পোস্টস

গল্প

ইন্টারভিউ

২ জুলাই ২০২৪

তাহসিন রিফাত নূর রুফতি

ধবধবে দরজাটা খুলে একজন বেরিয়ে আসতেই সবাই ঘিরে ধরল৷ কী হল, কী হল ভেতরে৷ সে কারো দিকে না তাকিয়ে সোজা হেঁটে বেরিয়ে গেল৷

বুকটা ধ্বক করে উঠল, না জানি কি হয়৷ ওর সিরিয়াল আর একজন পরেই৷ ভেতরে হচ্ছেটা কি কিছুই জানা যাচ্ছে না এখনো৷ কেউ কেউ ভেতরে ঢুকে আর বেরই হয় নি৷ আর যারা বেরিয়ে আসছে তারা কথা বলবার মুডে নেই৷ একজন কেবল কান্না আটকে কোনওমতে বলেছিল, "হল না!"
ক্যান্ডিডেট ঢোকার সময় কেউ কেউ উঁকি দিচ্ছে, দরজার ফাঁক দিয়ে যদি কিছু দেখা যায়, যদি ক্ষানিকটা আভাস পাওয়া যায় ভেতরকার৷ ভারী কালো পরদা অবশ্য সে পথ আটকেছে৷
খানিকটা টেনশন এড়াতে, খানিক কৌতুহলে সে পাশেরজনকে জিগ্যেস করে বসল, "আপনি কেন অডিশনে এসেছেন?"
পাশেরজন যেন কথা বলবারই সুযোগ খুজছিল, গলা খাঁকারি টাকারি দিয়ে বেশ গুছিয়ে বলল, "আসলে দেখেন... আমি একা মানুষ৷ সবারই তো কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়৷ বৌটা যখন ছিল ওর সাথে খটমটো করে আর সিরিয়াল দেখে সময় কাটাতাম৷ জ্বি-হুজুর বাংলা, সহমত জলসা...দারুণ সব নাটক হয় বুঝলেন৷ বৌকে নিয়েই দেখতাম৷ তা, গেল বছর বৌ গেল ছেড়ে৷ এখন তো ঝগড়াঝাঁটি করারও কেউ নাই, আর এক বছরে বৌ যাওয়ার দুঃখও শেষ৷ নতুন কিছু নাই লাইফে...তাই ভাবলাম, একটা চান্স নিয়েই দেখি না! এইভাবে মরাটা তো দারুণ ব্যপার, সারাজীবন খালি নাটক সিনেমাতেই দেখে গেলাম এমন মৃত্যু, দেখি না নিজেও....কী বলেন? তা, আপনি কি জন্যে এসেছেন? আপনার তো বয়সও বেশি না, বিয়ে করেননি বোধহয়৷ নাকি করেছেন?"
" না, বিয়ে করিনি৷ আসলে আমি ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম এটার জন্যে...নিজেকে প্রস্তুত করেছি সেই স্বপ্নের জন্যে৷"
এরকম সময় তার ডাক এল৷ উঠতে গিয়ে একবার পা টলে এল৷ পাশেরজন একটা গুডলাক হাসি দিলে সে নার্ভাস হেসে রওনা হল৷ সারি সারি ক্যান্ডিডেট মোড়া চারিপাশের মাঝখানটা যেন রেড কারপেট৷ সবাই নীরবে ওকে দেখছে৷ আরো নার্ভাস হয়ে গেল সে৷

বিশাল ঘর৷ সমস্তটা সাদা৷ একটা লম্বা টেবিল, বুক অবধি উঁচু৷ তার ওপাশে তিনজন বসে আছে৷ এদিকে একটা চেয়ার৷ এছাড়া ঘরে আর কোনও আসবাব নেই৷ তাতে যেন নিজেকে আরও অসহায় লাগল ওর৷ ছোট্ট অসুন্দর শরীরটা নিয়ে দৌড়ে কোথাও পালিয়ে যাবার ইচ্ছা চাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷
ওরা তিনজন নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, যেন ওকে দেখতেই পায়নি৷ ফিসফিস, খিকখিক করে হাসি৷ অনিশ্চয়তার অন্ধকারের সাথে গা চিড়িবিড়িয়ে রাগ এল ওর৷ মনে হল যেন ওকে নিয়েই হাসছে ওরা৷ শোনা যায় না এমন স্বরে সালাম দিল৷ ওর কাগজপত্র রাখল সামনে৷ নিজের শ্রেষ্ঠ কাপড়-জামা পরে এসে বরং আরো নীচু লাগছে ওকে, সহজেই দু'পক্ষের তফাতটা পরিষ্কার হয়ে গেছে৷

