পোস্টস

নন ফিকশন

সংবাদপন্থী অসম্পাদিত ভাবনায় ‘বাংলাদেশ ২.০’

৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ঈয়ন

শুরুতে স্মরণ করছি আবু সাঈদ ও মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের মতো শত শত বীরের আত্মদান, যা বাংলাদেশে পুনর্জাগরণের আশা জাগিয়েছে। এখানকার মানুষকে তারা যেনো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, যে জনপদ হাসতে হাসতে জান দিতে জানা জাগ্রত জনতার; তাঁরে হারাবে সে সাধ্য আছে কার? সাঈদ-মুগ্ধরা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, হাজার বছর ধরে খোদ প্রকৃতি যাদের লড়তে শিখিয়েছে তারা দুর্যোগে ভীত বা বিচলিত নয়, লড়াকু মনটা জাগিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়। বাংলাদেশের মানুষ জানে, বারবার এভাবেই নিজেদের অতিক্রম করেছে তারা। হয়তো একদিন লেখা হবে, একটি মজলুম জনগোষ্ঠীকে কিভাবে নতুন জমানার পথপ্রদর্শক করে তুললেন পরমসত্তা।


৪ এপ্রিল ২০২৪, বাংলাদেশের রাজধানীতে বসে ‘RandomQuestions’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে ফেসবুকে লিখেছিলাম, “যেখানে তারুণ্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলাতে চায় না, বরং রাজনীতি বিমুখতাকে ন্যায্য অবস্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সে সমাজ কি আগাচ্ছে, না কোনো এক গোলকধাঁধায় আটকে আছে?” মাত্র চারমাস পর, ৩ আগস্ট ২০২৪, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণা করছিল তখন পেশাগত কারণে সেখানেই ছিলাম।


২ আগস্ট ২০১৮, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহের সময় বারবার মনে পড়ছিল নবারুণ ভট্টাচার্য রচিত ‘একটা ফুলকির জন্যে’ কবিতাটি। বাসায় ফিরে ‘নবারুণের ইচ্ছেপূরণ’ শিরোনামে লিখেছিলাম “শত কুঁড়ি বারুদগন্ধে মাতাল করে ফুটছে আজ/সারা শহর উথাল পাথাল ভীষন রাগে যুদ্ধ সাজ।“ ছয় বছর পরের শহীদ মিনারের দৃশ্য লেখাটি পুনরায় মনে করিয়ে দিচ্ছিল।


একদিন পরই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থাণে পতন হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামীগ সরকারের। গণরোষের মুখে আকাশ পথে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। যার শাসনামলেই লিখতে হয়েছে, “ক্ষমতান্ধরা সর্বাগ্রে আত্ম-সমালোচনার ক্ষমতা হারায়;” কিংবা ”বলো না আমাকে/—মানুষের চেয়ে/মানুষখেকো কে।” তিনি পালিয়ে যাওয়ার কিছু সময় পরেই নিরাপত্তা বলয়ে ভেঙে তাঁর সরকারি বাসভবনে ঢুকে পড়েছিলেন আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা। সেসব গল্পে যাওয়ার আগে বলে যাই, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ঢাকার দৈনিক প্রথম আলো জানিয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে সারা দেশে মোট ১১১টি হত্যা মামলা হয়েছে।


জুলাই-আগস্টে এই অভ্যুত্থান পর্ব চলাকালে আমাদের, মানে মাঠের সাংবাদিকদের একদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি করেছে, অন্যদিকে পিটিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি বহু সাংবাদিক নিহত বা আহত হয়েছেন। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের আন্দোলন দমনে তৎকালীন সরকারের সহিংস চেষ্টায় পরিস্থিতি সংঘাতপূর্ণ হয়ে ওঠার পর আমরা সবদিক দিয়ে আক্রান্ত হয়েছি; মূলত সাংবাদিক সাহেবদের কারণে। তারা সাংবাদিকতার যে মহান দৃষ্টান্ত তৈয়ার করেছেন, তাতে মার খেতে আর খারাপ লাগছিল না। যেখানে পদে পদে মৃত্যুর হাতছানি, বেঁচে থাকাটাই এক বিশাল বিষ্ময়! এমনটা ভাবতে ভাবতেই বিভিন্ন ঘটনাস্থলে গিয়েছি প্রতিদিন।


