সপ্তম পরিচ্ছেদ

১১ জুন ২০২৪

Naoroz Bipul

সাইবার সেল থেকে ইন্সপেক্টর ইরফানকে ডেকে পাঠালো আব্দুল গফুর। ইরফান এসে জানালো, এখনও সে মুমিতের অবস্থান ট্রেস করতে পারেনি। কিডন্যাপ করার সময় মুমিতের অবস্থান ছিল নিজ বাসার সামনে। সেখানেই কিডন্যাপাররা তার মোবাইল ফোন সুইচ অফ করে দিয়েছে। এখন পর্যন্ত মোবাইল ফোন আর সুইচ অন করা হয়নি। 
চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে, আব্দুল গফুরের কাছ থেকে বিদায় নিলো ইরফান। সে চলে যাওয়ার পর, নীলিমা আর রোহানকে ডাকলো আব্দুল গফুর। তাদের কাছ থেকে সর্বশেষ আপডেট জানতে চাইলে, নীলিমা বলল, ‘আমার ইনফর্মাররা, সেইদিন আমাদের অফিস থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর, জুওয়াইরিয়া সোজা বাসায় গিয়ে ঢুকেছে। একবারও আর বের হয়নি, স্যার। খুবই ধুরন্ধর মেয়ে। ঠিক বুঝে ফেলেছে- পিবিআইয়ের নজর আছে তার উপর।’
‘কিন্তু পিবিআইয়ের চেয়ে বেশি ধুরন্ধর সে নয়।’ বলল আব্দুল গফুর, ‘সে যখন বাসা থেকে বের হচ্ছেই না, তখন ওর উপর থেকে নজর সরাও। ওর বাসায় কাজ করে সেইসব মহিলাদের উপর নজর দিতে বলে দাও তোমার ইনফর্মারদেরকে।’
‘কাজের মহিলাদের উপর, স্যার?’
‘হ্যাঁ, জুওয়াইরিয়াদের বাসায় যে কয়জন কাজের মেয়ে আছে- তারা কে কখন কাজে আসছে, কে কখন বের হচ্ছে, কার বাসা কোথায়- সেইসব ইনফরমেশন বের করো।’ বলল আব্দুল গফুর, ‘আর জুওয়াইরিয়ার মোবাইল ফোনের গত এক সপ্তাহের কল লিস্ট বের করো। যাও, নীলিমা।’
নীলিমা নিজের কাজে চলে গেলো। এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল রোহান। ওর দিকে তাকালো আব্দুল গফুর। জানতে চাইলো, ‘তো, বলো রোহান, তোমার কাছে মুমিতের কী কী ইনফরমেশন আছে।’
‘কোনো খারাপ কাজ কিংবা আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাথে মুমিতের কোনো সংশ্লিষ্টতা নাই, স্যার।’ বলল রোহান, ‘সেইদিক থেকে ক্লিন ইমেজ।’
‘আর বন্ধু-বান্ধব?
‘আমার ইনফর্মাররা মুমিতের তিনজন বন্ধুর খোঁজ পেয়েছে।’
‘একজনের নাম রোমেল- সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। মুমিতের মতোই ক্লিন ইমেজ।’
‘দ্বিতীয় জন?’
‘নাম জাফর- ইনফর্মররা জানিয়েছে, এটা হচ্ছে বিশিষ্ট ভদ্রলোক। গত কয়েক দিনের মধ্যে, একদিন জুওয়াইরিয়ার বাসায় যেতে দেখে গেছে।’
‘জুওয়াইরিয়ার বাসায় সে কেন গিয়েছে, সেই সম্পর্কে কিছু জানা গেছে?’
