পোস্টস

গল্প

আরশোলা

৩ জুন ২০২৪

অরণ্য

আজ তিন দিন একটা আলোহীন ঘরে আছি। কিছুক্ষণ আগে আলো জ্বেলেছি, এবং জ্বালবার পর-ই মনে হলো, অন্ধ হয়ে গেছি! ভয় পেয়েছিলাম কি না মনে পড়ছে না, তবে ঘরের কোণার দিকে তিনদিন ধরে নির্ভয়ে ঘুরে-বেড়ানো কয়েকটা আরশোলাকে দ্রুত পালিয়ে যেতে দেখে, ওদের জন্য মায়া হল। অন্যের ঘরে আজীবন যাদের বসবাস, তারা হয়ত সবসময়ই এক ধরণের সংকীর্ণতাবোধ নিয়ে বাঁচে, আর যখন সেই বোধটা থাকে না, তখন নিশ্চয় রোজকার সেই এক-ই সংকীর্ণতাবোধ নিয়ে বেঁচে থাকার গ্লানি ও কষ্ট থেকে মুক্তি পাবার আনন্দ তাদের মধ্যে কাজ করে যায়। আমি জানি না, তুমি আমার এই কথাগুলো পড়ে কী ভাবছো, তবে তোমাকে জানিয়ে রাখি, একটা আরশোলার চেয়ে খুব বেশি তাৎপর্যময় জীবন আমার কখনোই ছিল না, এবং অন্ধকারের মধ্যে একটানা বসে থেকে থেকে, যখন নিজের অস্তিত্ব নিজের কাছেই অদৃশ্য মনে হয়, তখন বুঝতে পারি, আলোর জন্য কোনো আক্ষেপ আমার ভেতরে অবশিষ্ট নেই আর।

 

তোমার মনে আছে, বলেছিলাম, জীবনে মাত্র একবার-ই আমি পাহাড়ে উঠেছি। অনেকদিন আগে। বছর বারো তো হবেই। বাবা নিয়ে গিয়েছিলেন। নাম মনে নেই। শহর ছেড়ে দূরে, ঘন্টা দু’য়েক লেগেছিল যেতে। সেই শেষবার, কিন্তু এখনও স্পষ্ট মনে আছে। যখন আমরা পাহাড়ে পৌঁছালাম, তখন প্রায় দুপুর। আমি গাড়ি থেকে নেমে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে, মাথাটা চারিদিকে ঘুরিয়ে যতদূর দেখা যায়, তার সবটুকুই দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ যখন উপরের দিকে তাকালাম, তখন কিছুই দেখতে পেলাম না, বরং আলোর তীব্র ছটায় আমার মনে হয়েছিল, অন্ধ হয়ে গেছি! ঘন্টা দেড়েক ছিলাম পাহাড়ে, এবং আচমকা উপরের দিকে তাকিয়ে আলোর ছটায় অন্ধত্বের যে বোধ সেদিন জন্মেছিল মনে, তা থেকে বেরুতে পারি নি আজও। তারপর থেকে প্রায় সময় আমি আলোহীন জায়গা খুঁজে সেখানে বসে থাকতাম, আর সেখান থেকে বেরিয়ে আচমকা আলোতে এসে যে বোধ হত, তাতে মনে হত, আমি এখনও সেই পাহাড়টায় দাঁড়িয়ে।

 