২০ জুলাই ২০২৪, অর্থাৎ কারফিউয়ের প্রথম দিন দায়িত্বপালনকালে যখন মিরপুরের কাজীপাড়ায় একদল আন্দোলনকারীদের রোষের শিকার হই, তখন আমার সাথে ছিলেন বাংলা আউটলুকের সাংবাদিক মুক্তাদির রশিদ রোমিও। মাত্র ১৮-১৯ বছর বয়সী যে ছেলেটি আমার হেলমেটের উপর ইট দিয়ে আঘাত করেছিল, তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি একটুও রাগ করতে পারিনি। কারণ আমি সেই দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারছিলাম সে কোনো ব্যক্তিকে না, সাংবাদিক সমাজকে আঘাত করতে চাচ্ছে। তাঁর জিজ্ঞাসা ছিল, “আমার ভাইকে যে কাল এখানে গুলি করে মারা হয়েছে, সেই খবর কোথাও আসেনি কেন। তখন তোরা কই ছিলি?” পরে অন্য আন্দোলনকারীরাই তাকে নিবৃত্ত করে। আমাদের প্রস্থানের সুযোগ করে দেয়।


সাংবাদিকতার জন্য বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে নিগৃহীত হয়েছি, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও। বাংলাদেশে সাংবাদিকদের সবাই মারে, মারবে। তবে শুধু 'মাইরের ভয়ে' নয়, বিবিধ লোভেও অনেক গণমাধ্যমকর্মী নিপাট গণসংযোগকর্মীতে পরিণত হয়। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের এবারের সন্ধিক্ষণে বিষয়গুলো বেশ খোলামেলা হয়ে গেছে। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের ভিডিও জার্নালিস্ট পুলিশকে ছাত্রদের গুলি করতে বলছে, এমন ভিডিও নেটদুনিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পর বহু পুরানো প্রশ্ন বারবার উঁকি দিয়েছে মনে। শিক্ষক বা সাংবাদিক হিসেবে চাকরি রক্ষার সাথে প্রকৃত শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতার যে দূরত্ব তাকে কী বলা যায়? স্তুতিজীবীতার সাথে বুদ্ধিজীবীদের দুরত্ব নির্ণয় এবং তা পরিমাপের সক্ষমতা থাকা সাংবাদিকদের জন্য কতটা জরুরী বলে মনে করেন? বাংলাদেশের আর কোনো পেশাজীবীদের সাংবাদিকদের চেয়ে বেশি আত্মসমালোচনা করতে দেখেছেন কি?


আন্দোলনের শুরুর দিকে অনুজ সাংবাদিকদের প্রতি কিছু কথা বলে রাখা জরুরী মনে করেছিলাম। সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছিলাম—


মনে রাখবেন, বাংলাদেশি সাংবাদিক হলে অবশ্যই একপক্ষ আপনাকে বিএনপি-জামায়াত ভাববে, অন্যপক্ষ আওয়ামী লীগ বা বাম। তাদের এমন ভাবনা গড়ে দিয়েছে আপনার-আমারই অগ্রজগণের কর্মকাণ্ড। এই দৃষ্টিভঙ্গী সহসা বদলানোর কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। এটা লজ্জা ও হতাশার। তবুও ঘাবড়ানোর কিছু নেই। ঠিকঠাকভাবে চাইলে আপনি এর মধ্যেও নির্দলীয় সাংবাদিকতা করতে পারবেন। মানে দলবাজ না হয়ে শুধু সংবাদের ন্যায্যতার পক্ষে থেকেও আপনি এই পেশায় টিকে থাকতে পারবেন। সমকালীন বাস্তবতায় নিঃসন্দেহে এটা ঝুঁকিপূর্ন এবং কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। এক্ষেত্রে আপনার করা বহু খবর গুম হবে, হারিয়ে যেতে পারেন আপনিও। তবু নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিক হতে চাইলে কেউ আপনাকে নিজেদের লোক মনে করা শুরু করলেই নিজেকে সন্দেহ করুন।


