের। থরোর গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারা কেবল সিভিল ডিসওবিডিয়েন্সেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা ফুটে উঠেছে “ওয়ালডেন”, “অন লাইফ এন্ড নেচার”, “লাইফ উইদাউট প্রিন্সিপাল”- সহ অন্যান্য গ্রন্থে। 


মহাত্মা গান্ধী থরোকে তার “দীক্ষক” হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। মার্কিন নাগরিক-অধিকার কর্মী রজার ন্যাশ বাল্ডউইন ফ্রান্সে এক ট্রেন সফরে গান্ধীর সঙ্গী হয়েছিলেন। বাল্ডউইনের সেই সফরে অন্য কোনো সঙ্গী না থাকলেও, গান্ধীর সঙ্গী ছিলেন থরোর “সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স” প্রবন্ধটি। গান্ধীকে থরো সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বাল্ডউনকে অবগত করেছিলেন যে, থরোর “সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স” প্রবন্ধে “তিনি তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের মর্মবাণী খুঁজে পেয়েছেন- কেবল ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারতীয় সংগ্রামের ক্ষেত্রেই নয়, বরং সরকারের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্কের বিষয়ে তার দর্শনের ক্ষেত্রেও।” 


মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন যে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সূচনাকালেই তিনি “সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স” পাঠ করেছিলেন। পাঠ-প্রতিক্রিয়া স্বরূপ তিনি উল্লেখ করেছিলেন, “আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম যে ভালোর সঙ্গে সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করা এবং মন্দের সঙ্গে অসহযোগ আচরণ করা সমানভাবেই একটি নৈতিক কর্তব্য।”  উল্লেখ্য যে থরোর সিভিল ডিসওবিডিয়েন্সের ধারণা থেকেই গান্ধী ও মার্টিন লুথারের অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের কৌশল উৎসারিত।


হেনরি ডেভিড থরোর “সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স” প্রবন্ধটি প্রধানত- একটি রাষ্ট্রে সরকার কিভাবে পরিচালিত হয়, সরকারের সঙ্গে তার নাগরিকের সম্পর্ক কেমন এবং সেই রাষ্ট্রের নাগরিকদের কর্তব্য কী- এসব বিষয়ে আলোকপাত করে। “সেই সরকারই সর্বোত্তম যেই সরকার সবচেয়ে কম শাসন করে” - এমন নীতিকে সমর্থন জানিয়ে থরো তাঁর প্রবন্ধ শুরু করেছিলেন। তিনি আরো উল্লেখ করেছিলেন, “সরকার মূলত জনগণের নির্বাচিত এমন এক কার্যপদ্ধতি (mode), যার মাধ্যমে মানুষ তাদের নাগরিক আকাঙ্ক্ষা কার্যকর করে(execute their will)”। 


তবে, থরোর মতে জনগণের স্বার্থে কাজ করার আগেই সরকারকে “বিকৃত (perverted)” কর্মকাণ্ড করতে দেখা যায় এবং তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার “অপব্যবহারও (abuse)” দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ১৮৪৬-৪৮ সালের মেক্সিকান যুদ্ধকে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করে থরো বলেছিলেন, “কাজটি কিছু সংখ্যক মানুষের উদ্যোগে হচ্ছে- যারা সরকারকে একটি অস্ত্র (tool) হিসেবে ব্যবহার করছে, যদিও জনগণ এ ধরণের উদ্যোগের প্রতি সম্মত হতো না।” সমসাময়িক উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইল কেন্দ্রিক নীতিকেও উপস্থাপন করা যেতে পারে। যদিও মার্কিন নাগরিকদের একটি বৃহৎ অংশই ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে এবং ইসরাইলের পক্ষে মার্কিন নীতি বাতিলের দাবি জানাচ্ছে, তবুও মার্কিন সরকার তার ইসরাইল নীতিতে অটল থাকছে। 


যদিও জনগণের নাগরিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতেই তারা সরকারকে নির্বাচিত করে, থরো তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, “তবুও সরকার সার্বজনীন উন্নতির জন্য কোনো কাজ করে না, এমনকি সার্বজনীন উন্নতির আগ্রহও তাদের মধ্যে দেখা যায় না।” প্রায় দুশো বছর পুরনো থরোর এই উক্তির সবচেয়ে সময়োপযোগী দৃষ্টান্ত রয়েছে কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্তে। 


বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তারা নিঃসন্দেহে আমাদের রাষ্ট্রে সর্বোচ্চ সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র। যুদ্ধে জর্জরিত স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সন্তানদের জন্য ৩০% কোটার ব্যবস্থার প্রবর্তন সেসময়ের উপযোগী সিদ্ধান্তই ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য ৩০% কোটা বহাল রাখার মাধ্যমে একটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়- বাংলাদেশের উন্নয়ন এখনো সার্বজনীন হয়ে ওঠেনি যে কোটার আর কোনো বিশেষ প্রয়োজন থাকবে না।


মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছাড়াও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে জেলা ভিত্তিক কোটা, নারী কোটা, আদিবাসী কোটা ও প্রতিবন্ধী কোটা রয়েছে। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের ৫৩ বছরে সরকারের নেয়া উন্নয়ন প্রকল্প ও নীতিমালা যদি সার্বজনীন হতো, তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার সহ নারী, আদিবাসী ও প্রতিবন্ধীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের উন্নতি ঘটতো। সেই ক্ষেত্রে, তাদের জন্যও কোটা ব্যবস্থার বিশেষ কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকতো না। অর্থাৎ, বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্প ও নীতিমালাগুলোকে অসম বলা যেতে পারে। এছাড়াও, সর্বমোট ৫৬% শতাংশ কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল যে বহু কোটাবিহীন আর্থ-সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত, সেটাও অনস্বীকার্য। 


