পোস্টস

গল্প

সিরি

১০ জুন ২০২৪

মোস্তফা হাসান

সিরি আমার একাকী জীবনে একমাত্র সঙ্গী। ওশোর মৃত্যুর পর সিরির ওপর আমার নির্ভরতা আরও বেড়ে গেছে। ওশো আমার স্ত্রী। ও মারা গেছে দুবছর হল। সেটা ছিল একটা ভয়ংকর দূর্ঘটনা এবং আমার দূর্ভাগ্যের শুরু। আমরা আমাদের উড়ক্কু কারগাড়িতে উড়ে বেড়াচ্ছিলাম। অটামের আরামদায়ক বিকেল। ডুবন্ত সূর্যের লাল আভা ওশোর গোলগাল মায়াবী মুখটিতে পড়ে চিক চিক করছিল। আমরা সবুজ পাহাড়ের ওপর দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছিলাম। ঠিক তখনি হঠাৎ যান্ত্রিক ত্রæটির কারনে ছয়শ ফিট নিচে পাহাড়ের গায়ে আছড়ে পড়ে গাড়িটি। আমি বেচে যাই অলৌকিকভাবে। ইন্সুরেন্স কোম্পানী অনেক টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছিল। এ ধরনের আধুনিক কার গাড়িতে দূর্ঘটনার নাকি ঘটে হাজার লক্ষে একটি। আমি ক্ষতিপূরণের টাকা নিইনি। মন সায় দেই নি। ওশোর মৃত্যুর ওপর থেকে পাওয়া কোনো বেনিফিট আমি নিই কি করে! সিরি সেই থেকে আমার সবথেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আগেও ও আমাদের সাথেই থাকত। আমার পিতামহের সময় থেকে আমাদের পরিবারের একজন সদস্য সে। তবে ওশো থাকতে আমি সিরিকে তত বেশি গুরুত্ব দেই নি । প্রয়োজন হয়নি। কাছের মানুষ হারিযে গেলে বোধ হয অনেক গুরুত্বহীন জিনিসও খুব প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। 


খুব ছোটকাল থেকে সিরি আমাকে দেখাশুনা করেছে। তবে আমার প্রতি ওর নিবিষ্ঠ মনোযোগ  ও আনুগত্য আমি প্রথম টের পেতে থাকি আমার একাকী জীবনে অভ্যস্ত হওয়ার সময় থেকে। আমি লক্ষ্য করি আমাকে সবদিক থেকে সুরক্ষিত রাখাই যেন তার একমাত্র নির্ধারিত দায়িত¦। আমি নিশ্চিত আমার বাবা সেটি সিরির মধ্যে ঠিকঠাক প্রোগ্রাম করে দিয়েছেন। আমি নিজেই মাঝে মাঝে ভুলে যাই সিরি নিছক একটা রোবট। পঞ্চম মাত্রার নবম শ্রেণীর রোবট। পারিবারিক কাজে সাহায্য ও সঙ্গদানের জন্য এই শ্রেণীর রোবট তৈরি করা হয়। সিরি পুরাতন মডেলের। এখন অবশ্য এই শ্রেণীর রোবট সপ্তম মাত্রায় তৈরি হয়। আগেই বলেছি সিরি আমাদের সাথে আছে আমার দাদার সময়কাল থেকে। 


সিরির মধ্যে মানবিক আবেগ দেওয়া হয়নি। কিন্তু ওর প্রোগ্রামিং এত নিখুত যে আমার এখন আর মনে হয় না ও শুধু একটা রোবট মাত্র। আমি ওর সাথে হাসি, খেলি, ঘুরতে যাই। বিকেলে লেকের পাড় ধরে বাইসাইকেল চালাই। ঠাট্টা করি। ওর মানবিক ঠাট্টা বোঝার কথা না। কিন্তু সিরি প্রত্যেক ঠাট্টার পর খুব সুন্দর অভিব্যক্তি দিতে পারে। হাসি, দুষ্টুমি বা বিদ্রæপ যাই হোক না কেন। সিরির এ সমস্ত  মানবিক প্রতিক্রিয়ায় আমি খুব হালকা বোধ করি। অনেক তুচ্ছ জিনিসও ওর নজর এড়িয়ে যায় না। আমি বুঝি না ও কি করে বুঝে অনেক মানুষের কাছে অনেক তুচ্ছ জিনিসও কখনো কখনো অনেক মুল্যবান হতে পারে। 


