রবীন্দ্রনাথের দুঃশ্চিন্তা দূর করার জন্য বিজ্ঞান আছে। বিজ্ঞানে সত্য উদ্ঘাটনের সুযোগ অবারিত। কার্বন ডটিংয়ের মাধ্যমে যেমন ঐতিহাসিক সত্য প্রতিষ্ঠা করা যায় আবার ডিএনএ পরীক্ষার সাহায্যে উদ্ধার করা যায় বংশ পরিচয় ও যাচাই করা যায় অনেক বিতর্কিত বিষয়। বিজ্ঞানে বিতর্কের সুযোগ আছে। আছে ভুলকে সংশোধনের স্বাধীনতা। এটি ধর্মের কথা নয় যে ঘাড় নুয়ে বিশ্বাস করতে হবে। এখানে সত্যাসত্য যাচাইয়ের নিক্তি আছে। আছে কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেবার নিরন্তর প্রচেষ্টা।
তাই আজ থেকে প্রায় শতবর্ষ আগে আইনস্টাইনও বোরের মাঝে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নান্দনিকতা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। যা পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে কোপেনহেগেন বিতর্ক নামে সমাধিক পরিচিত। বিজ্ঞানীদের মাঝে পক্ষ-বিপক্ষ হয়েছিল। কিন্তু কেউ কাউকে রামদা নিয়ে কোপাতে আসেনি। যুগেযুগে গ্রহণও বর্জনের মাধ্যমে বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। কোপেনহেগেন বিতর্কের অবসান ঘটাতে দৃশ্যপটে এসেছিলেন বেল। অসম্পূর্ণ রেখে তিনিও বিদায় নিয়েছেন। এসেছেন আরো অনেকে
পারেনি সব সুক্ষাতিসুক্ষ ছিদ্র বন্ধ করে সফল পরীক্ষার মাধ্যমে সত্য উদঘাটন করতে। ২০১৬-তে কি শতবর্ষী কোপেনহেগেন বিতর্কের যবনিকা হচ্ছে? তবে বিধাতা কি জুয়া খেলেন? হয়তবা।নতুবা, আইনস্টাইনের ভৌতিক ক্রিয়া না হয়ে কোয়ান্টাম এনটাঙ্গেলমেন্ট (বিজড়ায়ণ) কেন বাস্তব হতে যাচ্ছে।
পদার্থবিজ্ঞানে প্যারডক্স অতি সুপরিচিত একটি বিষয়। যেমনঃ টোয়াইন প্যারাডক্স, বাগ-রিবেট প্যারাডক্স, শ্রোয়েডিঞ্জার ক্যাট প্যারাডক্স ইত্যাদি। তেমনি একটি প্যারাডক্স হলঃ আইনস্টাইন-পোডলস্কি-রোজেন প্যারাডক্স বা ইপিআর প্যারাডক্স। ১৯৩৫-সালে এই ত্রয়ী কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সম্পূর্ণতার নান্দনিক ব্যাখ্যা দিতে একটি বিখ্যাত নিবন্ধ লেখেন তারা বিজড়িত বস্তুদ্বয়ের একটি যদি অপরটি থেকে দূরে অবস্থিত হয় তবে একটির পরীক্ষণ অন্যটিকে প্রভাবিত করতে পারে এ ধারণাকে বাতিল করে দিয়ে বস্তুর স্থানীয় বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ১৯৬৪-সালে দৃশ্যপটে বেলের আগমণের পূর্বে বিজ্ঞানীরা তেমনই বিশ্বাস করতেন। তবে তখনও বিতর্ক চলছিল। বেল স্থানীয় বাস্তবতাকে স্টান্ডার্ড কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিরুদ্ধে বলে ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন।যা বেলের অসমতা নামে পরিচিত। বেলের ভবিষ্যত বাণী বা আইনস্টাইনের ধারণা কোনটি সঠিক এনিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা কোন সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে নি। সম্ভবত প্রথম প্রফেসর আলেইন আসপেক্টের পরীক্ষণ আইনস্টাইনের স্থানীয় বাস্তবতার ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছে।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিকাশে আইনস্টাইনের ভূমিকা অপরিসীম। তিনিই সর্বপ্রথম শক্তির কোয়ান্টাইজেশন সফলভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনিই প্রথম আলোর দ্বিচারিতা সফলভাবে ব্যাখ্যা করেন। অথচ তিনি নীলস বোরের কোয়ান্টাম থিওরী (কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা) নিয়ে খুবই অসন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি মনে করতেন হাইসেনবার্গের অনিশ্চয়তার সূত্র অসম্পূর্ণ। বোর আইনস্টাইনের সব আপত্তির সফল নিষ্পত্তির চেষ্টা করেছিলেন। আইনস্টাইন মনে করতেন বিজড়িত বস্তুদ্বয়ের মাঝে আন্তঃসম্পর্ক বজায় থাকবে কেবল
