দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১১ জুন ২০২৪

Naoroz Bipul

হঠাৎ করেই জুওয়াইরিয়ার গাড়িতে কিছু একটা সমস্যা দেখা দিলো। ড্রাইভার ফরিদুল্লাহ্ গাড়ির গতি আস্তে আস্তে কমিয়ে নিয়ে আসলো। হাইওয়ের পাশে একটা যাত্রী ছাউনির সামনে গাড়ি থামালো।
পেছনে বসে মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত ছিল জুওয়াইরিয়া। হঠাৎ গাড়ি থামাতে দেখে ফরিদুল্লাহ্কে কিছু বলতে যাচ্ছিলো সে। কিছু বলার আগেই ফরিদুল্লাহ্ বলল, ‘গাড়িতে কুনো একডা সমস্যা দেকা দিছে, ম্যাডাম।’
জবাবে জুওয়াইরিয়া বলল, ‘দেখো কী সমস্যা?’
‘দেকতাছি, ম্যাডাম।’
গাড়ি থেকে নামলো ফরিদুল্লাহ্। সামনে গিয়ে ইঞ্জনের ঢাকনা তুললো। কয়েক মিনিট ধরে এটা ওটা সেটা টেনেটুনে দেখলো। ঢাকনা আবার নামালো। জুওয়াইরিয়ার জানালার পাশে আসলো। বলল, ‘সমস্যা ধরতে পারতাছি না, ম্যাডাম। মনে লয় মিস্ত্রি লাগবো।’
‘কী বলছো সব উল্টাপাল্টা কথা!’ বলল জুওয়াইরিয়া, ‘এই মাঝ রাস্তায় মিস্ত্রি পাবে কোথায়?’
‘সাদেকরে কল দিতাম, ম্যাডাম?’
প্রয়োজনে যে ওয়ার্কশপে জুওয়াইরিয়া গাড়ি রিপেয়ার করায়, সেই ওয়ার্কশপের মালিক সাদেক। ওকে কল করার কথা শুনে প্রায় আঁৎকে উঠলো জুওয়াইরিয়া। কল করলেও সাদেকের আসতে আড়াই থেকে তিনঘন্টা সময় লেগে যাবে। এদিকে বিকেল পেরিয়ে দিন প্রায় সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে চলেছে। সাদেক এসে গাড়ি ঠিক করবে- তারপর যেতে যেতে তো রাত হয়ে যাবে। জুওয়াইরিয়া গাড়ি থেকে নেমে আসলো। বলল, ‘তোমার মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে, ফরিদুল্লাহ্? সাদেক আসতে কতো সময় লাগবে সেই হিসাব আছে তোমার?’
‘তাছাড়া তো কুনো উপায়ও দ্যাকতাছি না, ম্যাডাম।’
‘এতোক্ষণ কী করবো আমি, এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবো?’ বলল জুওয়াইরিয়া, ‘বের হওয়ার আগে তুমি গাড়ি একবার চেক করে নেবে না?’
‘চেক কইরাই তো লইছি, ম্যাডাম। এঞ্জিন হটাৎ বিগড়াইলে কী করতাম?’
ফরিদুল্লাহ্’র কথাও সঠিক। ওকেও দোষ দেয়া যায় না। অস্বস্তিকর একটা চেহারা নিয়ে এদিক ওদিক তাকালো জুওয়াইরিয়া। ব্যস্ত এই হাইওয়েতে ওকে কেউ লিফট দেবে বলেও তো মনে হয় না। অবশ্য সে অপরূপা সুন্দরী একটা মেয়ে। কোনো যুবক ছেলে যদি পাওয়া যায়, তাহলে সুযোগটা জুওয়াইরিয়া কাজে লাগাতে পারে। এদিক ওদিক তাকাতে গিয়ে একটা স্টাইলিশ বাইক দেখতে পেলো সে। না, বাইকটা কেউ চালাচ্ছে না। যাত্রী ছাউনির পাশে ফুটপাতের উপর বাইকটা পার্ক করা আছে। আশেপাশে কাউকে দেখা গেলো না। জুওয়াইরিয়া বাইক চালাতে পারে না। পারলে এখন বাইকটা নিয়েই চলে যেতো সে। পরে কী হতো সেটা পরে দেখা যেতো।
মিস্ত্রি সাদেকের সাথে কথা বলছে ফরিদুল্লাহ্। গাড়ি কোথায় আটকা পড়েছে সেই লোকেশন জানাচ্ছে সে। 
স্টাইলিশ বাইকটার দিকে আবার তাকালো জুওয়াইরিয়া। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে গিয়েও ঝট করে আবার তাকালো সে। বাইকটার পাশ দিয়ে নেমে গেছে একটা সরু রাস্তা। সেই সরু রাস্তা দিয়ে বাইকটার কাছে উঠে আসলো সুদর্শন এক যুবক। যুবকের উপর প্রথমবারের মতো দৃষ্টি পড়তেই মুগ্ধ হয়ে গেলো জুওয়াইরিয়া। মনে হলো, কোথাও থেকে একরাশ হিমেল হাওয়া এসে ছুঁইয়ে দিলো ওর দেহমন। 
ছেলেটা এসে বাইকের উপর বসলে, প্রায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর দিকে এগিয়ে গেলো জুওয়াইরিয়া। মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললো। হাত বাড়ালো। বলল, ‘হাই, আমি জুওয়াইরিয়া। তুমি?’
