পোস্টস

গল্প

মুচিমিয়ার আকাশভ্রমণ

২৭ মে ২০২৪

F R Sazid

মূল লেখক FR Sazid



ইজ এক'খান ছুডো গপ্প কবো। 
এক গ্রামে এক গরীব মুচি বাস করতো। দিন আনে দিন খায়। একবার সে আকাশে প্লেন উড়তে দেখলো৷ এর আগে অনেকবারই দেখেছে। তয় সেবার কেনো জানি  প্লেন ওড়াটা তার নজরে ইস্পেশাল ভাবে গুতা দিলো। তার মনে সখ জাগলো, সে পেলেনে চড়ে আকাশ থেকে জমিন দেখবে। আর জমিনে দাড়ানো গিন্নিরে পেলেন থেকে উড়ন্ত চুম্মা দিবে। তয় ক্যামনে কি করবে বুইঝছেনা। মুচি চলি গেলো গেরামের ইস্কুলের অংক মাস্টারের কাছে। অংক মাস্টারটা নাকি খুব জ্ঞানী লোক।

:মাস্টোর সাব, আমি পেলেনে চড়বো
:তাই নাকি? 
:হয়। 
:কিন্তু সে তো অনেক টাকার ব্যাপার স্যাপার।
:আমার দ্বারে টাকা আছে। পকেটে ১৩০ টাকা আছে। আর গিন্নির কাছে কিছু টাকা জমাইছি।
:কত?
: এই গড়ে মুল্লুকে ১২০০ টাকা
:এই টাকায় তো হবেনা।
:অহ

মুচি মন খারাপ করে বাড়ি চলে গেলো। বাড়িতে ঢুকেই  সোজা খাটে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়লো।
তার গিন্নি জিজ্ঞেস করলো, 'কিগো? মনডা ভালা নাই? আইজ কি কম টাকা অইসে?'

হঠাৎ মুচি খাট থেকে উঠে গিন্নির ঘাড় পেছন থেকে ধরে নাক-মুখে এক ঘুষি মেরে দিলো।

:অ্যাই আমি কি করসি? আমারে মারো কেনো?
মুচি কোনো কথা শুনলোনা। দুই গালে ধামাধাম চড় মারতে শুরু করলো। একসময় গিন্নি আর সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। মুচি তাও থামলোনা। মাটিতে পড়ে থাকা অজ্ঞান গিন্নিকে পাড়াতে লাগলো।

:কিগো?  কতা বলছোনা কেনো?
:হ্যাহ? কি বলবু?
মুচি এতক্ষন এই সবই কল্পনা করছিলো।  তার সত্যিই ইচ্ছে করছে বউকে এইভাবে এক দফা মাইর দিতে৷ তয় এতো আদরের বউকে সামান্য কটা যৌতুকের টাকার জন্য মারা ঠিক হবেনা। এই ভেবে মুচি তার বাক্স নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে।
: কিগো? দুফুরে না খেইয়েই বেরিয়ে যাচ্চো কেনো?
মুচি কোনো উত্তর না দিয়েই বেরিয়ে গেলো।

:অ্যাই,  জুতা দুইটা একটু পলিশ করে দাও তো।
:জ্বে। দেন
মুচি ভদ্রলোকের জুতা পলিশ করা অবস্থায় আবার আকাশে প্লেনের শব্দ পেয়েই উপরে দৃষ্টি গেলো। মুচি প্লেনের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
:এই মিয়া? পলিশ না কইরা আকাশের দিকে তাকাইয়া হাসো ক্যান? তাত্তাড়ি করো। 
:পলিশ হইয়া গেসে স্যার।
:কত টাকা দেবো?
মুচি বত্রিশ পাটি খুলে বল্লো,"২০ টেকা"
ভদ্রলোক টাকা দিয়ে চলে গেলো।

মুচি গাছের নিচে বসে আছে। আর মনে মনে ভাবছে,
"আমার মানিকরে কত কষ্ট কইরা ইস্কুলে পড়াইতাসি। অয় বড় হইয়া বড় চাকরি করবো। কত্ত ট্যাকা কামাইবো।  তারপর অয়ই তো আমারে পেলেনে চড়াইতে পারবো।
সন্ধ্যা গড়ালো। মুচি বাড়ি ফিরলো।
:গিন্নি তাত্তারি ভাত দাও। ক্ষিদায় প্যাট জ্বলতাসে।

