এসো ইনট্রোডিউজ করি
সন্তোষ কুমার শীল
-চল্ কোথাও গিয়ে একটু নিরিবিলি বসি। এত মানুষের হৈ-হট্টগোল ভাল্লাগছে না। মাথার মধ্যে দপ্ দপ্ করছে।
-তা করবে না কেন? জন-মনিষ্যি বর্জিত ভাড়া বাড়িতে আরশোলা-টিকটিকির সাথে থেকে থেকে মানুষে তোর অ্যালার্জি ধরে গেছে। তাই পালাতে চাস।
-তোর সাথে এসেছি বলে ভাবিসনা মাথা বিক্রি করে দিয়েছি। বেশি উপদেশের বোঝা চাপালে স্টেশনের পথ জানা আছে।
-ওই তো আবার ইমোশন! তোকে নিয়ে আর পারা যায়না নবীন! আত্মীয় বাড়ি এসে যদি পালিয়ে থাকি লোকে তবে নিন্দে-মন্দ করবেনা?
-তোকে পালাতে কে বলেছে ? আমি শুধু খানিকক্ষণ নিরিবিলি থাকতে চাইছিলাম। না হয় হরিশদাকে ডেকে দে। তার সাথে বাইরে হাঁটাহাঁটি করে আসি।
এই শ্রাদ্ধ-শান্তির বাড়িতে কে কার খোঁজ রাখে! দেখ গিয়ে সে হয়তো কোথাও খোশগল্পে নয়তো তাস পেতে বসে গেছে। তারচে’ চল্ সবার সাথে তোকে ইনট্রোডিউজ করিয়ে দিই। সময় ভাল কাটবে। আরে মানুষ ছেড়ে যাবি কোথায়? গিয়েই বা কি করবি? বরং এক একজনকে লক্ষ্য করে দেখ্। দেখবি দারুণ মজা আছে। আরে মানুষ হচ্ছে এক একটা নাটকের মত! কত বিচিত্র চরিত্র, বিচিত্র সংলাপ এতে ঠাসা আছে! একটু লক্ষ্য করে দেখলে দেখবি এর চাইতে মজা আর অন্য কিছুতে নেই। আয় আমার সাথে।
-চল্। তবে আমি কিন্তু কারো সাথে হ্যান্ডশেক, কোলাকুলি কিংবা নমস্কার করে ইনট্রোডিউস করতে পারব না। তুই বরং ওই বৈঠকখানার দোতলায় চল্। ওখানে বসে আমরা সবাইকে দেখতে পাব কিন্তু আমাদের কেউ দেখবেনা। ওখানে বসেই ইনট্রোডিউজটা সেরে ফেলা যাক।
আমার এক জ্ঞাতি দাদার পারলৌকিক ক্রিয়াদি শেষে ভোজোৎসবের অনুষ্ঠান চলছিল। উপস্থিত শোকার্ত জনতা (ক্ষুধার্ত বটে তবে শোকার্ত কিনা জানা নেই) গুরুগম্ভীর এক শোকসভার আয়োজন করে পালাক্রমে শোক-সঙ্গীত, মৃতব্যক্তির স্মৃতিচারণ এবং ঢালাওভাবে প্রশংসাবাদ করছিল যা মিথ্যে বলারই নামান্তর। কারণ, পরলোকগত ব্যক্তি আমার আত্মীয় এবং আমি তার স্নেহভাজন ছিলাম। সঙ্গত কারণেই তাকে নিয়ে যারা ইনিয়ে-বিনিয়ে বক্তৃতা করছে আমি তাদের চেয়ে বেশি ভাল জানি এবং বলতে পারি। ভাল বক্তা সাজার লোভে যেন প্রশংসা করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে যা মৃত ব্যক্তিকে অসম্মান করার সামিল।
উপরে যেতেই নবীন অঙ্গুলি নির্দেশ করে জিজ্ঞেস করে- ওই যে জিন্সের প্যান্টের ওপর কালো পাঞ্জাবী-লাল ওড়না, অন্ধ মানুষের মত কালো চশমা পরা লোকটা, ওটা কে?