"এখান থেকে চাঁদের দুরত্ব কত বলতে পারবেন?"
চমকে তাকাল৷ সবাই ওর দিকে তাকিয়ে৷
সাহস জুগিয়ে বলল, "স্যার, এখান থেকে চাঁদের দুরত্ব একটা চাপাতির কোপ, স্যার৷"
সন্তুষ্ট হয়েছে কি না বোঝা গেল না, সে আশাও করে নি৷
"বাড়িতে কে কে আছে?"
"আমার বাড়িতে স্যার, বাবা মা আর একটা ছোট ভাই৷ আমি স্যার বড়৷"
একজন ওর কাগজপত্র দেখছিল, সে মুখ না তুলেই বলল, "একাডেমিক তো মন্দ না... নকল টকল তো ভালোই চলে, নাকি?"
সবাই হো হো করে হেসে উঠল৷ অপমানে লাল মুখে সে উত্তর দিল, "না, স্যার!"
"কি বলেন! নকল ছাড়াই পার করে দিলেন? আমাদের সময়ে আমরা কত রকম ওয়ে বের করেছিলাম নকলের জানেন, এটা হল ক্রিয়েটিভিটি..."
বলে তিনজনে কিছু স্মৃতিচারণ করল৷ তারপর প্রশ্নকর্তা স্বীদ্ধান্ত দেবার সুরে বলল, " আপনার মধ্যে তো ক্রিয়েটিভিটিই নাই৷ এই লাইন ক্রিয়েটিভ লাইন..."

"স্যার আমি নকল না করলেও কলেজে ফাংশনে নাটক করতাম৷ "
"মাথা থেকে ওসব ঝেড়ে ফেলেন৷ হ্যাহ! নাটক! এটা সিনেমা! সিনেমা মানে বোঝেন? বিগ ক্যানভাস... নায়িকার ইয়ে দেখে লোভে লোভে চলে আসছেন, না? অত সহজ না এসব.. ডেডিকেশন চাই, ডেডিকেশন৷"

মরিয়া হয়ে সে বলল, "নায়িকার লোভে না, আমি ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখেছি এটার৷ শরীর প্রস্তুত করেছি যত্ন করে..আমার মেডিকেল রিপোর্ট দেখেন স্যার, কোনও অসুখ, সমস্যা কিচ্ছু নেই৷"
"থামেন!" প্রচন্ড চিৎকার দিল বাম পাশেরজন, "যা প্রশ্ন করা হবে তার উত্তর দিবেন, তার বেশি না৷ বাইরে সিরিয়ালটা দেখসেন না? আমাদের লাগবে খুব বেশি হলে আট থেকে দশটা৷ মাথায় রাখবেন৷ "

যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে ডানপাশেরজন জিগ্যেস করল, "নাচতে পারেন?"
আশান্বিত গলায় বলল, "জ্বী স্যার৷ কোচিং এ শিখেছি৷ আধুনিক, ক্লাসিকাল...সব৷ "
"অবশ্য নাচ তো আমাদের লাগবে না৷ দৃশ্যটা হচ্ছে, নায়িকা ঘরে ঢুকে দেখবে আপনাকে৷ চমকে সে চিৎকার দেবে, তখন নায়ক আসবে...তারপর তো বুঝতেই পারছেন৷ "
মাঝেরজন এতক্ষণ একটাও কথা বলে নি৷ এবার বলল, "আপনাদের প্রশ্ন করা শেষ হল?"
"মোটামুটি!"
"আচ্ছা তাহলে ডিসিশন নেয়া যাক৷" বলে হাতের মুঠো খুলে একটা পয়সা দু আঙুলে ধরে বলল, "যদি হেড পড়ে তাহলে এ থাকছে, টেল পড়লে বাতিল৷"
বামেরজন বলল, "আগেরজনের বেলায় এটাই ছিল, ভুলে গেলেন?"
"ওহহো..." বলে ওর দিকে তাকাল, হেসে বলল, "যদি হেড পড়ে তাহলে আপনি বাতিল, আর টেল পড়লে থাকছেন৷ প্লেইন এন্ড সিম্পল!"

ওর চোখ ততক্ষণে পয়সায় আটকে গেছে৷ মাঝেরজনের দুই আঙুলের মধ্যের প্রতিটা নড়াচড়া তীক্ষ্ণ নজরে লক্ষ্য করছে, এর মধ্যেই আটকে আছে বাঁচামরা৷
পয়সা শূন্যে উঠল৷ টেবিলের উপরে ল্যান্ড করে একটু ঘুরতে ঘুরতে হেড-টেল হেড-টেল করে যখন থামল শেষটায়, জ্বলজ্বল করছে হেড৷

অবসাদ নিয়ে রাস্তায় নামল ও, একটা সাদামাটা তেলাপোকা৷ ওর পেছনেই বড় বিলবোর্ডটা৷ আরেকবার ফিরে তাকাল সে, লাস্যময়ী নায়িকার ছবির পাশে বড় বড় করে লেখা৷

সুবর্ণ সুযোগ! সুবর্ণ সুযোগ!!
চলচ্চিত্রে নায়ক-নায়িকার হাতে মৃত্যুর জন্যে কয়েকটি তেলাপোকা প্রয়োজন৷ আগ্রহী তেলাপোকারা এক্ষুণি যোগাযোগ করুন নিচের ঠিকানায়৷

এই খবর প্রচারের পর থেকে, ওকে দেখবে তাই টিভি খুলে বসে আছেন মা, সিনেমার অগ্রীম টিকিটের লাইনঘাট খুঁজছেন বাবা৷ অথচ, সে পারেনি৷ লম্বা শ্বাস ফেলে আবার হাঁটা শুরু করল ও, একটা সাদামাটা তেলাপোকা৷