পোস্টস

গল্প

চুপকথা

২৯ এপ্রিল ২০২৪

আযাহা সুলতান

মূল লেখক আযাহা সুলতান

১ 

বৃষ্টিস্নাত সকাল। বাসে সফর করছে অনি। পুরা নাম অনিরুদ্ধ খন্দকার। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাঝারি গোঁফ। বয়স চব্বিশ কি পঁচিশ। উচ্চতা মধ্যম। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবরণ। খাড়া নাক। টানা চোখ। মুক্তোর মতো সাদা ঝকঝকে দাঁত। হালকা গোলাপি ঠোঁট। চওড়া কপাল। চিকন জোড় ভ্রু। সামান্য কোঁকড়ানো গাঢ় বাদামিকালো কানঢাকা চুল। টোলপড়া থুতনি। মুখোমণ্ডল গোলাকার। পায়ে পাতলা চামড়ার সেন্ডেল। পরনে জিন্স। গায়ে নীল রঙের টি-শার্ট। নিতান্ত সুদর্শন যুবক। 

পরিবারে ‘অনি’ আদরের হতে হতে ‘রুদ্ধ’ যখন প্রায়ই বিসর্জিত হয়, তখন পূর্ণরূপে রূপায়িত হয় অনি। বর্তমানে তাকে ‘অনিরুদ্ধ’ বললে বান্ধবমহলেও চেনা দায়। চালকের পেছনসিটে বসা। রঙিন চশমা পরে আছে চোখে। না না—একেবারে রঙিন বলা ঠিক হবে না, কালোর ওপর ঘোলাটে ধূসর—রোদচশমা। বাইর থেকে চোখদুটো দেখার কোনো সুযোগ নেই। স্টপ স্টপে যাত্রী ওঠানামা চলছে। শ্রাবণের মাঝামাঝি সময়। এ সময়টাতে বৃষ্টির ওপর আস্থা রাখা যায় না। যখন-তখন বর্ষণমুখর হয়ে ওঠতে পারে, কখনো প্রবলাকারে এবং কখনো মুষলধারে—কখনোবা মৃদু মৃদু থেমে থেমে। এমুহূর্তে আকাশের রঙ কিছুটা ফর্সা। তবু গুটিগুটি বৃষ্টিফোঁটা ঝরছে অজস্র। সাদা এপ্রন পরা একটি মেয়ে ওঠে বসল চালকাসন ঘেঁষে অনির হাঁটুদুটো স্পর্শ করে—একেবারে তার সম্মুখে। বৃষ্টিভেজা তরুণীর অবয়বে ফুটে ওঠছে অপ্সরারূপ। চুলের গুচ্ছ বেয়ে ‘টপ’ ‘টপ’ করে ঝরে পড়ছে পরিষ্কার জলের ফোঁটা। মেয়ের এক হাতে কিছু বইখাতা, অন্য হাতে দৃষ্টিশক্তি বাড়ানোর স্বচ্ছকাচের চশমা আর একটি কলম। সহজে বোঝা যাচ্ছে কোনেক কলেজছাত্রী। পাশে বসা সহযাত্রিণীর সঙ্গে টুকটাক আলাপে জানা যায়, কলমটা কেনার সময় পাশে রাখা ছাতাটা কখন যে চম্পট হয়ে যায় টের পাওয়া যায়নি! পাশের থেকে কেউ একজন বলছে—ছাতা আর জুতো সব সময় চোখে চোখে রাখতে হয়। বিশেষ করে বৃষ্টির দিনে ছাতা আর উপাসনাকালীন জুতো। নইলে এসময় এদুটো জিনিস যথেষ্ট রক্ষিত স্থানেও সুরক্ষা দায়। 
 
 গাড়ির হেলনেদোলনে ও চালকের ব্র্যাক কষাকষিতে যাত্রীরা টালমাটাল। অনি আর মেয়েটি সঙ্কোচে বসলেও দুজনার হাঁটু বারবার দুজনাকে স্পর্শ করে চলছে। ছোঁয়াচে কোনো কিছুকে ছুঁতে থাকলে যেরকম অনুভূতি হয়, তদ্রূপ সুড়সুড়ি অনুভূত হচ্ছে অনির হাঁটু থেকে মনে! তবে, এমুহূর্তে সুদর্শনার মনের অনুভূতি কী—আমাদের পক্ষে বলা অসম্ভব। স্পর্শকাতর লজ্জাবতীকে স্পর্শ করে যেকেউ অন্তরের রূপ বলে দিতে পারে কিন্তু মেয়েদের অন্তরের স্বরূপ বোঝা বোধহয় অভিজ্ঞ কোনো মনোবিশেষজ্ঞের পক্ষেও সম্ভব না! এব্যাপারে আমরা সাধারণ জনেরা অনভিজ্ঞ হতেই পারি। একজন নারীর মন যে বুঝতে পারে সে পৃথিবীর সমস্ত কিছুকে বুঝতে পারে। 
 
 

মাঝে মাঝে কেবল আড়চোখে চক্ষুবদল হচ্ছে দুয়ের! একে অপরকে মুগ্ধচোখে চেয়ে যাচ্ছে বারবার। অনির পাশের সিটে বসা একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়স্ক—মনে হচ্ছে—ভদ্রলোক জানালার ফাঁক দিয়ে বারবার বাইরে তাকাচ্ছে। ভদ্রলোকের এসব দেখা হচ্ছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। এমন সময় চালকের এক অকল্পনীয় কাণ্ডকে সকলে মন্দ বললেও অনির জন্যে একেবারে শুভক্ষণ বা শুভলক্ষণ বলতে হয়! ঘটেছে কী? কৌতূহলী অনেকে—নিরীহ এক কুকুরকে বাঁচাতে চালক সজোরে ব্র্যাক কষলে প্রচণ্ড ধাক্কা লাগে অসতর্ক যাত্রীগণে। সেই ধাক্কার চোটে অনি মেয়েটির বুকে ঝুঁকে পড়লে লজ্জায় লজ্জিত দুজন—অনি ‘দুঃখিত’ ‘দুঃখিত’ বলে দুঃখপ্রকাশ করলে—লজ্জিতমুখে মেয়েটি মনে হচ্ছে, মনে মনে হাসছে। তারপর কিছুদূর এসে একটা স্টপে মেয়েটি গাড়ি থেকে নেমে যায় এবং পশ্চিমের একটা গাছগাছালিভরপুর নিরিবিলি পথ দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যাচ্ছে। যেতে যেতে বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে। অনিও চোখের চশমাটা মাথায় তুলে জানালার ফাঁক দিয়ে যতদূর মনোরমাকে দেখা যাচ্ছে অপলকে চেয়ে যাচ্ছে। অনি যাচ্ছে শহর থেকে বাড়ি কিন্তু এমুহূর্তে দিশেহারা মন তার হারিয়ে যায় কল্পনার ঝিলমিল রঙের জগতে! 
 ২ 
 আজকাল কোনো কাজেই মন বসছে না অনির। মনটা কেবল ধায় ধায় করছে। এমনকি খাওয়াদাওয়াতে পর্যন্ত কোনো রুচি নেই। ডিউটিতে কিবা ছুটিতে যেখানেই যাচ্ছে ভাবনার ঘোর পিছু ছাড়ছে না! মেয়েটির মনকাড়া হাস্যময়ী মুখ বারবার চোখের সামনে ভেসে ভেসে ওঠছে! সহকর্মী বন্ধুদের কেউ জিজ্ঞেস করলে মুখ নিচু করে হেসে বলছে—ধুর, কিছুইনা। আগে ছুটিতে বাড়ি এলে সারা দিনের মধ্যে এক ঘণ্টাও ঘরে পাওয়া মুশকিল। বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব আর দাবা-তাস-ক্রেরামের আড্ডায় কেটে যেত দিন। মা ছেলের সঙ্গে এক-আধটু সুখদুঃখের কথা বলবে তাও কোনোবারে সহজ হয়ে ওঠত না। বর্তমানে বলতে গেলে এক ধাক্কায় সব ওলটপালট হয়ে গেছে! একজন মন্দ মানুষ যদি এভাবে পরিবর্তন হয়ে যেতে পারত। বরং পারবে না বলেও কোনো কথা নেই। এখানে আমরা আদতের ওপর সবকিছু ছেড়ে দেওয়ার পক্ষপাতি নই। এখানে আমরা মনের ওপর সমস্ত কিছুর জোর দিতে পারি—পারি কি না? একজন মানুষ যদি চায় রাতারাতি মহাপুরুষ হয়ে যেতে পারে। আবার যদি চায় খুব নগণ্য মনের পরিচয়ও দিতে পারে। সব মানুষেরই মনের খেয়াল এবং সব মানুষেরই মনের ওপর নির্ভর করে। সুতরাং নাম ক্ষুণ্ন করা অতি সহজ কিন্তু সুনাম অর্জন করা খুব কঠিন। কোনো কোনো প্রেম মুহূর্তের মধ্যেই জন্ম নেয় ঠিক কিন্তু গন্তব্য মিলে না। কোনো কোনো প্রেম ধীরগতিতে হয়, তবে সার্থক হতে দেরি লাগে না। কাজেই কোনো প্রেম কূল পেল না বলে তুষের আগুনে জ্বলেপুড়ে নিজেকে ছারখার করা প্রকৃত প্রেমিকের কাজ নয়। না পাওয়ার ব্যথায় ব্যথিত হওয়া যায় কিন্তু এতটা পাগল হওয়া ঠিক না। অন্ধ হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু দেখেশুনে অন্ধের মতো পথচলা অস্বাভাবিক। বিরহকষ্টে বা কিছু হারানোর ব্যথায় দুখেদুখে মরা অথবা আত্মহত্যা করা বোকামি। 
 
