পোস্টস

গল্প

অপচেষ্টা

১০ জুন ২০২৪

Naoroz Bipul

প্রথম পরিচ্ছেদ

কালো রঙের প্রাইভেট কারটা এসে প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়ালো। ড্রাইভার নেমে এসে প্রাইভেট কারের পেছনের দরজা খুললো। গাড়ির ভেতর থেকে নেমে আসলো জুওয়াইরিয়া। চুলগুলো খোলা। কোমড়ের নিচ পর্যন্ত ছড়ানো। চোখে সানগ্লাস। পরনে জিন্স টি-শার্ট। টি-শার্টের রঙ গাঢ় খয়েরী। এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত প্রশস্ত বুকে, টি-শার্টের উপর সাদা রঙে লেখা- ডোন্ট ফার্ল্ট। মুখের ভেতর চুইংগাম নিয়ে জাবর কাটছে জুওয়াইরিয়া।

গাড়ি থেকে নেমে গেটের দিকে পা বাড়ালো সে। কয়েক পা গিয়ে আবার দাঁড়ালো। এ্যাপার্টমেন্টের ভেতর থেকে বের হয়ে আসছে, ওরই সমবয়সী একটা মেয়ে আয়িশা। ওর সাথে পরিচয় আছে জুওয়াইরিয়ার। একটা বিষয় নিয়ে ওদের দুজনের মধ্যে বাকবিতন্ডাও হয়েছিল এক সময়। পাশ কেটে যাওয়ার সময় বাঁকা দৃষ্টিতে আয়িশার আপাদমস্তক দেখলো জুওয়াইরিয়া- খুবই তাচ্ছিল্যের সাথে। আয়িশার পরনে খুবই সাধারণত পোশাক-আশাক। ওর দিকে জুওয়াইরিয়ার তাচ্ছিল্যের সাথে তাকানোর কারণ ওর পোশাক-আশাক নয়। তার যেমন সামর্থ্য সে তেমন পোশাক-আশাক কিনেছে- সেটা নিয়ে জুওয়াইরিয়ার কোনো মাথাব্যথা নাই। কারণ অন্যকিছু।

ওকে পাশ কেটে যাওয়ার সময় আয়শাও একবার কৌনিক দৃষ্টিতে তাকালো। একে অপরের চোখে চোখ পড়লো। এক পলকের দৃষ্টি বিনিময় শেষে, আয়িশা চোখ ফিরিয়ে নিলো। ওর সাথে একজন বয়স্ক ভদ্রলোকও আছেন। সম্ভবত আয়িশার বাবা তিনি। তাঁর সাথে আয়িশা চলে গেলো। 

জুওয়াইরিয়া এ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে চলে আসলো। ওকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিশন (পিবিআই) এর একজন অফিসার আব্দুল গফুর ডেকে পাঠিয়েছেন। অফিসারের দেয়া সময়মতো পিবিআইয়ের ঢাকা জেলা অফিসে আসতেই হয়েছে জুওয়াইরিয়াকে। ভেতরে এসে একজন কনস্টেবলের কাছ থেকে, অফিসার আব্দুল গফুরের বর্তমান অবস্থান জেনে নিলো সে। কনস্টেবল অবস্থান জানালে, জুওয়াইরিয়া এসে লিফটের ভেতর ঢুকলো। লিফট থেকে নামার পর আব্দুল গফুরের কক্ষের অবস্থান জানতে, আরেকজন কনস্টেবলের সাহায্য নিতে হলো ওকে। অফিসারের কক্ষের দরজা পর্যন্ত ওকে এগিয়ে দিয়ে গেলো কনস্টেবল।

ভেতরে উঁকি দিলো জুওয়াইরিয়া। অন্য কোনো লোকজন চোখে পড়লো না। বিশাল ডেস্কের ওপাশে বসে ডেস্কটপে কিছু একটা করছে এক ভদ্রলোক। পরনে গাঢ় বেগুনী রঙের টি-শার্ট। গায়ের রঙ- আফ্রিকান নিগ্রোদের মতো না হলেও মোটামুটি ভালোই কালো। ভদ্রলোকের বয়স অনুমান করলো জুওয়াইরিয়া- পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে হতে পারে। খুব সম্ভব এই ভদ্রলোকই পিবিআই অফিসার আব্দুল গফুর। 

ভেতরে ঢোকার আগে জুওয়াইরিয়া বলল, ‘ভেতরে আসতে পারি?’