এবং কেবল যদি তথ্য আলোর গতির চেয়ে বেশী গতিতে প্রবাহিত হতে পারে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। তাহলে কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা সঠিক হতে পারেনা। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উৎকর্ষে যাঁর অবধান অপরিসীম তিনি কিনাকোয়ান্টাম মেকানিক্সকে অসম্পূর্ণ ভাবতেন। যেহেতু কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনেক কিছুর সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে তাই বিজ্ঞানীদের অনেকে বোর ও আইনস্টাইনের বিতর্কে মনঃযোগ দেয় নি।
এই বিতর্ক তখনই বিজ্ঞানীদের আকর্ষণ করেছে যখন বেলের পরীক্ষণের ফলাফল আইনস্টাইনের ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক হল। কিন্তু বেল তার পরীক্ষণে লুকায়িত চলকের সন্ধান করে বিজড়িত বস্তুদ্বয়ের আচরণের সফল ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হন। প্রায় একই সময়ে অর্থাৎ ২০১৫-এর শেষ দিকে ভিয়েনা, এনআইএসটি ও ডাচ বিজ্ঞানীদের একটি দল ভিন্নভিন্নভাবে সফল পরীক্ষা করে আইনস্টাইনের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেন এক্ষেত্রে প্রায় শত বছর ধরে পদার্থবিজ্ঞানীরা নিরন্তর চেষ্টা করছে কোয়ান্টাম বিজড়ায়াণ ব্যাখ্যা করার যা চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রকে পরাভূত করে। সাব-এটোমিক বস্তুকণার ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম বিজড়ায়াণ ঘটতে পারে।
আর ইলেকট্রন হল তেমন একটি সাব-এটোমিক বস্তুকণা। ইলেকট্রন চুম্বকীয় ধর্ম হল স্পিন যা ঘূর্ণনের ফলে সৃষ্ট হয়। এ স্পিন উর্ধমূখী না নিম্নমূখী তা নিশ্চিত করে বলা যায় না ততক্ষণ পর্যন্ত না তাদেরকে পরীক্ষণের মাধ্যমে দেখা হয় কয়েন টসে যেমন হেড বা টেলের বিষয়টি অনিশ্চিত, যতক্ষণ পর্যন্ত না তালুবন্ধ করে দেখা হয়। প্রফেসর রোনাল্ড হেনসন বলেন, “দু’টি ইলেক্ট্রনের বিজড়িত হবার ঘটনা খুবই কৌতুহল উদ্দীপক।বিজড়িত ইলেক্ট্রনদ্বয়ের স্পিন একই সময়ে উর্ধ ও নিম্নমুখী হতে পারে কিন্তু যখন এদেরকে পরীক্ষণের মাধ্যমে দেখা হয় তখন একটি্র স্পিন উর্ধমুখী হলে অন্যটির নিম্নমুখী হবে।
সুতারাং তারা যথাযথভাবে সম্পর্কিত।” এ প্রভাব তাৎক্ষণিক, এমনকি একটি ইলেকট্রন রকেটে ও অন্যটি কোন এক গ্ল্যাক্সিতে থাকলেও এটি ঘটা সম্ভব। অন্যসব সাব-এটোমিক বস্তুকণাসমূহ একইভাবে বিজড়িত হবে।
ডাচ বিজ্ঞানীরা দু’টি বিজড়িত ইলেকট্রনকে ১ কিলোমিটারের চেয়ে অধিক দূরত্বে রেখে সফলতার সাথে পরীক্ষণ সম্পন্ন করেন। পরীক্ষা লব্ধ ফলাফল থেকে এরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, “কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানে বিজড়িত বস্তুদ্বয়দূরত্ব যা হোক না কেন তারা পরস্পর সম্পর্কিত।বস্তুদ্বয়ের একটির যে কোন ধরনের পরিবর্তন তাৎক্ষণিকভাবে অন্যটির আচরণে পরিবর্তন ঘটাবে। এমনটি ঘটার জন্যবস্তুদ্বয়ে মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের গতি আলোর গতির চেয়ে বেশী হবার দরকার নেই।”