৩ মে ২০২১, মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের কিছু ভাবনাও পুনরায় শেয়ার করেছিলাম ফেসবুকে। যেখানে বলেছিলাম — আধুনিক 'জার্নালিস্ট' মাত্রই পেশাদার 'অ্যাক্টিভিস্ট'। শুরু থেকেই তথ্য ও মতপ্রকাশের পক্ষে সোচ্চার থাকা বা নিদেন পক্ষে সত্য প্রচারজনিত পীড়নের প্রতিবাদ করার মতো 'অ্যাক্টিভিজম'-টুকু অন্তত এই পেশার মানুষকে জারি রাখতে হয়েছে, আগামীতেও হবে। প্রতিটি সংবাদকর্মীই স্বাধীনভাবে তথ্য সংগ্রহ ও তা প্রচারের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে যাচ্ছেন। তবে তাদের কারো সক্রিয়তা যদি বস্তুনিষ্ঠতার বদলে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যের প্রতি দায়বদ্ধ হয়, ওই মুহুর্তের জন্য সে অন্তত সাংবাদিক নয়।


‘সম্ভব না’—কে ‘সম্ভাবনা’—তে রূপান্তরের সামাজিক প্রক্রিয়াই—তো বিপ্লব; নাকি? ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে এখনো দীর্ঘমেয়াদী বিপ্লবের সূচনা বলেই মনে হচ্ছে। হয়তো আজ থেকে একশ বছর পরের মানুষ এই সময়টাকে আরো ভালোভাবে বিশ্লেষণ করতে পারবেন। আমাদের জন্য পট পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে সহিংস অস্থিরতা নতুন কিছু নয়। বরং সেটা এখানকার রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটা অংশ হয়ে গেছে। দখল, পুনর্দখল, লুটপাট শুরু না হওয়া অবধি হয়তো ক্ষমতার পালা বদল হয়েছে তা বিশ্বাসই করতে পারেনা এই জনপদ। এমন পরিস্থিতিতে কেউ ঝুঁকিমুক্ত নয়। তবে এই মুহুর্তে সাংবাদিকতায় যে ক্রমাগত ঝুঁকি বাড়ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর প্রতিটি বিপ্লবে শুধু প্রতিবিপ্লব নয়, থাকে বেহাত বিপ্লবের শঙ্কাও। তবু বিপ্লবীদের কাছে সাধারণের প্রত্যাশা একটু বেশিই থাকে বোধকরি। যে কারণে পান থেকে চুন খসলেও আঁতকে উঠি। জানেনই তো, আমরা বাংলাদেশি সাংবাদিক ঘরপোড়া গরু; সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই।


সাংবাদিকরা কখন প্রশ্ন করবেন বা কোথায় চিত্রগ্রহন তা নির্ধারণের মাধ্যমে সাংবাদিকতা নিয়ন্ত্রণ করে কি বৈষম্যবিরোধী সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব? ১৫ আগস্ট ২০২৪, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে যেভাবে মাইকে ঘোষণা করে সাংবাদিকদের চিত্রগ্রহণ বন্ধ করতে বলা হলো, সেটাও নতুন কিছু নয়। ৪ আগস্ট মিরপুরে ছাত্র-জনতাকে হামলার সময় ঠিক একইভাবে মাইকে ঘোষণা দিয়ে সাংবাদিকদের বাধা দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। বিগত আমলের বহু আন্দোলন দমনের ঘটনায় এমন প্রতিবন্ধকতা পেরিয়েই আমরা কাজ করেছি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ, কিংবা তারও আগে বিএনপি সরকারের আমলে যে শঙ্কা নিয়ে আমরা মাঠের সাংবাদিকরা কাজ করেছি, এখনো যদি একই ভয়ে আমাদের সিঁটিয়ে থাকতে হয়, তবে কী এই বিপ্লব প্রশ্নবিদ্ধ হবে না?


পরে অবশ্য ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে তারা এটা জানেন যে, নেতিবাচকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কালে নিজেদের নেতিবাচক হয়ে ওঠা ঠেকানোর যুদ্ধ জারি রাখা সবচেয়ে জরুরি। কারণ বদলে দেওয়া আর বদলা নেওয়া এক নয়। জান দিতে জানা অকুতোভয় একটি প্রজন্ম বাংলার আপামরের মনে নৃশংসতার ভয় বাড়াবে, নাকি তারা জিঘাংসার সংস্কৃতির অবসান ঘটাবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। ব্যক্তিগতভাবে টানা এতোগুলো দিন এরকম বৈরী পরিবেশে কাজ করিনি কখনো। জুলাইয়ের মাসের মাঝামাঝি থেকে প্রায় প্রতিদিন সংবাদ সংগ্রহে বের হওয়ার সময় মনে হয়েছে, আর ফেরা না'ও হতে পারে। ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ একেকটি দিন কাটাতে হয়েছে মাঠের সব সাংবাদিককে। পুরো দেশ একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল।