‘যায়নি, স্যার। আমার অনুমান, ফ্রেন্ডের ব্যাপারে জানতেই হয়তো জাফরকে ডেকেছিল জুওয়াইরিয়া।’
‘অর্থাৎ, মুমিতের কিডন্যাপিংয়ের ব্যাপারে জাফর কিছু না কিছু হলেও জানে। আরেকজন ফ্রেন্ডের ব্যাপারে বলো।’
‘আরেকজনের নাম- কারিব। এদের দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব এতোটাই ঘনিষ্ট যে, একজন কোনো অপরাধ করে বিপদে পড়লে, আরেকজনের কাছে সেটা অপরাধ নয়।’ বলল রোহান, ‘নিজের জীবন বাজি রেখে অন্য বন্ধুকে বিপদ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসবে।’
মুমিতের তিন বন্ধুর তথ্য জেনে, কয়েক মিনিট তা বিশ্লেষণ করলো আব্দুল গফুর। শেষে বলল, ‘তোমার ঐ বিশিষ্ট ভদ্রলোককে তুলে নিয়ে এসো।’
অনুমতি নিয়ে স্যারের কক্ষ থেকে বের হলো রোহান। ইনফর্মারদের সাথে যোগাযোগ করলো। জাফরের বর্তমান জেনে, তাকে তুলে নিয়ে আসার জন্য দুজন কনস্টেবল সাথে নিয়ে নিজেই বের হলো। এদিকে জুওয়াইরিয়ার মোবাইল ফোনের কল লিস্ট নিয়ে ফিরলো নীলিমা। প্রিন্টেড কল লিস্ট দিলো আব্দুল গফুরের সামনে। সে কল লিস্ট সময় নিয়ে দেখলো। অসংখ্য নম্বরের সাথে কথা বলেছে জুওয়াইরিয়া। প্রত্যেকটা নম্বরের ডিটেইলস ইনফরমেশন নিয়ে এসেছে নীলিমা। জুওয়াইরিয়া সবচেয়ে বেশি কথা বলেছে তার বাপের সাথে। গত সাতদিনের কল লিস্টে, প্রত্যেকটা নম্বরের সাথে জুওয়াইরিয়ার একাধিক বার কথা বলার রেকর্ড দেখতে পেলো আব্দুল গফুর। একটা নম্বরে ওর দৃষ্টি আটকালো। নম্বরটার সাথে শুধু একবার কথা বলার রেকর্ড পাওয়া গেলো। নীলিমা নম্বরটা হাইলাইট করেনি। সেটার উপরে আঙ্গুল রাখলো আব্দুল গফুর। বলল, ‘এই নম্বরটা কার জানতে পেরেছো, নীলিমা?’
নম্বরটা দেখে নিয়ে সেই নম্বরধারীর এনআইডি কার্ডের ফটোকপি খুঁজে বের করলো নীলিমা। কার্ডটা হাতে নিয়ে আব্দুল গফুর দেখতে পেলো, নাম লেখা- জাফর জোয়ার্দার। 
সাড়ে তিনঘণ্টা পর, জাফরকে সাথে নিয়ে অফিসে ফিরলো রোহান। আব্দুল গফুরের সামনে নিয়ে আসলো। জাফরের আপাদমস্তক দেখলো আব্দুল গফুর। বেশ সুদর্শন ছেলে। এলোমেলো চুল। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। পরনে জিন্স শার্ট। শার্টের হাতা অর্ধেক গুটানো। অফিসারের ইঙ্গিতে সামনের চেয়ার টেনে বসলো জাফর। আব্দুল গফুর বলল, ‘মুমিতকে চিনেন?’
‘কেন চিনবো না, স্যার?’ বলল জাফর, ‘সে তো আমার ফ্রেন্ড! কোনো সমস্যা স্যার আমার ফ্রেন্ডের?’
‘গত প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে ফ্রেন্ডের সাথে আপনার যোগাযোগ হয়নি?’
‘এমনিতে যোগাযোগ হয়নি, স্যার। বেশকিছু দিন গ্রামের বাড়ি ছিলাম।’ বলল জাফর, ‘ফোন করেছিলাম। বন্ধ পেয়েছি। মনে হয়, নতুন নম্বর নিয়েছে- আমি এখনও পাইনি।’
‘নম্বর পাল্টায়নি, আপনার ফ্রেন্ডকে কেউ কিডন্যাপ করেছে।’
আঁৎকে উঠার মতো একটা প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলো জাফর। বলল, ‘কী বলছেন স্যার, সহজ সরল নম্র ভদ্র একটা ছেলে- ওকে কিডন্যাপ করবে কে?’
‘আমরা এখনও নিশ্চিত না। তবে অনুমান করছি, তার গার্লফ্রেন্ড এই কাজটা করেছে।’
‘কোন গার্লফ্রেন্ড স্যার- আয়িশা?’
‘কোনো গার্লফ্রেন্ডের নাম আপনাকে আমি বলেছি?’