শ্রুতিমধুর একটা নারীকন্ঠ শুনে নিজের কাজ বন্ধ করলো আব্দুল গফুর। দরজার দিকে তাকালো। সুন্দরী অতি আধুনিক এক তরুণীকে দেখতে পেলো সে। বলল, ‘হ্যাঁ, প্লিজ।’

ভেতরে এসে অফিসারের দৃষ্টিতে প্রশ্ন দেখতে পেলো জুওয়াইরিয়া। প্রশ্নের জবাবে সে বলল, ‘জুওয়াইরিয়া। নীলিমা নামে কেউ একজন ফোন করে আসতে বলেছিল আমাকে।’

‘ওহ্ হ্যাঁ, নীলিমা আমাদের একজন এসআই।’ বলল আব্দুল গফুর, ‘একটা অপহরণ কেসের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আপনাকে ডাকা হয়েছে।’

‘অপহরণ কেস!’ যেন আকাশ থেকে পড়েছে, তেমনই একটা ভাব প্রকাশ করলো জুওয়াইরিয়া, ‘অপহরণ কেসের সাথে আমার সম্পর্ক কি?’

‘সম্পর্ক আছে অনুমান করেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়েছে আপনাকে।’ বলল আব্দুল গফুর। সেক্রেটারিয়েট টেবিলের বাম পাশের ড্রয়ার খুললো। থ্রি-আর সাইজের প্রিন্টেড একটা ছবি বের করলো। ছবিটা ডেস্কের উপর রেখে, জুওয়াইরিয়ার দিকে ঠেলে দিলো। জিজ্ঞেস করলো, ‘চিনেন?’

ছবিটা হাতে তুলে নিলো জুওয়াইরিয়া। ছবিটা সুদর্শন এক যুবকের। নিজেকে জুওয়াইরিয়া এই যুবকের গার্লফ্রেন্ড মনে করে। ছবিটা ভালোভাবে দেখে নিয়ে, ডেস্কের উপর রেখে দিলো সে। অফিসারের প্রশ্নের জবাবে বলল, ‘আমার বয়ফ্রেন্ড।’

ছবিটা নিজের কাছে টেনে নিলো আব্দুল গফুর। ড্রয়ারে রেখে দিলো। বলল, ‘নাম কি আপনার বয়ফ্রেন্ডের?’

‘কী আশ্চর্য, আমার বয়ফ্রেন্ডের ছবি আমাকে দেখাচ্ছেন- অথচ তার নাম আপনি জানেন না?’

‘নামটা আমি আপনার কাছে জানতে চেয়েছি।’

‘আমার সাথে আপনি এভাবে কথা বলতে পারেন না, অফিসার। আপনি বোধহয় আমার পরিচয় ঠিকঠাকমতো জানেন না!’

‘আমার কাছে আপনি শুধুই একজন সন্দেহভাজন।’ বলল আব্দুল গফুর, ‘আপনার কোনো প্রশ্ন শুনতে নয়, আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ডেকেছি আমি। কী নাম আপনার বয়ফ্রেন্ডের?’

‘আব্দুল্লাহ আল মুমিত।’ বলল জুওয়াইরিয়া, ‘সমস্যা কি সেটা কি আমি জানতে পারি, অফিসার?’

‘আপনি কি সত্যিই কিছুই জানেন না?’

‘না তো! আমার মুমিতের কী হয়েছে, তা কি অনুগ্রহ করে আমাকে জানাবেন, অফিসার?’

‘গত দুই সপ্তাহ ধরে এই ছেলে নিখোঁজ।’ বলল আব্দুল গফুর, ‘ধারণা করা হচ্ছে কে বা কারা হয়তো তাকে কিডন্যাপ করেছে। তার বাবা-মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে কেসটা তদন্ত করছে পিবিআই। এখন পর্যন্ত মুক্তিপণ চেয়ে কেউ কল বা মেসেজ করেনি।’

‘কিডন্যাপিংয়ের অভিযোগ পেয়েছেন, সুতরাং তাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব এখন আপনার।’ বলল জুওয়াইরিয়া, ‘এবং আপনি যেভাবে পারেন আমার বয়ফ্রেন্ডকে খুঁজে বের করে দিন, অফিসার। কেউ যদি মুক্তিপণ দাবি করে, সাথে সাথে আমাকে জানাবেন। মুক্তিপণ দেবার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আমি করবো।’