আন্দোলনের তুমুল সহিংস দিনগুলোতে সিনিয়র সহকর্মী কামরান রেজা চৌধুরী ও আমি প্রায় সারাক্ষণ একসাথে ছিলাম। আমরা বেশিরভাগ সময় তাঁর হলুদ ভেসপা ঘোরাঘুরি করতাম। শেখ হাসিনার পালানোর পর যখন লোকজন গণভবনে ছুটে আসছে, আমরা দুজনে তখন ভেসপাটি সেই সরকারি বাসভবনের গেটে রেখে ভেতরে প্রবেশ করি। প্রায় দুই ঘন্টা পর, আমরা যখন সংসদ ভবনে যাওয়ার জন্য সেখান থেকে বের হলাম, ভেসপাটি কোথাও ছিল না। কিন্তু তাকিয়ে দেখি কামরান ভাইয়ের ভেসপা হারানো নিয়ে কোনো আফসোস নেই। তিনি এই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হতে পেরে খুবই উত্তেজিত ছিলেন, নিশ্চয়ই আমিও।


যাদের আমরা আওয়ামী লীগের প্রথাগত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বলে চিনি, যেমন- বিএনপি-জামায়াত, তাদের নৈতিকভিত্তি শক্ত হলে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত দলটি এভাবে স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারতো না। নিঃসন্দেহে বিরোধী নেতাকর্মীরা লীগের ভয়াবহ পীড়নের শিকার হয়েছেন। তবুও তাদের প্রতিরোধ কখনো কেন জনতার প্রতিরোধে রূপান্তরিত হয়নি, সেটা তাদের ভাবা উচিত। কেন তারা জনতার ভাষায় প্রতিবাদ করতে পারেনি? এবারও ছাত্র-জনতার অর্জনকে কিভাবে দখল, লুটপাট আর জিঘাংসার উপলক্ষ বানিয়ে তারা শেখ হাসিনার পতন উদযাপন করছে সেটাও প্রত্যক্ষ করলাম। আন্দোলনকারীরা সর্বত্র তাদের নৈরাজ্য রুখে দিতে আপ্রাণ চেষ্টায় ছিলেন। আক্রান্তও হয়েছেন শিক্ষার্থীরা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছিল, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কেন কঠিন তা এভাবে, মানে এতোটা বুঝিনি আগে। একদিকে আশা জাগাচ্ছে নতুন প্রজন্ম, অন্যদিকে আতঙ্কে ভোগাচ্ছেন বুড়োরা। সারাক্ষণ "আমি, আমি" না করে কিভাবে "আমরা" হয়ে কাজ করতে হয়, তা দেখিয়েছেন নতুনরা। রাস্তা, ফুটপাত শুধু নয়, আইল্যান্ডের মধ্যে জমে থাকা ময়লাও পরিস্কার করে ফেলেছিলেন। তাদের কর্মকাণ্ড দেখে ভাবছিলাম, এবার যদি আমাদের মনটা একটু পরিস্কার হয়।


বিএনপি-জামায়াতের নৈরাজ্য ও জঙ্গিবাদ ঠেকানোর কথা বলে যে অসভ্যতার চর্চা শুরু হয়েছিল, নতুন বাংলাদেশে যদি আওয়ামী লীগের প্রতিবিপ্লব ঠেকানোর জন্য সেটাই অব্যাহত রাখা হয়, তখন পরিবর্তনটা আসবে কিভাবে? ‘জিঘাংসা’ ও ‘প্রতিহিংসা’ যদি ‘ক্ষমা’ ও ‘সহনশীলতা’ দ্বারা প্রতিহত করা না যায় তবে যারাই জিতুক, মনুষ্যত্ব হেরে যাবে। ছাত্র-জনতার বিনয়ের সামনে মাথানত করুক রাজনৈতিক প্রতিশোধস্পৃহা; হয়তো এটুকুই ব্যক্তিগত প্রত্যাশা। কারণ এটা কে না জানে, সহিংসতা কখনোই ইতিবাচক কিছু বয়ে আনে না। নেতিবাচকতা উৎপাদনই নৃশংসতার ধর্ম। যদিও আমরা জানি, কিছু লোক এমনই অন্ধ/কখনো বোঝেনি তাদের/চোখগুলো আসলে বন্ধ। তাদের কানে কানে বলতে ইচ্ছে করে, নাটক কম কইরো পিও/দুধে ধোঁয়া তুলশীর বনে/ভাজা মাছ উল্টায়া নিও।


সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যখন লেখাটি শেষ করার কথা ভাবছি, ততোদিনে বহু ঘটনা ঘটে গেছে। আসলে দারুণ ঘটনাবহুল একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এমন হাজারটা ঘটনা সামনে এসেছে যা আওয়ামী লীগ আমলে চেপে রেখেছিলেন খোদ ভুক্তভোগীরাও। যা অনেক কিছু নিয়েই নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। এরইমধ্যে গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। বেরিয়ে আসতে শুরু করেছেন সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার গোপন কারাগারের বন্দীরাও। আওয়ামী লীগ আমলে যারা হারিয়ে যাওয়া সবাই ফেরেননি। যেমন আমার শৈশবের বন্ধু কালু, মানে বরিশালের ছাত্রদল নেতা ফিরোজ খান ও তাঁর ভাই মিরাজ খান। ২০১২ সালের কথা। কী এক অনুষ্ঠান উপলক্ষে ঢাকা এসে ফোন করেছিল কালু। প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকায় দেখা করার সুযোগ পাইনি। বরিশালে ফেরার আগে আবারো ফোন করে আমার ব্যস্ততা নিয়ে মৃদু ভর্ৎসনাও করেছিল। সে ভর্ৎসনা তখন গায়ে লাগেনি, কিন্তু সে লাপাত্তা হওয়ার মনে লেগেছে খুউব। কারণ সমাজ তাকে যতো বড় সন্ত্রাসী আখ্যা দিক, যতো ইচ্ছে বদমাশ বলুক, আমার মতো অনেকের কাছেই সে ছোট্ট বেলার 'কালু' হয়েই থেকেছে আজীবন। আমার আরেক বাল্যবন্ধু, রফিকুল ইসলাম টিপু। সে-ও ছাত্রদল নেতা, যার ভাই রাফসান আহম্মেদ জিতুকে হত্যার অভিযোগ ছিল কালু-মিরাজের বিরুদ্ধে। তাদের প্রস্থান কিন্তু আজও তাদের স্রষ্টাদের ভীত কাঁপাতে পারেনি। আজও বহাল তবিয়তেই রয়ে গেছেন চন্দ্রদ্বীপের সেই সমাজপতিরা।


ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, এই সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার একমাস হতে যাচ্ছে। নতুন এই রাজনৈতিক পটভূমিতে দাঁড়িয়ে রোহিঙ্গা সঙ্কটসহ ভূরাজনৈতিক নানা গণিত, জঙ্গি উত্থানের শঙ্কা, পুলিশের বেগতিক হাল, সংবিধানসহ বহু বিষয় নিয়ে আলাদাভাবে লেখার প্রত্যাশা রাখি। এটা অনুভব করতে পারছি যে সময়টা কথা বলার জন্য দারুণ। বিশেষ করে সেই গল্পগুলো এখন সামনে আসা বেশি জরুরি মনে হচ্ছে, যেগুলো বিগত সরকারের কারণে সামনে আনতে পারিনি। কোথা থেকে যে শুরু করবো তা নিয়েই দ্বিধাগ্রস্থ আছি। এতো ঘটনার মধ্যে দিয়ে গিয়েছি যে, একটি মনে পড়তেই আরেকটি মনে পড়ে যাচ্ছে। বিডিআর গণহত্যা, শাপলা চত্ত্বর, লেখক-ব্লগার হত্যা এবং জঙ্গিবাদ ও ইসলামোফোবিয়ার উত্থানের মতো ঘটনাগুলোও ফিরে দেখা দরকার। ব্যক্তিগত পরিসরেও কত অজস্র অভিজ্ঞতা জমেছে এই সময়টাতে। জানতাম, বেঁচে থাকলে কখনো লেখা হবে। যেভাবে বিএনপি-জামায়াত আমলে চেপে যাওয়া অনেক ঘটনা আওয়ামী লীগ আমলে লিখেছিলাম। অর্থাৎ সেলফ-সেন্সরশিপের প্রাকটিস ২০ বছর আগেও করতে হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের এই সময়কালে তা যে মাত্রা পৌঁছেছিল; তাতে বলা যায়- কথা না বলতে বলতে বলার ভাষা হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে অনেকের। অন্তত নিজের এমনটা হয়েছে বলে অনুভব করি।


