পোস্টস

নন ফিকশন

আমি ও আমার তরুণ লেখক বন্ধুরা

২০ মে ২০২৪

ওয়াসিম হাসান মাহমুদ

মূল লেখক ওয়াসিম হাসান মাহমুদ

অজয় দাশগুপ্ত। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়। অমলেন্দু চক্রবর্তী। আনন্দ বাগচী। আশিস ঘোষ। দিব্যেন্দু পালিত। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। দেবেশ রায়। নিখিলচন্দ্র সরকার। প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়। প্রফুল্ল রায়। প্রবোধবন্ধু অধিকারী। বরেন গঙ্গোপাধ্যায়। বুদ্ধদেব গুহ। মিহির মুখোপাধ্যায়। রতন ভট্টাচার্য। শক্তি চট্টোপাধ্যায়। শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়। শিশির লাহিড়ী। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। শেখর বসু। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। সত্যেন্দ্র আচার্য। সমরেশ মজুমদার। সমীর মুখোপাধ্যায়। সুধাংশু ঘোষ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সুনীল দাস। সুনীল বসু। সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ। সোমনাথ ভট্টাচার্য।

ব‌ইয়ের পিছনে উল্লেখিত নামগুলো আছে। এবং আছে বিমল করের সিগন্যাচার। তাঁর সাইন অনেক কিছুই বলে দেয়‌। একজন আজীবনের সাহিত্য সাধক, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের চমৎকার মুখবন্ধ অনুসারে সাহিত্য সম্রাট বিমল কর।

আমি ও আমার তরুণ লেখক বন্ধুরা। ব‌ইয়ের দুই মলাটের মাঝ দিয়ে এক অদ্ভুত সুন্দর আবার এক‌ইসাথে আনন্দ-বিষাদে মাখা কালের কথা বলে গেছেন লেখক। উপরে লিখিত লেখকদের কারো কারো ব‌ই আমার পড়া আছে। অন্যদিকে আমার সাহিত্য বিষয়ক কম জানার কারণে অনেকের সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলাম। বোদ্ধা পাঠকেরা নিশ্চয় ইতিমধ্যে বুঝে গেছেন তৎকালীন সাহিত্য রথী-মহারথীদের তরুণ বয়সে লেখকের সাথে যে যোগাযোগ এবং হৃদ্যতা তা নিয়েই এ মেমোয়ার গ্রন্থ রচিত।

১৯৫৭-৫৮ সালে যখন অর্থনৈতিক অবস্থা ভারতে বেশ খানিকটা ভালোর দিকে তখন ব‌ই লিখা, ব‌ইয়ের দোকান দেয়ার একটা হিড়িকের শুরুটা হয়েছিলো। কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের পরবর্তি। আট বছরের আড্ডায় বিমল করের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ থেকে আন্তরিকতা হয়েছে অনেক তরুণ লেখকের। তারপর আড্ডা গেছে এসপ্লানেডে তারপর কার্জন পার্কের ডালিমতলায়। যা সঞ্জীবের মতে বিমলতলা। সেখানে আড্ডা চলমান ছিলো প্রায় সাত বছর।

'দেশ' পত্রিকায় চাকরি করার সুবাদে বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তিসম লেখক, সম্পাদকের সাথে একত্রে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আড্ডা, খুনশুটি এবং সাহিত্যচর্চা করে গেছেন বিমল কর। চা বাগানের এক সময়ের বড় বাবু বীরেশ্বর বসুর ভাড়াটে ছিলেন বিমল, সাহিত্য প্রেমী বীরেশ্বরের বিমল করের ভাষায় 'দাদা' । লেখক তাঁর উপন্যাস 'দেওয়াল' এর প্রথম খন্ড লিখেছিলেন সেই দাদার দলসিংপাড়া চা বাগানের বাড়িতে বসে। চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর বীরেশ্বর বাবু কলেজ স্ট্রিটে 'কথামালা' ব‌ইয়ের দোকান প্রতিষ্ঠা করেন। প্রবোধবন্ধু অধিকারী কথামালার 'অল পারপাজ ম্যান' ছিলেন।