কেস স্টাডি করে আব্দুল গফুর যতটা জানতে পেরেছে, জুওয়াইরিয়ার স্বঘোষিত প্রেমিক মুমিত। ওকে পাগলের মতো পছন্দ করে জুওয়াইরিয়া। কিন্তু মুমিত কখনোই জুওয়াইরিয়াকে পছন্দের কথা বলেনি। নিজের প্রতি জুওয়াইরিয়াকে আকৃষ্ট করারও চেষ্টা করেনি কখনো। কিন্তু মুমিতকে জয় করার জন্য জুওয়াইরিয়া পাগলপ্রায়। এমন সুন্দরী অতি আধুনিক, আর ধনাঢ্য বাপের একমাত্র মেয়েকে উপেক্ষা করার কারণ মুমিতই বলতে পারবে। জুওয়াইরিয়ার সাথে সাক্ষাৎ পরিচয় হওয়ার অনেক আগে থেকে, আয়িশা নামের অন্য একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক চলছে মুমিতের। মুমিত আর আয়িশার দুই পরিবারের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে, তাদের বিয়ের সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত। ঠিক সেই মুহুর্তে মুমিত অপহৃত। ছেলেকে নিয়ে দুই নারীর টানাহেঁচড়ার কোনো কিছুই জানেন না মুমিতের বাবা-মা। একমাত্র ছেলের কোনো হদিস না পেয়ে তাঁরা প্রচন্ডভাবে উদ্বিগ্ন।

স্বাভাবিকভাবেই এমন পরিস্থিতিতে জুওয়াইরিয়ার দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছে, মুমিতের বাগদত্তা আয়িশা। ওর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই জুওয়াইরিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকেছে আব্দুল গফুর। প্রাথমিক কিছু প্রশ্নের জবাবে সে বুঝলো- স্বঘোষিত প্রেমিক অপহৃত হওয়ার খবর শুনেও, জুওয়াইরিয়ার মধ্যে কোনো রকম উদ্বিগ্নতা নাই। প্রেমিককে উদ্ধার করতে প্রয়োজনীয় মুক্তিপণের ব্যবস্থা করবে বলে জানাচ্ছে সে। অথচ সেটার আগে জুওয়াইরিয়ার প্রচন্ডভাবে দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যাওয়া উচিৎ ছিল। যে দুঃশ্চিন্তার ছাপ আয়িশার মুখচ্ছবিতে দেখতে পেয়েছে আব্দুল গফুর। জুওয়াইরিয়া কি তাহলে কিনতে চায় মুমিতকে? ধনাঢ্য বাপের একমাত্র মেয়ে জুওয়াইরিয়া- প্রেমে বিজয়ী হতে না পেরে, পছন্দের পুরুষকে যেকোনো মূল্যে পাওয়ার একটা অভিপ্রায় তো মেয়েটার মধ্যে থাকতে পারে।

মুমিতের মুক্তিপণের ব্যবস্থা করার কথা শুনে, আব্দুল গফুর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে গেলো না। জানতে চাইলো, ‘আয়িশা নামে কাউকে চিনেন আপনি?’

‘চিনিনা।’ অফিসারের জিজ্ঞাসার জবাবে খুব দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখালো জুওয়াইরিয়া। সরাসরি অস্বীকার করলো। বলল, ‘কে আয়িশা?’

‘আপনার বয়ফ্রেন্ডের বাগদত্তা।’

‘বাগদত্তা? আমি ঠিক বলতে পারবো না, অফিসার।’ বলল জুওয়াইরিয়া, ‘মুমিত শুধু আমাকেই ভালোবাসে, আমি শুধু সেটাই বলতে পারি। তার বাগদান হয়েছে কবে কখন, তা আমি বলতে পারি না।’

‘মুমিতের বাগদত্তা কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে।’

‘কীসের অভিযোগ?’

‘কিডন্যাপিংয়ের অভিযোগ। মেয়েটার ভাষ্য, তার সাথে বিয়ে চুড়ান্ত হওয়ায় আপনি মুমিতকে হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয়েছেন।’ বলল আব্দুল গফুর, ‘তাদের বিয়ে ঠ্যাকানোর জন্য আপনি আপনার স্বঘোষিত প্রেমিককে কিডন্যাপ করেছেন।’

‘অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছি আমি।’ বলল জুওয়াইরিয়া, ‘অফিসার, আমি কি এখন উঠতে পারি?’