-আস্তে বল্ গাধা! শুনে ফেললেও বিপদ। ও হচ্ছে এলাকার মা-বাপ।
-সেটা আবার কি রকম?
-আগে ছিল জাল টাকার কারবারী। একবার গণধোলাই খেয়ে এলাকা ছেড়ে সট্কে পড়ে। বছর কয়েক পালিয়ে থেকে ইলেকশানের সময় ফিরে আসে। জালনোটের ব্যবসায় আয় করা হকনোটগুলো সংসদ সদস্য প্রার্থীর জন্য জলের মত খরচ করে তার প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। ইলেকশানে জিতেও যায়। তারপর থেকে সে হয়ে ওঠে এলাকার অলিখিত মা-বাপ।
-যে তিলক-টিকিধারীর সাথে কোলকুলি করছে সে কে?
-ওর মতই আরেক ফেরেব্বাজ। পরিশ্রমের কাজ করবেনা বলে চুল-দাঁড়ি রেখে মালা-তিলক-রঙ্গীন কাপড় পরে “কৃষ্ণ কৃষ্ণ” বলে ধান্দায় নেমে পড়ে। সাধারণ মানুষের অবস্থা তো বোঝোই! পাগল-ছাগল যাই হোকনা কেন ধর্মের গন্ধ পেলেই হল, হুমড়ি খেয়ে পড়বে। তাই মন্দ চলছিলনা। কিন্তু স্বভাব যায় কোথায়! একটু খাতির-যত্ন, সুযোগ পেতেই ব্যভিচারে মেতে ওঠে। ফল যা হবার তাই হল, জনতার রাম প্যাদানি খেয়ে গ্রাম ছাড়ে। কিছুদিন হল ফিরে এসেছে। দু’জনের একই দশা তো! তাই আনন্দে কোলাকুলি করছে আর শোধ নেবার ফন্দী আঁটছে।
-আচ্ছা ওই যে চেয়ারটায় বসে ঘুমুচ্ছে, উনি কে?
-ওকে অন্ততঃ তোর চেনা উচিৎ ছিল। এত মানুষের মধ্যে চেয়ারে গা এলিয়ে যখন ঘুমুচ্ছে নিশ্চয়ই সমাজপতি না হয়ে যায়না।
-কিন্তু ঘুমুচ্ছে কেন?
-ঘুমাবেনা তো কি বসে ভজন গাবে? হাদারাম কোথাকার! স্থূল শরীর-মনের মানুষগুলোই তো সমাজপতি হয়! জেগে থাকতে যে চৈতন্য দরকার এদের তা কোনকালে ছিল নাকি?
-তার পাশের জলচৌকিতে ওই যে মুখ কাচুমাচু করে বসে আছে তাকে চেনো?
-উনিই আমার আত্মীয় আর আজকের এই ভোজ উৎসবের কর্তাব্যক্তি।
-ওভাবে বসে আছে কেন?
-বুঝছো না! এটা হচ্ছে বিনয় প্রকাশের একটা বিশেষ ভঙ্গী সাথে অহং প্রকাশেরও- এই যে এত এত খরচ করে তোমাদের খাওয়াচ্ছি, তোমরা দাঁত কেলিয়ে লেজ নেড়ে খেয়ে যাচ্ছ, ওসব আমারই টাকায় ... ইত্যাদি আর কি!