অফিসারের এই প্রশ্ন শুনে জাফর কিছুটা ভ্যাপাচ্যাকা খেয়ে গেলো। সত্যিই তো অফিসার নির্দিষ্ট কারো নাম উল্লেখ করেনি। হুট করে আয়িশার নাম বলে দেয়া ওর একেবারেই উচিৎ হয়নি। এখন ইচ্ছে করলেই তো অফিসার একটা হেস্তনেস্ত করতে পারেন। অবশ্য তিনি তা করতে গেলেন না।
নিজের কথার ধারাবাহিকতায় আব্দুল গফুর বলল, ‘আপনার ফ্রেন্ডের কয়টা গার্লফ্রেন্ড আছে?’
‘আজকালকার ছেলে-পেলেদের কি গার্লফ্রেন্ডের নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা থাকে, স্যার?’ বলল জাফর, ‘আয়িশার সাথেই আমার শুধু পরিচয় আছে। দুই একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। আপনার প্রশ্নের জবাবে আমি তাই আয়িশার নামটায় বলে দিয়েছি।’
‘মুমিতের আরও একজন গার্লফ্রেন্ডের সাথে আপনার পরিচয়, জানাশোনা আছে।’
‘আরও একজন গার্লফ্রেন্ড- কার কথা বলছেন, স্যার?’
‘জুওয়াইরিয়া।’
‘ওহ্ জুওয়াইরিয়া? কিন্তু, আমার জানামতে জুওয়াইরিয়া তো স্যার, মুমিতের গার্লফ্রেন্ড না।’ বলল জাফর, ‘জুওয়াইরিয়া নিজের দিক থেকে মুমিতকে নিজের বয়ফ্রেন্ড মনে করে।’
‘আমারাও সেটাই জানি।’ আব্দুল গফুর, ‘আপনি জুওয়াইরিয়ার বাসায় কেন গিয়েছিলেন?’
জুওয়াইরিয়ার বাসায় জাফরের যাওয়ার খবরটা তাহলে অফিসারের কাছে অজানা নাই। নিজস্ব কৌশলে অফিসার সেই খবর জেনে নিয়েছেন। সুতরাং অস্বীকার করা জাফরের জন্য বিপদের কারণ হয়ে যেতে পারে। অফিসারের প্রশ্নের জবাবে সে বলল, ‘সে আমাকে তার বাসায় ডেকেছিল, স্যার।’
‘কেন?’
‘আমার ফ্রেন্ডের সম্পর্কে জানতে। আপনাকে যা বলেছি, ওকেও তা-ই বলেছি- আমি কিছু জানি না।’
‘ঠিক আছে জাফর সাহেব, জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন ছিল আপনাকে- করে নিলাম।’ বলল আব্দুল গফুর, ‘আপনি যেতে পারে।’
‘সত্যিই চলে যাবো, স্যার?’
‘তো, আপনি কি চাইছেন আপনাকে আমি লকআপে ঢুকাই?’ বলল আব্দুল গফুর, ‘রোহান, ওকে লকআপে ঢুকাও।’
‘না না স্যার, কী বলছেন- লকআপে ঢুকাবে কেন?’ দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েলো জাফর, বলল, ‘আসি, স্যার।’
আব্দুল গফুরকে সালাম দিয়ে বের হয়ে গেলো জাফর। নিজ সহকর্মী এসআই রোহানের দিকে তাকালো সে। জানতে চাইলো, ‘কী বুঝলে?’
জবাবে রোহান বলল, ‘মিথ্যে কথা বলছে, স্যার।’
‘তোমার কাছে কোন কথাটা মিথ্যে মনে হয়েছে?’