 

অনির পরিবর্তন ঘরেবাইরে অনেককে অবাক করে। ইদানীং বাড়ি এলে দরজা-জানালা বন্ধ করে সারা দিন নিজের রুমে কী করে কারও বুঝে আসে না। আগে যেখানে মাসে-দু-মাসে একবার বাড়ি আসা দূরে থাক, চার-ছয় মাসও অনেক সময় পার হয়ে যাচ্ছে খবর নেই, সেখানে আজকাল সাপ্তাহিক যাতায়াত! এমন পরিবর্তন শুধু বন্ধুদের নয়, শত্রুদেরও অবাক করে! যেখানে যাচ্ছে অপরিচিতার মুখ ছাড়া অন্যকিছু কল্পনায় আসছে না। ভাবনায় কেবল তারই সুশ্রী চেহারাটা ভেসে ভেসে ওঠছে বারবার। এটাকে তার বন্ধুবান্ধব অনেকে পাগলামি মনে করলেও আমাদের সূক্ষ্ম বিচারে তা পাগলামি নয়। কথায় আছে ‘বিশ্বাসে বস্তু মিলে’ আস্থা যেখানে বড় সেখানে কোনো কিছু ছোট ভাবতে নেই। 
 ৩ 

অনি বিএ পাশ করা একজন কর্মিষ্ঠ যুবক। শহরের বিখ্যাত একটি পোশাক-রপ্তানি-কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারী। মাসিক বেতন চব্বিশ হাজার। সংসারে মা আর ছোট্ট একটি বোন। শহর থেকে গ্রামের দূরত্বটা একান্ন কি বায়ান্ন মাইল। এরমধ্যে বেশ কয়েকবার বাড়িতে আসাযাওয়া হয়েছে, মেয়েটির দেখা মিলে না। এখানে অনি কেন, কথাটা এভাবে যেকেউ মনে করা যৌক্তিক, পথের দেখা কে কখনো মনে রাখে! হয়ত মেয়েটি ওখানেই ভুলে গেল সব। কিন্তু না, ঘটে তার বিপরীত। আরেকদিন বর্ষামৌসুমটা যায় যায়, হঠাৎ খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে কাঠফাটা রোদ। সূর্যের প্রখরতায় ঝলমল করে ওঠে আলোর আকাশ। অনি যাচ্ছে বাড়ি। মেয়েটি ওঠল গাড়িতে। নারীর নির্দিষ্ট আসন থেকে পুরুষের আসন—কোথাও একটু জায়গা ফাঁকা নেই যে, কোনো যাত্রী একদণ্ড স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে দাঁড়ায়। এদেশের বাস-ট্রেন-লঞ্চগুলোর অবস্থা এমনি বেগতিক! গাদাগাদি ছাড়া চলতে পারে না। এটা দরিদ্রদেশের বেহাল দশা বলা যায় না, মানুষেরই মুদ্রাদোষ। টাকা দিয়ে আমরা ঠেলাঠেলি বা গাদাগাদি করবই কেন? এটার আরেকটা জাতীয় দোষ ধৈর্যহীনতা। অনি মনে করল, এরকম অতিরিক্ত যাত্রীর ভিড়ে ঠেলাঠেলি করে একজন যাত্রিণী সিট ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকবে! এটা যেকোনো সভ্য দেশের জন্য অসভ্য ব্যাপারই নয়, একেবারে জঘন্য বিষয়ও বটে। এমন অসৌষ্ঠব অশিষ্টতাকে যারা আস্বাদ মনে করে তারা বর্বর। নারীদের জন্যে যেপুরুষদের মনে শ্রদ্ধাবোধ বা সম্মান নেই সে পুরুষ নামের বদনাম। একটু পর অনির চোখাচোখি হয় মেয়েটির—মনকাড়া হাসি হেসে বলল, আপনি! প্রতীক্ষিত অনি মৃদুহেসে তক্ষুনি আসন ছেড়ে দিয়ে মেয়েটিকে তার আসনে বসার অনুরোধ জানায়। মেয়েটি মুচকিহেসে আপত্তি-ইঙ্গিতে ধন্যবাদ জানায় এবং চোখের ইশারায় বোঝায় যথাস্থানে ঠিক আছে। কিন্তু এরকম বিনয়ী অনুরোধে কেউ কি আর সাড়া না দিয়ে পারে। 

অনি দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটির পাশে। সত্তর কি আশি কিলোমিটার বেগে ছুটে চলছে গাড়িটি। চালকের ব্র্যাক কষাকষিতে হেলেদোলে বারবার স্থির হচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা। মেয়েটি অনির দিকে এবং অনি মেয়েটির দিকে—পরস্পর পরস্পরকে বারবার আড়চোখে চেয়ে যাচ্ছে। লজ্জায় একে অপরকে কিছুই বলতে পারছে না, শুধুই আড়াআড়িভাবে একে অপরকে দেখে যাচ্ছে বারবার! দুজনার লজ্জিত চেহারায় ফুটে ওঠছে গোপন চাহনির অপূর্বভাব। চালক কী কারণে সজোরে ব্র্যাক কষল—টালমাটাল যাত্রীরা পড়ার উপক্রম। মেয়েটি অনিকে হাত ধরে স্থির করল। অনি মৃদু হেসে চাপাগলায় ধন্যবাদ জানাল। লজ্জায় মেয়েটি মাথা নিচু করে একটুখানি হাসল এবং উত্তরে কিছুই বলল না। রোদের আকাশে হঠাৎ বজ্রসঙ্কেত! কেয়ামতের অন্ধকার হয়ে তুফানবেগে ছুটছে বাতাস! গাছপালা ভেঙে চুরমার করে সম্ভবত এক্ষুনি মাটিতে পাতবে আসন! যাত্রীরা চালককে বারবার হুঁশিয়ার করে যাচ্ছে—গাড়ির গতি যাতে কমায়। প্রয়োজনে কোথাও যেন দাঁড় করায়। আকাশের পরিণতি কী বোঝা যাচ্ছে না। চালক গাড়ির গতি একেবারে কমিয়ে দিল। তারপর ধীরে ধীরে বাতাসের গতিও কমে এল। মেয়েটির গন্তব্য এল। আসমানে এখনো ভাসছে কালো মেঘের ভেলা—একটু পরপর বজ্রগর্জন। অনিকে নেমে আসার আভাস দিয়ে মেয়েটি হুড়মুড় করে গাড়ি থেকে নেমে গেল। অনির হৃৎস্পন্দন শত বেগে বেড়ে চলল! মিরের হাট যাত্রীছাউনি থেকে আধ মাইল পশ্চিমে মেয়েটির কলেজ। নিয়মিত পায়ে হেঁটে গমনাগমন করতে হয় এটুকু পথ। রাস্তাটা প্রায়ই নির্জন, পথিকের চলাচল তেমন একটা নেই বললেই চলে। কারণ কলেজপড়ুয়াদের সুবিধার্থে এ রাস্তার উৎপত্তি এবং কলেজগেইটে এসেই শেষ। এ নিরিবিলি পথটা অনেক ছাত্রছাত্রীদের জন্যে কাছের হওয়াতে প্রায় ছাত্রছাত্রী এপথ দিয়ে নিয়মিত আসাযাওয়া করে। জনবহুল বড় রাস্তা ধরে এলে এসব ছাত্রছাত্রীদের অনেকটা ঘুরে আসতে হয়। তাই এ পথটা প্রায় ছাত্রছাত্রীদের পছন্দের আগে। 
 ৪ 

