অনেক আগে, একটা ছোট রাজ্যে এক বুদ্ধিমান রাজা ছিলেন। তার নাম ছিল রাজা বিজয়। তিনি রাজত্ব করতে খুব ভালোবাসতেন, কিন্তু একটা সমস্যা ছিল—তিনি নিজের রাজ্যের জনগণের সাথে কখনো ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলতেন না। তিনি মনে করতেন, রাজা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা পার্থক্য থাকা উচিত। রাজ্যে শান্তি ছিল, কিন্তু জনগণ রাজাকে খুব একটা ভালোবাসত না। তারা তাকে শুধু একটি দূরবর্তী শাসক হিসেবে জানতো।
একদিন, রাজা মনে করলেন, তার রাজ্য কতটা সুখী এবং শান্তিপূর্ণ, সে সম্পর্কে তিনি একটি পরীক্ষা করবেন। তাই তিনি এক মাসের জন্য নিজের পরিচয় গোপন করে, সাধারণ মানুষ হিসেবে রাজ্যে ঘুরে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
রাজা বিজয় একদিন তার রাজপুরোহিতকে ডেকে বললেন, "আমি কিছুদিন রাজ্যের বাইরে যাচ্ছি। আমার পরিচয় গোপন রাখতে হবে। আমি সাধারণ মানুষের মধ্যে গিয়ে দেখব তারা কীভাবে জীবনযাপন করে, কীভাবে তাদের রাজ্য পরিচালনা হয়। তুমি আমার পলাতক হওয়ার খবর কাউকে বলো না।"
রাজপুরোহিত রাজাকে আশ্বস্ত করল, "হুজুর, আমি কোনো কিছুই প্রকাশ করব না। তবে আপনার উদ্দেশ্য যদি মানুষদের ভালোবাসা পেতে হয়, তাহলে আপনাকে একেবারে সাধারণভাবে চলতে হবে।"
রাজা নিজের রাজার পোশাক বদলে সাধারণ কাপড় পরলেন, মাথায় একটি টুপি এবং হাতে একটা লাঠি নিয়ে বের হয়ে পড়লেন। শহরের বাইরে, এক ছোট্ট গ্রামে এসে তিনি একটি টিনের ঝুপড়িতে বসে গেলেন। গ্রামবাসী তাকে একজন অচেনা পণ্যের বিক্রেতা মনে করল। প্রথম দিন, কেউ তাকে বিশেষ গুরুত্ব দিল না।
কিছুদিন পর, রাজা একদিন বাজারে দাঁড়িয়ে দেখলেন, এক বৃদ্ধা মহিলার সামনে একটি ছোট্ট পিপড়ির ঝাঁক এসে বসেছিল। মহিলাটি খুব অসহায়ভাবে চেষ্টা করছিল পিপড়িগুলোকে তাড়াতে, কিন্তু সব চেষ্টা বিফলে যাচ্ছিল। রাজা ভাবলেন, এই মহিলাকে সাহায্য করা উচিত। তিনি গম্ভীরভাবে এগিয়ে গিয়ে বললেন, "এ Auntie, আপনি কষ্ট পাচ্ছেন, তবে এটা ঠিক হবে না। আমি কিছু পরামর্শ দিতে পারি?"
বৃদ্ধা মহিলাটি তাকিয়ে বললেন, "তুমি কে, পুড়ির বাবাজি? যাও, আমাকে কিচ্ছু বলো না। এসব পিপড়ির ঝাঁক ঠিকই চলে যাবে, আমাকে সাহায্য করতে পারবে না।"
রাজা হাসিমুখে বললেন, "ঠিক আছে, তবে আমি একটা ট্রিক জানি। আপনি পিপড়িগুলোর জন্য কিছু মিষ্টি রেখে দিন। আমি দেখব, কী হয়।"
বৃদ্ধা মহিলার চোখ চমকে গেল। "মিষ্টি? তাতে কি পিপড়ি চলে যাবে?"
রাজা তার লাঠির সাহায্যে মিষ্টির কুচি কয়েকটি পিপড়ির ঝাঁকে রাখলেন। কয়েক সেকেন্ড পরই পিপড়িগুলো মিষ্টির দিকে চলে গেল। বৃদ্ধা মহিলার চোখে বিস্ময়, "ওরে বাবা! তুমি তো সত্যিই জানো!"
রাজা একি সময়ে বললেন, "আপনি যদি তাদের খাবারের পছন্দ ঠিকভাবে জানতে পারেন, তাহলে আপনি তাদের সমস্যার সমাধান করতে পারবেন। সমাজের কাজেও একই রকম। যখন আপনি মানুষের প্রয়োজন বুঝতে পারেন, তখন সব কিছু সহজ হয়ে যায়।"
মহিলাটি বুঝতে পেরে রাজাকে ধন্যবাদ দিলেন। তার পর, রাজা চলে গেলেন আরো দূরে এক গ্রামে, যেখানে একটি ছোট্ট স্কুল ছিল। সেখানে তিনি দেখলেন, একজন শিক্ষক খুব কষ্টে পাঠদান করছেন, কারণ ছাত্ররা শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছিল এবং একে অপরকে খিস্তি দিচ্ছিল।
রাজা খুব শান্তভাবে স্কুলে ঢুকে গিয়ে শিক্ষককে প্রশ্ন করলেন, "আপনি কীভাবে এই শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলা ফেরাবেন?"
শিক্ষক দুঃখিত মনে বললেন, "স্যার, আমি বহুবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছে না।"
রাজা হেসে বললেন, "আপনি ছাত্রদের শৃঙ্খলা নিয়ে চিন্তা না করে, তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ুন। যদি আপনি তাদের বন্ধু হতে পারেন, তাহলে তারা আপনাকে শ্রদ্ধা করবে এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখবে।"
শিক্ষক রাজার পরামর্শ মেনে, ছাত্রদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব গ্রহণ করলেন। পরবর্তী সপ্তাহে, শিক্ষার্থীরা আরো আগ্রহী হয়ে পড়ল এবং শৃঙ্খলা ফিরে এল।
এক মাস পরে, রাজা তার রাজ্যে ফিরে এলেন। কিন্তু সে সময় তার দৃষ্টি ছিল অন্যরকম—এখন তার মনে হয়েছিল, রাজ্য শুধুমাত্র তার শাসনেই নয়, মানুষের মাঝে আন্তরিকতা ও ভালবাসায় শান্তি আসে।
রাজা তার জনগণকে বললেন, "আজ থেকে, আমি শুধু রাজা নই। আমি তোমাদের বন্ধু, তোমাদের সঙ্গী। আর আমরা একসাথে রাজ্যকে সুখী এবং সমৃদ্ধ করব।"
এরপর থেকে, রাজ্যে আনন্দ এবং শান্তি ফিরে এল। রাজা বিজয় তার জনগণের মধ্যে কেবল শাসক হিসেবে নয়, একজন ভালো বন্ধু হিসেবে স্মরণীয় হয়ে রইলেন।