‘জুওয়াইরিয়া ম্যাডামের বাসায় গিয়ে, নিশ্চয় মুমিত কিডন্যাপিংয়ের কথাটা জানতে পেরেছে।’ বলল রোহান, ‘অথচ আপনি জিজ্ঞেস করলে, কিছুই জানে না তেমন একটা ভাব নিয়েছে।’
‘কারেক্ট, মাই বয়!’ বলল গফুর, ‘ওর পেছনে তোমার একটা সোর্স লাগাও। মুমিত কিডন্যাপিংয়ের সাথে কোনো না কোনো ভাবে সে জড়িত। ওর লেজ ধরেই আমরা মুমিতের কাছে পৌঁছাবো।’
‘এখনই ব্যবস্থা করছি, স্যার।’
নিজের সোর্সের সাথে যোগাযোগ করে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আব্দুল গফুরের কক্ষ থেকে বের হয়ে গেলো রোহান। সামনের চেয়ারে এখনও বসে আছে নীলিমা। আব্দুল গফুর বলল, ‘বের হবো, নীলিমা। আমার সাথে চলো।’
‘শিউর, স্যার।’
স্যারের সাথে বাহিরে আসলো নীলিমা। অফিস এ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি। নীলিমা পেছনের সিটে উঠলো। ড্রাইভারের পাশের সিটে উঠে বসলো আব্দুল গফুর। ড্রাইভার গাড়ি ছাড়লো। স্যারের সাথে কোথায় যাচ্ছে, তা এখনও নিশ্চিত নয় নীলিমা। আগে থেকে কখনো নিশ্চিত হতেও পারে না ওরা। পৌঁছানোর পর বুঝতে পারে- কোথায় এসেছে।
আব্দুল গফুরের নির্দেশনা পেয়ে, ক্রিস্টল আই গ্রুপের কর্পোরেট অফিসের সামনে এসে গাড়ি থামালো ড্রাইভার। দেশের অন্যতম ধনাট্য একটজন ব্যক্তিত্ব কারীমুদ্দিন হাসীব। ক্রিস্টল আই গ্রপের কর্ণধার- জুওয়াইরিয়ার বাবা। রিসিপশনে এসে, কারীমুদ্দিন হাসীব অফিসে আছেন কি না তা নিশ্চিত হয়ে নিলো আব্দুল গফুর। জানালো, সাক্ষাতের জন্য সে আগেই যোগাযোগ করেছিল। কারীমুদ্দি হাসীবের এ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়া আছে। নিজ বসের পার্সোনাল এ্যাসিস্টেন্ট রুমলীর সাথে যোগাযোগ করলো রিসিপশনিষ্ট সুলেখা। কথা শেষ করে, আব্দুল গফুরকে লিফট দেখালো। বস তাকে যেতে বলেছেন- তাঁর চ্যাম্বার তিন তলায়।
লিফটের দিকে গেলো না আব্দুল গফুর। এসআই নীলিমাকে সাথে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় উঠে আসলো। পরিচয় পেয়ে রুমলী নিজেই ওদেরকে বসের চ্যাম্বারে নিয়ে গেলো। বিশাল ডেস্কের ওপাশে বসে আছে পঞ্চান্ন থেকে ষাট বছর বয়সী ভদ্রলোক- কারীমুদ্দিন হাসীব। তাঁর সামেনে দুইটা চেয়ারে বসে আছে সুদর্শন দুই যুবক। জুওয়াইরিয়ার সাথে যুবকদের চেহারার কিছুটা সাদৃশ্য লক্ষ্য করলো আব্দুল গফুর। অর্থাৎ তারা দুজনই নিশ্চয় জুওয়াইরিয়ার ভাই। নিজের পরিচিতি পত্র প্রদর্শন করলো আব্দুল গফুর। বলল, ‘সিনিয়র সুপারিন্টেনডেন্ট অব পুলিশ আব্দুল গফুর- ফ্রম পিবিআই।’
পরিচয় পেয়ে দুই যুবক প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে বাপের দিকে তাকালো। জবাবে কারীমুদ্দিন হাসীব কিছু বলতে পারলেন না। তিনি শুধু জানেন, তাঁর মেয়ের একটা বিষয় নিয়ে অফিসার তাঁর সাথে আলাপ করবেন। ছেলেদের প্রশ্নবোধক দৃষ্টির জবাবে বললেন, ‘তোমরা নিজেদের চ্যাম্বারে যাও, আমি এদিকটা দেখছি।’
পিবিআই অফিসারের আপাদমস্তক একবার দেখলো দুই যুবক। কিছু বলল না। বাপের চ্যাম্বার থেকে বের হয়ে গেলো। ওদিকে অফিসারকে আপ্যায়ন করতে ততক্ষণে কফি দিয়ে গেছে রুমলী। ইশারা পেয়ে সামনের চেয়ারে বসলো আব্দুল গফুর। কফির দিকে ইঙ্গিত করে কারীমুদ্দিন হাসীব বললেন, ‘প্লিজ…’
‘ধন্যবাদ, চৌধুরী সাহেব।’ বলল আব্দুল গফুর। কফির মগ তুলে নিলো। একবার চুমুক দিয়ে মগটা আবার ডেস্কে নামিয়ে রাখলো সে। বলল, ‘আপনার ব্যস্ত শিডিউলে কিছু সময় আমাকে দেয়ার জন্য, আমি সম্মানিত।’
‘আপনার বিনয়ে আমি আনন্দিত।’ বললেন কারীমুদ্দিন হাসীব, ‘আপনাকে আমি আমার মেয়ের কী ধরণের তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারি?’