ধীরগতিতে দুজন পাশাপাশি হাঁটছে। কথাবার্তা টুকটাক চলছে। তবে কী কথোপকথন হচ্ছে তা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে না। কাঠের কৃত্রিম পায়ে ভর দিয়ে একজন পঙ্গুভিক্ষুক পাশ কেটে চলে যাচ্ছে—যেতেই অনি ভিক্ষুকের হাতে কয়টা টাকা গুজে দিল, ভিখারি যেন পৃথিবী পেল। একটু পর ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি এল। সামনে দেখা যাচ্ছে ভাঙাচুরা টিনের একটি চৌচালা ঘর। সহজেই বোঝা যাচ্ছে ছেড়ে যাওয়া দোকান। অনি আর মেয়েটি দৌড়ে এসে দোকানটাতে আশ্রয় নিল—মনে হল সাপের ঘাঁটি। সম্ভবত কোনেকসময় চা-রুটির দোকান ছিল এটি। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকলে যেকোনো জায়গা বা ঘর সাপের আস্তানা হয়। এখানেও তাই মনে হচ্ছে। কত বছর ধরে ব্যবহার-অযোগ্য হয়ে পড়ে আছে বোঝার কারও উপায় নেই। বায়ুকোণে মস্ত একটা বটগাছ। দোকানটা হেলে গিয়ে গাছটার গায়ে ঠেস দিয়ে কবে হতে দাঁড়িয়ে আছে কে জানে। এ গাছটায় মনে হচ্ছে আজ দোকানটার বড় সহায়ক। মাকড়সা বুনেছে যেখানে-সেখানে বাসা। উইপোকা গড়ে তুলেছে ঢিপি। ইঁদুর খুঁড়েছে অসংখ্য গর্ত। নৈর্ঋতকোণে বড়ই শান্তিতে ঘুমাচ্ছে একটি কুকুর। ঈশানকোণে দুটো বাচ্চা নিয়ে লোটে আছে একটা ছাগি। বৃষ্টি হচ্ছে দেদারচে, এক-একটি ফোঁটা যেন তার এক-একটি পাটকেল। একটু পর শোনা গেল ভনভন শব্দ। দেখা গেল, ঘুণপোকায় আক্রান্তছাদের ভাঙা খুঁটিতে মস্ত একটা মৌচাকের। মৌচাকটা দেখে শুধু একজন মৌয়ালই নয়, যেকোনো সাধারণ মানুষও আনন্দিত হবে এবং আশ্চর্য অনুভব করবে। অনিও আশ্চর্য অনুভব করল এবং বলল, এখনো কোনো মানুষের নজরে আসেনি বোধহয়। 

মেয়েটি বলল, হয়তোবা। তবে যার ভাগ্যে আছে, সে অবশ্য ভাগ্যবান—ভাগ্যিস...

মৌমাছিদের প্রতি মেয়েটির মায়া দেখে অনির আরও আকৃষ্টতা মেয়েটির প্রতি বেড়ে গেল—বলল, মধু আপনার ভালো লাগে? আমার কিন্তু অত্যন্ত প্রিয়। 

মেয়েটি চমৎকৃতগলায় বলল, বা রে! লাগবে না মানে, মধু কার-না ভালো লাগে বলুন? এটা একটা মহৌষুধও বটে। আমরা আসলে জানি না, মৌমাছিদের হত্যা করে আমাদের কি ক্ষতিই না আমরা করছি। ডাইনোসরদের মতো হয়তো মৌমাছিরাও একদিন এ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবে! এরকম ভালো জিনিস যদি পৃথিবীতে না থাকে, তা হলে আমাদের অস্তিত্বও মনে হয় পৃথিবীতে বেশিদূর টিকিয়ে রাখা সম্ভব না। 

শুনে অনি মনে মনে আশ্চর্য বোধ করল এবং রসিকতা করে বলল, তাই নাকি? অনেক কিছু জানেন দেখছি!

মেয়েটি বলল, অনেক কিছু জানি না। তবে মধুর কার্যকর-সম্বন্ধে কোথা পড়ছি মনে নেই। এটাকে নিয়ে এখনো বোধহয় তেমন একটা রিসার্চ হচ্ছে না কোথাও। কিন্তু অনেক গবেষণা হওয়া দরকার। কারণ মধুতে নাকি অনেক গুণ আছে, বিশেষ করে মানুষের উপকারিতার। 

অনি রসিকতার হাসি হেসে বলল, এত দিন জানতাম মধুর প্রতি দুর্বলতা কেবল পুরুষেরই আছে; আজ জেনেছি মেয়েদের দুর্বলতার কথা!

মেয়েটিও ঠাট্টার ছলে হাসল—বলল, দুর্বলতা! আকর্ষণ কেন নয়?

অনি হেসে বলল, যে জিনিসকে মানুষ মরিয়া হয়ে চায় সেই জিনিসের কাছে সে সব সময় দুর্বল আর আকর্ষণীয়তার বিপরীত দিকই তো হচ্ছে দুর্বলতা।

মেয়েটি বলল, গুপ্তধনের প্রতি সকলের যেমন একটা টান দেখা যায়—এও তো একপ্রকারের গুপ্তধন। 

মেয়েটির কথায় অনি মিথ্যা অস্থিরতা দেখাল—বলল, গুপ্তধনের সন্ধান যখন অনায়াসে মিলেছে তা হলে আর দেরি কেন...

মেয়েটি বাধা দিয়ে বলল—না না, আপনি একাজ করতে যায়েন না; একাজ খুব কঠিন, একাজে কত কৌশল আর দক্ষতার প্রয়োজন হয় আপনার জানা আছে?

অনি খুব হাসল—(মিথ্যা) বলল, জানব না মানে, খুব জানা আছে—কঠিনকে সহজ করা পুরুষেরই তো কাজ আর যে পুরুষ কঠিনকে সহজ করতে পারে না সে পুরুষ পুরুষই না। 

অনির (মিথ্যা) আগ্রহ দেখে মেয়েটি আরও আবেগগ্রস্ত হলো—অনুরোধ করে বলল, দোহাই, থাকতে দিন-না ওদেরকে আরামে। কারও ক্ষতি করে আনন্দ লাভ করা যায় তবে শান্তি লাভ করা যায় না। একটা মৌমাছির বাসা ভাঙতে গেলে কত মৌমাছি মারা পড়ে কেউ দেখেও তা দেখে না! কারণ মানুষ তখন মধুসংগ্রহের আনন্দে মুগ্ধ। সৃষ্টির সমস্ত কিছু মানুষের উপকারে আসে সুতরাং মানুষ কি কখনো এসব সৃষ্টির উপকারে আসে? নিজের লাভের কথা যে চিন্তা করে বেশি, তার ক্ষতি হয় আরও বেশি। মেয়েটির কথা শুনলে যেকেউ অবাক না হয়ে পারবে না। অনি দুষ্টামিভাব ভুলে তক্ষুনি নিজের অবস্থানে ফিরে আসে। ক্ষুদ্র একটা জীবের প্রতি যার এত দরদ ও এত ভালোবাসা, সে না জানি মানুষের প্রতি কত মমতাময়ী হবে কিবা হতে পারে। মনে মনে স্রষ্টার কাছে মেয়েটিকে প্রার্থনা করে বসল—প্রভু, আর কিছু নাইবা দিলে আমায় তবে আর কিছু চাইও না পেতে। জীবনে তো তোমার কাছে আমি কিছুই চাইনি। ওকে যেন আমার করে দাও। 


 উল্লিখিত আলাপের মধ্যে নাম জানাজানিকে উল্লেখ করে, অন্যান্য আলাপাদি সব বেদরকারি হিসাবে বাদ দেবো আমরা। মেয়েটির ডাকনাম বর্ষা। ভালো নাম অর্পিতা মল্লিক। হিন্দুসম্প্রদায়ের উচ্চবংশীয় মেয়ে। ‘বর্ষা’ নাম শুনে অনির কোনো কতূহল জন্মেনি; কারণ, বর্তমানে সব গোত্রে এ নামের ছড়াছড়ি। বর্ষা হিন্দু জেনে অনি একটুও আশ্চর্য হয়নি। ভালো লাগা যেখানে ভালোবাসা সেখানে। আকসার ভালো লাগা থেকেই তো ভালোবাসার জন্ম হয়। ভালোবাসা মানেই বাধাবিপত্তি আছেই—থাকবেই। এটা নিয়ে কেউ আগে দুশ্চিন্তা করে না। তবে ‘অনি’ ‘অনিরুদ্ধ’ নাম শুনে বর্ষা সন্দেহযুক্ত ছিল—কারণ, এ নাম এখনো বোধহয় একটা সীমারেখার গণ্ডি পার হয়ে বেরিয়ে আসতে পারেনি। অনি মুসলিম জেনে বর্ষা মনে মনে একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি কল্পনা করল—হুড়হুড় করে আকাশ ভেঙে যেন মাথায় পড়তে লাগল! পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল!