বিদেশি গণমাধ্যমে কাজ শুরু করার পর থেকে আমার ‘অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড’ হালনাগাদের আবেদন মঞ্জুর করেনি তথ্য অধিদফতর। মোট তিনবার আবেদন করেছিলাম। সহায়তা চেয়েছিলাম আওয়ামীপন্থী সিনিয়র সাংবাদিকদের। খেয়াল করে দেখেছি, তারা ক্ষেত্র বিশেষে বিএনপিপন্থী সাংবাদিকদের সহায়তা করলেও সংবাদপন্থীদের সেভাবে সাহায্য করেন না। অর্থাৎ ঢাকাই গণমাধ্যমের দুনিয়ায় সাংবাদিকতার পরিচয় নিয়ে যারা রাজনীতিতে ব্যস্ত থাকেন না; মানে শুধু সংবাদের মধ্যে থাকেন, তাদের পথ বরাবরই বন্ধুর। যে কারণে বিগত ছয় বছর ধরে সচিবালয়সহ বিভিন্ন সরকারি অফিসে ‘দর্শনার্থী পাস’ ব্যবহার নিয়ে ঢুকতে হচ্ছে আমাকে। এক্ষেত্রে অবশ্য লাভই হয়েছে। পথেঘাটে বেশি থাকার সুযোগ তৈরি হয়েছে। যেটা আমি এখন বেশ উপভোগও করছি। তবে হ্যাঁ, এটা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, বিগত সরকারের আমলে সাংবাদিক হিসেবে আমার ‘অ্যাক্সেস’ কমেছে। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, একাধিক সরকারি সংস্থার গণসংযোগ বিভাগের তালিকা থেকে আমার নাম কাটিয়েছেন আমার কোনো সাংবাদিক ভাই বা বোন। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি বা গোয়েন্দা সংস্থার চেয়েও বেশি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন নিজেদের মাথা বেঁচে দেওয়া গণমাধ্যম মালিক-সম্পাদক বা সহযোদ্ধারা। যারা কয়েক যুগ ধরে চলমান পার্টিজান জার্নালিজমের ফসল। যাদের কারণে বাংলাদেশে আজ সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার এই হাল। 

 

চিন্তা করুন, একটি দেশের সাংবাদিক ইউনিয়ন, সেটাও কয়েকদশক ধরে রাজনৈতিক মতাদর্শের আলোকে দুইভাগে বিভক্ত। এর মধ্যে দাঁড়িয়েও প্রচুর সাংবাদিক অন্য কিছু নয়, স্রেফ সাংবাদিকতাটাই করছে। বর্তমানে কোনো সাংবাদিক চাইলে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের সংগ্রহ করা তথ্য ও মতামত প্রকাশ করতে পারেন। যদিও আমরা জানি, প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সময় সম্পাদকীয় নীতির সাথে সাংঘর্ষিক, বা আরো খোলামেলাভাবে বললে মালিকের স্বার্থের বাইরে কিছু করা কোনো সাংবাদিকের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তিনি চাইলেই কোনো তথ্য নিজের সোস্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করতে পারেন না। এমনটা করে চাকরি হারানোর ঘটনা দেশে-বিদেশে প্রচুর ঘটেছে ইতিমধ্যে। তবে স্বাধীনভাবে তথ্য প্রকাশের জন্য যে কেউ সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করার অধিকার রাখেন। শুধু এটা মাথায় রাখতে হবে, “স্বতঃস্ফূর্ত সাংবাদিকতা সতত মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়। পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের প্রত্যেক সহজাত সাংবাদিক নেহাতই আত্মঘাতী কীট।”