এমন সময় দু’জন লোক সভায় প্রবেশ করে। তাদের হেলেদুলে হাঁটা, বিশেষ পোষাক সহজেই সবার নজর কাড়ে। একজন বৈশাখের খরতাপের মধ্যেও পুরু কাপড়ের ফুলহাতা সাফারি, জুতা-মোজা পড়ে ফুলবাবু হয়ে আছে। বগলের কাছ থেকে সাফারির দুই-তৃতীয়াংশ ঘামে ভিজে দারুণ একটা ডিজাইন তৈরি হয়েছে। অন্যজনের লাল শর্ট পাঞ্জাবী, জিন্সের প্যান্ট, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, সোনালি ফ্রেমের চশমা চোখে। সাফারী পরিহিত লোকটি এসেই দীর্ঘক্ষণ ধরে তার দেরিতে আসার কারণ ব্যাখ্যা করে সবার সাফারিং বাড়িয়ে দিতে শুরু করে। ক্রমশঃ তার কন্ঠস্বর উঁচু হতে হতে জুতার সামনের অংশে ভর দিয়ে চিৎকার করে মৃত ব্যক্তির স্মরণ এবং উপস্থিত লোকদের বিরক্ত করতে লাগলেন। নবীন ব্যঙ্গ করে বলে- এ যে দেখেছি রাগ প্রধান, উচ্চাঙ্গ বক্তৃতা শুরু করল! এখানে থাকতে দেবে তো? নাকি বাড়ি ছাড়া করবে?
পিছন থেকে হরিশদা বলে ওঠে- যাওনা, কে তোমাকে দিব্যি দিয়ে থাকতে বলেছে। ওই বক্তৃতার জোরেই দু’টো মাত্র বিয়ে করে তিন খানা স্ত্রী জাতীয় লোক পেয়েছে। নবীনের চোখ ছানাবড়া- সে কী?
-হ্যাঁ। দ্বিতীয় পক্ষের শালীকে নিয়ে মোট তিন নারী। এইখানেই শেষ নয়! এক উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিকে তিন নাম্বার দ্বারা পটিয়ে বিনা পয়সায় সরকারি কোয়ার্টারে থাকছে। আর কি চাই বল্ ?
-তুমি তাকে চেনো নাকি?
-না চিনে উপায় আছে ? আমার কাছে তাকে মাঝে মাঝে আসতে হয় যে!
-আর সাথের ব্যাগওয়ালা?
-ওর চেলা। ভন্ডামী ধরতে না পেরে বাটপারের কাছে কাব্যচর্চার পাঠ নিচ্ছে।
-সাফারিওয়ালা কবিও নাকি?
-এরা কি যে নয় তাই বলা মুশকিল। দেখছিস না কত সহজে চেলা জুটিয়ে ফেলে ! বাসস্থান মাগনা পেয়ে যায়!
ইতিমধ্যে খাবার পরিবেশনের আয়োজন হলে আমরা নিচে নামি। ঘর ভর্তি মেয়েছেলের মধ্যে একটা জলচৌকি পেতে আট লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকুরিতে ঢোকা সুখময় হেডমাস্টার তখন যুবতীদের হাত দেখায় ব্যস্ত। নবীন কি মনে করে বেরসিকের মত তার হাতটা বাড়িয়ে ধরে বলে- আমার হাতটা একটু দেখুন না স্যার !
সুখময় ঘরামী কটমটিয়ে নবীনের দিকে একটা অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে- সকাল বেলা হাত না ভিজিয়ে আমার বাসায় এসো, দেখে দেব।
-এরা কি সবাই হাত না ভিজিয়ে এই সকাল তিনটেয় দেখাচ্ছে ?
হরিশদা নবীনকে টেনে নিতে নিতে বলে- তোর হাত কি এদের সবার মত আরামদায়ক, মোলায়েম যে সকাল ছাড়াও দেখা চলে ?
