গ্রীষ্মের এক রাতে, গ্রামের নিস্তব্ধতা আর ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দে রাকিবের মন অস্থির হয়ে ওঠে। দাদু সম্প্রতি মারা গেছেন, আর তার কিছু মুল্যবান জিনিস শহরে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব রাকিবের উপর পড়েছে। সাহস করে রাকিব দাদুর পুরনো বাড়ির দিকে রওনা দেয়। রাতে গ্রামের পরিবেশটা সবসময়ই একটু ভয়ঙ্কর লাগে। চারদিকে নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ, আর হালকা বাতাসের ফিসফিস শব্দে পরিবেশটা আরও রহস্যময় হয়ে ওঠে। রাকিব মনে মনে দাদুর কথা ভাবতে থাকে। দাদু ছিলেন গ্রামের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। তার মৃত্যুতে পুরো গ্রাম যেন শোকাহত। কিন্তু রাকিবের মনে একটাই কথা, দাদুর স্মৃতির কিছু নিদর্শন রাখতে হবে। তাই সে সাহস করে দাদুর পুরনো বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। বাড়িটা গ্রামের সবচেয়ে পুরনো বাড়িগুলোর একটি। দাদু সবসময় বলতেন, এই বাড়ির প্রতিটি ইটে তার জীবনের স্মৃতি লুকিয়ে আছে। রাকিব বাড়ির কাছে পৌঁছে দেখে, বাড়ির দরজায় একটা বড় তালা ঝুলছে। তালাটা খুলতে গিয়ে তার হাতে একটা কাঁপুনি লাগে। তালা খুলে ভেতরে ঢুকতেই রাকিবের মনে হয়, যেন বাড়িটা তার দাদুর জীবন্ত স্মৃতি হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির প্রতিটি কোণে মাকড়সার জাল ঝুলছে, আর প্রতিটি জানালায় ধুলো জমে আছে। রাকিবের চোখে ভাসতে থাকে তার দাদুর চেহারা, যে চেহারায় সবসময় এক ধরনের শান্তি আর অভিজাত্য ছিল।
দাদুর ঘরটাতে ঢুকতেই রাকিব দেখে, ঘরটা এখনও সেই আগের মতোই আছে। দাদুর বিছানায় এখনও সেই পুরনো চাদর, টেবিলে দাদুর পছন্দের বইগুলো, আর একপাশে দাদুর ব্যবহৃত পুরনো ঘড়িটা। রাকিব ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘড়িটা ছিল দাদুর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস। দাদু সবসময় বলতেন, এই ঘড়িটা তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সাক্ষী। রাকিব ঘড়িটা হাতে তুলে নিতেই তার মনে হয়, যেন ঘড়িটার মধ্যে একটা জীবন্ত প্রাণ আছে। ঘড়িটা তোলার সাথে সাথেই সে একটা ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ পায়, যেন কেউ তার গায়ে হাত দিয়ে যাচ্ছে।
রাকিব ভয়ে কাঁপতে থাকে, কিন্তু সে সাহস করে ঘড়িটা হাতে রাখে। হঠাৎ সে একটা অদ্ভুত আওয়াজ শোনে, যেন কারো হাঁটার শব্দ। সে পেছনে ফিরে তাকায়, কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। আবার সে ঘড়িটা খুঁজতে থাকে, কিন্তু তার মনে হয় কেউ যেন তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তার হৃদস্পন্দন বাড়তে থাকে, আর তার শরীরে একটা ঠান্ডা ঘাম জমতে থাকে। রাকিব ভাবতে থাকে, এভাবে কতক্ষণ থাকবে? সে কি দাদুর এই প্রিয় জিনিসটা নিয়ে যেতে পারবে?