৫ 

আজকের সারাটা দিন কেটেছে বর্ষার চিন্তার মধ্যে ডুবে। সারাটা রাত একবিন্দু ঘুমোতে পারেনি। মনের সঙ্গে হাজার পরামর্শ করেও কোনো উপায় বের করতে পারেনি। অনিকে ভুলে থাকাও অসম্ভব। ভালো লাগা জিনিসটা যে কী, কীভাবে সে মনকে বোঝাবে। হিন্দুদের গোত্র নিয়ে যেখানে হিন্দুদের মধ্যে আপত্তি, সেখানে...ভাবতে ভাবতে রাত কেটে তার কখন যে ভোর হয় জানতে পারেনি। বেশ কিছু দিন অনির সঙ্গে যোগাযোগ না করে তাকে ভুলে থাকারও চেষ্টা করছে অনেক কিন্তু সম্ভব হয়নি। যতই ভুলে থাকতে চেয়েছে ততই বেশি করে মনে পড়ছে অনির মুখ! প্রকৃত ভালোবাসা বোধহয় এরকমই হয়? 

প্রায় পনের দিন পর দুজন মিলিত হয় নির্জন সেই পরিত্যক্ত দোকানটাতে। এটা ওদের দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। একে-অপরে এখনো কিছুটা সঙ্কোচে আছে। একে-অপরকে এখনো ‘আপনি’ সম্বোধন করে চলছে। অনেক কথা হলো—হচ্ছে। অনি ‘বর্ষা’ নামেরও খুব প্রশংসা করছে। সাপের আস্তানা আজ তাদের প্রেমালাপের নিরাপদ ঘাঁটি। অনির কথা শুনে বর্ষা মাঝে মাঝে ‘হেঁ হুঁ হাঁ’র মাধ্যমে মনে মনে বিরক্তি বোধ করলেও আবার মাঝে মাঝে খুব চমৎকৃতও হচ্ছে। ভালো লাগার মুখে বিষের বাণীও অমৃত লাগে। এবার বর্ষাও রসিকতা করে বলছে, পৃথিবীতে মনে হয় না ‘বর্ষা’ ‘বৃষ্টি’ নাম খুবই দুর্লভ। এ নাম এতটা অমূল্য নয় যে, কারও অধিকারে এলে সাত রাজা বা রাজ্যের ধন মনে করতে হবে। তবে নির্দিষ্ট কারও নাম হলে যে, ছেলেরা সেই নামের মিথ্যা প্রশংসা করতে ভুলে না তা জানি। মেয়েরা কিন্তু ছেলেদের নামের কোনো সৌন্দর্য নিয়ে আশ্চর্য বোধ করে না। নাম তো নামই, একটা হলেই তো হয়; তাতে আবার আশ্চর্য হওয়া বা প্রশংসার কী আছে! বর্ষার এমন কটূক্তি অনিকে রীতিমতো অবাকই নয়, মনে মনে আঘাতপ্রাপ্তও করছে। তবে আমাদের মতে, ভালোবাসার মানুষের ওপরি বিরক্তি বোধ করা ভালোবাসারই পরিপন্থী। বর্ষার এমন টানকথার মানেই হচ্ছে, কোনেকটা হেতুতে যদি অনিকে ভুলে যেতে পারে, তা হলে অনেক অঘটন থেকেই বেঁচে যেতে পারে। 

অনি ম্লান হাসল—বলল, জানি, তবে...

বর্ষা অনির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সকৌতুকে হেসে বলছে, মেয়েদেরকে মুগ্ধ করার অভিনব কৌশল ছেলেদের চেয়ে বেশি আর কে জানে! একটু প্রশংসাতে যে মেয়েরা গলে যায় তারাই আসলে বিপদে পড়ে বেশি। মিথ্যা গুণগান করে মেয়েদেরকে ফাঁদে ফেলা ছেলেদের পুরোনো স্বভাব। যারা ছেলেদের হাবভাব না বুঝে সহজে প্রেমে পড়ে যায় তারাই একসময় ধোঁকা খায় নিশ্চিত। বর্ষাও (মিথ্যা) বলল, আমি কিন্তু প্রশংসার চেয়ে সমালোচনায় বেশি ভালোবাসি। 

অনি ভেতরে ভেতরে একটু অভিমানিত বোধ করল এবং আবারও ম্লান হাসল—বলল, কথাগুলো যদি সত্যিই আমার উদ্দেশ্যে বলা হয়, তবে বলব, আমি সত্যকে গলাটিপে হত্যা করে মিথ্যার আশ্রয়ে কখনো পথ চলি না এবং কারও সঙ্গে রসিকতা করতে পারি কিন্তু প্রবঞ্চনা না। আমার আরও কিছু বিশ্রী স্বভাব আছে, আমি কাকে আঘাত করি তো ফুল দিয়ে—পাথর দিয়ে নয় এবং সাজা দিই তো শ্রীকান্ত কারাগার—নির্জন কোনো অন্ধকার দ্বীপ নয়। আঁধার ঘরে আমার জন্ম হয়েছে ঠিক কিন্তু অন্ধকারে পথ চলতে আমি মোটেও ভালোবাসি না। আপনি কী মনে করছেন জানি না, তবে আমার কথাবার্তায় এবং আচরণে যদি এমন কিছু মনে করে থাকেন, তা হলে সেটা হবে আপনার নিতান্ত ভুল। কারণ, এ অনিরুদ্ধ কারও জীবন নিয়ে ঠাট্টা করতে পারে কিন্তু জুয়া খেলতে পারে না। হাতের প্রত্যেকটি আঙুল যেমন একই ধাঁচের নয়, তেমনি সৃষ্টিকারকের সকল সৃষ্টিও কিন্তু এক রকমের নয়। 

বর্ষা অনুতপ্ত হলো—বলল, দুঃখ পেলেন বুঝি? আপনাকে দুঃখ দেওয়া তো আমার উদ্দেশ্য ছিল না। আসলে প্রতিটি মুহূর্তেই মানুষের শিক্ষার প্রয়োজন আছে—কথাটা একশ ভাগ খাঁটি। উপহাসে মানুষ বিরক্ত হয় জানি কিন্তু উন্মত্ত হয় জানতাম না।

অনি বলল, কিছু কিছু মানুষের এরকম বদাভ্যাস থাকা ভালো—যা আমি মনে করি।

বর্ষা বলল, আপনার মনে করা আমার মোটেও মনে লাগেনি।

অনি বলল, নাইবা লাগল। তবে ওজনহারা মানুষকে কখনো আমি সুজন মনে করি না।

বর্ষা বলল, এ কথাটা মনে লাগল। শেষমেষ দুজন দুজনার প্রতি সীমাহীন মুগ্ধ হয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতেই হলো। ওই যে ‘ভালো লাগার মুখে বিষের বাণীও অমৃত লাগে’ 

৬ 

বর্ষা মধ্যবিত্ত পরিবারের আদুরে মেয়ে। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সকলের ছোট। বাবা শশাঙ্কদেব মল্লিক একজন ব্যাংককর্মকর্তা। মা চারুলতা দেবি প্রাইমারি স্কুলশিক্ষিকা। দিদির প্রকাশনাম তৃষা। লিখিতনাম মৌমিতা মল্লিক। বিয়ে হয়েছে এক বছর পূর্বে এক বিত্তবান পরিবারে। থাকে স্বামীর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায়। বড়দাদার নাম মহেন্দ্রদেব মল্লিক। থাকে গ্লাফে। মনে হয় তেমন একটা সুবিধাতে নেই। মা বারবার বলে আসছে নাকি দেশে ফিরে আসতে। ‘আসব’ ‘আসব’ করে কখনো ফিরার সুযোগ হয়ে উঠছে না! শুনছি—মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের জিন্দেগি বড়ই নাজুক। এখানে শতে দুয়েক জন লোক সুবিধায় আছে কি না বলা মুশকিল। তবু মানুষ মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দিতে জায়গাজমি আর শেষসম্বল ভিটেবাড়ি এখনো বিক্রি করছে! ছোটদাদার নাম নরেন্দ্রদেব মল্লিক। বর্তমানে বিএ পড়ছে। বীরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হয়েছে। থাকে ছাত্রাবাসে। সংসার একেবারে ঝঞ্ঝাটমুক্ত বলা যায়। 

