দুদিন পরে আরেকটা সমস্যায় পড়ল ও। ল্যাপটপ থেকে শর্ট ফিল্মের ফুটেজ উধাও। ও তো ডিলিট করেনি! প্রশ্নই ওঠে না ডিলিট করার। রিসাইকেল বিনও দেখল। নাহ্! নেই। হার্ড ডিস্কের অন্যান্য ফাইলগুলোও একে একে খুলে খুলে দেখল। অদ্ভুত ব্যাপার। সব ফাইল খালি! কী হল ব্যাপারটা! এরকম কখনো হয় নাকি!
মেজাজ বিগড়ে গেল ওর। কত ফুটেজ আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছিল। সব গেছে।
সেই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ও এই ব্যাপারটা নিয়ে পড়ে আছে। ডিরেক্টারকে এক্ষুনি সব বলা ঠিক হবে কিনা ও বুঝতে পারছে না। কিছু টাকা উপার্জনের সম্ভাবনা ছিল। গেল। উলটে হয়ত বেড়ে গেল খরচ।
সন্ধ্যায় এক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুকে ফোন করল। সে জানাল, এই ভাবে হার্ড ডিস্ক সম্পূর্ণ উড়ে যাওয়া খুবই রেয়ার ব্যাপার। তবে একদম অসম্ভব না। হতেই পারে এবং রিসাইকেল বিনে তার কোন চিহ্ন থাকবে না।
২
ই এম আই তে কেনা এই ল্যাপটপটা বছরখানেক চলছিল ভালোই। এখনো ভালো চলছে। একটু স্লো এই যা। অবশ্য র্যাম বাড়িয়ে নিলে নাকি স্পিড বেড়ে যাবে। ওই বন্ধু বলেছিল।
সমস্যা এটা না। গত কদিন ধরেই ও আর একটা ব্যাপার নিয়ে বিব্রত। ওর ল্যাপটপে ডিসপ্লের উপরে বাঁ দিকে একটা ছোট গোল দাগের আবির্ভাব ঘটেছে। এক টাকার কয়েনের আকৃতির মত। এক সপ্তাহ আগেও এটা ছিল না। গত পড়শু থেকে এর আবির্ভাব। পড়শু ছিল একটা ছোট বিন্দু আকৃতির। আর আজ প্রায় এক টাকার কয়েন আকৃতিতে বেড়ে উঠেছে। দুই তিন দিনে এর পরিধি যে হারে বেড়েছে তাতে দিন পনেরর মধ্যেই সমস্ত স্ক্রিনটা দখল করে নেবে মনেহয়।
এবার ডিসপ্লে চেঞ্জ করার খরচ। ল্যাপটপের টাকাই এখনো শোধ হয় নি। এক বছরের ওয়্যারান্টি পিরিয়ড শেষ। তার উপর আবার এটা। ডিসপ্লের দাম কম করেও ছয় হাজার টাকা। এত টাকা এই মুহূর্তে কোথায় পাবে ও!
ওর আয় বলতে ছোট খাটো এডিটিং। বিশেষ করে বিয়ে বাড়ির ভিডিও। এখন বিয়ের অফ সিজেন। হাতে ছিল ওই শর্ট ফিল্মের কাজটা। তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারলে হাতে কিছু টাকা আসত।
ফিল্মের গল্পটা সাদামাটা। বিকাশ আর মিলি নামের এক যুগলের গল্প। মিলি তার স্বামীর স্মৃতি ফেরানোর চেষ্টা করছে। এক এক্সিডেন্টে বিকাশের স্মৃতি শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। অবশ্য গল্প নিয়ে ও ভাবিত নয়। ও তো এডিটর! গল্প নিয়ে ভাবা তো ওর কাজ না। তবে সমস্যা হল চার ঘন্টার ফুটেজ কেটে কুড়ি মিনিটের মধ্যে আনা। কোন দৃশ্য রেখে কোনটা বাদ দেবে!
