পোস্টস

উপন্যাস

মাই সেকেন্ড ক্রাশ (২)

১৬ জুন ২০২৪

রাজিয়া সুলতানা জেনি

আগের পর্ব

 

 

জীবনে প্রথম চটি পড়ি ক্লাস সিক্সে। সেই দিনটার কথা কেন যেন মনে পড়ে গেল। পেছনের বেঞ্চে বসেছিলাম। পাশে ছিল সুমন। কি যেন পড়ছিল মনোযোগ দিয়ে। উঁকি দিলাম। ও দেখলাম লুকিয়ে ফেলল। এরপরে কি ভেবে নিজেই জিজ্ঞেস করল

— পড়বি?

— কি?

— জিনিস।

— দেখি।

দেখাল। কাভার পেজে দারুণ উত্তেজক এক ছবি। এরপরে পড়তে শুরু করলাম। সে কি শিহরণ! অদ্ভুত এক অনুভূতি। পিউবার্টি ঠিক সেভাবে তখনো আসেনি। কেবল মেয়েদের ব্যাপারে ইন্টেরেস্টেড হতে শিখেছি।

সেদিনের ঘটনাগুলো ফিল করার চেষ্টা করলাম। হল না। কেবল ভাসা ভাসা কিছু স্মৃতি মনে আসল। সেই নিউজপ্রিন্ট কাগজে, ঘটাং প্রেসে ছাপা বই, কভারের সেই উত্তেজক নগ্ন ছবি। একটা বই বা খাতার পেছনে লুকিয়ে, পেছনের বেঞ্চে বসে পড়া। খুব অল্প সময়ের জন্য অতীতে গেলেও দ্রুতই বর্তমানে ফিরে এলাম।

সামনে বসা অনন্যার দিকে আবার তাকালাম। ভেবেছিলাম চোখে দুষ্টুমি দেখতে পাব। কিন্তু না। ওর চোখ শান্ত। মনে হল স্বাভাবিক কোন তথ্য জানিয়েছে।  কথাগুলো আমাকে হতবাক করার জন্য বলেছে, না বিয়েটা যেন না হয়, সেটা পাকাপোক্ত করার জন্য বলেছে, সেটা বোঝার চেষ্টা করলাম। এধরনের কথা শোনার পরে যে এই মেয়ের ব্যাপারে আমি ‘ইয়েস' বলব না, সেটা না বোঝার মত গাধা, এই মেয়ে না। তারপরও যখন বলেছে, এর একটাই মানে, হয় ও বুঝে গেছে, এই বিয়ে হচ্ছে না। বা ও নিজেই চাইছে না এই বিয়ে হোক। আর নয়তো অনেস্ট টাইপ ক্যারেক্টার। নিজের সম্পর্কে আপত্তিকর অংশ জানিয়ে দেয়াটাই সঠিক মনে করে।

যাইহোক, ধাক্কাটা সামলাতে আমার কিছুটা সময় লাগল। আর চোখে মুখের হতভম্ব ভাবটা স্বাভাবিক হতে লাগল আরও কিছুটা বেশি সময়। বুঝতে আর বাকী নেই, এ মেয়ে আর দশটা মেয়ের মত না। যে মেয়ে প্রথম পরিচয়ে হবু বরের চোখে চোখ রেখে ‘চটি পড়েন?' প্রশ্ন করার গাটস রাখে, সে আর যাই হোক, খুব সাধারণ মেয়ে না। একেবারে অন্য ধাতুতে গড়া। আর জীবনসঙ্গী হিসেবে এমন সাহসী মহিলা... আমি অন্ততঃ চাই না। তবে… আলাপ করতে আপত্তি নেই।

কেন যেন ওর এই লেখালেখি সম্পর্কে ডিটেইল জানতে ইচ্ছে করছে। কিভাবে এই লাইনে এলো, কি তার ইন্সপিরেশান, কেন লেখে, গল্পগুলো কি তার নিজের সৃষ্টি? না কারো কাছে শোনা? এসব আলাপ কি করব? করা কি ঠিক হবে? বুঝতে পারছি না।