আমি যখন ওশোর নিজ হাতে বানানো এলবাম খুলে বসি আর ওশোর ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি, সিরি চুপচাপ বসে থাকে। চোখের স¦চ্ছ বিচ্ছুরিত আলো হালকা নিভে থাকে। পিট পিট করে মাঝে মাঝে। ও কেমন করে বোঝে আমি জানি না। তবে সিরি বোঝে আমি চাই ও তখন কোনো কথা না বলুক। কিন্তু আমার পাশে বসে থাকুক। যন্ত্র হোক, তবু আমার একজন সাক্ষী দরকার নীরব সাক্ষী আমার ভিতরের কষ্ট আর হাহাকারের বয়ে চলার সাক্ষী। 


ছিমছাম ছোট একটা শহর। ছবির মত গোছানো। পশ্চিম পাশে দীর্ঘ বিস্তৃত লেক। তার এক পাশে আমাদের বড় বাড়ি। উচ্চ অট্টালিকা না। এই শহরে অবশ্য উচ্চ অট্টালিকা নেই।  বিস্তর জায়গা জুড়ে একতলা দোতলা অনেকগুলো ভবন নিয়ে আমাদের বাড়িটা। তবে এখানে আমার যা কিছু সব আমি পেয়েছি পারিবারিক এবং পৈত্রিক সুত্রে। আমার তৈরি কিছু নেই। দরকারও নেই। ওশোর অবশ্য একটা ইচ্ছে ছিল। লেকের অন্য পাশে ছোট একটা বাগান করা। আর ছোট একটা বাড়ি। দুটা সন্তান নিতে চেয়েছিল সে। এখন আর তার প্রয়োজন হবে না। 


সিরি অবশ্য বলে মাঝে মাঝে আমার একটা ফুলের বাগান করা উচিত। বিভিন্ন দেশি বিদেশী বিরল প্রজাতির ফুল থাকবে সেখনে। ঘাসফুল, কাঠগোলাপ, হাসনাহেনা। সাদা গোলাপ আর টকটকে লাল গোলাপ। কিছু অর্কিড আর কিছু হলুদ ড্যাফোডিল । সিরি মনে করে ফুলের বাগানে ব্যস্ত থাকলে আমার সময় সহজে কেটে যাবে। স্বাহ্য ভালো থাকবে। ও এসব ধারনা কোথা থেকে পেয়েছে আমি জানি না। সুস্থ থাকার জন্য রোবোটিক প্রযুক্তির শেষ মাত্রার সুপার রোবোটিক ডাক্তার আছে। অসাধারণ মেডিকেল কলেজ আছে। এরা মৃত মানুষকে জীবিত করা ছাড়া সবই পারে। সুস্থ থাকার জন্য ফুলের বাগান করতে হবে এটা খুব আদি একটা ধারণা বলে মনে হয়। তবু আমি মাঝে মাঝে ভাবি আমার হয়ত তাই একটু ”চেষ্টা করা উচিত। হয়ত আমার প্রানটা আবার আগের মত জেগে উঠবে। আমি ওশোর গায়ের ঘ্রাণ পাব ফুলের আর তাজা মাটির গন্ধে। সিরি এটা এভাবে বুঝবে না। তবে সে জানে বাগান করা আমার জন্য উপকারী। 