মানিক খাটে বসে অংক করছে।
:মানিক? অই মানিক? 
:আব্বা, কাইলকা  অংক পরিক্ষা। কত্ত অংক বাকি। অহন কথা কইয়ো নাতো।
এই বলেই মানিক আবার অংক কষতে লাগলো।
:মানিক, আমার না পেলেনে চড়ার খুব শখ। তুই যহন বড় হইয়া চাকরি করবি, কত্ত ট্যাকা কামাবি। তহন আমারে পেলেনে চড়াবিতো?
মানিক কোনো উত্তর দিলোনা। তার সব মনোযোগ অংক কষাতেই। 
: অই আহো। ভাত বাড়সি। 
:মানিকে খাইসে?
: অহন তো মাত্র সন্ধ্যা। মানিক আট্টু পরে খাইবো। তুমি খাইয়া শুইয়া পড়ো।

মুচি খাবার শেষ করে শুয়ে পড়লো। গিন্নি পাশে বসে মানিকের খানিকটা ছিড়ে যাওয়া ইস্কুলের শার্টটা শেলাই করছে। আর মানিক মেঝেতে বসে অংক করছে। কোনোরকম এই একরুমের  টিনসেট ঘরেই তাদের বসবাস।

সকাল হলো৷ মানিক রাতে অংক করতে করতে মেঝেতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। উঠে দেখে তার মা তার বাবার পাশে বসে কান্না করছে।
:কান্দো ক্যান? কি অইসে?
তার মা মানিকের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। তারপর মেঝেতে নেমেই মানিককে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
: তোর আব্বায় নাই রে মানিক। তোর আব্বায় চইল্লা গেসে আমগোরে ছাইরা।

মানিক সঙ্গে সঙ্গে খাটে গিয়ে বাবার পাশে বসলো। চেয়ে রইলো বাবার সরল মুখের দিকে। 
দুপুরের মধ্যেই দাফন-কাফনের কাজ শেষ হলো।
সবাই চলে গেলো৷ মানিকের মা ঘরে বসে হাউমাউ করে কান্না করছে৷ গ্রামের লোক, আত্মীয়-স্বজন সবাই তাকে শ্বান্তনা দিচ্ছে। মানিক তার বাবার কবরের পাশে বসে আছে। অংক পরিক্ষা আর দেওয়া হলোনা। সন্ধ্যে গড়ালো। মানিক এখনো তার বাবার কবরের পাশেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে আছে। খানিক্ষন পর আকাশে প্লেনের শব্দ পেলো। মানিকের চোখ গেলো আকাশের দিকে । সে প্লেনের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ তার মনে হলো তার বাবা যেনো কবর থেকে বলছে,"ওই দ্যাখ মানিক আরেক্ষান পেলেন যাচ্চে। তুই আমারে পেলেন চড়ানোর আগেই আমি চলে গেলাম। "
এইমাত্র মানিকের চোখ থেকে গড়গড়িয়ে পানি পড়তে লাগলো। যেনো অন্তরের শক্ত পাথরটা এতক্ষনে ভাঙ্গলো। 

মানিক বড় হলো। তার বাবা মারা যাওয়ার পর অল্প ক'মাস বেচেছিলো তার মা। এক দুরারোগ্য ব্যাধি বাসা বেধেছিলো তার মায়ের শরীরে। এরপর সে তার মামার বাড়িতে থেকেই উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশুনা চালিয়েছিলো। মানিক এখন পেলেন চালায়। মানে পাইলট। আজ তার বাবার মৃত্যু বার্ষিকী। মানিক বসে আছে ককপিটে। একটু পরই বাংলাদেশ টু দোহার দিকে থেকে  যাত্রা শুরু করবে। হঠাৎ তার কানে ভেসে উঠলো,
"তুই যহন বড় হইয়া চাকরি করবি, কত্ত ট্যাকা কামাবি। তহন আমারে পেলেনে চড়াবিতো?"
   
   (সমাপ্ত)

    
#গল্প #সাহিত্য #মুচিমিয়ার_আকাশভ্রমণ