দু-এক দিন পরপরই ডিরেক্টর এসে ইন্ট্রাকসন দিয়ে যান। এটা করো। ওটা করো। অবশ্য ও এই কাজটাতে বেশ মজা পায়। অনেকটা শল্য চিকিৎসার মত ব্যাপার।
ল্যাপটপ ছাড়াও ওর ঘরে আরো কয়েকটা জিনিসপত্র রয়েছে। যেমন পুরনো একটা ক্যামেরা, লাইট কাটার, দুই তিনটা কী বোর্ড, ডাটা কেবলের জট পাকানো কিছু তার ইত্যাদি। সব কিছু ঘরের এখানে ওখানে ছড়ানো ছিটানো। কেউ ঘরে প্রবেশ করলে সাবধানে ওগুলো ডিঙিয়ে আসতে হয়। যেন সাপের উপর দিয়ে চলা।
ও কোলকাতায় এসছিল সিনেমাটোগ্রাফার হতে। এজন্য বছর তিনেক আগে বাড়ি থেকে এক রকম জোর করেই বেরিয়ে পড়েছিল। ফটোগ্রাফির কোর্সও করেছিল একটা। টালিগঞ্জের ফিল্ম স্টুডিওর কয়েকজনের সঙ্গে চেষ্টা করেছিল আলাপ জমাতে। নিয়মিত দেখা করা ফোন যোগাযোগ ইত্যাদি। কিন্তু কোন কাজ হয় নি। অথচ ওর কাজের স্যাম্পল দেখে সবাই বলেছে, ‘ব্রিলিয়ান্ট জব! তোমার হবে!’... তা কী হবে বা হচ্ছে ও বুঝতে পারছে না।
সাফল্য বলতে গেলে কেষ্টপুরের এই গিঞ্জি এলাকায় তিন হাজার টাকায় একটা ভাড়ার ঘর যোগার করতে পেরেছে অল্প স্যালামির বিনিময়ে। প্রতি মাসের এক তারিখে যমদূতের মত এসে জানলা গার্ড করে দাঁড়িয়ে থাকে বাড়িওয়ালা। মোটা কালো রোমশ হাত প্রসারিত করে বলে-‘ভাড়াটা দাও!’
টাকাটা যে কীভাবে ভিখারির খুচরোর মত আগলে রাখে, ও-ই জানে!
ওর চোখ এখন ল্যাপটপের দিকে। গোল কালো দাগটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে। চোখ সরাতে ইচ্ছা করছে না। কেমন যেন নেশার মত লাগছে। আর মনে হয় দাগটা স্থির নয়। খুব ধীরে ধীরে ওটার পরিধি বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে।
স্তব্ধ ভাবে চেয়ে আছে ও ডিসপ্লের দিকে। এইভাবে পরিধি বাড়তে বাড়তে একসময় সমস্ত ডিসপ্লেটা দখল করে নেবে এই কালো দাগটা। তারপর কী হবে, ওটার পরিধির বৃদ্ধি শেষ হয়ে যাবে, না চলতেই থাকবে! যদি চলতে থাকে তাহলে ওর এই ঘরটাও একসময় ওটার দখলে চলে যাবে না তো!
বিষণ্ণ ও মেঝেতে পাতা বিছানায় বসে বসে এইসব হাবিজাবি ভাবছে। এই তিনবছরে ও একটা খাট বা চৌকিও যোগার করতে পারেনি।
আজ আর রান্না করতে ইচ্ছা করছে না। ইচ্ছা করছে না বাইরের হোটেলেও যেতে। আজ ছাতু আর মুড়ি দিয়েই কাটিয়ে দেবে। এই দুটো জিনিসের স্টক ওর ঘরে অফুরন্ত।
বাথরুম থেকে ফিরে এসে আবার বসে পড়ল ল্যাপটপের সামনে। বাইরে সম্ভবত গভীর রাত। সারাটা দিন কীভাবে যে কেটে গেল!