রাকিব ঘড়িটা হাতে নিয়ে পেছনে ফিরে তাকায়, দেখে একটা ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে। ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে, আর রাকিব চিনতে পারে, এটা তার দাদুর মূর্তি। দাদুর চোখ দুটো লাল হয়ে আছে, আর মুখে একটা অশুভ হাসি। দাদুর কণ্ঠে শোনা যায়, "এই ঘড়িটা আমার, এটা কেউ নিতে পারবে না।" ভয়ে রাকিব ঘড়িটা ছেড়ে দিয়ে দৌড়াতে শুরু করে।
রাকিবের পা জমে গেছে ভয়ে। দাদুর সেই মূর্তি তাকে যেন আঁকড়ে ধরতে চাইছে। ঘরের প্রতিটি কোণ থেকে যেন দাদুর আত্মা তাকে ডাকছে। তার কানে শোনা যায় দাদুর পুরনো কথাগুলো, "এই ঘড়িটা আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সাক্ষী।" রাকিবের মনে হয়, দাদুর আত্মা এখনও এই ঘড়িটার সাথে বাঁধা। দাদু হয়তো জীবিত অবস্থায় এই ঘড়িটাকে এতটাই ভালোবেসেছিলেন যে, মৃত্যুর পরও তিনি এটা ছেড়ে যেতে পারেননি। রাকিবের মনে পড়ে, দাদু সবসময় বলতেন, "এই ঘড়িটা আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের কথা বলে।"
রাকিব দৌড়াতে দৌড়াতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। বাইরের বাতাসটা ঠান্ডা, আর মেঠোপথে কোন আলো নেই। গ্রামটা যেন অন্ধকারে ঢেকে গেছে। রাকিবের মনে হয়, পুরো গ্রামটাই যেন দাদুর আত্মার প্রভাবিত। সে দৌড়াতে দৌড়াতে গ্রাম পেরিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। তার মনে হয়, দাদুর আত্মা তাকে অনুসরণ করছে। পেছনে পেছনে শুনতে পায় দাদুর সেই অশুভ হাসি। রাকিব দৌড়াতে দৌড়াতে ভাবতে থাকে, সে কি সত্যিই দাদুর আত্মাকে দেখেছে? নাকি এটা তার কল্পনা? রাকিবের মনে পড়ে, গ্রামে একটা কথা প্রচলিত আছে। যে কেউ দাদুর ঘড়িটা নিতে যায়, সে আর ফিরে আসতে পারে না। গ্রামের লোকজন বলে, দাদুর আত্মা নাকি এখনও সেই ঘড়িটা পাহারা দেয়। রাকিবের ভয় বাড়তে থাকে। সে ভাবতে থাকে, এই ঘড়িটা কি সত্যিই অভিশপ্ত? নাকি এটা শুধু তার মনের ভুল? তার হৃদস্পন্দন বাড়তে থাকে, আর তার শরীরে একটা ঠান্ডা ঘাম জমতে থাকে। রাকিব ভাবতে থাকে, সে কি কখনো এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে? বাইরে এসে রাকিব দেখে, পুরো গ্রাম যেন অন্ধকারে ঢেকে গেছে। মেঠোপথেও আর কোনো আলো নেই।
দৌড়াতে দৌড়াতে সে বাড়ি পৌঁছে, দরজায় পৌঁছে পিছনে শুনতে পায় একটা হাসির শব্দ। সেদিনের পর থেকে রাকিব আর কখনো রাতে দাদুর বাড়ির দিকে যায়নি। গ্রামের লোকজন বলে, দাদুর আত্মা নাকি এখনও সেই ঘড়িটা পাহারা দেয়, আর রাতে কেউ সেখানে গেলে তাকে আর ফেরত আসতে দেয় না। রাকিবের জীবনে সেই রাতটার পর অনেক কিছুই বদলে গেছে। তার মনে সবসময় একটা ভয় কাজ করে, দাদুর আত্মা কি তাকে অনুসরণ করছে? সে সবসময় নিজের চারপাশে তাকিয়ে দেখে, কেউ তাকে দেখছে কিনা। গ্রামের লোকজনও রাকিবকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। তারা বলে, "রাকিব সেই রাতে কিছু একটা দেখেছে, যা তাকে ভয়ানকভাবে প্রভাবিত করেছে।" রাকিব নিজেও ভাবতে থাকে, সে কি সত্যিই দাদুর আত্মাকে দেখেছে? নাকি এটা তার মনের ভুল? রাকিবের বন্ধু বান্ধব, পরিবার সবাই তাকে বুঝাতে চেষ্টা করে। তারা বলে, "তুমি যেটা দেখেছ, সেটা হয়তো তোমার কল্পনা।" কিন্তু রাকিব কিছুতেই তা মানতে পারে না। তার মনে সবসময় একটা ভয় কাজ করে। সে সবসময় ভাবে, দাদুর আত্মা কি সত্যিই তাকে অনুসরণ করছে? রাকিব রাতে ঘুমাতে পারে না। তার মনে হয়, তার ঘরে দাদুর উপস্থিতি আছে। সে শুয়ে শুয়ে শুনতে পায়, যেন কেউ তার পাশে বসে আছে।
গ্রামের মানুষজন দাদুর বাড়ির কাছ দিয়ে যেতে ভয় পায়। তারা বলে, "সেই বাড়িতে একটা অভিশাপ আছে।" রাকিবও আর কখনো সেই বাড়ির দিকে যায়নি। তার মনে সবসময় একটা অদ্ভুত ভয় কাজ করে। সে সবসময় ভাবে, "আমি কি কখনো এই ভয় থেকে মুক্তি পাবো?" রাকিবের জীবনটা যেন একটা ভয়ের কাহিনী হয়ে উঠেছে। সে সবসময় নিজেকে একা মনে করে, আর ভাবতে থাকে, দাদুর আত্মা কি সত্যিই তাকে অনুসরণ করছে? নাকি এটা শুধু তার মনের ভুল?
