রাত ১১:২৫। সিএনজি টা মাত্র কমলাপুর রেল স্টেশনে এসে থামলো। সিএনজির ভেতর থেকে তাড়াহুড়ো করে নেমে আসল মুহিব। লম্বাই ৫ ফুট ৮ হবে, মাঝারি ওজনের শরীর, টি শার্ট ও জিন্সপ্যান্ট পরা। গালে হালকা চাপ দাড়ি। জিনিসপত্র বের করে ভাড়া টা কোন মত দিয়ে দৌড় শুর করলো ট্রেনের দিকে। ট্রেন ১১:২৫ এ ছিল। এখন ও আছে কিনা জানে না। কিন্তু জিনিস পত্রের কারণে ভাল ভাবে দৌড়াতে পারছে না। স্টেশনে মাত্র একটা ট্রেনই দাঁড়িয়ে আছে তা ঢাকা থেকে চট্রগ্রাম যাওয়া তুর্না এক্সপ্রেস কি না বুঝা যাচ্ছে না।
প্ল্যাটফর্মের একজন গার্ড কে দেখে মুহিব জিজ্ঞাসা করল ট্রেন সর্ম্পকে। গার্ড বললো এটা তুর্না এক্সপ্রেস একটু দেরিতে এসেছে তাই দেরিতে ছাড়বে। তাড়াতাড়ি করে নিজের বগি খুঁজে উঠে পরল মুহিব। ট্রেনের ভেতরে যাত্রীরা এখন ঠিকঠাক করে বসেনি। কেউ মালামাল গোচাছে, কেউ সিট ঠিক করছে, কেউ সেলফি তুলছে। অনেক খোঁজাখুজি করে সিট খুঁজে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
সিটে বসার আগে তার সাথে থাকা মালপত্র গুলো মাথার উপরে থাকা বক্স এ রেখে দিলো মুহিব। তারপর সিটে বসে খুব আরাম অনুভব করছে সে। মাথা উঠিয়ে আশেপাশের সিটের লোকজন দেখে নিলো। সব ফুল হয়েগেছে কিন্তু তার পাশের সিটা খালি এখনো কেউ আসেনি।
তার সামনে সিটে বস আছে ২ টি ছেলে। দেখে একটু ভয় হল মহিবের। তার কোলে থাকা ব্যাকপ্যাক টাকে শক্ত করে নিজের দিকে চেপে ধরল। ব্যাগের ভেতরে আছে তার ছোট বোনের জন্য কেনা একটি সর্ণের চেন। দাম ৩০,০০০ টাকা। নিজেকে শান্ত করার জন্য জানালার দিকে তাকালো মুহিব। কানে হেডফোন গুজেদিল সে। ট্রেন চলতে শুরু করলো। পরের গন্তব্য ঢাকা বিমান বন্দর স্টেশন।
রাত ১১:৫৫ ট্রেন টি ঢাকা বিমান বন্দর স্টেশন এসে থামলো। কর্মচঞ্চল হয়ে উঠলো স্টেশন। হেডফোন খুলে ব্যাকপ্যাক সাথে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পরল মুহিব। আশে পাশে কিছুক্ষন তাকিয়ে একটি চা দোকানের দিকে হাটা ধরল সে।
মুহিবঃ একটা চা দাও ত মামা
চা ওয়ালাঃ কি চা?
মুহিবঃ দুধ চা দিন।
চা ওয়ালাঃ কি দুধ? গরু দুধ না পাউডার দুধ।
মুহিবঃ পাউডার দুধ।
চা ওয়ালাঃ পাউডার দুধের চা ৪০ টাকা।
মুহিবঃ একটু বিরক্ত মুখে বললো, তাড়াতাড়ি দাও।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে আশেপাশের মানুষ দেখছে। একটি মেয়ে কে দেখলো ২ লাগেজ টানতে টানতে ট্রেনের দিকে যেতে। চা শেষ করে নিজের বগির দিকে হাটা দিল মুহিব। ট্রেনের গেট লাগানো হাতল ধরে উঠার সময় দেকে আরো ২ বগি পরে ওই মেয়ে টি তার সাথে থাকে লাগেজ ট্রেনে উঠানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ভারি হবার কারণে উঠাতে পারছে না। কাছা-কাছি কেউ নেই যে তাকে সাহায্য করবে। মুহিব নেমে আগিয়ে গিয়ে কোন কিছু না বলে মেয়ে টির লাগেজ ট্রেনে উঠিয়ে দিল। মেয়ে টি মুহিবের দিকে তাকিয়ে কিছুই না বলে ট্রেনে উঠে পরলো। মুহিব হতবম্ভ হয়ে মেয়েটির চলে যাওয়া দৃশ্য দেখতে লাগলো। ট্রেন চলতে শুরু করলো। মুহিব নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে হালকা দৌড় দিয়ে নিজের বগিতে উঠে পড়লো।
মুহিব নিজের সিটে বসে দেখলো পাশের সিট টি এখনো খালি। সামনের সিটের দিকে তাকিয়ে দেখে ২ ছেলে ঘুমুছে। তাদের ঘুমানোর স্টাইল দেখে মুহিব মনে মনে ভাবছে এরা চোর হতে পারে না। হেডফোন কানে দিয়ে ২ চোখ বন্ধ করল মুহিব। চোখ বন্ধ করতে চোখে ভেসে আসলো ওই মেয়েটির চেহারা। চেহারা গোলগাল, মাথায় হিজাব দিয়ে ঢাকা, চেহারা খুব মিষ্টি। মেয়েটির পরনে ছিলো একটি কালো রঙের বোরকা, পায়ে Sneaker জুতা। দেখতে কোন ধার্মিক পরিবারের মেয়ে মনে হচ্ছে। প্রথম দেখাতে মেয়েটিকে খুব ভাল লাগলো মুহিবের। চিন্তা করতে লাগলো যে বগিতে মেয়েটি উঠেছে সেই বগিতে গিয়ে একটু দেখে আসবে কিনা?