বেলা গড়িয়ে গেছে। খাবারের ডাক পড়তেই ক্ষুধার্ত মানুষগুলো যে যেমন পারে বসে পড়ে। খাবার থালাও দেয়া হয়েছে। ভাত পরিবেশন চলছে। ইতিমধ্যে সোরগোল ওঠে- এই চেয়ারম্যান আসছে। ভাত দেয়া বন্ধ কর।
পরিবেশনকারী কর্তব্য নির্ণয় করতে না পেরে দাঁড়িয়ে থাকে।
পনেরো-বিশখানা মোটর সাইকেল ধুলির ঝড় উড়িয়ে উঠোনের কোণে এসে থামে। অদ্ভুতসব বাহারী পোশাক পরিহিত আরোহীরা নেমে চেয়ারম্যানের চারপাশে দাঁড়িয়ে পড়ে। বয়স্ক কয়েকজন লোক হন্তহন্ত হয়ে ছুটে এসে বিনয়ে বিগলিত হয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কি সব বলতে শুরু করে। তারপর ভাত সামনে নিয়ে বসা পনেরো-বিশজন লোক ধমকে উঠিয়ে দিয়ে চেয়ারম্যানের বসার ব্যবস্থা করে। তারমধ্যে নবীনও ছিল। সে উগ্রমূর্তি ধারণ করে বলে- “বিকেল চারটের পর দুপুরের খাবার দিয়ে আবার চেয়ারম্যানকে খাতির দেখাতে আমাদের উঠিয়ে দিচ্ছো? ঠিক আছে, তোমাদের শ্রাদ্ধ তোমরাই খাও”- বলে সে হাঁটা দেয়। অগত্যা চেয়ারম্যান নিজে এসে নবীনের হাত ধরে দুঃখ প্রকাশ করে তাকে বসতে অনুরোধ করে। মুহুর্তেই নবীন হিরো হয়ে ওঠে।
দু’জন লোক এসে ভীষণ জরুরী এবং মূল্যবান কথা বলার ভঙ্গীতে নবীনের কানের কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করে- ডাল রান্নাটা কেমন হয়েছে?
নবীন বিরক্ত হয় আবার কৌতুকও বোধ করে। সে রঙ্গ করে বলে- কেন, এটা আপনি রেঁধেছেন নাকি? বলে হো হো করে হেসে ওঠে। অবস্থা বেগতিক দেখে তারাও ওষ্ঠ স্ফুরিত করে দন্তরাজির কিয়দাংশ বের করে হাসির মত একটা ভঙ্গী করে কেটে পড়ে। তারপর বিভিন্ন লোকের সামনে গিয়ে “এইখানে একটু ডাল”, “ওর থালায় ভাত”, “ওকে এক পীছ মাছ”, “আরেকটু নিতেই হবে”, “আলুটুকু না খাইয়ে ছাড়ছিনা” এসব নানা কথায় নিজেদের জাহির করতে থাকে। হরিশদা বলেন- এদের চেনো? এরা হচ্ছে পাতি মাতব্বর- সমাজের অত্যাবশ্যক অকাজের লোক।
বিদায় নিতে ঘরে ঢুকে নবীনের চোখ ছানাবড়া- জবজবে ভেজা উদোম গায়ে খড়ের গাদার মত ভূঁড়ি ঝুলিয়ে চেয়ারভর্তি একটা লোক বসে। কঁচি কঁচি ছুকড়িরা কেউ বাতাস করছে, কেউ টাক মাথায় তেরেকেটে তাধিন দিচ্ছে, কেউবা আবার উঁইয়ের ঢিবির মত বিশাল ভূঁড়িটায় কাতুকুতু দিচ্ছে। নবীন স্বগতোক্তি করে, এটা আবার কোন্ দেশী জন্তু?
হরিশদা নবীনের হাত ধরে হেঁচকা এক টানে দূরে নিয়ে বলে- এটা হচ্ছে অতি আদরের ঘুষখোর পদস্থ জামাই। তোর ওতে কাজ নেই। সামনে এগিয়ে চল্।
গাড়িতে বসে স্বল্পভাষী নবীন যেচে জিজ্ঞেস করে- আবার কবে এমন একটা খাওয়া-দাওয়ার শুভদিন হবে? আজ তো একটা অভূতপূর্ব দিন! মানুষ চেনায় এত মজা জানতামনা তো!
হরিশদা ধম্কে ওঠেন- তুই ওরকম অনেক কিছুই জানিসনা। এখন থেকে চোখ-কান খোলা রাখিস। সর্বত্রই এরকম মজার জিনিস দেখতে পাবি।