‘আপনি কি আপনার মেয়ের সারাদিনের কাজকর্ম সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখেন, চৌধুরী সাহেব?’
‘রাখি না।’ বললেন কারীমুদ্দিন হাসীব, ‘মেয়ে যখন যা ইচ্ছে হয় সেটাই করে বেড়াতে পারে। কিন্তু আপনি আমাকে বারবার চৌধুরী সাহেব বলে সম্বোধন করছেন কেন? আমি তো চৌধুরী সাহেব না।’
‘আপনার মেয়ের সাম্প্রতিক কার্যক্রমের জন্যই আপনাকে আমি বারবার চৌধুরী সাহেব বলছি।’
‘সাম্প্রতিক কী কাজ করে, আমার মেয়ে কার পাকা ধানে মই দিয়েছে?’
‘অন্য একটা মেয়ের।’
‘কীভাবে?’
‘এক মুদি দোকানদারের ছেলের সম্পর্ক চলছে, আয়িশা নামের একটা মেয়ের সাথে।’ বলল আব্দুল গফুর। আবার একবার চুমুক দিলো কফির মগে। বলল, ‘তাদের বিয়েও ঠিকঠাক। সেই ছেলের উপরে নজর পড়েছে আপনার মেয়ের।’
‘নজর পড়েছে নাকি আমার মেয়ে সেই ছেলের প্রেমে পড়েছে?’ বললেন কারীমুদ্দিন হাসীব, ‘কথা দুইটার মধ্যে পার্থক্য আছে কিন্তু।’
‘রাইট- আপনার মেয়ে সেই ছেলের প্রেমে পড়েছে।’ বলল আব্দুল গফুর, ‘যাকে বলে অন্ধপ্রেম। এই পরিস্থিতিতে, আপনি মুভির গতানুগতিক চৌধুরী সাহেবের ভূমিকায় আসবেন, নাকি মেয়ের ইচ্ছে পূরণ করবেন।’
‘আমার মেয়ের হাসিমুখের প্রাধান্য আমার কাছে সবার আগে। আমার মেয়ে কোনো মুদি দোকানদারের ছেলেকে পছন্দ করেছে, নাকি রাস্তার ঝাড়ুদারকে- সেটা আমার কাছে বিবেচ্য বিষয় না।’ বললেন কারীমুদ্দিন হাসীব, ‘সেই ছেলের বাপের মুদি দোকানটাকে আমি সুপারশপ বানিয়ে দিতাম। কিন্তু আপনার ভাষ্যমতে, ছেলে তো আমার মেয়েকেই চায় না। সেক্ষেত্রে ছেলের জন্য কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। জোর করে কিছু হয় না।’
‘ব্যাপারটা আপনি বুঝেছেন কিন্তু আপনার মেয়ে বুঝতে পারেনি।’ বলল আব্দুল গফুর, ‘গত প্রায় তিন সপ্তাহ যাবৎ ছেলেটা নিখোঁজ। আমি নিশ্চিত না, কিন্তু অনুমান করছি- আপনার মেয়ে কিডন্যাপ করেছে।’
‘আমার মনে হয়, আপনার অনুমান সঠিক নয়, অফিসার।’ বললেন কারীমুদ্দিন হাসীব, ‘জুওয়াইরিয়া গত দুই মাস দেশেই ছিল না। ফিরেছে প্রায় এক সপ্তাহ আগে। সে কীভাবে তার বয়ফ্রেন্ডকে কিডন্যাপ করবে?’
কথা শেষ করে ডেস্কের উপর থেকে মোবাইল ফোনটা হাতে নিলেন কারীমুদ্দিন হাসীব। কল করলেন জুওয়াইরিয়ার নম্বরে। প্রথমবার রিঙ হতেই জুওয়াইরিয়া কল রিসিভ করলো। মেয়ের সারা পেয়ে কারীমুদ্দিন হাসীব বললেন, ‘মাই প্রিন্সেস, তুমি এখন কোথায়, সুইটহার্ট? বাহিরে মনে হচ্ছে?’