সঠিক বেঠিক নিয়ে চিন্তার সাথে সাথে আরো একটা ঘটনা ঘটতে শুরু করল। ‘আমি লিখি’ শোনার পর থেকে হার্ট একটু বেশি বেশি বিট শুরু করেছে। একটু আগেই, ‘আজ উঠি’ বলার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম, আর এখন, ‘আরেকটু গল্প’ করতে মন চাইছে। ওদিকে আমার মনের আরেকটা কোণ চোখ রাঙ্গাচ্ছে, 'ঘটনা অন্য মোড় নিতে পারে। কাহিনীর এখানেই ইতি টানো।'

কিন্তু পারছি না। মাথায় ততক্ষণে দুষ্টুমি সব আইডিয়া ঘুরতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে, ‘আমি লিখি' তথ্যটা দেয়ার আরেকটা অর্থ আছে। ও আসলে একটা প্রশ্ন ইনভাইট করছে। করা উচিৎ হবে কি না সেটা না ভেবেই প্রশ্নটা করে ফেললাম

— তাই? কোথায়?

— লঙ ডিস্ট্যান্স বাসে অর ট্রেনে কখনো ট্রাভেল করেননি?

— করেছি।

— ওখানে অফার পাননি, এসব বই কেনার?

— কোথায় এসব বই পাওয়া যায়, আমি জানি। বাট এসব বইয়ের তো স্পেসিফিক কোন নাম থাকে না। বা স্পেসিফিক নাম দিয়ে তো এই ধরণের বই খোঁজা যায় না। হকারের কাছে যে কালেকশান থাকে, সেখান থেকে একটা পছন্দ করা হয়। তাই আমি জানতে চাইছিলাম… আই মিন...

— আমার লেখা বই কোথায় পাওয়া যায়?

— ইয়া। আই মিন… যদি বলি সেটাই?

— প্রকাশকের ঠিকানা আছে। তবে ভাল হয় একটা স্পেসিফিক দোকান থেকে কিনলে। ওখানে আমার সবগুলো বইয়ের কালেকশান পাবেন।

অর্থাৎ বইগুলো পাওয়া সম্ভব। ঠিকানাটা এই মুহুর্তে চাইলে হ্যাংলা বা পার্ভার্ট ভাবতে পারে। তাই অ্যাড্রেসটা চাইলাম না। তবে আবিষ্কার করলাম, মেয়েটার এই প্রফেসান সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে করছে। কেন যেন জিজ্ঞেস করে ফেললাম

— পেমেন্ট কেমন দেয়?

— প্রথম দিকে তেমন দিত না, তবে আমার লেখা হিট হওয়ার পরে, খুব খারাপ দেয় না। বিক্রির ফিফটি পার্সেন্ট।

— রেগুলার লেখেন?

— বলতে পারেন। তবে ইদানীং…

কথাটা শেষ করল না। চুপ করে গেল। বলতে চাইছে না? না আমাকে স্পেসিফিক ইন্টেরেস্ট দেখাতে হবে? এতোটা ভাববার মত অবস্থায় আমি নেই। স্পন্টেনিয়াসলি প্রশ্নটা মুখ থেকে বেরিয়ে আসল

— ইদানীং?

— ইদানীং বইয়ের পাশাপাশি ওয়েবেও লিখি। আই মিন, আমার নিজের একটা ওয়েবসাইট আছে।

মেয়েটার ব্যাপারে আরেক দফা সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করলাম। যুগের সাথে তাল মেলাতেও জানে। 'চটি পড়েন’ প্রশ্নটা শুনে মেয়েটাকে প্রথমে ফাজিল টাইপ ভাবলেও এখন মনে হচ্ছে, এই মেয়ে চটি লেখাকে খারাপ কিছু ভাবে না। যেসব ব্যাপার একটা মেয়ের জন্য বাহ্যিকভাবে আনটাচেবল ভাবা হয়, এই মেয়ে অনায়াসে সেসবে ইনভলভড হওয়ার সাহস রাখে। বললাম

— আই সি।

— যদি চান, ভিজিট করতে পারেন।

— অ্যাড্রেসটা?