এই ব‌ই থেকে জানা যায় 'অগ্রণী'র একটি অনিয়মিত স্টল ছিলো 'কথামালা'র আগে। 'নিজ স্ক্রিপ্ট' এসে হাজির হলো ১৯৬০ সালে। মালিক অশোকানন্দ দাশ, জীবনানন্দের অনুজ। দেখাশোনা করতেন অজয় দাশগুপ্ত যাকে সবাই খোকা হিসেবে বেশি চিনতেন।

বিমল কর এই গ্রন্থে তাঁর তরুণ লেখক বন্ধুদের জীবনী লিখেন নি, না কোন সাহিত্যতত্ত্বের রেফারেন্স ব‌ই লিখেছেন। একজন অগ্রজের দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি আলোচনা করেছেন সেই সময়ের বেশ ক'জন সম্ভাবনাময় এবং গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের লেখনি, মধ্যবিত্ত জীবনের প্রতিনিয়ত ঘা খাওয়া বিভিন্ন ঘটনাবলী এবং হিউমারসমৃদ্ধ এক একটি ইভেন্টের কথা।

শিল্পী সুবোধ দাশগুপ্ত প্রচ্ছদ করতে গিয়ে কিভাবে বিভিন্ন সময় তাদের ডুবিয়েছেন, দেবেশ রায়ের সাথে বিমল করের অদ্ভুত প্রথম সাক্ষাৎ, প্রফুল্ল রায়ের চরম বাউন্ডুলেপনা, কবি শংকর চট্টোপাধ্যায়ের সাথে জৌতির্ময় গঙ্গোপাধ্যায়ের বিভিন্ন ফাজলামি কিংবা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের অঘটন-ঘটন-পটিয়সী আচার-আচরণ অনেক কিছুই দেখেছেন লেখক।

বিমল করের ঐ সময়রেখায়‌ই শীর্ষেন্দু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং সমরেশ মজুমদারের লেখালেখির প্রতি শ্রদ্ধার কথা ব‌ইয়ে ঘুরেফিরে চলে আসে। এই তিনজন ছাড়াও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখালেখির ব্যাপারে লেখকের মুগ্ধতা বলার মতো। অনেকের অনেক বিষয় বিমল করের হয়তো অপছন্দ ছিলো, তবে সেসব অপছন্দ মনে হয় একজন অগ্রজের দৃষ্টি থেকে দেখেছেন তিনি। ব‌ইটি পড়ার সময় ক্লোজ রিডিং করলে বুঝা যায় অনেকের ব্যক্তিগত বিষয়-আশয় তিনি খুব সম্ভবত গোপন করেছেন।

সাহিত্য পাতা করতে গিয়ে তৎকালেও বারবার ধরা খাওয়ার অভিজ্ঞতা এই লিস্টের প্রায় সব লেখকের হয়েছে। বিমল কর একজন সিনিয়র লেখক হ‌ওয়ায় নির্লিপ্ত থেকে গেছেন। অনেক অম্ল-মধুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই ব‌ইয়ে। লিস্টের নামের বাইরের অনেকে আছেন। উক্ত সময়েই বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত এবং লিজেন্ডারি লেখকেরা উঁকি দিয়ে গেছেন বিমল করের ভাষার জলতরঙ্গ দিয়ে। পারিবারিক-অর্থনৈতিক কারণে বহু লেখকের রাইটিং থেকে সরে আসার কষ্টের গল্প বলেছেন বিমল কর। সাহিত্যে ভাষার ক্ষেত্রে লেখকের মধ্যে রক্ষণশীলতা বরাবরের মতোই ছিলো না। তিনি এমনকি তৎকালীন 'শাস্ত্র-বিরোধী আন্দোলন' এর লেখক শেখর-সুব্রত-আশিস-রমানাথের লেখা ফলো করে গেছেন।