জাস্ট কৌতূহলের বশে ও ডিসপ্লের কালো জায়গাটায় আঙুল দিয়ে চাপ দিল। এল ই ডি স্ক্রিন বলে সামান্য দেবে গেল। তারপর বাঁ চোখ রাখল ওখানে। স্বাভাবিকভাবেই অন্ধকার। দ্বিতীয়বার ডান চোখ। এইভাবে খেলার মত কাটল কিছুক্ষণ।
৩
পরদিন সকাল এগারোটার পর ওর মোবাইলে রিং টোন বেজে ওঠে।
-‘কাজ কদ্দুর এগোল?’
ও ভাবতে পারে নি ফুটেজ মুছে যাবার পরদিনই ডিরেক্টার ফোন করে বসবে।
-‘চলছে। অল্প বাকি আর। বুঝতেই পারছেন চার ঘন্টার ফুটেজ কুড়ি মিনিটে আনা!’
-‘এটাই তো তোমার কাজ হে... শোনো, সামনের সোমবারের মধ্যেই শেষ করো বুঝলে? ‘একটা ফেস্টিভ্যালে পাঠাব’।
-‘একদম চিন্তা করবেন না। সময় মত পেয়ে যাবেন’।
-‘ওকে। সোমবার দেখা হচ্ছে। বাই!’
আজ বুধবার। হাতে মাত্র পাঁচ দিন। অথচ ফুটেজটাই নেই! কাজ বেশ অনেকটা এগিয়েছিল। আচ্ছা ডিরেক্টারকে সত্যিটা না জানিয়ে ও ভুল করছে না তো! ওর এখন একমাত্র ভরসা সেই ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু। ফোন করল। সে জানাল-
-‘হার্ড ডিস্কের ডিলিট হওয়া মেমোরি রিকভার করা যায় কিনা দেখতে হবে। নিয়ে এসো কাল। চেষ্টা করব’।
-‘কাল নয়। আজ। এখুনি’।
-‘এখন তো আমি অফিসে!’
-‘তাহলে সন্ধ্যায় অফিসের পর তোমার সাথে দেখা হচ্ছে’।
-‘ওকে। ডান্!’
সোমবারের মধ্যে সাবমিট করতে হবে ফিল্মটা। আজ বুধবার। হাতে মাত্র পাঁচ দিন। অবশ্য কিছুটা সময় তো হাতে আছেই। দেখাই যাক।
৪
দুই দিন পর অর্থাৎ শুক্রবার সন্ধ্যায় হার্ড ডিস্কটা ফেরত পেল ও। সামান্য লালচে ধরনের চারকোনা ধাতব পিণ্ডটা হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।
বছর তিনেক আগে ওর মায়ের জরায়ু অপারেশন করে বাদ দিতে হয়েছিল। নার্সিংহোমে সকাল থেকে অস্থিরতা আর উদ্বেগের মধ্যে বসে থাকার পর লেডিডাক্তার ওকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল অপারেশন রুমের দরজার সামনে। ‘এই যে!’