চোখ খুলে বগির গেটের দিকে তাকালো সে। তারপর আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সবাই ঘুমাচ্ছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে আবার চোখ বন্ধ কর সে। গান শুনতে শুনতে মেয়েটিকে নিয়ে ভাবতে লাগলো সে। কানে ভেসে আসছে কারো কথা কিন্তু হেডফোন লাগানোতে বুঝা যাচ্ছে না। হঠাৎ করে মুহিবের কাধে নরম হাতের স্পর্শ। তাকিয়ে দেখে সেই মেয়েটি তার পাশে দাঁড়িয়ে কি যেনো বলছে। প্রথমে ভেবেছে স্বপ্ন। পরে মেয়েটি আবারো মুহিবের কাধে হাত দিয়ে তাকে ডাকছে। মুহিব হেডফোন খোলার পর মেয়েটির গলা আওয়াজ মুহিবের কানে পৌছালো।
মেয়েটিঃ আসসালামু আলাইকুম, এটা কি সিট নাম্বার ৬?
মুহিবঃ যেহেতু আমার সিট নাম্বারঃ ৫, তাহলে পাশের টা ৬ ই হবে (মনে মনে)। জি, এটা ৬ নাম্বার সিট।
মেয়েটি কাধ থেকে ব্যাগ টা খুলে সিটে রাখলো। তারপর সাথে থাকা ২ লাগিজ মুহিবের ডান পাশে ফাকা জায়গাতে রাখার চেষ্টা করছে। লাগিজ রাখতে গিয়ে মুহিবের সামনের সিটে থাকা ছেলে ২ টি জেগে গেলো। ছেলে ২ টি হঠাৎ সুন্দর মেয়ে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। তাড়াহুড়ো করে নিজেদের সামলে নিচ্ছে। ২ জন খুব সুন্দর ভাবে সেটে বসে থাকার চেষ্টা করলো।
মুহিব সিট থেকে উঠে মেয়েটির লাগিজ ২ টি ঠিক করে রাখলো। মেয়েটি মুহিব কে কিছু না বলে সিটে বসে পরলো। তারপর সামনে বসে থাকে ছেলে গুলোর দিকে দেখে কিছুটা ভয় অনুভব করলো। তারপর ডানে বসে থাকা মুহিবের দিকে তাকিয়ে বললো, Thanks.
মুহিবঃ কেন?
মেয়েটিঃ আপনি আমার ২ বার help করলেন তাই।
মুহিবঃ Welcome।
মেয়েটিঃ আপনি কোথায় যাবে?
মুহিবঃ চট্রগ্রাম।
মেয়েটিঃ আমি ফেনী যাবো।
মুহিবঃ এই ট্রেনে কেন?
মেয়েটিঃ Direct কোন ট্রেন পাই নি। তাই এটাতে উঠতে হলো।
মুহিবঃ ও আচ্ছা।
মুহিব মনে মনে খুব খুশি। যে মেয়ে টি কে ভাল লাগলো এবং একটু আগে খোঁজার ও চিন্তা করলো। সেই মেয়ে তার পাশে বসা। মুখে বিরবির করে আল্লাহকে শুকরিয়া জানাতে থাকে সে।
মুহিবের বিরবির শুনে মেয়েটি মুহিবে কে বললো, ‘আপনি কি কিছু বলছেন’।
মুহিব অপ্রস্তুত হয়ে বলল, না না।
মেয়েটি হাতে থাকা ব্যাকপ্যাক টি খুলে কি জেন খুঁজছে। পরে ফোন টি বের করে কাকে যেন ফোন দিচ্ছে। ওই পাশ থেকে ফোন ধরতেই মেয়েটি বলে উঠলো। হ্যাঁ ভাইয়া আমি ট্রেনে উঠেছি। হ্যাঁ সব ঠিক আছে। এই বলে কলটা কেটে দিলো।
মুহিব জানালার দিয়ে তাকিয়ে ভাবছে কিভাবে মেয়েটির সাথে কথা শুরু করা যায়। তার সর্ম্পকে আরো জানা যায়। কিভাবে মেয়েটি কে বলা যায় যে সে মেয়েটিকে পছন্দ করতে শুরু করেছ। মনে মনে আবার চিন্তা হলে মেয়েটির কি আবার কোন boyfriend আছে কিনা? মনে হয় নেই। কারণ যদি থাকতো তাহলে এত রাতে মেয়েটি কে ট্রেনে উঠাতে আবশ্যই আসতো।
মেয়ে টি মাথা তুলে বগির সামনে পেছনে তাকালো। তারপর সামনে বসে থাকা ছেলে গুলোর দিকে তাকালো। দেখলো ছেলে গুলো হা করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি আবার বিব্রতবোধ করলো তারপর মুহিবের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি একটু washroom এ যাব। আমার সাথে কি যাবেন?
মুহিব কোন কিছু চিন্তা না করে বললো, অবশ্যই।
দুই জন তাদের সাথে থাকা ব্যাকপ্যাক নিয়ে উঠে ট্রেনের washroom এদিকে হাটা শুরু করলো। তাদের সামনে বসে থাকা ২ টি ছেলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। Female washroom এর সামনে গিয়ে মেয়েটি তার ব্যাকপ্যাক মুহিব কে দিয়ে বললো, এটা ধরেন। তারপর washroom এ ঢুকে গেল। মুহিব ২ টি ব্যাকপ্যাক নিয়ে মেয়েটির বাহিরে বের হবার জন্য অপেক্ষা শুরু করলো আর ভাবতে থাকলো কিভাবে মেয়েটির সাথে কথা শুরু করা যায়। ভাবতে ভাবতে পেছনে ফিরে খোলা জানালার দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো।
কিছুক্ষন পর মেয়ে টি washroom থেকে বের হয়ে মুহিবে কাছে থাকা তার ব্যাকপ্যাক নিয়ে কিছু না বলে সিটের দিকে হাটা ধরলো। মুহিব ও তা কে অনুসরণ করলো। সিটে বসে মেয়ে টি বল, Sorry and Thank you।
মুহিবঃ কেন?