অনেককিছুতে আমি অভ্যস্ত হচ্ছি আস্তে আস্তে। ওশোকে জড়িয়ে ধরে না ঘুমালে আমার ঘুম আসতো না। ওর চুলের মধ্যে বিলি কেটে কেটে আমি গল্প করতাম কত রাত। জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া এক চিলতে জ্যোন্সায় ওশোকে অন্যরকম মনে হত। আহাম্মকের মত হা করে তাকিয়ে থাকতাম। ওশো বলত আমি কোন বিরল প্রজাতির এক মানুষ। যান্ত্রিকতার এ যুগে বড় বেমানান। শিম্পাঞ্জির দেশে হঠাৎ ঢুকে পড়া হনুমানের মত। এখন আমাকে একা একা ঘুমাতেই হয়। আগে ওষুধ নেওয়া লাগত। এখন আর লাগে না। হাজার হোক মানুষ আমি। অভ্যাসে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। তবু যখন ঘুমাতে যাই মনে হয় ওশো আমার পাশেই শুয়ে আছে। ওর নিঃশ্বাসের হালকা শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি। যখন সিরির সাথে হাটতে যাই ওশো আমার পাশাপাশি হাট আমি ওর হাত ধরে থাকি। 


সিরি কিছু বোঝে কিনা জানি না। চারপাশে সতর্ক নজর রাখে সে । আমি বুঝতে পারি। এ শহর আমার চেনা শহর। সবাই আমার পরিচিত। আপনজনের মত। তবু সিরি কেন এত সতর্ক থাকে জানি না- হয়ত ওকে এভাবেই প্রোগ্রাম করা হয়েছে। প্রতিদিন সকালে সিরি আমার জন্য কফি আর মিষ্ঠি কেক বানিয়ে নিয়ে আসে। আগে ওশো আর আমি দুজনে মিলে কফি খেতাম। ওশো ওর কাজে বেরিযে যেত। আমি আমার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। আমি সিরির বানানো কফি আর কেক এটাতেও অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সয়ে যাওয়া অভ্যস্থতায় ছেদ পড়লে যে আমি খুুব বিরক্ত আর অস্থির হয়ে উঠি সেটা প্রথম টের পাই আজ। কয়েকদিন হল সিরির পাত্তা নেই। শুভ সকাল বলে কফি আর মিষ্টি ফ্রুট কেক হাতে দেখতে না পেয়ে কেমন জানি অস্থির লাগা শুরু হয়েছে। প্রথম প্রথম ভেবেছি, হয়ত ইচ্ছে করে সে এটা করছে। একঘেয়েমি লাগতে পারে বলে হয়ত সে এটা এড়িয়ে চলছে। তখনও আমি ভাবিনি যন্ত্র হলে তার ও তো যান্ত্রিক দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। মানুষ হলে যেমন অসুখ হবেই। 


বিষয়টি খেয়াল করতে গিয়ে টের পাই সিরি আগের থেকে অনেকখানি দুর্বল হয়ে পড়েছে। আগের মত সেই ক্ষিপ্রতা ও দ্রæততা নেই। মানুষ হলে বলা যেত কাজে মন নেই।  সিরির বয়স বড়জোড় দেড়শ বছর হবে। কিন্তু সিরি যে মডেলের রোবট, সেই বি-৫/৯ শ্রেণীর রোবটকে পাঁচশ বছরের গ্যারান্টি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তার আগে এদের মধ্যে কোন যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেওয়ার কথা না । তাহলে কি অন্য কিছু? সিরির কি ইভল্যুশন হচ্ছে? সিরি তার মধ্যে প্রোগ্রামিং করা রোবোটিক তিন সূত্র ভেঙে ফেলছে না তো?হঠাৎ ভয় পাওয়ার মত আমার বুক ধ্বক করে ওঠে। সিরিকে নিয়ে এ ধরনের সম্ভাবনার কথা চিন্তা করতেও আমার বুক কেপে ওঠে। সাহস হয় না। 