স্টিলের মাঝারি একটা চকচকে পাত্রে লাল থলথলে একটা বাতিল মাংসপিন্ড। তখনও জ্যান্ত মনে হচ্ছিল।
হার্ড ডিস্কটাকে এখন ঐ রকমই কিছু একটা মনে হচ্ছে ওর।
তারপর থেকে ওর মা কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল। খিটখিটে মেজাজ। কারো সাথে কথা বলত না। কয়েকমাস পর দেখা দিল মেন্টাল ডিজ-অর্ডার। ‘মা’ বলে ডাকলে অনেকক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত।
ডাক্তার বলেছিল, ‘ঠিক হয়ে যাবে। তবে অসুধ খেয়ে যেতে হবে অনেকদিন’।
তখন থেকেই ও মনস্থির করে- এখানে আর নয়। কোথাও চলে যেতে হবে। বাবার সাথে রীতিমত লড়াই করে যোগার করে ফটোগ্রাফি আর এডিটিং কোর্সের ফিজ্।
প্রথমে কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা রুম শেয়ার করত। তারপর ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে চাকরি একটা পেয়েছিল অল্প মাইনের। কয়েকমাস করার পর ছেড়ে দেয়।
তারপর পেল এই ভিডিও এডিটিঙের কাজটা। বেশিরভাগই বিয়ের। মাঝে মাঝে মিউজিক ভিডিও বা ইভেন্ট ভিডিওরও কাজ পায়। নিয়মিত যোগাযোগ রাখত স্টুডিও পাড়ার সাথে। টেনেটুনে চালাচ্ছিল বড় কিছু করার স্বপ্ন বুকে নিয়ে।
শর্ট ফিল্ম এই প্রথম। ফুটেজটা থাকলে বেশ কয়েক হাজার টাকা উপার্জন হত।
ডুয়ার্সের মনোরম প্রকৃতি এখন আর ওকে টানে না। ওর বাবা প্রথম প্রথম ফোন করত। বলত, ‘কিছু না হলে বাড়ি চলে আয়! দোকান দিয়ে দেবে কম্পুটারের...’ ভালো লাগত না ওর এসব নেগেটিভ কথাবার্তা শুনতে। তারপর থেকে বাড়ির ফোন খুবই কম ধরত।
হার্ড ডিস্ক যন্ত্রটা বেশ ভারি। কত কেবলের আউটপুট! সাদা মত একটা স্টিকারে ইংরেজিতে লেখা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাজারো অক্ষর গিজ গিজ করছে।
বন্ধ্যা এই যন্ত্রটা ও ল্যাপটপে সেট করে নিল। ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু বলে দিয়েছে তার পক্ষে এর মেমোরি রিকভার করা সম্ভব নয়। বড় কোন সংস্থা পারলেও পারতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে অনেক খরচ।
স্তব্ধ হয়ে বসে আছে ও। শুক্রবার রাতটা না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিল।
৫
শনিবার একই ভাবে কাটল। রবিবার সারাদিন কাটাল ঘুমিয়ে। স্নান আর খাওয়া দাওয়ার ঠিক ঠিকানা নেই। ওকে যেন কোনো জাহাজ জোর করে একটা নির্জন দ্বীপে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে। ফেরার উপায় জানা নেই।
ডিরেক্টারকে এখনো কিছু জানায় নি। কাল সকালেই তো তার আসার কথা। দেয়ালের দিকে তাকাল। তিনটি কাঁটাই এক হয়ে আছে। সময় কি এখন স্থির না চলমান!
ল্যাপটপটা অন করে ও বাথরুমে গেল। ফেরার সময় লাগোয়া রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতে ইচ্ছা করছিল। কতদিন রান্না করা হয় না! কিন্তু দরজা পার করল না। দ্বিধা নিয়ে ফিরে এল দুটো পা। বসে পড়ল বিছানায়। পাসওয়ার্ড দিয়ে প্রবেশ করল স্ক্রিনে। সূর্য তার সমস্ত গ্রহ উপগ্রহ নিয়ে সপরিবারে হাজির ওয়ালপেপারে। পিছনে অজস্র তারা চিনির গুঁড়োর মত। এই দৃশ্যে ওই কালো গোল দাগটা সত্যি বেমানান।
আজ তার পরিধি স্ক্রিনের এক তৃতীয়াংশ দখল করে নিয়েছে। ছোট্ট একটা পোড়া রুটির মত। ক্যামেরার পিছনে যেভাবে চোখ রাখে ঠিক সেইভাবে ও চোখ রাখল ওখানে। প্রথমে বাঁ চোখ। তারপর ডান। আবার বাঁ চোখ। তারপর ডান। শেষবার চোখ আর সরছে না। ডান চোখটা আঠার মত আটকে রাখল মিনিট খানেক।
আবছা কিছু দেখতে পেল মনে হল। তাকিয়ে রইল। আবছা ছবিগুলো যেন স্পষ্ট হচ্ছে ধীরে ধীরে। আরো স্পষ্ট করে দেখার জন্য ও বাঁ হাতের সামনে থাকা বোর্ড থেকে লাইট আর পাখার সুইচ অফ করে দিল। এবার যেন দৃশ্যগুলো আরো স্পষ্ট। আশ্চর্য, এখানে ছবি এলো কী করে!