মেয়েটিঃ Sorry আপনাকে উঠেয়ে নিয়ে গেলাম সে জন্য আর Thank you আমার সাথে গেলেন তার জন্য।
মুহিবঃ Welcome বলে মোবাইল স্ক্রিন এ নজর দিল।
মেয়েটি ব্যাকপ্যাক খুলে সেখান থেকে ২ টি চিপস বের করে ১ টি মুহিবের দিকে দিয়ে বললো, নিন চিপস খান। মুহিব মোবাইল স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে চিপস এর প্যাকেট টা হাতে নিয়ে হাসি মুখে বলল, Thank you।
তার ২ জন চিপসের প্যাকেট খুলতে খুলতে তাদের সামনের ২ ছেলের দিকে নজর দিল। ছেলে ২ টি আবার ও বেসামাল অবস্থায় ঘুমাচ্ছে।
ট্রেনের ভেতর বেশীর ভাগ মানুষই ঘুমাচ্ছে, কিছু ছেলে মেয়ে মোবাইল টিপাটিপি করছে, কিছু ট্রেনের ভিতর পায়চারী করছে। সবকিছু দেখতে দেখতে চিপস খাচ্ছে ২ জন। মুহিব মেয়েটির দিকে তাকিয়ে চিন্তা করছে মেয়েটির নাম জিজ্ঞাস করবে কিনা। খুব ইতস্তত বোধ করছিল সে। মনের গহিন থেকে ভেসে আসলো, মেয়েটির সাথে কথা না বললে বিয়ে করবি কিভাবে? তারপর সাহস করে মুহিব বলল, আপনার নামটা জানা হলোনা।
মেয়েটিঃ জান্নাত
মুহিবঃ খুব সুন্দর নাম।
জান্নাতঃ অপনার নাম?
মুহিবঃ আমার নাম মুহিব।
জান্নাতঃ কি করেন আপনি?
মুহিবঃ Student। Jahangirnagar University তে HR থেকে Honours করছি।
জান্নাতঃ কোন year?
মুহিবঃ 4th year।
চিপস এর প্যাকেট শেষ জান্নাতের। প্যাকেট টি ব্যাকপ্যাক এর side pocket এ রেখে দিল সে। ততক্ষনে মুহিবের ও চিপস শেষ। জান্নাত মুহিবের হাত থেকে চিপস এর প্যাকেট নিয়ে তার ব্যাকপ্যাক এর side pocket এ রেখে দিল।
মুহিবঃ প্যাকেট গুলো ব্যাগে রাখলেন কেন?
জান্নাতঃ এখানে ময়লা ফেলবার মত কিছু নাই। নিচে ফেললে নোংরা হবে। তাই ব্যাগে রাখলাম। পরে ফেলে দিবো।
মুহিবঃ খুব ভালো কাজ।
জান্নাত মোবাইল টা বের করেছে। Notification চেক করতে।
মুহিবঃ আপনি এখন কোন ক্লাসে পরেন?
জান্নাতঃ কোন ক্লাসে মানে?
মুহিবঃ জান্নাতের প্রশ্ন শুনে অপ্রস্তুত হয়ে বলো, আসলে আপনাকে দেখে মনে হল আপনি কোন কলেজে পড়েন। তাই জিজ্ঞাসা করলাম।
জান্নাতঃ আমার কি দেখে মনে হলো এটা?
মুহিবঃ অনেক ভালোবাসা নিয়ে বলে উঠলো, আপনাকে দেখতে এখন অনেক বাচ্চা বাচ্চা লাগছে। চেহারা থেকে এখন বাচ্চা ভাব টা যায়নি। অনেক কিউট তাই।
মুহিবের কথাটা শুনে জান্নাতের মুখের ভঙ্গি পরির্বতন হয়ে গেল।
নরম ভাষায় বলে উঠলো আমি versity তে পড়ি। 1st year শেষের দিকে।
মুহিবঃ ও আচ্ছা, তাহলে তো অনেক ভালো।
জান্নাতঃ অনেক ভাল কেন?
মুহিবঃ না মানে আপনি বড় হয়েছেন। এই আর কি। স্বাভাবিক হবার জন্য জান্নাত কে পাল্টা প্রশ্ন কর বললো, কোন versity?
জান্নাতঃ Shanto-Mariam থেকে Interior Design পড়ছি।
মুহিবঃ হুম, Creative person।
জান্নাতঃ ছোট বেলা থেকে Drawing, Designing এ প্রতি আমার অনেক আকর্ষণ। তাই চিন্তা করলাম Interior Design পড়ি।
মুহিবঃ (নরম ভাষায়)সুন্দর মানুষই সুন্দর জিনিস তৈরি করতে পারে।
২ জনের মধ্যে নিঃশব্দে দৃষ্টি বিনিময় হল অনেকক্ষন। তারপর জান্নাত ব্যাগ থেকে Exam board এবং এর মধ্যে কিছু কাগজ বের করে আকাঁআকিঁ শুরু করলো। মুহিব জান্নাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো যে সে খুব মনযোগ সহকারে আকাঁআকিঁ করছে। তাই তাকে আর বিরক্ত না করে হেডফোন কানে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। কানে ভেসে আসছে রোমেন্টিক গান। গান শুনতে শুনতে জান্নাত কে নিয়ে ভাবছে। বার বার তার চোখে ভেসে আসছে জান্নাতের মিষ্টি চেহারা। মাঝে চোখ খুলে দেখলো জান্নাত মন দিয়ে কি যেন আঁকছে। তাই আবার চোখ বন্ধ করলো সে।
রাত ১:৩৫। ট্রেনটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে এসে থামলো। চোখ খুলে ট্রেনের গ্লাসের জানালা খুলে মাথা বের করে স্টেশনের অবস্থা দেখছে মুহিব। সিটে বসে জান্নাতের দিকে তাকিয়ে বললো, চা খাবেন। জান্নাতঃ হ্যাঁ খাবো। আমার অনেক মাথা ধরেছে।
২ জনই তাদের ব্যাকপ্যাক কাধে নিয়ে ট্রেনের গেটের দিকে হাটা দিলো। ট্রেন থেকে নেমে চায়ের দোকান খুজতে থাকে মুহিব। স্টেশনের ভিতরে চায়ের কোন দোকান নেই। এ দেখে মুহিব জান্নাত কে বললো, ভেতরে কোন দোকান নেই। চলেন বাইরে গিয়ে চা খাওয়া যাক।
জান্নাতঃ ট্রেন চলে গেলে?