ভদ্রলোকের কথা শুনে ভ্রু-কুঁচকালো আব্দুল গফুর। জুওয়াইরিয়া বাহিরে কীভাবে? বাসার সামনে থাকা ইনফর্মারের দেয়া তথ্যমতে ওর তো এখন বাসায় থাকার কথা। ইনফর্মার তাকে বাসা থেকে বের হতে দেখেনি। তাহলে? ইনফর্মারের চোখে সে কীভাবে ধুলো দিয়েছে? এসআই নীলিমার দিকে তাকালো আব্দুল গফুর। যা বোঝার বুঝে নিলো নীলিমা। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করলো সে। হোয়াটএ্যাপ মেসেঞ্জার ওপেন করলো। টেক্সট করলো ইনফর্মারকে।
ওদিকে বাপের প্রশ্নের জবাবে জুওয়াইরিয়া বলল, ‘হ্যাঁ বাবা, বাহিরে।’
‘কোথাও যাচ্ছো?’
‘কয়েক দিন বাসায় বসে থাকতে থাকতে বোর ফীল করছিলাম, বাবা।’ বলল জুওয়াইরিয়া, ‘কয়েকজন ফ্রেন্ডকে নিয়ে আমার রেস্ট হাউসে যাচ্ছি।’
‘ওকে সুইটহার্ট, যাও। চীল করো।’
কল কেটে মোবাইল ফোন ডেস্কের উপর রাখলেন কারীমুদ্দিন হাসীব। আব্দুল গফুরের দিকে তাকালেন তিনি। সে তাঁর দিকেই তাকিয়ে ছিল। তিনি বললেন, ‘মেয়ে তো দিব্যি চীল করে বেড়াচ্ছে! ইচ্ছে করেই তার বয়ফ্রেন্ড কিডন্যাপিংয়ের ব্যাপারটা তাকে জিজ্ঞেস করিনি। আপনার অনুমানের উপর নির্ভর করে আমি আমার মেয়েকে ব্লেইম করতে পারবো না।’
‘রাইট, অনুমানের ভিত্তিতে দোষারোপ করা উচিৎ হবে না। দাঁড়িয়ে কারীমুদ্দিন হাসীবের দিকে হাত বাড়ালো আব্দুল গফুর। হাত মেলালো তাঁর সাথে। বলল, ‘আসছি, ভালো থাকবেন।’
হাত তুলে দরজা দেখালেন কারীমুদ্দিন হাসীব। এসআই নীলিমাকে নিয়ে তাঁর চেম্বার থেকে বের হলো আব্দুল গফুর। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী ব্যাপার নীলিমা, তোমার ইনফর্মার জুওয়াইরিয়ার বাসার সামনে বসে বসে কী করছে? জুওয়াইরিয়া বাসা থেকে বের হয়েছে তা ইনফর্মার ধরতে পারেনি কেন?’
‘একটা টুইস্ট আছে, স্যার!’
‘কী টুইস্ট?’
মোবাইল ফোনটা আব্দুল গফুরের দিকে বাড়ালো নীলিমা। বলল, ‘আমার হোয়াটসএ্যাপে ইনফর্মারের দেয়া টেক্সটটা পড়েন।’
নীলিমার মোবাইল নিলো আব্দুল গফুর। টেক্সট পড়লো। ইনফর্মার লিখেছে- জুওয়াইরিয়ার বাসার কাজের বুয়া খাদিজাকে ফলো করছিল সে। খাদিজা প্রতিদিন সকাল নয়টায় কাজে আসে। রাত নয়টায় বের হয়ে যায়। আজ সকাল সাড়ে এগারোটায় বের হতে দেখে, ইনফর্মার তাকে ফলো করতে থাকে। প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে জুওয়াইরিয়ার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল ওর ড্রাইভার ফরিদুল্লাহ্। খাদিজা গিয়ে উঠে পড়লো গাড়িতে। 
বাসার কাজের বুয়া, মালিকের গাড়িতে কেন উঠবে? ধারণাটা আগেই করেছিল আব্দুল গফুর। বুয়া খাদিজার বেশ ধারণ করে বাসা থেকে বের হয়েছে জুওয়াইরিয়া। সাইবার সেলে ইরফানকে কল করলো আব্দুল গফুর। জুওয়াইরিয়ার মোবাইল ফোন নম্বর ট্র‍্যাক করতে বলে দিলো।