বিস্ফোরণের প্রচন্ড শব্দ। শহরের রাস্তা ব্রিজ রেল লাইন দুমরে মুচড়ে যাচ্ছে। আর বিরাট এলাকা জুড়ে ধোঁয়া বটগাছের আকৃতি নিয়ে আকাশের নিচে স্থির হয়ে আছে।
ধোঁয়ার গাছটা সত্যি সত্যি এবার বট গাছে পরিণত হল। তার নিচে ধ্যান মগ্ন এক সৌম্যকান্তি পুরুষ।
তারপর আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত একদল সৈন্য কোন এক গুহায় ঢুকে যাচ্ছে। একটা ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত মানুষদের উপর গুলি চালাল। আর বিশেষ একজনকে চিহ্নিত করে সাদা কাপড়ে পেঁচিয়ে নিয়ে এল বাইরে।
ধ্যানমগ্ন পুরুষটির পিছনে একটা নদী। জলের রঙ লাল। গাছের সামনে পাথুরে জমি। সেখান দিয়ে ঘাড়ে ক্রশ কাঠ নিয়ে বহু কষ্টে হেঁটে চলেছে এক আহত অসহায় পুরুষ। আলুথালু পোশাক। সারা শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। সেই রক্ত স্রোতের মত গিয়ে পড়ছে নদীতে। কিন্তু পুরুষটির মুখমন্ডলে কষ্টের কোন ছাপ নেই। হঠাৎ ধ্যানমগ্ন পুরুষটির চোখ খুলে গেল। উঠে দাঁড়ালেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন দুটো বিমান প্রচন্ড গতিতে আকাশচুম্বী দুটো বিল্ডিং ভেদ করে চলে গেল। ধারাল চাকুর মত কেটে দিল বিল্ডিং-এর দাঁড়িয়ে থাকা দেহ দুটো।
হাসির রেখা জেগে উঠল পুরুষটির মুখমন্ডলে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পুরো এলাকাটি বাক্সের আকারে গুটিয়ে একটা ঘরের মত হয়ে গেল। মনে হচ্ছে কোন হাসপাতাল বা নার্সিংহোম। এক রোগী কিছু তার আর সরু পাইপ নিয়ে শুয়ে আছে। পাশে বসে আছে এক অল্প বয়স্ক মহিলা।
মুখটা এবার আস্তে আস্তে বড় করে দেখানো হচ্ছে। ওর মনে হল ওটা ওর নিজেরই মুখ। প্রচন্ড ভয়ে স্ক্রিনটা নামিয়ে দিল ও। মাথা ঘুরছে। অন্ধকার ভেদ করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। কোন ক্রমে উঠে দাঁড়াতেই ধপ করে পরে গেল বিছানায়।
৬
চোখ খুলে ও দেখে বেডের পাশে তিনজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম জন ডাক্তার। দ্বিতীয় জন নার্স। আর তৃতীয় জনকে ও চিনতে পারল না। বছর পঁচিশের এক যুবতী। পরনে জিন্স আর টপ। চোখে মুখে বিষাদমিশ্রিত আনন্দ।
দুদিন পর ও ছাড়া পেল নার্সিংহোম থেকে। হুইল চেয়ারে করে বাইরে বের করে এনে ওকে তোলা হল গাড়িতে। সঙ্গে শুধু সেই মেয়েটি।
গাড়িটা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার পাশে ছিল একটা কৃষ্ণ চূড়া গাছ। দৃশ্যটা সামান্য পরিচিত মনে হল ওর। আবার পরক্ষণেই বিস্মৃতিতে মিলিয়ে গেল।