মুহিবঃ ট্রেন এখানে ৫-৭ মিনিট থাকবে। সমস্যা হবে না।
জান্নাতঃ ঠিক আছে।
স্টেশনের গেটের পাশে ময়লা ফেলবার জন্য বড় ঝুরি রাখা। ময়লার ঝুরি দেখে ব্যাকপ্যাক এর side pocket রাখা চিপসের প্যাকেট দুইটি বের করে ফেলে দিলো জান্নাত। ২ জন স্টেশনের গেট দিয়ে বের হতেই খুব সামনেই একটা ছোট দোকান পেয়ে গেলো। দোকানের ভেতরে আলো অনেক কম। দোকানের কাছে যাবার পর মুহিব দোকানের ভেতরে দিকে তাকালো। ভেতরে অনেক লোক, বেশিরভাগই রাতের রিক্সা চালোক। কেউ চা খাচ্ছে, কেউ সিগারেট। ভেতরের পরিবেশ টা মেয়েদের জন্য উপযোগী নয়। ভেতর থেকে মারাত্মক সিগেরেটের গন্ধ আসছে তাই জান্নাত কে বাইরে দাঁড়াতে বললো মুহিব। ভিতরে গিয়ে দোকানদার কে ২ টা চা দিতে বললো।
দোকানদারঃ কি চা?
মুহিবঃ দুধ চা দিন।
দোকানদারঃ কি দুধ? গরু দুধ না পাউডার দুধ।
দোকানদারঃ পাউডার দুধ।
দোকানদারঃ পাউডার দুধের চা ৪০ টাকা।
মুহিবঃ একটু অবাক হয়ে বললো, তাড়াতাড়ি দাও ট্রেন চলে যাবে।
দোকানদার চা বানাতে শুরু করলো। মুহিব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আর ভাবছে এরকম ঘটনা তার সাথে ঢাকা বিমান বন্দর স্টেশন ঘটেছে। একি রকম ঘটনা কিভাবে হলো বুঝতে পারছে না সে।
গরম ধোয়া উঠানো চা তৈরি। চা নিয়ে বাহিরে আসলো মুহিব। এক কাপ চা বারিয়ে দিলো জান্নাতের দিকে। কাপ টা হাতে নিতে নিতে ধন্যবাদ বলল সে। ২ জন নিঃশব্দে চা খাচ্ছে আর আশে পাশে তাকাচ্ছে। স্টেশনের ভেতরে লোক কম হলেও বাইরে লোকজন বেশী। বেশীর ভাগই রিক্সা, আটো চালোক।
মুহিব হঠাৎ জান্নাতের দিকে চোখ যেতেই দেখলো জান্নাত তারদিকে তাকিয়ে আছে। সে তাকাতেই একটা মুচকি হাসি দিয়ে চায়ে চুমুক দিলো। মুহিব ও মুচকি হাসি দিলো। চা শেষে ২ জন স্টেশনের দিকে হাটা দিলো। স্টেশনের গেট দিয়ে ঢুকতেই ট্রেনের হুইসেল শুনলো তারা। হাটার গতি বাড়িয়ে দ্রুত ট্রেনে উঠে পরলো ২ জন। সিটে বসতে বসতে সামনের সিটে বসা ২ ছেলে দিকে নজর দিল মুহিব। বেচারা যেভাবে ঘুমাচ্ছে মনে হয় তারা আর সামনে ঘুমাতে পারবে না। ট্রেন চলতে শুরু করলো। পরবর্তী গন্তব্য আখাউরা স্টেশন।
আবার আকাঁআকিঁ শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে জান্নাত। তা দেখে মোবাইল আর হেডফোন হাতে তুলে নিলো মুহিব। Art board হাতে জান্নাত বলল, আপনার বাসায় কে কে আছে?
মুহিবঃ বাবা, মা, ২ বোন আর আমি।
জান্নাতঃ বোনরা আপনার বড় না ছোট।
মুহিবঃ একজন বড় আর একজন ছোট।
জান্নাতঃ কি করে তারা?
মুহিবঃ বড় জনের বিয়ে এর ৩ বছর হয়েছে। তার একটা বাচ্চা আছে। আর ছোট জন এবার SSC দিয়েছে।
জান্নাতঃ আঞেল আন্টি কি করে?
মুহিবঃ বাবা কলেজের শিক্ষক আর মা গৃহিণী।
জান্নাতঃ চট্রগ্রামের কোথায় থাকেন আপনারা?
মুহিবঃ চট্রগ্রামে আমার বড় বোন এর শ্বশুর বাড়ি। আমাদের বাড়ি নোয়াখালী।
জান্নাতঃ ও আচ্ছা। বোনের বাড়িতে ঘুরতে যাচ্ছেন?
মুহিবঃ তেমন না। পরিক্ষা শেষে ছুটি পেলাম কিছুদিন। বড় বোন বললো বাড়িতে যাবার সময় তাকে সহ নিয়ে যেতে। ভাগিনা যেতে চাচ্ছে। তাই ওকে চট্রগাম থেকে নিয়ে তারপর নোয়াখালী যাবো।
জান্নাতের সাথে কথা বলার সময় মুহিব খেয়াল করলো জান্নাত মুহিবের চেহারা খুব ভালোভাবে খেয়াল করছে। মুহিবের নাক, কান, চোখ সবকিছু খুব ভালভাবে দেখছে জান্নাত। এতে খুব বিব্রত হল মুহিব। জানলা দিয়ে বাহিরে তাকালো সে। ট্রেনটি দুই দিকে গাছের সারির মধ্য দিয়ে চলছে। অন্ধকারে তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে দুই একটা বাড়ির বাহিরের আলো দেখা যাচ্চে। বাহির থেকে জান্নাতের দিকে চোখ ফেরালো সে। জান্নাত এখনো আকাঁআকিঁতে ব্যস্ত। কি যে আঁকছে বুঝা যাচ্ছে না।
মুহিবঃ আপনার বাসায় কে কে আছে?
জান্নাতঃ আকাঁআকিঁ বন্ধ করে বললো। আমরা ৬ জন। বাবা, মা, বড় ২ ভাই, বড় ভাবি আর আমি।
মুহিবঃ কে কি করে?