রাকিবের জীবনে সেই রাতটার প্রভাব এতটাই গভীর হয়েছে যে, সে সবসময়ই ভয়ের মধ্যে থাকে। তার মনে হয়, সে যেন একটা অভিশাপের মধ্যে বন্দী হয়ে গেছে। দাদুর ঘড়িটা তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে একটা ভয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে। রাকিব জানে না, সে কি কখনো এই ভয়ের মধ্যে থেকে মুক্তি পাবে। গ্রামের লোকজনও জানে না, রাকিবের জীবনে কি হবে। তারা শুধু বলে, "রাকিব সেই রাতে কিছু একটা দেখেছে, যা তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে বদলে দিয়েছে।"
রাকিবের জীবনে সেই রাতটার প্রভাব দিন দিন গভীর হতে থাকে। তার মন সবসময় ভারী, আর ভয়ের ছায়া তাকে ছাড়ে না। প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে গেলে তার মনে হয়, দাদুর আত্মা তার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গ্রামের লোকজনও তার অস্বাভাবিক আচরণ দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। তারা তাকে পরামর্শ দেয় গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যেতে, কিন্তু রাকিব তার গ্রামের স্মৃতি আর দাদুর স্মৃতি ছেড়ে যেতে চায় না। এক রাতে, রাকিব সিদ্ধান্ত নেয়, দাদুর আত্মার সাথে শেষবারের মতো মুখোমুখি হবে। সে ভাবে, যদি দাদুর আত্মার সাথে কথা বলতে পারে, তবে হয়তো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সাহস জোগাড় করে সে আবার দাদুর বাড়ির দিকে রওনা দেয়। পথে যেতে যেতে তার মনে নানা ধরনের ভাবনা আসতে থাকে। হয়তো আজকের রাতেই সবকিছু সমাধান হবে, হয়তো সে দাদুর আত্মার কাছ থেকে মুক্তি পাবে। দাদুর বাড়ির কাছে পৌঁছে রাকিব আবার সেই অদ্ভুত ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ পায়। ভেতরে ঢুকে সে দেখতে পায়, ঘড়িটা ঠিক আগের জায়গায় আছে। হঠাৎ তার সামনে দাদুর আত্মা আবার উপস্থিত হয়। দাদুর চোখে সেই অশুভ লাল রঙ, আর মুখে সেই পুরনো অশুভ হাসি। রাকিব ভয়ে পিছিয়ে যায়, কিন্তু এবার সে পালাবে না।
রাকিব কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে, "দাদু, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি শুধু আপনার স্মৃতিটা রাখতে চেয়েছিলাম।" দাদুর আত্মা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে, "এই ঘড়িটা আমার জীবনের প্রতীক, এটা কেউ নিতে পারবে না।" রাকিব সাহস করে বলে, "তাহলে কি আপনাকে কখনো শান্তি পাওয়া যাবে না?"
দাদুর আত্মা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে, "তুমি যদি সত্যিই আমাকে শান্তি দিতে চাও, তাহলে এই ঘড়িটা নিয়ে যাও, কিন্তু তা আমার স্মৃতি সম্মান রেখেই করো।" রাকিব সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে, আর ঘড়িটা নিয়ে দাদুর আত্মাকে প্রতিশ্রুতি দেয়, সে ঘড়িটাকে সঠিকভাবে যত্ন নেবে। রাতের অন্ধকারে রাকিব ঘড়িটা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। তার মনে একটা অদ্ভুত শান্তি নেমে আসে। দাদুর আত্মা যেন তাকে মুক্তি দিয়েছে। গ্রামে ফিরে সে ঘড়িটাকে যত্ন সহকারে রাখে, আর দাদুর স্মৃতির প্রতি সম্মান রেখে প্রতিদিন প্রার্থনা করে। সেই রাতের পর থেকে রাকিবের ভয় কেটে যায়। সে আর কখনো দাদুর আত্মাকে দেখতে পায় না। গ্রামের লোকজনও দেখে, রাকিবের জীবন আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। তারা বুঝতে পারে, রাকিবের জীবনের সেই অন্ধকার অধ্যায় শেষ হয়েছে। রাকিব আবার তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে, আর দাদুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে জীবন যাপন করতে থাকে। এভাবেই রাকিব তার ভয়কে পরাস্ত করে, আর দাদুর আত্মাকে শান্তি দেয়। গ্রামের লোকজনও বিশ্বাস করতে শুরু করে, সত্যিকারের ভালোবাসা আর সম্মানই পারে যেকোনো অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে। রাকিবের জীবন আবার শান্তি আর সুখে ভরে ওঠে, আর তার হৃদয়ে থাকে দাদুর স্মৃতির মুল্যবান সেই ঘড়ি।