যেকোন লেখক কোন রাজনৈতিক দর্শনের কিংবা কী করে বেড়াচ্ছে সেসবের চেয়ে তাদের কোন কোন জনকে নিয়মিত লেখালেখির দিকে ধাবিত করার প্রচেষ্টা বরাবরের মতোই তাঁর মাঝে কাজ করে গেছে।

রতন ভট্টাচার্যের বিয়ে করে রাইটিং এর জগত থেকে গায়েব হয়ে যাওয়া, এক‌ই সময়ে সোমনাথ ভট্টাচার্যের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া এবং সমান্তরালে দু'জনের‌ই ক্রিয়েটিভ ফিল্ডে ফিরে আসার আশ্চর্যজনক বর্ণনা আছে বিমল করের লেখনিতে। আনন্দ বাগচীর বাকুরায় গিয়ে রাইটার্স ব্লকে পড়ে যাওয়া, কলকাতায় আসার পর কবি এবং একজন তীক্ষ্ম রম্যলেখক হিসেবে নিজেকে ফিরে পাওয়া, এসব‌ই ঘটেছে সাহিত্যের এই ভেটেরানের জ্ঞাতসারেই।

সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ এবং অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন লেখকের চোখে মুর্শিদাবাদের রত্ন। কখনো সিরাজের সাহেবি চালচলনের কথা আবার কখনো বাঘের মতো বন্ধু শিশির লাহিড়ীর ফূর্তিবাজী যেন পাঠকের চোখের সামনেই চলে আসে ব‌ইটি পড়ার সময়।

সবচেয়ে মজার লেগেছে নিখিলচন্দ্র সরকারের বিয়ের লগ্ন মিস হ‌ওয়ার ভয়ে প্রেসার ডাউন, বাদল বোসের তীব্র গতিতে গাড়ি চালিয়ে নিখিলকে লগ্ন ধরানো কান্ডটা।

বিমল করের স্মৃতিচারণের উপর বেইস করে অশোক দাস সূচী ও লেখক পরিচিতি বর্ণানুক্রমিকভাবে প্রস্তুত করেছেন।

সাহিত্য অনুরাগীরা এ রিভিউর প্রথমে মেনশন করা লেখকদের সবার গুরুত্বপূর্ণ ব‌ই এবং বিমল করের অদ্ভুত সুন্দর ভাষায় সেই সকল ব‌ইয়ের টুকরো টুকরো অথচ মোক্ষম পর্যালোচনা পাবেন "আমি ও আমার তরুণ লেখক বন্ধুরা'তে।

বিমল করের মতে ইতিহাসের মতো সিরিয়াল স্মৃতিচারণে মেইন্টেইন করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। তবে সাহিত্য করতে যে বিপুল সাধনার প্রয়োজন এবং সাহিত্যের পারম্পর্যের অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করতে এই চমৎকার ব‌ইটি সচেতন পাঠকের খুব ভালো লাগতে পারে। এই ব‌ইয়ে লেখকদের প্রতি আছে রাইটিং ক্রাফ্টস নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইনসাইট। আমার মতে "আমি ও আমার তরুণ লেখক বন্ধুরা"তে পাঠকের ফিরে আসা যাবে বহুবার।

ব‌ই রিভিউ

নাম : আমি ও আমার তরুণ লেখক বন্ধুরা
লেখক : বিমল কর
প্রথম কমলা-গিতা-বীণা প্রকাশ : ডিসেম্বর ২০২১
দ্বিতীয় মুদ্রণ : আগস্ট ২০২২
প্রচ্ছদ : মৃণাল শীল
পরিবেশক : পত্রভারতী
জনরা : মেমোয়ার
রিভিউয়ার : ওয়াসিম হাসান মাহমুদ