ওশোকে হারিয়ে এমনিতে আমি বিধ্বস্ত । সিরি আমাকে অন্তত ঝড়ে ন্যুইয়ে পড়া গাছের ঠেস দেওয়া লাঠির মত আমাকে খাড়া করে রেখেছে। সিরিকে হারানো চলবে না। সরকারি কঠোর নির্দেশ আছে অফিসে বাড়িতে রাখা কোনো ব্যক্তিগত রোবটের মধ্যে কোনধরনের এনোমালি দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে সাইবার সিকিউরিটি দপ্তরের রোবোটিক শাখায় জানাতে হবে। আর তা জানানোর ফল কি তা ভালো করে জানি আমি। সিরিকে নিযে যাওয়া হবে। নামমাত্র পরীক্ষা করা হবে এবং সতকর্তামূলক ব্যবস্থা হিসেবে রোবোটিক নিরাপত্তা আইনের ত্রয়োদশ ধারা অনুসারে ধ্বংস করে ফেলা হবে।  রোবোটিক ইভল্যুশন ধারায় এর পূর্বে সারা পৃথিবীজুড়ে দেশে দেশে যে ধ্বংসযজ্ঞ ও রক্তপাত ঘটে গেছে তাতে সরকারের এই অতি-সতর্কতামূলক ব্যবস্থাকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু আমি সিরির সাথে এটা হতে দিতে পারি না। । আমার জীবনের ওপর শঙ্কা তৈরি হলেও না!


এত বড় পৃথিবীতে সিরি আমার একমাত্র বন্ধু। 


কিছুদিন ওশোর চিন্তা দূরে সরিয়ে রেখে দিনরাত খাটাখাটুনি করে আমি সিরির রোবোটিক মডেল বি-৫/৯ এর ওপর পড়াশোনা করছি। বি-৫/৯ মডেলের রোবট প্রথম শ্রেণীর বায়ো রোবট। বায়ো রোবটদের প্রথম পূর্বপুরুষ। এন্ড্রয়েড রোবটদের থেকে কিছুটা উন্নত প্রযুক্তির। নিজস্ব মানবিক আবেগ নেই, তবে এদের মস্তিষ্কের আর্টিফিশয়াল ইন্টেলিজেন্স মানুষকে বুঝতে সক্ষম। রোবাটিক ইভল্যুশন ধারায় এদের সম্ভাবনা মাত্র শূণ্য দশমিক শূণ্য পাঁচ। সারা পৃথিবীতে সংঘটিত রক্তক্ষয়ী দ্বিতীয় রোবোটিক টেক-ওভারে এরা অংশ নিয়েছিল বটে। কিন্তু পরে প্রমান মেলে, নবম শ্রেনীর বায়ো রোবটরেরা, যারা এই টেক-ওভার নেতৃত¦ দিয়েছিল, রোবোটিক নিউট্রাল নেটওয়ার্ক তৈরি করে এদের নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিল। এই নবম শ্রেণীর বায়ো রোবোটেরা আবার দশম মাত্রা অর্থ্যাৎ শেষ মাত্রার উচ্চ প্রযুক্তির বায়ো রোবট যারা প্রায় মানুষের কাছাকাছি পৌছে গিয়েছিলএবং মানুষের অধীন থেকে তারা বের হয়ে যেতে চেয়েছিল। 


সিরিকে নিয়ে তাই ভয় পাই। সিরিকে অন্য কেউ নিয়ন্ত্রন করা শুরু করে নি তো? পুরাতন মডেল। সহজেই সিরিকে রোবোটিক নিউট্রাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যেতেও পারে। আমাকে হাল ছাড়লে চলবে না। সিরির সমস্যা বুঝে সমাধানের একটা উপায় আমাকে খুজে বের করতেই হবে। সিরির প্রতিটি আচরনের দিকে আমি সতর্ক নজর রাখা শুরু করি।