আমি চেয়েছিলাম তোমাকে আমার সব কথা জানাতে। জানাই, কিভাবে আমি চারটা বছর একটা বড় কাচের বয়ামে মরা আরশোলা জমিয়ে রাখতাম। প্রায় প্রতিদিনই পুরো বাড়ি বা বাড়ির আশেপাশে তন্ন তন্ন করে খুঁজতাম, পেয়েও যেতাম, কিন্তু যেদিন পেতাম না, সেদিন রাতে ঘুম আসত না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে, চোখ বুজে কত আজগুবি ভাবনাই না ভাবতাম। এভাবে হয়ত একদিন, বড়জোর দু’দিন পারতাম, কিন্তু তৃতীয় দিনে মরা আরশোলার জন্য আমার ক্রিকেট খেলার ব্যাটটা নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম, এবং যেখানেই কোনো একটাকে দেখতে পেতাম, তাকে তাড়া করে ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে থেতলে দিতাম। তুমি জানো না, সেই সময়ে আমার মুখের ভঙ্গি কী রকম হতো? একদিন মা দেখতে পেয়ে, চমকে উঠেছিলেন, এবং আমার গালে চড় মেরে বলেছিলেন, ‘হারামজাদা, অমন করে কি কেউ আরশোলা মারে’? আমি মায়ের ‘অমন’ শব্দটার মানে সেদিনও যেমন বুঝি নি, তেমনি আজও; কারণ আরশোলা মারার সময়কার মুখোভঙ্গি আমি কখনোই পাই নি দেখতে। তবে মনে আছে, মারার পর আরশোলাটাকে কাগজে তুলে ছাদের উপর রোদে শুকোতে দিতাম, আর দূরে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতাম। আমার সেই কান্না সারাদিন, সারারাত চলত, এবং যখন থামত, তখন একটা ফ্যাকাসে রংয়ের ছোট্ট খাতায়, যেটা বাবার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলাম, ওদের নাম লিখে রাখতাম। জানো, আমার হত্যা করা প্রতিটি আরশোলার একটি করে নাম আমি দিতাম, আর তাদের হত্যার দিন, তারিখ, সময় সব লিখে রাখতাম। এভাবে ছয়শ’ একান্নটা নাম আমি লিখেছিলাম, যার প্রথমটি ছিল নিজের, দ্বিতীয়টি বাবার, এবং তৃতীয়টি মায়ের।

 

তৃতীয় নামটি লেখার সময় অবশ্যই আমার হাত কেঁপেছিল, এবং লেখার পর নিজের বিছানা ছেড়ে মায়ের বিছানায় গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে, বুকে মুখ লুকিয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম। মা কয়েকবার অবশ্য আদর করে জানতে চেয়েছিল, আমি উত্তর দিই নি, আর যখন উনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তখন সারারাত উনাকে জড়িয়ে ধরে থাকতে থাকতে মনে হয়েছিল, আমি সত্যিকারের একটা লাশকে জড়িয়ে ধরে আছি। সেদিনের সেই রাত ছিল আমার জীবনের সবচে’ দীর্ঘতম ও অন্ধকার রাত। তোমাকে এতসব কথা আমি আগেও বলতে চেয়েছি, কিন্তু পারি নি, কারণ আমার সেই ছোট্ট ফ্যাকাসে খাতাটা এখনও আমি মাথার পাশে রেখে ঘুমাই।

 

আমি জানি, এরপর তুমি আমার কাছে এলে খাতাটা দেখতে চাইবে, কিন্তু আমি দেখাব না, কারণ সেখানে তোমার পরিচিত অনেকের নামও আছে। বছর চারেক আগে, যখন তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল, সেদিন মনে হয়েছিল খাতাটা পুড়িয়ে ফেলি, কিন্তু পরের দিন স্টেশনে বাবাকে নতুন মা-সহ বিদায় জানাতে গিয়ে, প্লাটফর্মে পাটিতে মোড়া, পা ও মাথা বেরিয়ে থাকা একটা রক্তাক্ত লাশ দেখে হাসি পাওয়ায়, পারি নি! জানো, লাশটির হাত ও পায়ের মধ্যে দিয়ে লম্বা বাঁশ আড়াআড়ি রাখা ছিল। দৃশ্যটা দেখে আমার ছোটবেলার একটা কথা মনে পড়েছিল। আমরা ক’বন্ধু মিলে একটা বেড়ালকে বস্তায় ভরে পিটিয়ে মেরেছিলাম। বেড়ালটির অপরাধ ছিল এই, ও দুটো বাচ্চা প্রসব করেছিল, এবং যতবারই তাকে বাচ্চাসহ দূরে রেখে আসা হতো, ততবারই সে তাদের নিয়ে ফিরে আসত। ওর এই অপরাধের শাস্তি স্বরুপ আমরা ক’বন্ধু মিলে তাকে বস্তায় পুরে ইচ্ছেমত পিটিয়ে মেরেছিলাম, আর মারার পর তার হাত-পা বেঁধে, একটা বাঁশ আড়াআড়ি ঢুকিয়ে, কাঁধে করে গ্রাম ছেড়ে দূরে বিলের মধ্যে কবর দিয়েছিলাম। তারপর আর কখনই বেড়ালটি ফিরে আসে নি, ফিরে আসে নি তার বাচ্চাদুটোও, কারণ, পরে আমরা বাচ্চা দুটোকেও ওদের মায়ের কবরের পাশে রেখে এসেছিলাম।