থরো তাঁর প্রবন্ধে সরকার ও তার জনগণের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে উল্লেখ করেছিলেন, “সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই রাষ্ট্রে যন্ত্রের মতো কাজ করে, মানুষের মতো নয়।… অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের কোনো বিবেকবোধ বা নীতিবোধ থাকে না”। মার্কিন আর্মির উদাহরণ উল্লেখ করে থরো লিখেছিলেন, “অনৈতিক আইনের প্রতি প্রবল শ্রদ্ধাবোধের প্রচলিত ও প্রাকৃতিক পরিণতি দেখা যায় সৈনিকদের মাঝে, যারা খুব শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে এগোতে থাকে যুদ্ধের মাঠের দিকে, তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে- তাদের বিবেক ও চিন্তাশক্তির বিরুদ্ধে- যার জন্য তাদের মার্চিং দেখতে খুব জীবনীশক্তিহীন বলে মনে হয়”। অবশ্য, থরো একথাও উল্লেখ করেছিলেন যে, বিবেকবোধ লোপ পাওয়া ব্যক্তিদেরই সরকার আখ্যায়িত করে সুনাগরিক হিসেবে এবং নীতিবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি- যারা অনৈতিক আইন ও অসমতার বিরুদ্ধে লড়েন- তাদেরকে সরকার চিহ্নিত করে তাদের শত্রু হিসেবে। 


সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে পূর্বের কোটা পদ্ধতির পুনর্বহালের সিদ্ধান্তের পর আবারো শিক্ষার্থীরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলনমুখর হয়ে উঠেছে। এর পূর্বে, ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে আন্দোলনমুখর হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের তরুণ সমাজ। সেকালে এবং একালেও, কোটা সংস্কারের আন্দোলনে সরকার প্রতিনিধিদের কেউ হয়েছেন “অবাক”, আর কেউ এই আন্দোলনকে বলেছেন “দুঃখজনক”।


তবে, থরোর বক্তব্য বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকেই সমর্থন করে। তিনি তাঁর প্রবন্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উপস্থাপন করেছিলেন, “অন্যায় আইনের অস্তিত্ব রয়েছে; কিন্তু আমাদের কি তা মান্য করে চলা উচিত? নাকি তা সংশোধনের চেষ্টা করা উচিত? নাকি, এমন আইনের প্রতি অবাধ্য হওয়া উচিত?” উত্তরে থরো লিখেছিলেন, “যদি সেই আইন মানুষকে অন্যের প্রতি অন্যায় করতে বাধ্য করে, তাহলে আমার মতে, সেই আইনের প্রতি অবাধ্য হতে হবে।” থরো আরো উল্লেখ করেছিলেন যে, অন্যায় আইন সম্পূর্ণ নির্মূল দায়িত্ব জনগণের না, তবে তাদের নূন্যতম কর্তব্য হলো অন্যায় আইন থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করা। অর্থাৎ, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করাকে থরো একটি নাগরিক কর্তব্য বলে মনে করেন। 


মার্কিন চিন্তাবিদ হাওয়ার্ড জিন ১৯৭০ সালে একটি লেকচারে বলেছিলেন, “আমাদের পৃথিবীতে একধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে, সব কিছুই ভুল ভাবে পরিচালিত হচ্ছে; ভুল ব্যাক্তিরা‌ বন্দী, আবার ভুল ব্যক্তিরা মুক্ত; ভুল ব্যক্তিরা ক্ষমতাপ্রাপ্ত, আবার ভুল ব্যক্তিরা ক্ষমতাহীন।” যদিও যে কেউ ভাববেন মানুষের আইন-নীতির প্রতি অবাধ্যতা এই বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী, কিন্তু জিনের মতে, এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার কারণ হলো “Civil Obedience”, বা জনগণের অন্যায় ও বৈষম্যমূলক নীতির প্রতি মান্যতা-বাধ্যতা।


থরোর মতে, “যতদিন রাষ্ট্র মানুষের সর্বোচ্চ ও স্বাধীন ক্ষমতাকে স্বীকার না করবে, এবং তাদের ক্ষমতার উৎস হিসেবে মানুষকে স্বীকার না করবে, ততদিন একটি মুক্ত ও আলোকিত রাষ্ট্র তৈরি হবে না”। প্রথাগত রাষ্ট্রে অন্যায় নিয়ম-নীতির অস্তিত্ব থাকবেই। তবে, নাগরিক হিসেবে অন্যায় ও বৈষম্যমূলক আইনের প্রতি অবাধ্য হওয়াকে থরো একটি নাগরিক কর্তব্য মনে করেন। সেটাই হেনরি ডেভিড থরোর সর্বকালের জন্য উপযোগী এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধগ্রন্থ “On the Duty of Civil Disobedience” বা, “নাগরিক অবাধ্যতার কর্তব্য” মর্মবাণী। 



রেফারেন্স: 

১. Hendrick, G. (1956). The Influence of Thoreau's “Civil Disobedience” on Gandhi's Satyagraha.

২. King, Martin Luther, Jr. (1986). The Autobiography of Martin Luther King, Jr. (ed. by Carson, C.)

৩. Thoreau, H.D. (1849). On the Duty of Civil Disobedience. 

৪. Howard Zinn (1970), A Lecture on “The Problem is Civil Obedience”.