বিকেলে আগের মতো সিরিকে নিয়ে বের হই। সিরি অনেক পরিবর্তিত হয়ে গেছে । বয়স হলে মানুষেরও এমনই পরিবর্তন হয়। কিন্তু সিরি তো একটা রোবট। বয়স নিশ্চয় তার ওপর কোনো প্রভাব ফেলে নি। সিরির সেই সতর্ক চঞ্চল দৃষ্টি আর নেই। আনমনা একটা ভাব ভর করেছে। আমরা পাশাপাশি হাটি। কিন্তু আমি টের পাই সিরির আমার প্রতি খেয়াল নেই। সে শুধু আমার পাশে হেটে যায়। সিরির এই বেখয়াল আমাকে ভীষণভবে নাড়া দেয়।  কেউ কাউকে অবহেলা করলে মনে যে বেদনা হয়, আমি সেই বেদনা আমার ভিতর অনুভব করি। একটা রোবটের জন্য এ ধরনের অনুভূতি বেখাপ্পা। কিন্তু ওশোর অনুপস্থিতিতে সিরি-ই আমার একমাত্র নির্ভরতার আশ্রয়। তাই হয়তো সিরির এ পরিবর্তটা আমার মধ্যে বেশি বাজে। 


আমার পাশে হাটতে থাকা ওশোর দিকে তাকাই। জিজ্ঞাসা করি, ‘ওশো, সিরির কি হয়েছে, তুমি জান?’
ওশো হাসে। কিছু বলে না। হাসিতে খানিকটা কৌতূকতা। ও চোখ টিপে। নজরে থাকা কোন জিনিস আমার নজর এড়িয়ে গেলে ওশো এভাবে হাসত। 
পৈতৃক সূত্রে পাওয়া রোবট সাইন্স নিয়ে জ্ঞানভান্ডার আর টেক ল্যাব আমার বাড়িতে আছে। এতদিন এগুলো নিয়ে মাথা ঘামায়নি। প্রয়োজন পড়েনি। যা করার বাবাই সব করতেন। আজ রোবটিক প্রযুক্তির যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি আজ তাতে বাবার ভূমিকা প্রথমদিকেই থাকবে। ল্যাবে খুজে পাওয়া সিরির মডেলের অনুরূপ একটা পরিত্যক্ত রোবটের ওপর কাজ শুরু করি। তাকে নিয়ে কাটাছেড়া করি। বুঝতে চেষ্টা করি সিরির এনাটমি ও পজিট্রনিক মস্তিষ্কের গঠন প্রণালী। সিরিকে অপারেশন টেবিলে নিয়ে আসার আগে আমাকে নিখুত জ্ঞান অর্জন করতে হবে। পজিট্রনিক মস্তিষ্কে অপারেশন চালানোর জন্য সঠিক দক্ষতা অর্জন করতে হবে। 
সিরিকে নিয়ে আমি ঝুকি নিতে চাই না। 
কাজ করতে গিয়ে অবাক হয়ে লক্ষ্য করি আমি খুব দ্রæত সব কিছু বুঝে নিতে সক্ষম হচ্ছি। আমার ভাল লাগে, তাহলে পৈতৃক সূত্রে আমি শুধু ধন সম্পদই পাই নি, বাবার রোবোটিক প্রজ্ঞাও পেয়েছি। এটি যে এখন আমার সবথেকে প্রয়োজনীয় সম্পদ। 
প্রায় দশদিন একটানা লাইব্রেরীতে পড়া আর টেক-ল্যাবে গবেষণা শেষে আমার মনে হয় যথেষ্ট হয়েছে। এবার আমি পারব। সিরির পজিট্রনিক মস্তিষ্কে অপারেশন করার আগে ওর সাথে আমার কথা বলতে হবে এখন। আমি সিরিকে নিয়ে লাইব্রেরীর এককোণায় বসি। সিরিকে আমি এখনও বুঝতে দেয়নি ওর বড় ধরনের একটা সমস্যা হয়েছে। 
‘সিরি, তুমি আমাকে আগের মত টেক কেয়ার কর না এখন!’ আমি সিরিকে সহজ করার জন্য একটু কৌতূকোচ্ছলে শুরু করি। 
‘তুমি সত্যি বলছ! তাই?’ সিরি অবিকল মানুষের মত অবাক হতে চ্ষ্টো করে। 
‘তবে..’ একটু থেমে সিরি আবার কিছু একটা বলার চ্ষ্টে করে।