স্মাইল দিল। ‘আমি জানতাম’ টাইপ দুষ্টুমি মেশানো স্মাইল না। টিপিক্যাল ভদ্র স্মাইল। এরপরে বলল

— দিচ্ছি। সাইটটা অবশ্য পেইড। সাবস্ক্রিপশান নিতে হবে।

কথাটা বলার ভেতরে কেমন একটা বিজনেসম্যান অ্যাটিচ্যুড ছিল। এই মেয়েকে যতোটা সহজ সরল ভেবেছিলাম, এই মেয়ে আসলে তেমনটা না। শুধু স্মার্ট বললে, ভুল হবে, ভেরি ভেরি স্মার্ট। অ্যান্ড ইম্প্রেসিভ। মনে মনে হাসলাম। নিশি আপাকে নিজে থেকেই বলেছিলাম, একটু স্মার্ট ইন্টেলিজেন্ট মেয়ে দেখো। আই গট ওয়ান, বাট…।

কেন যেন মেয়েটার ব্যাপারে অন্য একটা সন্দেহও মাথায় জাগল। ডাজ শী হ্যাভ এনি প্ল্যান? আলাপটা শুরু করার পেছনে কি কোন উদ্দেশ্য আছে? আমার আচরণে কি এমন কিছু দেখেছে যার কারণে আমাকে পটেনশিয়াল ক্লায়েন্ট ভেবেছে ওর ওয়েব সাইটের? যদি ভেবেই থাকে, তাহলে অবশ্য ভুল করেনি। সাবস্ক্রিপশান আমি অবশ্যই নেব। এমন না যে রেগুলার পড়তে ইচ্ছে করছে। বলা যায়, কিউরিওসিটি।

আর কি আলাপ করা যায় যখন ভাবছিলাম তখনই মেয়েটা জানাল

— চলুন, উঠি?

ব্যাপারটা কেমন যেন ইন্টেনশনাল মনে হল। একটা সাইকোলজিক্যাল গেম খেলল আমার সাথে। ওর সম্পর্কে কিউরিওসিটি জাগাবার জন্যই প্রশ্নটা করেছিল মনে হল। যেন ওকে আমার সারা জীবন মনে থাকে?

প্রথমবারের মত মেয়েটার জন্য অন্যরকম একটা ফিলিং হল। মিথ্যে বলব না, আমার আরেকটু গল্প করতে ইচ্ছে করছিল। ওর সম্পর্কে আরেকটু জানতে মন চাইছিল। সেই ছোটবেলায়, চটি পড়তে গিয়ে যে শিহরণ ফিল করতাম, তেমন একটা শিহরণ কাজ করছিল সারা শরীরে।

আবার এটাও ঠিক, ‘উঠি' বলার পরে, খুব ডেফিনিট কারণ না থাকলে, বসতে বলাটা অনুচিত। যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, বাসায় গিয়ে ‘নো' বলব, তাই এই রিলেশানটা আর এক্সটেন্ড করব না ঠিক করলাম। ওর ‘চলুন, উঠি?’, প্রশ্ন অবলিগ প্রস্তাবটার উত্তরে, ‘সিওর' বা 'অ্যাজ ইউ উইশ’ জাতীয় কিছু একটা বলতে গিয়ে টের পেলাম অন্য একটা কথা বলছি। জিজ্ঞেস করছি

— বাসায় জানে?

— কি?

— এই আপনার পর্ণ স্টোরি রাইটিং এর ব্যাপারটা?

সুন্দর একটা স্মাইল দিল। প্রথমবারের মত লক্ষ্য করলাম, শী হ্যাজ অ্যা ভেরি এক্সপ্রসিভ স্মাইল। অনেক কথা বলে ওর এই দুষ্টুমিমাখা স্মাইল। বলল

— না। ছদ্মনামে লিখি।

— কি নামে?

আবার স্মাইল। এবারেরটায় দুষ্টুমির পরিমাণ আরেকটু বেশি ছিল। আমি নিজেও ফিল করলাম, ইরোটিক টাইপ একটা এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে। বুঝতে পারছি, এভাবে আলাপ করাটা ঠিক হচ্ছে না। জড়িয়ে পড়ছি। তাছাড়া, প্রথম পরিচয়ে, এতো ডিটেইল জিজ্ঞেস করাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন আর ভুল শুধরাবার উপায় নেই। ক্যালাস টাইপের একটা হাসি দিয়ে কোন রকমে বললাম

— জাস্ট ফর কিউরিওসিটি।

বলেই বুঝলাম, জাস্ট কমিটেড সেকেন্ড ব্লান্ডার। এবং আমার মাথা ঠিকমত কাজ করছে না। নিজেকে কড়া নির্দেশ দিলাম, 'ইউ স্যুড স্টপ। কথা বললেই, ব্লান্ডার করবে।'