ছেলেটা তখন মাথায় হেলমেট পরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। হেলমেটটা আবার বাইকের ট্যাঙ্কের উপর রাখলো। জুওয়াইরিয়ার আপাদমস্তক একবার একবার দেখলো। ওর পাশ দিয়ে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটার দিকে তাকালো। চোখ ফেরালো জুওয়াইরিয়ার দিকে। ওর বাড়ানো হাতে হাত রাখলো। বলল, ‘মুমিত। গ্ল্যাড টু মিট ইউ।’
সেইদিনই ছিল মুমিতের সাথে জুওয়াইরিয়ার সাথে প্রথম সাক্ষাতের দিন। আজ মুমিতের সাথে সেই প্রথম সাক্ষাতের বর্ষপূর্তি। সেদিন জুওয়াইরিয়ার হাতটা ধরে আলতো করে একবার চাপ দিলো মুমিত। আলতো চাপের সেই অনুভূতিটা, সেইদিন জুওয়াইরিয়ার হাত থেকে পৌঁছে গিয়েছিল একেবারে হৃদপিণ্ডে। নিজেই হাতটা ছাড়িয়ে নিলো জুওয়াইরিয়া। জানতে চাইলো, ‘তুমি কি ঢাকার দিকে যাচ্ছো?’
‘এসেছিলাম যখন ঢাকা থেকে, এখন যাবোও ঢাকায়।’
‘আমার গাড়িটা হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেছে।’ নিজের গাড়ি দেখিয়ে বলল জুওয়াইরিয়া, ‘তুমি কি আমাকে লিফট দেবে? সুন্দরী কোনো নারীকে পেছনে বসিয়ে বাইক চালানোতে আলাদা একটা ফিলিংস আছে কিন্তু!’
এবার আবার একবার জুওয়াইরিয়ার আপাদমস্তক দেখলো মুমিত। বলল, ‘তুমি সুন্দরী?’
নিজের লম্বা চুলে একবার হাত চালালো জুওয়াইরিয়া। মুখের উপরে চলে আসা একগোছা চুল সরিয়ে দিলো। বলল, ‘কোনো সন্দেহ আছে?’
‘নেই।’ সেলফ বাটন চেপে বাইক স্টার্ট করলো মুমিত। বলল, ‘তুমি অনেক কনফিডেন্ট। তোমার এই কনফিডেন্স আমার ভালো লেগেছে। সেই জন্যই তোমাকে লিফট দেবো। উঠো।’
বাইকে উঠার আগে- হ্যান্ডব্যাগ থেকে টাকা বের করে ড্রাইভার ফরিদুল্লাহ্কে দিলো জুওয়াইরিয়া। সাদেক পৌঁছালে গাড়ি ঠিক করিয়ে ঢাকায় ফিরতে বলে দিলো। ফিরে আসলো মুমিতের কাছে। বাইক নিয়ে ফুটপাত থেকে হাইওয়েতে নেমে এসেছে মুমিত। বাইকের হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখা এক্সট্রা হেলমেটটা খুললো সে। জুওয়াইরিয়াকে দিলো। বলল, ‘পরে নাও।’
হেলমেট পরে বাইকের পেছনে উঠে বসলো জুওয়াইরিয়া। প্রায় একঘন্টার মতো বাইক চালিয়ে আসলো মুমিত। পেছনে থেকে জুওয়াইরিয়া বলল, ‘আমরা কি যাত্রাবিরতি নিতে পারি না কোথাও?’