সলিড নিউজে আবার মানুষের আগ্রহ কম। তারাও ক্লিকবেইট কন্টেন্টেই ক্লিক করে। সেটা অন্য আলাপ। তবে এবারের আন্দোলনের ঘটনাবলীর মধ্যে থেকে মনে হয়েছে, গণমাধ্যমের মালিকদের উপর যে রাগটা করা উচিত, সেটাই মানুষ মাঠের সাংবাদিকদের উপরে করে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারকে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেননি, শুধু তেল দিয়েছেন, বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। যদিও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনগুলো সেই ধারণা পয়দা করেছে জনমনে। অথচ আমরা প্রশ্ন করতাম। যেসব প্রশ্নোত্তর প্রচারিত হতো না। বরং প্রশ্ন করার জন্য সাংবাদিকের চাকরি চলে যাওয়ার কমপক্ষে একডজন ঘটনা আমিই বলতে পারবো। আবার অনেকে আমার মতো অ্যাক্সেস হারিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম আমলেই বুঝে গিয়েছিলাম, তারা ক্ষমতায় থাকাকালে সাংবাদিকতা করাটা খুব সহজ হবে না। ৩১ জুলাই ২০১১, আমার সাংবাদিকতার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। সেদির প্রথমবারের মতো নিজের সম্পাদককে পুলিশের গারদে রিমান্ডের অপেক্ষায় রেখে এসেছিলাম। আমার তৎকালীন কর্মস্থল শীর্ষ নিউজ ডটকম ও সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজ সম্পাদক মো. একরামুল হককে একটি চাঁদাবাজি মামলায় রিমান্ডে নেয়ার অনুমতি দিয়েছিল ঢাকার আদালত। ঘটনার ধারাবাহিকতায় কিছুদিন পর প্রতিষ্ঠান দুটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।


গণতান্ত্রিক থেকে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার পরিণতি কী হয় তা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ মৃত্যুভয় তোয়াক্কা না করা এই প্রজন্মকে। এখনো দেশে বা দেশের বাইরে বসে আপনারা যারা চিন্তা প্রকাশের সীমা রেখা টেনে দিতে চাইছেন, তারা একটু ভেবে দেখবেন, আপনারা কেন এমন করছেন? সবাইকে কেন আপনার মতো করেই ভাবতে হবে? মনে রাখবেন, সবাই এক গোয়ালের গরু নয়। কখনো জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য ছিলেন না, এখন বা আগামীতেও হবেন না, এমন অনেকে ঢাকায় সাংবাদিকতা করেছেন, করেন এবং করবেন। আবার কেউ কেউ একটি সদস্য পদের জন্য মরিয়া হয়ে উঠবেন। আপনি এমন অনেক বাংলাদেশি দেখবেন, যারা মুক্তিযুদ্ধ বাণিজ্য এবং মুক্তিযুদ্ধের অপমান, কোনোটাই সমর্থন করে না। তাদের মতে, এই বাণিজ্য একাত্তরের চেতনাবিরোধী, আর অপমানটা স্রেফ গাদ্দারি। যারা নতুন বাংলাদেশের হাল ধরেছেন তারা এই বিষয়গুলো মাথায় রেখেই আগাচ্ছেন বলে বিশ্বাস করি। আশাকরি, বাংলাদেশকে দারুণ একটি আগামী উপহার দেবেন তারা। সেনাসমর্থিত বিপ্লবী ছাত্র-জনতার এই সরকারের কাছে এই মুহুর্তে আমাদের প্রধান চাওয়া, ‘মব জাস্টিস’ বন্ধ করা। 

 

৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, খুলনায় দুজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে বলে খবর এসেছে গণমাধ্যমে। যার মধ্যে একজন হিন্দু কলেজ ছাত্র। মুসলিমদের মহানবীকে কটূক্তির অভিযোগ তোলা হয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে। নিরাপত্তা বাহিনীর সামনেই তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। খবরে প্রকাশ, অপরজনকে হত্যা করা হয়েছে চোর সন্দেহে। এই পরিস্থিতির অবসান না হওয়া অবধি, তথ্য ও মতপ্রকাশের ভীতি কাটবে না আসলে। নতুনভাবে স্বাধীন হওয়ার স্বাদটা সাংবাদিকরা অন্তত পুরোপুরি পাবেন না। বাংলাদেশ ২.০—তে দাঁড়িয়ে সবার কাছে আরেকটি অনুরোধ, কারো টেক্সট ও ভিজুয়াল কন্টেন্ট তাঁর পারমিশন বা ক্রেডিট ছাড়া পুনঃপ্রকাশ করে নিজেকে ছোট করবেন না।