অতঃপর মাসদুয়েকের মতো হতে চলল, তাদের খবরাখবর আমরা নিতে পারিনি। ইদানীং শুনছি, বেশ মিলামিশা চলছে। ‘আপনি’ ডাক থেকে দুজন ‘তুমি’ বলাতে নেমে এসেছে। একে অপরকে দিনদুয়েক না দেখলে নাকি পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছে। বর্ষার হাতে কোনো ফোন নেই। বাবা-মার ফোনে কথা বলা তো দূরের কথা, হাত লাগানোরও অনুমতি নেই। এ পরিবারে মেয়েদেরকে খুব কড়া নজরে রাখা হয়। বাবা শশাঙ্ক দেবের ধারণা, মোবাইল ফোনই একমাত্র পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের নষ্টের গোড়া। মা চারুলতারও একই মত। তাই মা-বাবার অনুমতি ছাড়া ফোনে কথা বলা এঘরের ছেলেমেয়েদের মানা। বর্ষা কলেজ যাওয়া-আসাতে অপরিচিত ফোনের দোকান থেকে বা কোনো বান্ধবীর মুঠোফোন থেকে অনির সঙ্গে জরুরি কথাবার্তা সারে, তারপর নির্দিষ্ট স্থানে দেখা করে দুজন। 

ফাল্গুনের কোমলরোদের সকাল। লালে লালে ছেঁয়ে গেছে কৃষ্ণচূড়ার ডাল। পথের গাছগাছালি এক অপূর্বতায় সজীব। পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত শাখা। হাওয়ায় হাওয়ায় দোলে মাটি চুমতে চাইছে বাঁশঝাড়ের আগা। উল্লিখিত হয়েছে—বর্ষার কলেজ যাওয়া-আসার এটাই একমাত্র পথ নয়, তবু বেশিরভাগ সময় এপথ দিয়েই যাওয়া-আসা করে সে। কারণ, পথটা কাছের হওয়াতে শুধু বর্ষার কাছেই নয়, অনেক ছাত্রছাত্রীদেরও পছন্দের আগে। যেমন নিরিবিলি তেমন বাঁশবনে আর বড় বড় গাছের ডালপালার ছায়ায় চমৎকার আচ্ছাদিত। এরাস্তার পাশ দিয়ে চলে গেছে একটি নদীর মতো খাল। এ খালের দুধারের ঢালুপাড়ের অপূর্বতার বর্ণনা করতে গেলে আরেক গল্প হয়। ঝাউবন আর বেলাভূমির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবে না এমন কোনো বেরসিক মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। শীতের মৌসুমে এখানে বনভোজনের বেশ আয়োজন জমে। এস্থান বর্ষার কাছে বড়বেশি ভালো লাগে। তাই আজ সকালে কলেজ যেতে অনির সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে বিকাল চারটায় এখানে আসতে। অনির ছুটি তিনটায় তবে এখানে আসতে হলে গাড়ির ঝঞ্ঝাটে ঘণ্টাখানিক লেগে যায়। 

কলেজছুটির পর সৃষ্টির সঙ্গে বর্ষা কথিতস্থানে এসে বসে আছে। হাসাহাসি ও কথাবার্তা বেশ জমে উঠেছে। সৃষ্টি? সহপাঠিনী বান্ধবী। কোথাও আসতে কখনো বর্ষার এতটু দেরি না হলেও অনির কিন্তু প্রায়ই হয়। কারণ সে একটা দায়িত্বে নিযুক্ত। দায়িত্বের প্রতি যে অবহেলা করে সে জীবনে উন্নতি করতে পারে না—এটা অনির যুক্তি। সেক্ষেত্রে অনিকে দায়িত্ববান বলা যায়। কাজে ফাঁকি দেওয়া তার মোটেই পছন্দ না। আমরাও মানি—কামচোরের জীবন অন্ধকার। এমন সময় পেছন থেকে এসে অনি দুহাতে বর্ষার মুখটা আলতোভাবে ধরল—মাথায় একটা চুমু খেল আর বলল, দুঃখিত লক্ষ্মীটি, ভীষণ ভীষণ দুঃখিত। 

বর্ষা মুখটা ভার করে বলল, এ একটি শব্দই কি সবকিছুর সমাধান? 

অনি—অনেক চেষ্টা করেছি...ভেবেছিলেম...ভাবনা কি আর...অফিসে একটা জরুরি কাজ...বলে আবারও দুঃখপ্রকাশ করে বলল, দুঃখিত... 

সৃষ্টি অনির কুশলমঙ্গলের উত্তর দিয়ে প্রেমিকার অভিমান ভাঙানোর অভিনব কায়দা দেখে মনে মনে হাসছে হয়তো। 

বর্ষা—দুঃখিত! একটু কঠিনগলায় বলল, এ শব্দটা শুনলে এখন খুব বিরক্ত লাগে—অন্তত তোমার মুখে... 

অনি বলল, দুঃখিত, আর শুনবে না প্রিয়।

বর্ষা বলল, আবারও...

অনি হেসে বলল, এই দেখ, কান ধরেছি...

বর্ষা বলল, ওয়াদা করলে তো? 

অনি বলল, করলাম। 

বর্ষা বলল, এভাবে চলবে না।

অনি বলল, তবে?

বর্ষা বলল, আমার মাথায় হাত রেখে সৃষ্টির সামনে শপথ নিতে হবে। আর মনে করো না এটা শুধু ‘দুঃখিত’ শব্দটির জন্যেই। 

অনি বলল, তা হলে? 

বর্ষা বলল, দেরি করা যে তোমার আজকাল অভ্যাসে পরিণত হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই বদাভ্যাস থেকে মুক্তির লক্ষ্যে।  

বর্ষার মাথায় হাত রেখে শপথ তো অনি নিয়েছে ঠিক; তবে, আমরা জানি না সে কতটুকুইবা পালন করতে পারবে। অনির ব্যাপারে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। তার ওপর বর্ষার যেমন পুরোপুরি আস্থা আছে, আমাদেরও আছে। আমাদের আপত্তি এখানে, মেয়েরা সামান্য কিছুতেই ওয়াদা চায়। হোক ভালোবাসায় কিবা বন্ধুবান্ধবের আড্ডায়। এখানেই মেয়েদের বিপত্তি। তারা মনে করে হাতে হাত রেখে ওয়াদাবদ্ধ হলে কিবা কারও মাথার কিরা খেয়ে শপথ নিলে সব লেঠায় চুকে যায়! কিন্তু না, ওয়াদা বা শপথ একমাত্র শেষকথা বা লেঠার নিষ্পত্তি নয়। মসজিদ মন্দির গির্জা মঠে—যেকোনো উপাসনালয়ে গিয়ে যেকেউ সহজেই ধর্মগ্রন্থের শপথ নিতে পারে ঠিক; তবে আমরা নিশ্চিত, রক্ষা করা দায়। আমরা এমন বহু প্রেমিক-প্রেমিকাকে দেখেছি, মাথার কিরা বা চোখের কসম খেয়ে বিশ্বাস ভঙ্গ করতে! চরিত্র যার মন্দ তাকে সত্তর তালায় আবদ্ধ রাখলেও সে সীমা লঙ্ঘন করবেই। তদ্রূপ ওয়াদাভঙ্গ যার পেশা সে ওয়াদাভঙ্গ করবেই। অনির ব্যাপারে তবে আমাদের পুরো আস্থা আছে। সে কথা দিলে রক্ষা করার প্রাণপণ চেষ্টা করে। 
 ৭  

সপ্তাখানেক পর—ফাল্গুনের শেষের দিকের সময়—আবার দুজন মিলিত হয় একটি পার্কে। হাঁটতে হাঁটতে অনেক কথা হলো—হচ্ছে। কথার ফাঁকে বর্ষা হঠাৎ বলল—অনি, তোমার একটা নাম দিতে চাই? যে নামটা হবে একান্ত আমার। 

অনি হেসে বলল, দাও... 

বর্ষা কোনো কিছু চিন্তা না করে বলল, অন্ত। আবার একটু চিন্তা করে বলল, না না, ওটা নির্দিষ্ট একটা সীমারেখায় শেষ হয়ে যায়। তোমার নামের ‘অ’র পরে একটা ‘ন’ বাড়িয়ে তাকে করব অসীম আর তুমি হবে আমার ‘অনন্ত’।

অনি বলল, বাহ্‌, চমৎকার তো! তা হলে যে, তোমারও একটা নাম দিতে হয়। কী নাম দেওয়া যায় বল, বলে বলে একই কথা বারবার উচ্চরণ করতে লাগল। একটু পর চমৎকৃতকণ্ঠে লাফ দিয়ে উঠল—বলল, পেয়েছি। 

বর্ষা বলল, কী? 