জান্নাতঃ ফেনী তে আমাদের অনেক বড় একটি স্যানেটারী ও টাইলসের দোকান আছে। বাবা ও বড় ভাই সেটি পরিচালনা করে। মেজো ভাই ফেনী সরকারি কলেজে মাস্টার্স পড়ছে। মা আর ভাবী গৃহিণী।
এই বলে আবার আঁকতে শুরু করলো জান্নাত। মুহিব চোখ বন্ধ করলো। চোখ বন্ধ করলে তার চোখে জান্নাতের ছবি ভেসে আসে। কি মায়াবি চেহারা। যত দেখে তত দেখতে মন চায়। জান্নাত কে ভাল লাগতে শুরু করেছে তার। কিন্তু জান্নাত কে দেখে বুঝার উপাই না যে সে আমাকে পছন্দ করে কি না। এগুলো নিয়ে চিন্তা করতে করতে ট্রেন আখাউরা স্টেশনে চলে এলো।
ট্রেনের কাঁচের গ্লাস খুলে মাথা বাহিরে দিয়ে আশপাশ দেখছে মুহিব। ট্রেনে উঠার মত কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ১০/১২ জন ট্রেন থেকে নেমে গেলো। স্টেশন এ ঘুমিয়ে আছে ১০০ ও বেশি মানুষ। কারো থাকার জায়গা নেই কারো আবার থেকেও নেই। মাথা ভেতরে নিয়ে জান্নাতের দিকে তাকালো সে। আকাঁআকিঁতেই তার মনোযোগ। আশেপাশে আর কিছুতে নজর নেয় তার। কাচের জানালাটা বন্ধ করে সিটে বসে পরলো সে। ২ মিনিটের মধ্যেই ট্রেনটি আবার চলতে শুরু করলো। পরবর্তী স্টেশন কুমিল্লা।
ফোন বেজে উঠলো। ব্যাগ থেকে ফোন বের করলো জান্নাত। ফোন উঠিয়ে বললোঃ আসসালামু আলাইকুম। আব্বা। আমি এখন … বলে মুহিবের দিকে তাকালো সে। জান্নাত কি চাচ্ছে বুঝতে পেরে মুহিব বলে উঠলো, কুমিল্লা স্টেশন। জান্নাত ও বললো কুমিল্লা স্টেশন পার করলাম। ঠিক আছে, বলে ফোন রেখে দিলো সে।
মুহিবঃ আঙ্কেল ফোন দিয়েছে?
জান্নাতঃ হ্যাঁ।
মুহিবঃ কি বলে?
জান্নাতঃ বললো লাকশাম স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়লে ওনাকে ফোন দিতে।
মুহিবঃ অনেক টেনশনে আছে।
জান্নাতঃ হ্যাঁ, আমি মেয়ে মানুষ। এত রাতে একা একা ট্রেনে করে বাড়ী যাচ্ছি তাই টেনশনে আছে।
মুহিবঃ হ্যাঁ তা তো থাকবেই।
জান্নাতঃ আমরা অনেক রক্ষণশীল পরিবার। ছোট বেলা থেকে আমাদের পরিবারে ইসলাম চর্চা হয়।
মুহিবঃ এটা তো খুব ভাল কথা। কিন্তু আপনি এখনে কার সাথে থাকেন?
জান্নাতঃ আমার মামা বাসায় থাকি। উত্তরা সেক্টর ৪ এ থাকে।
মুহিবঃ মামার পরিবার সহ?
জান্নাতঃ হ্যাঁ, মামা, মামী আর তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। ২ জনই স্কুলে পরে।
মুহিবঃ পরিবারের সাথে থাকা মানে ভালো থাকা। আমরা তো মেসে থাকি। ভালো খাবার পাই না। বুয়া কোন রকম রান্না করে। মাঝে মাঝে কোন স্বাদ থাকে না। বুয়া না আসলে বাহিরে খেতে হয়। অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই। এই জীবন (হতাশ হয়ে)।
জান্নাতঃ এখন একটু কষ্ট করেন। পড়া শেষ করলে চাকরি। চাকরি পেলে বিয়ে তারপর বৌয়ের হাতের খাবার খেতে পারবেন।
মুহিবঃ তাহলে তো আর কথাই নাই। বঊ পেতে যদি এত কষ্ট করতে হয় তাহলে বঊ আর লাগবে না।
জান্নাত হাসি দিয়ে আবার আঁকতে শুরু করলো। ঘুম ঘুম লাগছে মুহিবের। সিটে হেল্যান দিয়ে চোখ বন্ধ কর সে। চোখ বন্ধ করেই স্বপ্নে হারালো সে। পড়ার টেবিলে বসে আছে সে। পড়ছে। তখন ফোন বাজলো। ফোনে স্ক্রিনে অপরিচিত নাম্বার। ফোন ধরলো সে। অপর পাশ থেকে মেয়ে কন্ঠে ভেসে আসলো, আসসালামু আলাইকুম। আওয়াজ টা শুনে পরিচিত মনে হলো তার। কিন্তু চিনতে পারছে না।
মুহিবঃ ওয়ালাইকুমুস সালাম। কে বলছেন?
অপর পাশ থেকেঃ আপনি কি আজ দেখা করতে পারবেন আমার সাথে।
মুহিবঃ কে বলছেন সেটা তো আগে বলবেন?
অপর পাশ থেকেঃ আপনি আসতে পারবেন কি না বলেন।
মুহিবঃ আপনাকে না চিনলে কিভাবে দেখা করবো।
অপর পাশ থেকেঃ আমাকে আপনি চিনে। বিকেল ৫ টার সময় উত্তরা ৪ নাম্বার সেক্টরের মাঠের পাশে যে পুকুর আছে সে পুকুর পাড় চলে আসবেন।
ফোন কাট হয়ে গেলো। মুহিব অবাক হয়ে ফোনের দিকে তাকে ভাবছে কে হতে পারে।
ঠিক বিকেল ৫ টার সময় উত্তরা ৪ নাম্বার সেক্টরের মাঠের পাশে পুকুর পাড় চলে আসলো সে। পরানে আছে লাল রঙের পাঞ্জাবী আর জিন্স প্যান্ট। আশে পাশে তাকাচ্ছে সে। যেহেতু কোন এক মেয়ে ফোন দিয়েছে তাই মেয়েদের দিকে নজর তার। হঠাৎ পেছন থেকে মেয়ে কন্ঠে বলে উঠলো, আসসালামু আলাইকুম। হতভম্ব হয়ে পিছনে তাকাতে তাকাতে বললো, ওয়ালাইকুমুস সালাম। পিছনে তাকিয়ে দেখে জান্নাত তার সামনে। বুঝে উঠতে পারছে না যে সে কি করবে। খুশিতে আত্মহারা সে। চার দিকে বসন্তের ফুল ফুটতে শুরু করলো। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না সে। জান্নাত বলে উঠলো, কেমন আছেন?