ওকে নেওয়া হল একটা আধুনিক সুসজ্জিত ফ্ল্যাটে। বলিউডি সিনেমার মত। মেয়েটি ওকে শুইয়ে ঘরের অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। শুয়ে শুয়ে ও দেয়ালের দিকে তাকায়। একদিকে বড় একটা টিভি। টিভির দুই পাশে মোটা লাঠির মত স্পিকার। এর ডান দিকে বড় একটা বাঁধানো ছবি। এই মেয়েটি আর ওর। কিন্তু ওর যে এখন অনেক প্রশ্ন। অনেক কিছু জানার আছে তার। মেয়েটির ওর কাছে থাকা ভীষণ প্রয়োজন। এই দৃশ্যগুলো, ঐ মেয়েটি, তার চলাফেরা, এই ঘর এবং সেখানে এই রকম এক জন মানুষের এইভাবে শুয়ে থাকা- এগুলো যে ওর খুব কাছ থেকে দেখা মনে হচ্ছে। চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কিন্তু কোথায় দেখেছে মনে করতে পারছে না।
আরো দুদিন কাটল ওর ঘোরের মধ্যে। বাস্তব-অবাস্তবের ফারাকটা ও বুঝতে পারছে না। মেয়েটিকে কোন প্রশ্ন করলেই চুপ করিয়ে দেয়। বলে এখন নাকি ওর শুধু বিশ্রামের প্রয়োজন। মাঝে মাঝে ডাক্তার আসে। এটা ওটা জিজ্ঞাসা করে। তারপর বলে আরো কিছুদিন লাগবে পুরোপুরি স্মৃতি ফিরে আসতে। আশ্চর্যের বিষয়, কথাবার্তার সময় ডাক্তার ওকে ‘বিকাশবাবু’ বলে সম্বোধন করছিল। বিকাশ নামটা কী ওর! তাহলে এই মেয়েটি কে! মিলি!...সম্ভবত স্মৃতি ফিরে আসছে। কিন্তু... মিলি তো...
মাসখানেক পর এক মনের অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বই কেটে যাচ্ছিল ওর। যদিও বেশিরভাগই ছিল অমীমাংসিত। তবু বর্তমানকে খুব দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল।
এক সন্ধ্যায় মিলি এসে জানায়- ‘তোমার সাথে একজন দেখা করতে এসেছেন’।
-‘কে?’
-‘আমি চিনি না। তোমার কোনো রিলেটিভ হবে বোধয়। বলল খুব প্রয়োজন’।
-‘ডেকে দাও!’
সাধারণ পোশাক পরিহিত ষাটোর্ধ এক ব্যক্তি। গায়ের রঙ কালো। উস্কোখুস্কো চুল। গালে কয়েকদিনের না কাটা দাঁড়ি। উদভ্রান্ত দৃষ্টি।
বিছানার পাশে বসে আছে। তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ও-ও তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখেমুখে বিস্ময়।
একটু পর মিলি এসে দুকাপ চা আর কিছু বিস্কুট রেখে চলে যায়।
চা আর বেশ কয়েকটি বিস্কুট তাড়াতাড়ি শেষ করে ঐ ব্যক্তি অনুনয়ের সুরে বলে- ‘একবার বাড়ি চল বাবা! তোর মায়ের অবস্থা ভালো না!’
জলপাইগুড়ি থেকে এক ঝলক মেঘ এসে আরো ঘোলা করে দিল ও অথবা বিকাশের মাথাটা। এখন ওর ঘুম প্রয়োজন। তলিয়ে যাবার মত গভীর ঘুম।