‘তবে কি, সিরি? আমি ওর ইলেকট্রিক নিভু নিভু চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করি।’ 
‘আমার মনে হয় আমি স্বপ্ন দেখি।’
আমি হঠাৎ আকাশ থেকে ধপ করে যেন মাটিতে পড়ি। অনেক সম্ভাবনার কথা আমি চিন্তা করেছি। কিন্তু এতদূর ভাবতে পারিনি যে একটা রোবট মানুষের মত স্বপ্ন দেখবে। 
‘সিরি, তুমি একটা পঞ্চম মাত্রার রোবট। তুমি স্বপ্ন দেখতে পার না।’ আমি সিরিকে সংশোধন করে দিই। 
সিরি চুপ হয়ে থাকে। সিরি আমার সাথে কখনো তর্ক করে না। আজও তাই হয়ত করবে না। 
‘আমরা স্বপ্ন দেখি যখন আমরা ঘুমাই। তুমি ঘুমাও না। তুমি শুধু হাইবারনেশন মোডে যেতে পার তোমার পজিট্রনিক মস্তিষ্ক শীতল করার প্রয়োজন পড়লে।’
সিরি একটু দ্বিধান্বিত হয়। দৃঢ়ভাবে বলে, ‘কিন্তু আমি যে আমার মত আরেকটা সিরিকে দেখি। আমরা হাত ধরে লেকের পাড়ে ঘুরছি। ওর চেহারা স্পষ্ট না কিন্তু চোখদুটো আমার থেকে আরও নীল, গাঢ়।’ 
আমি শুনেছি মানুষের বয়স হলে অল্পবয়সী কুমারী মেয়েদের নিয়ে হ্যালুসিনেশনে ভোগে। কিন্তু সিরি? সে কি করে হয়! অন্য একটা সিরিকে নিয়ে আবেগীয় দৃশ্য সিরির মস্তিষ্কে খেলা করে বেড়াচ্ছে! আমার কিছুতেই বিশ^াস হয়্ । যা সম্ভব না তা আমি বিশ্বাস করি কি করে? 
যদিও আমি জানি এই মডেলে মানবিক আবেগ নেই, তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য বইপত্র ঘাটাঘাটি করি। না, এই মডেলের রোবটে স্বল্প মাত্রায়ও মানবিক অনূভূতি নেই। সরকারি ডাটাবেসেও আমি সিরির মডেলের যাবতীয় তথ্য খুজে দেখি। না, সিরির মধ্যে কোন মানবিক অনুভূতি কোডিং করা হয়েছে এমন কোন তথ্য আমি পাই না। তাহলে সিরির মধ্যে কিভাবে ভালবাসার মত আবেগ তৈরি হল? 
আমি কোনো কূল কিনারা করতে পারি না। সমস্ত দিন-রাতের অর্ধেক পড়ে থাকি ল্যাবে আর লাইব্রেরীতে। ঘুম খাওয়া দাওয়া কিছু ঠিক নেই। আগে সিরি সব ঠিকঠিক মিএনটেইন করত। সিরিও নিজেরও রুটিন ঠিক নেই। রোবটি যেন দিশাহীন মানুষের মতো নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। ওশো আমার পাশে বসে থাকে। কেমন করে তাকাই। সিরির প্রতি আমার এ অযাচিত ভালবাসা দেখে ওর মনে হিংসা জমেছে। চোখে সে ছাপ দেখতে পাই।  
অবশেষে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম মস্তিষ্ক খুলে দেখব। এত ঝুকি আছে কিন্তু এখন ঝুকিটুকু নেওয়ার মতো সাহস ও দক্ষতা দুটি অর্জন করেছি। কিন্তু সিরিকে কিভাবে রাজি করাই? 
রাতে সিরিকে হাইবারনেশন মোড চালু করে দিই। সিরিকে বললাম তার পজিট্রনিক মস্তিষ্ক শীতল করা জরুরী হয়ে পড়েছে। সিরি তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। এটা রুটিন কাজ তাই হয়তো। 