অনি বলল, সাধনা। আমি তোমার ‘অনন্ত’ তুমি আমার ‘সাধনা’ আজ থেকে আমরা ‘অনন্ত-সাধনা’। বর্ষা চুপ দেখে বলল, নামটা তোমার পছন্দ হয়নি? 

বর্ষা বলল, হয়েছে, খুব হয়েছে। 

অনি বলল, তা হলে? নামটা কেমন হলো বললে না যে?

বর্ষা ভরপুর হেসে বলল, তোমার বিষণ্নতার রূপটা দেখতে। তুমি মুখটা কালো করলে মন্দ লাগে না। চমৎকার বলে যে আর কাজ নেই—একেবারে তুলনাহীন। তারপর দুজন নির্জন একটি গাছের তলায় বসল।

সাধনার কোলে মাথা রেখে অনন্ত শুয়ে আছে ঘাসের ওপরে। এমন অপূর্ব ভালোবাসায় বোধহয় প্রকৃতি সজীব? সৃষ্টির সমস্ত কিছু মনে হয় এ ভালোবাসার কাছে বন্দি? এ জগৎসংসার বোধহয় ভালবাসারই সৃষ্টি? গাছগাছালিতে ভরপুর এ পার্ক প্রেমিক-প্রেমিকার জন্যে স্বর্গীয় এক বাগান বলা যায়। তার রূপের বর্ণনা করতে গেলে পাথেয় শেষ হয়ে যাবে কিন্তু পথ শেষ হবে না। তাই পাথেয় ফুরিয়ে যাওয়ার আগে পথের সমাপ্তি জরুরি। 

বর্ষা বলল, এভাবে আমাদের মিলামিশা আর কত দিন অনন্ত? ভালো মনে হচ্ছে না। আত্মীয়জনদের কেউ যদি দেখে ফেলে, অন্তত আমার রক্ষা নেই।

অনি বলল, আমায় রক্ষা করবে কোন রক্ষাকর্তায়? তবে স্রষ্টা সকল সৃষ্টির প্রতি দরদ রাখেন। 

বর্ষা ম্লান হেসে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল—বলল, স্রষ্টা সবকিছুর প্রতি দরদ রাখেন ঠিক, কিন্তু সমস্ত সৃষ্টি মনে হয় দয়াপরবশে সৃষ্টি করেননি? কারণ, কিছু কিছু সৃষ্টিকে দেখে মনে হয় না স্রষ্টা সকল সৃষ্টির মধ্যে বিরাজমান। 

অনি বলল, হতে পারে। তবু স্রষ্টার প্রতি অগাধ বিশ্বাস রাখতে হয়। পরিণতি যাই-ই হোক, বিশ্বাস রাখতে হবে—স্রষ্টার ইশারায় সবকিছু ঘটে—ঘটছে। 

বর্ষা বলল, সেই তো ঘটছেই। তবে তোমার পরিণতি যাই হোক, আশা করি আমার মতো হবে না। 

আমরা ‘অনন্ত’ ডাক ডাকতে পারি না, কারণ সেটা একান্ত বর্ষার। অনির পরিণতি কী, আমরা না জানলেও তবে কিছুটা আঁচ করতে পারি; কারণ, মামার বাড়ির দিক বাদ দিলে তার পরিবারে আছেইবা কে—মা আর ছোট্ট একটি বোন ছাড়া। কিন্তু বর্ষার পরিণতির কথা আমরা জোরগলায় কিছু বলতে না পারলেও এতটু ধারণা দিতে পারি, এরকম সম্পর্ককে কোনো সনাতন পরিবার ‘স্বাভাবিক’ বলে মেনে নেয়নি—নেবে না। 

ওভাবে চলতে চলতে আরও মাসছয়েক চলল। সত্য কত দিন আর গোপন থাকে। সত্যকে সত্তর পর্দার আড়ালে ঢেকে রাখলেও সত্য কখনো-না-কখনো প্রকাশ হয়ই হয়। এ গোপনীয়তাকে আর বেশি দিন গোপন রাখা গেল না। দুই পরিবারের পরিজনমহলে জানাজানি থেকে দ্রুত কানাকানিতে নেমে আসে। বর্ষাদের স্বজনরা ধিক্কারশব্দে—হুঁ...হাঁ...একটা ম্লেচ্ছকে...কেউ বলছে, স্বজাতিতে এতই কি অভাব হয়েছে যে, একজন বিজাতিকে নিয়ে ঘর পাততে হবে? ছি, লজ্জাশরম সংসার থেকে একেবারে ওঠে গেল নাকি! ইত্যাদি বলে বলে প্রায়ই বর্ষার মা-বাবাকে লজ্জা দিয়ে যাচ্ছে আর নিন্দুকের মুখে মুখে রচিত হয়ে চলছে বারো হাজার নিন্দার আখ্যান! 

ওদিকে অনির পরিবারবর্গে তেমন একটা হইহুল্লোর শোনা না গেলেও মামার বাড়ির দিক থেকে দুয়েক কথা শুনতে হয়নি এমন কথাও নয়। মামারা গোস্বায় লালনীল হয়ে বলছে, এমন বিজাতির মেয়ে আমাদের সমাজে স্বীকৃতি নেই। মামিরা তেলেবেগুনে জ্বলে তার মায়ের কান ভরছে, চোদ্দ গোষ্ঠীর মানইজ্জত ডুবাবে আর কি। নাহয় এমন বিধর্মীকে নিয়ে কেউ ঘর পাততে চায় বুঝি! তার বাপের ইজ্জত না থাকলে না থাকতে পারে কিন্তু আমাদের আছে—তুমি তোমার ভাইদের সম্মান ভেস্তে দিতে পারো না; এ মেয়ে ঘরে তুললে তুমি বিষ খাবে বলো। 

এদিকে বর্ষার ওপর দৈহিক-মৌখিক অনেক নির্যাতন নেমে এল। তবু তাকে কিছুতেই কাবু করা যাচ্ছে না। এবার ভাইবোনদের কথামতো ঘরবন্দি করে কলেজ যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হলো। অনির সঙ্গে কোনোপ্রকার যোগাযোগ করবে থাক, তাকে কল্পনা করাও নিষিদ্ধ হলো। বর্ষা নিরুপায়, অনিও তাই। দুজন প্রাগলপ্রায়। সাপ যেমন মণিহারা হয়ে ভীষণ অন্থির হয়ে যায়। 
 
 একদিন গভীররাতে অনি স্বপ্নে দেখছে, বর্ষাকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কোথায়! বর্ষার কাঁদনে আকাশ যেন বিদীর্ণ হচ্ছে বজ্রপাতে! হঠাৎ অনির ঘুম ভেঙে গেল। কী ভয়ানক দুঃস্বপ্ন! ভাবল, স্বপ্ন কি সত্যি হয়? আবার ভাবছে হলেও হতে পারে। 