মুহিবঃ ভাল আপনার কি অবস্থান?
জান্নাতঃ আলহামদুলিল্লাহ্।
মুহিবঃ আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না যে তোমার সাথে দেখা হবে।
জান্নাতঃ প্রয়োজনীয় কথা আছে।
মুহিবঃ (পুকুরের পাশে একটি সিটের দিকে দেখিয়ে বললো) চলুন ওদিকে গিয়ে বসি।
দুইজন সিটের দিকে হাটা শুরু করলো। সিটে বসে জান্নাত বললো, বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।
এই কথা শুনে মুহিবের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পরলো। বসন্তের ফুল যে হঠাৎ শীতের ফুল হয়ে গেলো। সে যে জান্নাত কে ভালোবাসে। জান্নাতের বিয়ে হয়ে গেলে তার কি হবে।
জান্নাতঃ আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাই না। আমি আপনাকে ভালোবাসি and I want to marry you no one else।
জান্নাতের কথা শুনে মুহিবের মনে আবার বসন্ত আসতে শুরু করলো।
জান্নাতঃ আপনি কি আমাকে এখন বিয়ে করবেন?
মুহিবঃ আমি এখন তো বিয়ে করতে পারবো না।
জান্নাতঃ কেন আমি কি আপনার পছন্দ না। আমাকে ভালো বাসেন না।
মুহিবঃ আবশ্যই আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি কিন্তু আমার এখন পড়া শেষ হয় নি। চাকরি বাকরি নেই। এখন বিয়ে করলে কিভাবে সংসার চালাবো।
জান্নাতঃ আমার কিছু লাগবে না। আমি আপনার গ্রামের বাড়িতে থাকবো। কিন্তু আমাকে এখনি বিয়ে করতে হবে।
এই বলে মুহিবের হাত ধোরে ঝাঁকাতে শুরু করলো জান্নাত। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ খেয়াল করলো যে কেউ তার হাত ধরে ঝাঁকাচ্ছে। চোখ খুলে দেখে জান্নাত। মুহিব কে বলছে লাকসাম ষ্টেশন এসে গেছে। আমার অনেক ক্ষুদা লেগেছে। কিছু খেতে হবে।
মুহিব জান্নাতের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে রইলো আর ভাবতে থাকে এতক্ষন সব স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন কেন ভেঙ্গে গেল? At least স্বপ্নে তো জান্নাত আমাকে ভালোবাসে। মুহিব কে আবার ঝাঁকুনি দিয়ে হাত দিয়ে ইশারা দিয়ে জান্নাত বললো, কি হয়েছে?
মুহিবঃ (নিজেকে স্বাভাবিক করে জিজ্ঞাসা করলো) কয় টা বাজে।
জান্নাতঃ ৩:৩০
মুহিবঃ কি খাবেন?
জান্নাতঃ অনেক ক্ষুদা লেগেছে। নিচে নামি তারপর দেখা যাবে।
ঘুম ঘুম চোখে উঠে দাড়ালো মুহিব। ২ জন ব্যাগ কাধে নিতে নিতে সামনের সিটের ২ টি ছেলের দিকে তাকালো। তারা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ব্যাগ কাধে নিয়ে ট্রেনের গেটের দিকে হাটলো তারা। গেট দিয়ে মাথা বের করে আশে পাশে তাকাচ্ছে মুহিব। অন্যান্য ষ্টেশন থেকে এখানে লোকজন বেশী। গেট দিয়ে নামতে নামতে ট্রেনের টিটিই সাথে দেখা।
জান্নাতঃ আচ্ছা কতক্ষন ট্রেন এখানে থাকবে?
টিটিইঃ ইঞ্জিন পরিবর্তন হবে তাই একটু সময় লাগবে। At least ১৫ মিনিট।
জান্নাতঃ আচ্ছা।
এই শুনে দুইজন আশেপাশে খাবারের দোকান আছে কিনা তা দেখছে। স্টেশনের ভেতরে ছোট একটা দোকান আছে। এগিয়ে গিয়ে দেখলো দোকানে চা, কফি, বিস্কুট, কেক ইত্যাদি আছে। মুহিব জান্নাতের দিকে তাকালো। জান্নাত মুখ লাড়িয়ে না বললো। ২ জন ট্রেনের গেটে দিকে হাটা শুরু করলো। গেটে দিয়ে বেড় হয়ে দেখলো স্টেশনের সামনে অনেক গুলো দোকান খোলা। এর মধ্যে ৩-৪ টা খাবারের দোকান আছে।
দেখতে ভাল এরকম একটা খাবারের দোকানে ঢুকলো ওরা। ভেতরে তেমন একটা লোকজন নেই। ভেতরে আলো একটু কম। ওরা ২ জন টেবিলে গিয়ে বসলো। টেবিল টি খুব ছোট। চেয়ারে বসার পর দুইজনের শরীর এক সাথে লেগে গেলো। শরীর লাগতে জান্নাত মুহিবের দিকে তাকালো। মুহিব প্রথমে বুঝতে পারে নি। তখন লুঙ্গী আর গেঙ্ঘি পরা মধ্যম বয়সী এক লোক তাদের টেবিলের সামনে এসে দাড়ালো।
মুহিবঃ কি আছে খাবার জন্য?