‘পারি।’
হাইওয়ের পাশে বিলাসবহুল একটা রেষ্টরন্টের সামনে এসে বাইক থামালো মুমিত। নির্দিষ্ট জায়গায় বাইক পার্ক করলো। জুওয়াইরিয়াকে সাথে নিয়ে রেষ্টরন্টের ভেতরে আসলো। ওয়েটাররা ওর সাথে হেসে হেসে কথা বলাতে জুওয়াইরিয়া বুঝতে পারলো, মুমিত এখানে পরিচিত। এদিকে সে নিয়মিত আসে। ওকে নিয়ে একটা টেবিলে এসে বসলো মুমিত। জিজ্ঞেস করলো, ‘কী খাবে?’
‘তেমন কিছু না।’ বলল জুওয়াইরিয়া, ‘শুধু একটা স্যান্ডউইচ আর কোল্ডড্রিঙ্কস।’
ওয়েটারকে ডেকে অর্ডার করলো মুমিত। অর্ডার অনুযায়ী পরিবেশন করা হলো। স্যান্ডউইচ খাওয়া শেষ হলে কোল্ডড্রিঙ্কসে চুমুক দিলো জুওয়াইরিয়া। বলল, ‘কী করো তুমি? আই মীন, প্রফেশনের কথা জানতে চাইছি।’
‘ভাড়া খাটি।’
‘স্যরি, বুঝতে পারিনি!’
স্বশব্দে এবার হাসলো মুমিত। বলল, ‘যে বাইকে করে লিফট নিয়েছো, সেটাই ভাড়ায় চালাই। নিজের বাইক। ইনকাম মোটামুটি ভালোই হয়। আপাতত এই প্রফেশনেই আছি।’
‘ওহ্ হো, কথাটা তুমি তখনই বলবে না?’
‘বললে কী হতো?’
‘ভাড়া ঠিকঠাক করে নিয়ে তোমার বাইকে উঠতাম। লস করিয়ে দিলাম তোমার!’
‘কখনো কখনো সুন্দরীদের জন্য একটু আধটু লস করা যায়।’ বলল মুমিত, ‘তাছাড়া, এখানে আমি একটা ভাড়াতেই এসেছিলাম। তোমার জন্য লসটা পুষিয়ে যাবে।’
টেবিলের উপর বাম পাশে রাখা মোবাইল ফোন হাতে দিলো জুওয়াইরিয়া। বলল, ‘তোমার নম্বরটা বলো।’
‘আমার নম্বর দিয়ে কী করবে?’
‘কী করবো আবার, যখনই গাড়ি নষ্ট হবে- কন্টাক্ট করে তোমাকে ভাড়া করে নেবো!’
পার্মানেন্ট একজন যাত্রী পাওয়া গেলো ভেবে, সরল বিশ্বাসে মোবাইল ফোন নম্বর বলে দিলো মুমিত। তারপর থেকে সময় নেই অসময় নেই, নিজের খেয়াল খুশিমতো ওকে ডেকে নিতে শুরু করলো জুওয়াইরিয়া। ওকে নিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে থাকলো সে। বেশিরভাগ সময়ই লঙ ড্রাইভে ঢাকা থেকে অনেক দূরে চলে গেলো। মুমিতের সাথে ঘনিষ্টতা বাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকলো। সরাসরি মুমিতকে প্রপোজ করার আগেই, নিজের ফ্রেন্ড সার্কেলে মুমিতকে বয়ফ্রেন্ড হিসেবে বলে বেড়াতে লাগলো। কথাটা মুমিতের কানে আসলো অন্যভাবে। 
সরাসরি মুমিতকে কখনো প্রপোজ না করাতে, মুমিতও সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে যায়নি। কৌশলে শুধু জুওয়াইরিয়াকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলো মুমিত। বুদ্ধিমতী মেয়ে জুওয়াইরিয়া। ওকে মুমিতের এড়িয়ে চলা ঠিক ধরে ফেললো। সিদ্ধান্ত নিলো, মুমিতের প্রেমে পড়ার কথাটা এবার সরাসরি ওকে বলেই দেবে জুওয়াইরিয়া। যেদিন বলেছিল, সেইদিনের পরিস্থিতি ছিল তো অত্যন্ত ভয়াবহ।