নিয়তি কোথায় নিয়ে কাকে মিলায় এবং কাকে কোথায় এনে দাঁড় করায় একমাত্র নিয়ন্তা ছাড়া কেউ জানে না। অনি আর বর্ষার শেষ পরিণতি কী আমরাও জানি না। বেশ কিছু দিন কেটে যাচ্ছে, বর্ষার আর কোনো খবরাখবর পাচ্ছে না বলে অনির মন খুবই অস্থির। হঠাৎ একদিন বর্ষার ঘনিষ্ঠা বান্ধবী রিক্তার সঙ্গে দেখা! সেই নিরিবিলি পথে। যেপথে অনি আর বর্ষা প্রায়ই মিলত—দেখা করত। সেপথ আজও অবিকল আছে। তেঁতুলগাছটিও অবিকল আছে। তার ছায়া ও ঝিরঝির বাতাসের স্নিগ্ধতার উপস্থিতিও অবিকল আছে। শুধু বর্ষার উপস্থিতি অবিকল নেই। তেঁতুলগাছটিতে হেলান দিয়ে বসে হাসাহাসি ও মাতামাতি এগুলো আজ কেবলই স্মৃতি। বাস্তুহারা উদ্বাস্তু কেউ স্মৃতির নগরে বা শহরে ফিরে এলে মনের কান্নার জল যেরূপ নীরবে ঝরিয়ে পড়ে। অনিও মাঝে মাঝে স্মৃতির রাজ্যে এসে চোখের জল ফেলে। রিক্তার সঙ্গে কথা বলে যতটু শান্তি পাওয়া গেল, তারচেয়ে অনেকবেশি দুঃখ পেতে হলো। বর্ষাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে দূরে—অনেক দূরে—পিসির শ্বশুরবাড়ি—কোথা বলে রাঙ্গাধুলি। শুনে আসমান ভেঙে মাথায় পড়ে তার! ভাগ্য যে কত নির্মম হতে পারে প্রমাণ পেল এবার! এ জগৎসংসার কত যে চিত্রময়ী ও বিচিত্র চোখের সামনে ভেসে ভেসে উঠছে বারবার! বর্ষার বলে যাওয়া সান্ত্বনার অনেক কথা বলে রিক্তা চলে গেল। অনির অশান্ত মন কোনোভাবেই শান্ত হতে পারছে না। আমরা জানি, একমাত্র ডাহুক-ডাহুকী ছাড়া (কেউ বলে কাক) অন্য কোনো দৃষ্টান্ত নেই—বিচ্ছেদের দরদে জীবন বিসর্জন দেয়। মানুষের জীবনে তো নয়ই। কিন্তু প্রেমকে কেন্দ্র করে পৃথিবীতে অনেক অঘটন ঘটেছে—এমন বহু নজির আছে। বিরহেতে প্রেমের যে সৌন্দর্য আছে, সার্থকতায় তা নেই। আত্মহত্যা একটা কুৎসিত জিনিস। অনেকে আত্মহত্যা করে না—প্রয়োজনে যুদ্ধ করে। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে পৃথিবীতে অনেক যুদ্ধ হয়েছে। প্রেমের জন্যেও অনেকটা হয়েছে। তবে অনি কোনো রাজা-মহারাজা বা হৃদয়হীন পুরুষ নয় যে, জোর করে কেড়ে নেবে। সে কপালের ওপর বিশ্বাসী। জোর করে কিছু হাসিল করলে তা মোটেও সুখের নয় এবং পরিণতিও ভালো হয় না। এটা অনির ধারণা। আমাদের ধারণার সঙ্গে হুবহু না মিললেও অনেকের ধারণার সঙ্গে মিলে। রিক্তার কথামতো বর্ষার আরেক ঘনিষ্ঠা বান্ধবী প্রাচীর সঙ্গে দেখা করল—অনেকটা শান্তি ও সান্ত্বনা খুঁজে পেল : খুঁজে পেল বাঁচার অনুপ্রেরণা—

হাজার বছর পরে 
         হয়তো আবার দেখা পাবে আমার 
         এ করুণার বাসভূমে হয়তো আর আসব না ফিরে 
         এ বাংলার লোকালয় তখন হয়তো রবে না 
         রবে না হয়তো এদেশের কোনো চিহ্নপ্রতীক 
 রবে না 
         রবে না হয়তো জাতিভেদের কোনো ভেদাভেদ 
         রবে না রবে না হয়তো মানুষে মানুষে বিবেদবিদ্বেষ 
         রবে না মৃত্তিকায় কেউ রবে না অট্টালিকার আত্মগরিমায় 
         ধনীগরিব উঁচুনিচু আর্য-অনার্য প্রভেদ ভুলে মনুষ্যজাতি হবে এক 
 তখন? 
         তখন হয়তো পৃথিবীর আরেক দেশে জন্ম হবে আমার অন্যরূপে 
         তুমি হবে আরেক—হয়তো রবে দূরে—কিবা—তবু হৃদয়ের কাছে 
          তোমার আঙিনার হলুদবনের গুলঞ্চলতার ফুলটিরে ভালোবাসবে তুমি 
          হয়তো সে আমি, অনুভবে সকল অনুভূতি করবে বন্ধু স্মরণ—
 তখন 
          খেয়াল করো ওই পথের ধারে কলমিডাটায় বসে আছে যে-ফড়িং 
         তোমার বাড়ির উঠোনে শজনেগাছে বসে আছে যে-হলুদ পাখিটি 
         কিবা বসে আছে পেয়ারাডালে—বারবার উঁকি দিচ্ছে ওই ঘুলঘুলিতে 
          অথবা তোমার চলার পথে দ্রোণফুল হয়ে জড়িয়ে আছে পায়ে 
 টের পাবে না তুমি 
         যে-ভালোবাসার সমাধি হতে চলে যাচ্ছি আজ প্রেমহীন গহিনারণ্যে 
         জেনে রেখো প্রিয়, সেখানে হবে হয়তো আমার বেদনার কবর—
          এই যে এ বিদায়ের পল, এই যে এ অপূর্ণ ভালোবাসাবিকল 
         যদি কখনো পূর্ণ হয়—হতে পারে—হবে তবে ওই ধরাধামে 
 অথবা না হোক কবে 
          এ জগজ্জড়তার ছত্রছায়ায় চাই না একবিন্দু ঠাঁই 
         চাই না নির্দয়ের কাছে করুণার কড়িমাত্র পাথেয় 
         চাই না বিরূপ এ চরাচরে মানবরূপে জন্ম নিই আবার 
         ধর্মান্ধতার জাঁতিকলে বলির মৃগ হতে চাই না পুন 
 বন্ধু তবে 
         আমায় যদি মনে পড়ে কবে—দেখো ওই নক্ষত্রের প্রাঙ্গণে 
          জোনাকির আলোর মতো জ্বলছে মিটিমিটি—দলেদলে করছে নর্তন 
          হয়তো সেখানে আমি একজন ভালোবাসার মশাল জ্বেলে 
         প্রিয়তমের প্রতীক্ষায় বসে আছি আহ্লাদে শুধু আহ্লাদের ঘরে 
 মনে রেখো 
         সেদিন ফুটবে না আর কোনো বেদনার নীলোৎপল 
         আসবে না আর কোনো বিদায়ব্যথার করুণমুহূর্ত 
         যেতে হবে না দূরে—অনেক দূরে প্রিয়জন ছাড়ি 
          আজ যেতে বাধ্য—নেই কোনো উপায়—কোনো সামর্থ্য 
 বন্ধু যাই 
          অপরাধী আমি নই—তবে ভাবো যদি অপরাধী 
          মানি বিধিলিখন, ধন্য তবে ধিক্কারের বাণী যদি পাই 
         আবার জন্ম যদি সত্যি হয় চাই না এ হিংস্রজীবন 
         পুনর্জন্মে যদি আসি মাছরাঙা হয়ে ওই নদীটির কিনারে 
 ধন্য সেই জনম 

পড়তে পড়তে জলে টলমল করছে অনির দুচোখ। একটু পর ‘টপ্‌’ ‘টপ্‌’ করে ঝরে পড়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু। চিঠিটা ভাঁজ করে রেখে দেয় পকেটে—আবার বের করে পড়ে। আবার যত্ন করে রেখে দেয় পকেটে। একটু পর আবার বের করে পড়ে! মাতাল যেমন মদের নেশায় টলতে টলতে বারোশ রাজ্যের স্বপ্ন দেখে আর মুহূর্তেই বারো হাজার দেশের মালিক বনে এবং একসময় হুঁশহারা হয়ে লুঠিয়ে পড়ে মাটিতে। অনি তেমন স্বপ্নের মালিক না হলেও একমাত্র সম্পদ বুকে চেপে স্মৃতির রাজ্যে টলমলাতে টলমলাতে হুঁশহারা হয় কখনো কখনো—আবার চলার অনুপ্রেরণা খুঁজে পায় একটু একটু। এভাবে দীর্ঘদিন না চললেও বেশ কিছু দিন পাগলের মতো চলল! আস্তে আস্তে মন স্বাভাবিক হলো কিন্তু মনের পরিবর্তন এতটা হলো না! বর্ষাকে কখনো ভুলা গেল না! বাস্তব দৌড়ের ঘোড়াকে ফেরানো সম্ভব, তবে মনের দৌড়ের ঘোড়াকে ফেরানো মুশকিলই নয় একেবারে অসম্ভব। মন যেদিকেই ছুটে কেবল ছুটতেই থাকে। এটাকে আমরা পাগলের দৌড় বলব না। বাস্তবের পাগলামি আর চোটের পাগলামি এক নয়। 

জয়-পরাজয় এমন এক জিনিস, জিতলে আনন্দে চোখে আসে পানি আর হারলে মনকে সান্ত্বনা তো দেওয়া যায় তবে দুঃখটা আজীবন মনের কোণে থেকে যায়। ভালোবাসার জয়-পরাজয়ও তদ্রূপ। বর্ষার বিচ্ছেদের প্রায় দুবছরের মতো হয়ে গেল তবু অনির মনের কান্না এতটু কমলো না! বোনটিকে বিয়ে দেওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই মরে গেল মা! তারপর হয়ে গেল আরও বেশি একা। একাকিত্ব জীবন যে কী, একমাত্র একাকী ছাড়া কেউই বুঝে না। এমন জীবনে বাঁচা তো যায় তবে কোনো শান্তি অনুভব করা যায় না। ছন্নছাড়া জীবন বড়ই কঠিন আর এ কঠিন জীবনে কখন কী ঘটে তাও বলা বা বোঝা মুশকিল। 
 ৯ 