দোকানের লোকঃ (২ জনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বললো) স্যার গরম খিচুরি আর গরুর মাংশ আছে। অনেক ভালা হয়বো। মাংস বাড়ায়া দিমু সমস্যা নাই।
মুহিব জান্নাতের দিকে তাকালো। দেখলো সে একটু অস্বস্তি অনুভব করছে। মুহিব বুঝতে পারলো অস্বস্তি কারণ। তাই জান্নাতের জবাব এর জন্য অপেক্ষা না করে, নিজের চেয়ার টি জান্নাতের চেয়ার থেকে দূরে সরাতে সরাতে বলো ২ টা নিয়ে আসেন।
মুহিবঃ মামা একটু তাড়াতাড়ি আনতে হবে না হলে ট্রেন মিস হবে।
দোকানের লোকঃ স্যার ২ মিনিট লাগবো।
২ মিনিটের মধ্যে গরম ধোয়া উঠা খিচুড়ি আর গরুর মাংশ তাদের সামনে হাজির। দুইজন খাবর শুরু করলো।
মুহিবঃ (খেতে খেতে বললো) ঠান্ডা কিছু নিবো।
জান্নাতঃ মোজ।
মুহিবঃ মামা ২ টা মোজ দেন।
দোকানের লোকঃ মামা ঠান্ডা নাই। নরমাল দিমু?
মুহিবঃ দেন।
২ জন খুব দ্রুত খাচ্ছে। খাওয়া শেষ করে বিল দিয়ে ২ জন হালকা করে দৌড় দিয়ে ষ্টেশনে ঢুকলো। ট্রেন এখনো এখনে আছে দেখে ২ জন দৌড় থামালো। আস্তে আস্তে করে হেটে ট্রেনে উঠলো তারা। ট্রেনের ভেতর অল্প কিছু লোক জেগে আছে। তাদের সবার ঘুম ঘুম চোখ। সিটে বসে আবার ও আঁকতে শুরু করলো জান্নাত। ২ মিনিটের মধ্যে ট্রেন চলতে শুরু করলো। পরের ষ্টেশন ফেনী। ওখানে নেমে যাবে জান্নাত। কি করবে বুঝতে পারছে না মুহিব। ভালোবাসার কথা এখনি বলে দেবে সে না ভালো একটা জায়গার জন্য অপেক্ষে করবে। কিন্তু কমপক্ষে জান্নাতের ফোন নাম্বার, বা ফেসবুক আইডি টা নিলে পরে ভালোবাসার কথা বলা যাবে।
জান্নাতের দিকে তাকিয়ে মুহিব জিজ্ঞাসা করলো, ট্রেনে উঠার পর থেকে দেখছি আপনি কি যেন আঁকছেন।
জান্নাতঃ একটা প্রিয় মানুষের মুখ আঁকছি।
মুহিবঃ তাকে পছন্দ করেন?
জান্নাতঃ হ্যাঁ।
মুহিবঃ (মন খারাপ করে) সে জানে?
জান্নাতঃ জানেনা। আমি তো প্রকাশ করিনি যে আমি তাকে পছন্দ করি।
মুহিবঃ তাকে জানিয়ে দিন।
জান্নাতঃ হ্যাঁ। দেখি কি করা যায়। আপনার কাউকে পছন্দ নেই?
মুহিবঃ করি। কিন্তু বলা হয় নি তাকে।
জান্নাতঃ কেন?
মুহিবঃ সে আমাকে পছন্দ করে কিনা জানি না তাই।
জান্নাতঃ কিন্তু না বললে জানবেন কি করে। তাকে বললে সে হয়ত accept করবে বা reject করবে।
মুহিবঃ Reject করলে তো তাকে হারিয়ে ফেলবো। তখন কি হবে।
জান্নাতঃ তখন অন্য কাউকে খুঁজবেন।
মুহিবঃ আপনি খুব simple করে চিন্তা করেন।
জান্নাতঃ আরে আমাকে যে পছন্দ করে না আমি তার জন্য সারা জীবন মন খারাপ করে বসে থাকবো। এটা নিজের প্রতি injustice. আমি পারবো না।
এই বলে আবারো আকাঁআকিঁ শুরু করে দিলো সে।
মুহিব আর কথা না বাড়িয়ে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। চিন্তা করছে পরের ষ্টেশনে জান্নাত নেমে যাবে। মন খারাপ লাগছে তার। খুব ভয় অনুভব হচ্ছে তার। না জানি তাকে হারিয়ে ফেলে। এই নিয়ে চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে গেল সে। ঘুমে মধ্যে আবার ও সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো।
মুহিবের মা দরজা নক করে তার রুমে ঢুকলো। মুহিব শোয়া থেকে উঠে বসলো।
মুহিবের মাঃ তোর বিয়ের জন্য মেয়ে দেখছি।
মুহিবঃ দেখ।
মুহিবের মাঃ তোর কোন পছন্দ আছে।
মুহিবঃ (দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো) না।
মুহিবের মাঃ একটা মেয়ে দেখেছি। অনেক দূরে থাকে। কিন্তু আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
মুহিবঃ তোমাদের পছন্দ আমার পছন্দ।
মুহিবের মাঃ এই নে মেয়ের ছবি।
মুহিবঃ বললাম না। তোমাদের পছন্দই আমার পছন্দ। ছবি দেখা লাগবে না।
মুহিবের মাঃ বিয়ে করবি তুই। দেখে নেয়া ভালো।
মুহিবঃ সমস্যা নেই।
মুহিবের মাঃ তোর বাবা চাচ্ছিলো সবার পছন্দ হলে আগামী শুক্রবার তোদের বিয়ে পড়াতে। পরে অনুষ্ঠান করা যাবে।
মুহিবঃ ঠিক আছে। তোমরা বিয়ের আয়োজন কর।
মুহিবের মাঃ আমি ছবি টা তোর টেবিলের উপর রেখে যাচ্ছি সময় হলে দেখে নিস।
এই বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো মুহিবের মা। মুহিব আবারো বিছানায় শুয়ে পড়লো। আর জান্নাতের কথা ভাবছে।
শুক্রবার বিয়ের দিন। তাদের বাড়ি সাজানো। চারদিকে উৎসব উৎসব আমেজ। সবার ছুটা ছুটি। সবাই যে যার মত তৈরি হচ্ছে। নিজের রুমে নীরবে তৈরি হচ্ছে মুহিব। মুহিবের বড় বোন তার রুমে এসে বললো, কিরে তোর মুখে হাসি নেই কেন? আজ তোর বিয়ে। তুই ঠিক আসছ?