আরো মজার বিষয় হলঃ অতিসম্প্রতি অষ্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির কোয়ান্টাম ডাইনামিকস সেন্টারের একদল বিজ্ঞানী ফোটন নামক অপর একটি সাব-এটমিক বস্তুকণাকে বিভাজিত করে দেখান যে একক বস্তকণার ক্ষেত্রেও কোয়ান্টাম বিজড়ায়ণ সম্ভব।তারা একটি ফোটনকে দু’টি ল্যাবে বিভাজিত করে হোমোডাইনামিক ডিটেক্টরের সাহায্যে পরীক্ষা করে দেখান যে, বিভাজিত অংশ দু’টির একটির স্থানীয় অবস্থার পরিবর্তনে অন্যটির অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। কোয়ান্টাম বিজড়ায়াণ শুধু দু’টি সাব-এটমিক বস্তুকণার ক্ষেত্রে নয় একটি বস্তুকণার দু’টি বিভাজিত অংশের মাঝে ঘটতে পারে।
দীর্ঘদিন ধরে চলামান এ সমস্যার সমাধান হয়ত সধারণের মাঝে আলোড়ন তুলেনি। কিন্তু এটি অবধারিত যে কোয়ান্টাম বিজড়ায়াণ সত্য হতে যাচ্ছে। কোয়ান্টাম ইনফরমেশন ও কমিউনিকেশন টেকনোলজিতে ঘটতে যাচ্ছে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন।যা মানব সভ্যাতাকে নিঃসন্দেহে একধাপ এগিয়ে নেবে। যুগান্তকারী আবিষ্কারের ফলশ্রুতিতে যেসব জাগতিক পরিবর্তন সাধিত হবে তা হলঃ সুক্ষাতিসূক্ষ ঘড়ি, অলঙ্ঘনীয় পাসওয়ার্ড, সুপার কম্পিউটার, অত্যাধুনিক মাইক্রোফোন ও বায়োকম্পাস।এ আবিষ্কার দ্বার উম্মোচন করবে কোয়ান্টাম লজিক ঘড়ির, যা ৩.৭ বিলিয়ন বছরে মাত্র ১ সেকেন্ড সময় হারাবে। এ ঘড়ি জিপিএস নেভিগেশন, টেলিযোগাযোগ ও জরিপ কাছে ব্যবহার করা যাবে। অলঙ্ঘনীয় পাসওয়ার্ডঃ যাকে কোয়ান্টাম চাবি বলা যায়।কোন তথ্য আদান-প্রদানে, ব্যাংকে অর্থের লেনদেনে সিকিউরিটি কোর্ড হিসাবে এ কোয়ান্টাম চাবি ব্যবহার করে সুরক্ষা দেয়া যাবে।
হয়তো কিছুদিন পরে বাজারে আসবে সুপার কম্পিউটার বা কোয়ান্টাম কম্পিউটার যা সাধারণ কম্পিউটারে ব্যবহৃত বীটের পরিবর্তে কিউবীট ব্যবহার করবে যাতে কম্পিউটারের প্রসেসরের গতি বৃদ্ধি করা যাবে মাইক্রোফোন বিজড়িত ফোটনের মাধ্যমে অধিক পরিমাণে তথ্য যোগাড় করতে পারবে। মানুষ যে শুধু কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যবহার করবে তা নয়। পাখীরা মানুষের আগে কোয়ান্টাম বিজড়ায়ণ ব্যবহার করে। তাই হয়ত প্রকৃতিকে জ্ঞানের আধার বলা হয়।মনে করা হয় ইউরপিয়ান রবিন বার্ড চলার জন্য বায়ো-কম্পাস হিসাবে কোয়ান্টাম বিজড়ায়ণ ব্যবহার করে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভৌতিক ক্রিয়া নিয়ে সবচেয়ে বেশী অস্বস্তিতে ছিলেন আইনস্টাইন। আইনস্টাইন, বোর, হাইসেনবার্গ, বেল’রা স্বর্গে।কিন্তু মর্ত্যের বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশ্বায়ন তথা বৈশ্বিক বাস্তবতার যুগে আইনস্টাইনের স্থানীয় বস্তবতার ধারণা অচল। বেঁচে থাকলে আইনস্টাইন বেশী খুশি হতেন। কারণ বিজ্ঞানের নান্দনিকতা যে সত্য উদ্ঘাটনে। একদা আইনস্টাইনে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল,
“যদি আপেক্ষিকতার তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হত তবে কি করতেন?” আইনস্টাইন বলছেন, “জার্মানরা বলতো আইনস্টাইন ইহুদি, বিশ্ববাসী বলতো আইনস্টাইন জার্মান।
এখন জার্মানরা বলছে আইনস্টাইন জার্মান, আর বিশ্ববাসী বলছে আইনস্টাইন বিশ্ব নাগরিক।” জীবদ্দশায় আইনস্টাইনকে বস্তুর স্থানীয় বাস্তবতার বিষয় এমন প্রশ্ন কেউ করেনি। কিন্তু কোয়ান্টাম বিজড়ায়ণ সত্য, তথাপি আইনস্টাইন বিশ্বনাগরিক। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে একথা প্রতিয়মান হয় যে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা ব্যতীত সফলতা অসম্ভব। আর নিরন্তর প্রচেষ্টার জন্য চাই অবারিত সুযোগ।
“দরজা খুলে দাও, জানালা খুলে দাও, আসতে দাও হাওয়া
ওঠুক ভরে বুক রোদের আরশীতে দেখতে দাও মুখ।”