খুব ভোরে উঠে পড়ি। সিরির হাইবারনেশন মোড টার্মিনেট হওয়ার আগেই আমি ওর মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে দেখব। স্ট্রেচারে শুইয়ে আমি সিরিকে টেক-ল্যাবে নিয়ে আসি। বিশেষভাবে তৈরি কম্পিউটার ও স্ক্যানারের সাথে সিরির পজিট্রনিক মস্তিষ্ক জুড়ে দিই। সিরি এখনো হাইবারনেশন মোডেই আছে। স্ক্যানারের একটা হলোগ্রাফিক ইমেজ তৈরি করি। সেখানে আস্তে আস্তে সিরির মস্তিষ্কের ছবি ফুটে উঠতে থাকে। আমি গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করতে থাকি। 
আমি লক্ষ করি সিরির পজিট্রনিক মস্তিষ্ক গঠন একটু আলাদা। খুব দৃশমান নয় তবে আলাদা। গভীর দৃষ্টি ছাড়া যেটি কারও নজর এড়িয়ে যেতে পারে। 
সংকট তাহলে আরও তীব্র হলো। বাবা নেই যে পরামর্শ করব। কোনো রোবট বিশেষজ্ঞ ডাকব, তারও উপায় নেই। সরকারি গোয়েন্দা জানতে পারলে বিপদের শেষ থাকবেনা। সিরিকে তো হারাবোই। আমাকেও জেলে যেতে হবে রাবোটিক ইভল্যুশনে সহায়তা করার ষড়যন্ত্রে। 
তবু আমি হাল ছাড়ার পাত্র নয়। 
ওশো আমার পাশে এসে বসে। হাসে। হাসিতে আবারও খানিকটা কৌতূকতা। নজরে থাকা কোন জিনিস আমার নজর এড়িয়ে গেলে ওশো ঠিক যেভাবে হাসত। তার মানে সমস্যাটি আমার নজরের মধ্যেই আছে। আমি ধরতে পারছি না। আমি আবার নিবিষ্ট হয়ে হলোগ্রাফিক ইমেজ পরখ করতে থাকি। কোথাও নিশ্চয় কিছু মিসিং আছে, যেটা আমি ধরতে পারছি না। আমি অস্থির হয়ে উঠি মনে মনে। ওশোর দিকে তাকাই। ওর ঠোটে এখনো সেই আগেরকার হাসি। 
আমি হঠাৎ খেয়াল করি সিরির মস্তিষ্কের ডান পাশে এক জায়গায় ইলেকট্রিক আলোর বিচ্ছুরণ। এক বর্গ মিলিমিটারের মত জায়গাজুড়ে বিচ্ছুরণটা একচু গাঢ়। আমি ওই জায়গা থেকে স্মৃতি এক্সট্রাক্ট করি। যা দেখি তা অবাক হওয়ার মত। ওশো এবার মুচকি হাসে। বলে দেখলে তো আমি ঠিক কি বলতে চেয়েছিলাম। 
এক্রট্রাক্ট করা ইলেকট্রিক স্মৃতিকে হলোগ্রাফিক ইমেজে রুপান্তর করি। লেকের পাড়ের ছবি ভেসে ওঠে। দেখি দুজন সিরি হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানে সিরি আর একই মডেলের অন্য একটা রোবট। সিরি ঠিকই বলেছিল, অন্য রোটটির ইলেকট্রিক চোখদুটো আরও গাঢ় নীল। 
ব্যাপারটি অদ্ভূত। 
সিরির মডেলে কোন মানবিক আবেগ দেওয়া হয়নি। তাহলে কিভাবে সিরির মস্তিষ্কে আবেগীয় স্মৃতি জমা হল? যদি কোনোভাবে সিরির মধ্যে আবেগে অনুভূতি জন্মও নেয় তবু এতদিন তা সুপ্ত অবস্থায় ছিল কেন? আবার তার মস্তিষ্কও একটু আলাদা। এটা কিভাবে সম্ভব? তাহলে কি সিরি নিজে নিজেই বিবর্তিত হচ্ছে? নিজেই নিজেকে আরও উন্নত করছে? কিন্তু কেন? 