মুহিবঃ আমি ঠিক আছি। আমরা যাবো কখন?
মুহিবের বোনঃ গাড়ি আসলে তারপর।
মুহিবঃ আমরা কোথায় যাবো?
মুহিবের বোনঃ তোর শশুর বাড়ি কোথায় তুই জানস না।
মুহিবঃ না
মুহিবের বোনঃ আমরা ফেনী যাবো।
মুহিবঃ ফেনী কি দরকার আশে পাশে কাউকে পেলে না।
এই বলে বাতরুমে চলে গেলো সে।
সকাল ১১ টার সময় গাড়ি এলো। বাদ জুম্মা বিয়ে। ফেনীতে পৌছাতে ১২:৩০ বেজে গেলো। নামাজ পরে মেয়েদের বাড়িতে ঢুকলো বরযাত্রীরা। ব্যাপক পরিমানে ব্যান্ড বাজানো হচ্ছে। রাস্তা থেকে বাড়ির উঠান পর্যন্ত ব্যান্ড বাজাতে বাজাতে বর কে নিয়ে আসলো। উঠানে প্যান্ডেল করা হয়েছে। প্যান্ডেলের এক কোণাতে ৪-৫ জন বসা যাবে এমন ছোট করে একটা মঞ্চ করা হলো। মুহিব কে নিয়ে সেখানে বসালো। মুহিবে বড় বোন মুহিবের কোলে তার ছেলে বসিয়ে দিয়েছে। ব্যাচারা ছোট ভাগিনা কে নিয়ে বসে আছে। মুহিবের জায়গা থেকে প্যান্ডেলে ঢুকার গেট দেখা যাচ্ছে। মঞ্চের সামনে ১০ টির মত টেবিল আর বসার জন্য চেয়ার রাখা ২ পক্ষের লোকজনের ভোজের জন্য। বরপক্ষের লোকজন এসেই টেবিল গুলো দখল করে নিয়েছে। আগে বিয়ে তারপর ভোজন সভা।
মুহিবের ডান পাশে এসে বসলো কাজী সাহেব। পাত্র পাত্রীর অভিভাবকগণ সবাই হাজির। এখন শুধু কনের অপেক্ষে। সবার তাড়া দিচ্ছে কনেকে তাড়াতাড়ি আনার জন্য। গেট দিয়ে যখনই কনে প্রবেশ করলো একটা উৎসবের পরিবেশ তৈরি হলো।
মুহিব প্রথম বারের জন্য কনের দিকে তাকালো। আর তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো। জান্নাত! হ্যাঁ। জান্নাত আসছে। কিভাবে সম্ভব। মুহিব ভাগিনা কোলে নিয়ে উঠে দাড়ালো। জান্নাত আসে আসে হেটে মঞ্চে উঠলো। দুই জন দুই জনের সামনাসামনি। ভাগিনাকে কোলে নিয়ে মুহিব অবাক হয়ে জান্নাত কে দেখছে।
জান্নাতঃ কি হয়েছে?
মুহিবঃ তুমি এখানে?
জান্নাতঃ আপনার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, তো আমি থাকবো না তো কে থাকবে।
মুহিবঃ আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।
জান্নাতঃ বিশ্বাস করতে হবে না। তাড়াতাড়ি বিয়ে পড় তারপর বাকি টা।
বর আর কণে মঞ্চে উঠেছে তাই খুব জোরে ব্যান্ড বাজতে শুরু করলো। জোরে ব্যান্ড বাজার শব্দে মুহিবের কোলে থাকা তার ভাগিনা কাদতে শুরু করলো। ভাগিনা কাঁদতে কাঁদতে লাফাতে শুরু করলো। মনে হচ্ছে পড়ে যাবে। এই দেখে মুহিব ভয় পেয়ে গেলো। আর হঠাৎ তার ঘুম ভেগে গেলো। ঘুম ঘুম চোখে তাকালো সে। ট্রেনে তা সিটের পিছনের সিটে থাকা একটা বাচ্চা কাঁদছে। আর ট্রেন টা হুইসেল দিচ্ছে। তার সিটের সামনে থাকা ২ টি ছেলে তার দিকে ভয়ঙ্কর চোখে তাকিয়ে আছে। জান্নাতের সিটের দিকে চোখ পড়তে দেখলো যে সিট টি খালি। লাফ দিয়ে সিটে সোজা হয়ে বসলো সে। জান্নাত এবং তার কিছুই নেই। সামনের সিটের ২ টি ছেলে কে মুহিব জিজ্ঞাস করলো, এই সিটের মেয়ে টি কোথায়?
ছেলে ২ টিঃ ২ জন লোক এসে মেয়েটিকে ট্রেন থেকে নামিয়ে নিয়ে গেলো।
মুহিবঃ (ভীত অবস্থায় জিজ্ঞাসা করলো) এটা কোন ষ্টেশন?
ছেলে ২ টিঃ ফেনী ষ্টেশন।
মুহিব চোখ বন্ধ করে বিরক্ত মুখে ট্রেনের সিটে ২ হাত দিয়ে ঘুষি দিলো। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো সে। থেমে থাকা ট্রেন টি চলতে শুরু করলো। মুহিব কাঁচের গ্লাস টি খুলে মাথা বের করে দিয়ে দেখছে যে জান্নাত কে দেখা যাচ্ছে কি না। চার দিক এখনো অন্ধকার। ষ্টেশনের গেট দিয়ে বাহিরে দিকে তাকালো মুহিব। লাইটের আলোতে দেখা যাচ্চে জান্নাত একটি ব্যাটারী চালিতো রিক্সায় বসে আছে।
মুহিব দৌড় দিয়ে ট্রেনের গেটের দিকে গেলো। যদি জান্নাতের সাথে শেষ বারের মত দেখা করা যায়। কিন্তু ট্রেন টি ততক্ষনে জোরে চলতে শুরু করেছে। মুহিব গেটে দাঁড়িয়ে জান্নাতের রিক্সার দিকে তাকিয়ে আছে। রিক্সাটি চলতে শুরু করলো আর মুহিবের চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেলো। বিমর্ষ হয়ে জান্নাতের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে সে। ট্রেনটি দ্রুত ছুটতে শুরু করলো।