 

আমার খাতায় সেই বেড়াল ও বাচ্চা দুটোরও নাম আছে। জানি, তুমি কী ভাবছো? হয়ত আমাকে ভয় পেতে শুরু করেছ। কিন্তু, তুমি তো জানো না, আমি নিজেই সবসময় ভীত থাকি। রাতে কখনোই আমার ঘুম আসে না, যদিওবা আসে, মনে হয় মারা গেছি, আর আমার শরীরের উপরে গিজগিজ করছে শত শত আরশোলা, যাদের প্রত্যেকের নাম আমি জানি। আচমকা ঘুম থেকে জেগে উঠি, বিছানায় বসে কাঁপতে থাকি, কিন্তু আলো জ্বালতে সাহস পাই না। মনে হয়, আলো জ্বাললেই দেখতে পাবো, সেই সব আরশোলা, পালিয়ে যাচ্ছে! তুমি প্রথম যেবার আমার ঘরে এলে, সেদিন ছোট্ট এই ঘরটা দেখে খুশি হয়েছিল। বলেছিলে, ‘বাহ! এই ঘরটা আমাদের দু’জনের জন্য চমৎকার’। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে এও বলেছিলে, ‘নাহ, এখানে তুমি থাকো কী করে? একটা জানালাও নেই’! তোমার সে দিনের কথাটা এখনও মনে পড়ে, এবং একটা বড়সড়, ঠিকঠাক জানালার আক্ষেপ গোপন রেখে, উত্তরে বলেছিলাম দীঘির কথা। জানো, আজকাল প্রায় মনে হয়, একটা জানালা আমার খুবই দরকার, যেটা দিয়ে আকাশ নয়, বরং বড় দীঘি দেখা যায়। ঠিক আমার গ্রামের বাড়ির মতো, অতবড় বাড়ির যে কোনো জানালায় দাঁড়ালে, বড় একটা দীঘির সবটা দেখা যায়।

 

ছোটবেলায় আমি রোজ বিছানায় পেচ্ছাব করতাম, আর মা প্রতিদিন সকালে সেই দীঘিটায় আমার বিছানার চাঁদর, কাঁথা সব ধুয়ে শুকোতে দিতেন। জানো, গতকাল রাতে এতবছর পর আবার আমি বিছানায় পেচ্ছাব করেছি! পেচ্ছাব করার পর যখন উঠে বসলাম, তখন দেখি একটা শান্ত-শিষ্ট আরশোলা চুপচাপ আমার খাতাটার পাশে বসে আছে। আলো জ্বাললাম, তবুও পালালো না। আমার কেন জানি মনে হল, ঐ আরশোলাটা আমার মা। আমারা ভীষণ কান্না পেল, দু’হাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কাঁদলাম অনেকক্ষণ, আর কান্না থামার পর যখন দেখলাম আরশোলাটা তখনও সেখানে বসে আছে, তখন খাতাটা তুলে সেটা দিয়ে তাকে পিটিয়ে থেতলে দিলাম! তারপর একভাবে তাকিয়ে থাকলাম ওর থেতলে যাওয়া শরীরের দিকে! জানো, ওভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কী মনে হল আমার?

 

আজ আমার মায়ের মৃত্যু-দিন!