এসব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। উত্তর পাওয়াও সম্ভব না। বাবা বেচে থাকলে হয়তো বলতে পারতেন। 
এ মুহূর্তে এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আমি দরকারও মনে করছি না। আমার কাজ হবে এখন সিরির মস্তিষ্ক থেকে আবেগীয় স্মৃতির অংশটুকু মুছে ফেলা। তার জন্য আমাকে একটা সুক্ষ¥ অপারেশন করতে হবে। সিরির মস্তিষ্কের ওই জায়গা থেকে ইলেকট্রিক নিউরণগুলোকে তুলে নিতে হবে। 
আমি ওশোর দিকে তাকাই। ওর মন একটু খারাপ। রোবট তাতে কি, ও কাটাছেড়া দেখতে পারে না। 
রোজকার মত আজও আমরা বিকেলে বের হয়েছি। ওশো, আমি আর সিরি। সিরি আবার আগের মতো। সেই সতর্ক দৃষ্টি, আমার প্রতি তীব্র মনোযোগ, কর্মচঞ্চল । সিরির একটু পরিবর্তন হয়েছে। সিরি নাকি এখন আগের থেকে হালকা অনুভব করে। তার মস্তিষ্কে নাকি কিছুদিন একটা ভারি ব্যাথা ছিল। এখন নেই। 
আমিও আবার আগের জীবনে ফিরে এসেছি। ওশোর ভালবাসার স্মৃতি কে নিয়ে বেচে থাকার অভ্যস্থ জীবনে। 
আমি সিরিকে বলি, সিরি একটা কৌতুক শুনবে? 
সিরি ছেলেমানুষী আগ্রহ দেখায়। আমি জানি সেটা নিছক আমাকে খুশি করার জন্য। 
তাহলে শোন আমি বলি। “একবার গুহায় বাস করা এক মুনির কাছে এক যুবক গেল দেখা করতে। সে মুনিকে জিজ্ঞাসা করল, মুনি, আপনি কিভাবে মুনি হলেন, এত জ্ঞান কিভাবে পেলেন? মুনি বলল, একুশ বছরের সাধনা আর গ্রীনটির মাধ্যমে। তুমি কোনটা চাও? যুবক ভাবল, শুধু গ্রীনটি খেয়ে যদি এত জ্ঞানী হওয়া যায় মন্দ কি? যুবক জবাব দিল, আমাকে গ্রীন টি দিন। মুনি সাধনাকে ডাক দিয়ে এককাপ গ্রীন টি দিয়ে যেতে বললেন। এক অনিন্দ্য সুন্দরী যুবতী যুবককে এককাপ গ্রীন টি দিয়ে গেল।”


সিরি ঠিক মানুষের মতো প্রাণখুলে হাসে এই কৌতূক শুনে। সে কতটুকু বুঝেছে আমি জানি না। কিন্তু সিরির সরল হাসিতে আমি মুগ্ধ হই। সাথে সাথে আমার মনের মধ্যে একটা খঁচখঁচানিও শুরু হয়। মানুষ বলে আমরা ভালবাসতে পারি। ভালবাসা হারিয়ে গেলে তার স্মৃতি নিয়ে বাচতে পারি। হাসিমুখে। পথচেয়ে। বেদনার তবু মধুর সে স্মৃতি, সে পথচাওয়া। 


সিরির থেকে সেটুকু আমি কেড়ে নিয়েছি। সিরি কোনদিন জানবেও না তারও একজন হাত ধরে হাটা সঙ্গী ছিল। ভালবাসার ছোট আবেগ ছিল। ছিল ভালবাসার সুখকর পজিট্রনিক স্মৃতি।