অনুমতি চাইলেও ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠেই পড়েছে জুওয়াইরিয়া। আব্দুল গফুর বলল, ‘কোনো কিছু জানা থাকলে তথ্য দিয়ে আমাদেরকে সহযোগিতা করুন, জুওয়াইরিয়া। এটা আমার রিকুয়েষ্ট। যদি ফাইন্ড আউট করতে পারি, মুমিত কিডন্যাপিংয়ের সাথে আপনার কোনো রকম সম্পৃক্ততা আছে, তাহলে আপনার পরিনতি ভালো হবে না।’

আব্দুল গফুরের হুমকির কোনো রকম তোয়াক্কায় করলো না জুওয়াইরিয়া। অনুমতি চাইলো, ‘আমি কি যেতে পারি, অফিসার?’

‘অফকোর্স, ইউ মে গো নাউ।’

জিন্স প্যান্ট পরিহিত চওড়া নিতম্বে ঢেউ তুলে, আব্দুল গফুরের কক্ষ থেকে বের হয়ে গেলো জুওয়াইরিয়া। কয়েক মুহুর্ত ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকলো আব্দুল গফুর। ডেস্কের একপাশে রাখা কলিং বেলের সুইচটাতে পরপর দুইবার টিপ দিলো। প্রায় সাথে সাথেই আসলো একজন কনস্টেবল। আব্দুল গফুর বলল, ‘নীলিমা আর রোহানকে পাঠাও।’

ত্রিশ সেকেন্ড পরেই আব্দুল গফুরের কক্ষে প্রবেশ করলো এসআই নীলিমা, ওর সাথে এসআই রোহান। স্যারের অনুমতি পেয়ে সামনের দুইটা চেয়ারে বসলো ওরা। 

‘নীলিমা, তোমার সবগুলো সোর্সকে এ্যাক্টিভ করো।’ বলল আব্দুল গফুর, ‘জুওয়াইরিয়ার পেছনে লাগাও। ওর মধ্যেই কিছু না কিছু একটা আছে। ওর প্রতিটি মুহুর্তের খবর আমি জানতে চাই।’

‘শিউর, স্যার।’

‘রোহান…’

‘স্যার…’

‘মুমিতের পুরো ব্যাকগ্রাউন্ড বের করো।’ বলল আব্দুল গফুর, ‘সে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত কি না, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাথে তার কোনো লিংক আছে কি না- সেইসব তথ্যসহ তার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের সব তথ্য আমাকে জানাও।’

‘শিউর, স্যার।’

‘আওয়ার টাস্ক ইজ টু লোকেইট দ্যা লাভার বয় হু ওয়াজ কিডন্যাপড উইদিন দ্যা নেক্সট উইক।’ বলল আব্দুল গফুর, ‘যাও, কাজে নেমে পড়ো।’

অনুমতি পেয়ে নিজ নিজ আসন থেকে উঠলো নীলিমা, রোহান। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করলো ওরা। নিজেদের সোর্সদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে করতে, কক্ষ থেকে বের হয়ে গেলো। 

আব্দুল গফুর যতদূর জানতে পেরেছে, মহল্লার একজন মুদি দোকানদারের একমাত্র ছেলে মুমিত। দেখতে অত্যন্ত সুদর্শন। সৌন্দর্য, শারীরিক গঠন- সবদিক থেকে সত্যিকার অর্থেই মুভির একজন হিরো। নারী মহলে অত্যন্ত প্রিয়মুখ। একজন মুদি দোকানদারের ছেলের প্রেমে পাগল ধনাঢ্য বাপের আহ্লাদী মেয়ে। এ যেন বাংলাদেশের মুভির প্রেম কাহিনির বাস্তব পুনরাবৃত্তি। এখন এই গল্পে চৌধুরী সাহেব অর্থাৎ জুওয়াইরিয়ার বাপের ভূমিকাটা কি- তা জানা দরকার আব্দুল গফুরের- তিনি কি মুভির গতানুগতিক চৌধুরী সাহেব নাকি, আহ্লাদী মেয়ের যেকোনো আহ্লাদ পূরণ করতে সদা প্রস্তুত?