বহু বছরপর অনির নিরুদ্দেশের খবর আমরা জানতে পেরেছি—রাঙ্গাধুলি গেল। সেখানে বছরখানেক কাটল। বর্ষাকে তন্নতন্ন করে খুঁজেও মিলেনি। হারিয়ে গেলে কোনো জিনিস কি পাওয়া যায়? সহজেই না। কীভাবে জানলাম? খবর নেওয়ার আপনজন তেমন একটা না থাকলেও কারও, খবর রাখার ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব অনেক থাকে। রাঙ্গাধুলিতে আর মন বসছে না তার, না স্থির হতে পারছে কোথাও। এভাবে যাযাবর জীবনের উদ্দেশ্যহীন যাত্রার শুরু! আজ এখানে তো কাল ওখানে। গ্রাম হতে গ্রামান্তরে। দেশ হতে দেশান্তরে। কোথায় যাত্রাবসান—শেষঠিকানা কোথায় কে জানে। এ-ই দীর্ঘ দাড়িগোঁফ। লম্বা চুলে ধরেছে পাক। পরনে কাপড় মলিন। ঝাড়ি দিলে মনে হয় ধুলা পড়বে এক মণ। যে দেখে সে মনে করে আস্ত এক পাগল। 

চলছে...চলছে...চলছে...বারোটা বছর ধরে চলতে চলতে একদিন এক আশ্রমের ধারে এসে চলন শেষ! একশ চার ডিগ্রি জ্বরে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না আর। কাশিতে বন্ধ হয়ে আসছে বুকের দম। সমস্ত শরীর ব্যথায় জর্জরিত। মাটিতে লুঠিয়ে পড়ল। চোখদুটো দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে নীরবে হাজার বেদনার জমে থাকা অশ্রু। পান্থদের জড়ো হওয়া দেখে আশ্রম থেকে ছুটে এল অনেকে। বলাবলি করছে একে-অপরে...নানান মন্তব্য...হিন্দু না মুসলিম...আহারে মানবজীবন...অনি নীরবে সব শুনছে আর ভাবছে বর্ষার মুখ। এসময় একজন মধ্যবয়স্ক মেয়েলোক ভিড় ঠেলে এসে কোলে তুলে নিল অনির মাথা। সঙ্গে সঙ্গে এক অন্যরকম অনুভূতি অনুভব করল সে। মনে হচ্ছে সবচেয়ে বড় আপনজনের ছোঁয়া। চোখের জলে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না রমণীর মুখ। স্নেহের আঁচলে মুছে দিচ্ছে রমণী অনির চোখের পানি। তৎক্ষণাৎ শুরু হয় প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মুহূর্তে পৃথিবী অন্ধকার হয়ে নেমে এল যেন কেয়ামতের দুর্যোগ। তিনশ বত্রিশ কিলোমিটার বেগে মনে হয় ছুটে চলছে তুফান। তুফানের বেগে জড়ো হওয়া পথিকেরা যে যার গন্তব্যে দৌড়ে ছুটছে। মঠের দুই জন সন্ন্যাসিনী মাত্র বসে আছে তাদের সহকর্মিনীর পাশে। (এ সংসারে আপনজনের প্রতি যাদের এতটু মায়া নেই, দরদ নেই; সেখানে অপরিচিত একজন অজানা-অচেনা পান্থের জন্যে দরদবান হওয়ার সংখ্যা এতটুকুই নেহাত কম নয়) প্রকৃতির সারা সৌন্দর্য মিশমার করে বোধহয় এক্ষুনি নিয়ে যাবে নিজের আস্তানায়। তুফানের কী জোর, তারচেয়ে আরও বেশি জোর এবার অনুভূত হচ্ছে অনির শরীরে। দৃষ্টিশক্তি যেন ফিরে এল পুরোপুরি। বর্ষাকে সহজেই চিন্তে পারছে অনি! আশ্চর্য অনুভব করে অপূর্ব ভালোবাসার কণ্ঠে ডাকল, সাধনা! একে-অপরকে ঝাপটিয়ে ধরল বুকে! চব্বিশ বছর পর অন্যরকম এক স্বপ্নের জগতে যেন প্রবেশ করল তারা। বিশ্বাস কেমন করে হয়। মানুষ যেখানে সাধারণ কিছুকে সহজে বিশ্বাস করতে পারে না, সেখানে অসাধারণতাকে কীভাবে বিশ্বাস করা সম্ভব! জীবনে যতটুকু সুখ উপলব্ধি করতে পারেনি দুজনে, তারচেয়ে আজ বেশি লাগল শান্তি। অনেকটা কমে এল বাতাসের গতি। কান্নার জলে ভেসে যাচ্ছে এখনো দুজনার চোখ। অনি কাশতে কাশতে খুব ক্ষীণগলায় জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ সাধনা? কণ্ঠে তার অপূর্বতার দরদ। বর্ষা চুমুই চুমুই ভরে দিল অনির মুখ। পৃথিবীটা স্বর্গ হয়ে দেখা দিল আবার দুজনের মনে। 

বর্ষা বলল—অনন্ত, কোনো দিন কল্পনা করিনি প্রিয় নামটা আবার ডাকতে পারব! 

অনি দরদভরা কণ্ঠে বলল, পৃথিবীটাই তো একটা অঘটনের জায়গা, যা কল্পনা করা হয় তা কখনো ঘটে না আর যা ঘটে তা কখনো কল্পনা করা হয় না। স্রষ্টাকে ধন্যবাদ। এ আমাদের সাক্ষাৎ, হয়তো শেষ সাক্ষাৎ নয়; হয়তো চিরমিলনের দেখা হয়ে অদেখা বাড়ির উদ্দেশ্যে গমন। অনির কতূহলী কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসছে। বর্ষার দরদের বাঁধ ভেঙে উছলি পড়ছে হৃদয়ের সমস্ত শোক। কখনো কাউকে না-বলা কথা বলতে লাগল নিসঙ্কোচে : সেই অনেক লম্বা কাহিনী—বিয়ে পাকাপাকি হলে এক সুযোগে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে আসি। ভাগ্যক্রমে এ আশ্রমের কর্ত্রীর নিকট আশ্রয় পাই। বড়ই মহতী ছিলেন অনূঢ়া এ মঠকর্ত্রী। আমাকে আপন মেয়ের মতো ভালোবাসতেন। আমিও মায়ের মতো দেখেছি। আমার ‘না’ সত্ত্বেও আমার হাতে আখড়ার ভার তুলে দেন এবং আরেকদিন চলে যান স্রষ্টার ডাকে। সংক্ষিপ্ত এটুকু বর্ণনাশেষে যখন বলতে লাগল—চল, মঠে যাই। ততক্ষণে অনির চোখে ঘুম এসে গেছে—চিরনিদ্রা! শোকে—বর্ষা আর একফোঁটা চোখের জল বিসর্জন দিতে হলো না, টলে পড়ে তার নিথর দেহ অনির বুকের ওপর! কিছুক্ষণের জন্যে বোধহয় স্তব্ধ হয়ে গেল পৃথিবীর নাড়ির বন্ধন। থেমে গেল মনে হয় সব কোলাহল। মিটে গেল মনে হয় বিরহযন্ত্রণার সকল দুঃখকষ্ট। 

কিছু মানুষ পৃথিবীতে আসে আহার-বিহারের জন্যে। কিছু মানুষ আসে নিজস্বার্থ প্রতিষ্ঠা করতে আর কিছু মানুষ আসে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে পৃথিবীর কিছু উপকার করতে। তবে মানুষ বলতেই কিছু-না-কিছু বিশেষ গুণের অধিকারী আর এগুণ কোথায় এবং কখন প্রকাশ পায় একমাত্র প্রকাশকই ভালো জানেন। অনি পৃথিবীর কোনো উপকারে এলো না ঠিক, তবে বর্ষার চিন্তার প্রতীক হয়ে সাহিত্যের অনেক উপকার করে গেল। প্রেমের বিরহ-সৌন্দর্য-রূপায়ণে ‘চুপকথা’ ছদ্মনামে যেই রচনাসম্ভার পাওয়া গেছে বর্ষার, নিঃসন্দেহে আমাদের সাহিত্যভাণ্ডারকে করবে আরও বৃদ্ধি এবং আরও সমৃদ্ধশালী।