কফি হাউজটা সেলফ সার্ভ টাইপ। তাই বিল দিয়েই কফি এনেছিলাম। সো উঠতে চাইলেই ওঠা যায়। আমার শেষ এক্সকিউজটা শুনে অনন্যা কোন উত্তর দিল না। হয়তো মনে মনে হাসছে।

এরপরে যা করল, তারপরে আর বসে থাকা যায় না। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। এর মানে কি? অর্থাৎ ছদ্মনামটা বলবে না। ওয়েব অ্যাড্রেসটা তো দিতে চেয়েছিল। ওটাও কি দেবে না? কেমন একটা এক্সপেক্টেশান নিয়ে ওর দিকে তাকালাম।

অনন্যা তখন আমার দিকে তাকিয়ে একটা স্মাইল দিয়ে ‘আসি তাহলে?’ বলে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল। অর্থাৎ এন্ড অফ দ্যা স্টোরি।

আমার এখন কি করা উচিৎ? পেছনে পেছনে যাওয়া? না এখান থেকেই ‘বাই' বলা?

ভাববার সময় নেই। দ্রুত এগিয়ে গেলাম। ওর পাশে পাশে হাঁটতে থাকলাম। ওয়েবসাইটের অ্যাড্রেসটা দেয়ার কথা কি ভুলে গেছে?। আবার কি চাইব? দরজার একেবারে কাছে চলে এসেছি।

ও দরজা খোলার আগেই আমি দরজা টেনে খুললাম। অনন্যা আগে বেরোল। এরপরে আমি। টাইম ইজ রানিং আউট। ওর সাথে হয়তো আর কখনো দেখা হবে না।

নিজের অজান্তেই বড় একটা নিঃশ্বাস টেনে নিলাম। বোধহয় এমন অসমাপ্তই থাকবে সম্পর্কটা। মেনে নেয়া ছাড়া উপায় কি?

ফিল করলাম, মনের যে কোণটা মেয়েটার সাথে আলাপ করতে চাইছিল, সে কোণটা এখন ডেসপারেট ফিল করছে, কমিট করেও ওয়েব অ্যাড্রেসটা কেন দেবে না? আলাপ আরেকটু লম্বা করা গেলে হয়তো...

আমার গাড়ীটা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। ঝট করে আইডিয়াটা মাথায় আসল। বললাম

— ড্রপ করে দিই?

মিষ্টি একটা স্মাইল দিয়ে ছোট্ট করে শুধু বলল

— নো থ্যাংকস।

অসহায়ত্বের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি আমি। আর তখনই থার্ড ব্লান্ডার, মতান্তরে প্রথম সঠিক কাজটা করলাম। ঝট করে উঠে দাঁড়ালাম আর অনন্যার চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট উচ্চারণে বললাম

— ওয়েব অ্যাড্রেসটা?

আমার দিকে তাকাল। চোখে দুষ্টুমি? না আমন্ত্রণ ‘ওয়েলকাম টু মাই ওয়েবসাইট'? বুঝতে পারলাম না, কারণ তার আগেই চোখ নামিয়ে ফেলল। পার্সের একটা চেইন খুলে একটা কার্ড বের করল। আমার দিকে এগিয়ে দিল।

যন্ত্র চালিতের মত হাত বাড়িয়ে কার্ডটা নিলাম। আর কিছু বলার সুযোগ পেলাম না। একটা ফাঁকা রিক্সা যাচ্ছিল, সেটাকে হাতের ইশারায় থামিয়ে, উঠে বসে। আর রিক্সা চলতে শুরু করলে আমার দিকে তাকিয়ে সুইট একটা গুডবাই স্মাইল দিল।

যতক্ষণ দৃষ্টির গোচরে ছিল, মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকলাম। চলে যাওয়ার পরে ধীরে ধীরে কার্ডটার দিকে তাকালাম। পুরো কার্ডে একটা মাত্র লাইন লেখা। ইংরেজিতে। টাইপরাইটার ফন্টে লেখা। ডাবলু ডাবলু ডাবলু ডট মিস রসময় গুপ্ত ডট কম।

 

চলবে