পোস্টস

প্রবন্ধ

জীবনের উপমা, দর্শন ও বাস্তবতা

২৭ জুলাই ২০২৪

সাজ্জাদুল করিম

আমি সাধারণত গল্প করতে পারি না। গল্প করতে বসলে কঠিন কঠিন সব কথা চলে আসে। যদিও কঠিন কঠিন কথা বলার মত জ্ঞান বা বয়স কোনোটাই আমার হয়নি। তবে মাঝে মাঝে পছন্দের কাউকে পেলে তার কাছ থেকে গল্প শুনতে চেষ্টা করি। এই তো সেদিন আমার এক প্রিয় মানুষের সাথে জীবন নিয়ে গল্প করছিলাম। গল্পের ছলে উনি জীবনের এক চমৎকার উপমা দিয়ে বসলেন- “জীবন কাঠ পেন্সিলের মত, ধার করতে করতেই ফুরিয়ে যায়।” তাৎপর্যপূর্ণ কথা বটে। যদিও জীবন নিয়ে মানুষের চিন্তার শেষ নেই। নানা মুনির নানা কথা আমরা এপ্রসঙ্গে জানতে পারি। কেউ কেউ বলেন- জীবন হলো কিছু ঘন্টা-মিনিট-সেকেন্ড, দিন-রাত, মাস-বছর ইত‌্যাদির সমষ্টি। আবার কারোও কারোও মতে-জীবন হলো কিছু অভিজ্ঞতা, ভালো লাগা, মন্দ লাগার সমাহার। আবার অনেকে এভাবেও বলে থাকেন- জীবন হলো কিছু স্বপ্ন, কিছু বাস্তবতা; কিছু প্রাপ্তি, কিছু অপ্রাপ্তি; কিছু ঘটনা, কিছু দুর্ঘটনা; কিছু আশা, কিছু নিরাশার সম্মিলিত প্রতিচ্ছবি। এভাবে জীবনের মানে খুঁজতে গিয়ে ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান, অধিবিদ্যা এরকম নানা ধরণের মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একেক জনগোষ্ঠী ও সংস্কৃতির কাছে এই প্রশ্নের উত্তরও একেক রকম হয়ে থাকে। বুদ্ধদেব গুহ জীবনের উপমা দিতে গিয়ে বলেন- “জীবন একটা সমুদ্রের মত- বিশাল, দিগন্তবিস্তৃত- আবর্তময়। এ এক মত্ততায় ভরা ঢেউয়ের সমুদ্র, ঢেউ, তারপর ঢেউ, তারপর আরো ঢেউ। এখানে অনেক ফেনা, ডুবে যাওয়া, পাথর আছড়ে পড়া আবার আশ্চর্য নীল শান্তও কখনও কখনও। সত্যিই জীবন একটা দারুণ গোলমেলে নোনা-স্বাদে ভরা দুরন্ত অভিজ্ঞতা।”আক্ষরিক অর্থেই জীবন সমুদ্রের মতো নানা উত্থান-পতন, জোয়ার-ভাটা, সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশার দোলাচলে ভরপুর। ক্রিনেট নামক আরেক মনীষী বলেছেন- “জীবনকে এক পেয়ালা চায়ের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। যতোই তৃপ্তি সহকারে আমরা তা পান করি, ততোই দ্রুত তলার দিকে অগ্রসর হতে থাকে।”  বাস্তবিকইজীবনের যত আনন্দ-উচ্ছাস, অর্জন-প্রাপ্তি, সুখ-স্বচ্ছন্দ, বিত্ত-বৈভব, প্রভাব-প্রতিপত্তি সবকিছুই মৃত্যুর কাছে অসহায়। জীবনকে যত ভালভাবেই যাপন করিনা কেন মৃত্যুই তার শেষ পরিণতি। এই জীবনকে যাপন করতে করতেই আমরা ধীরে ধীরে এর পরিণতিতে পৌঁছি। আবার আমার কাছে জীবনকে পাঠশালার মতো মনে হয়। জীবনের প্রতিটি পর্যায় পাঠশালার এক একটি শ্রেণির ন্যায়। শিশুকাল হলো প্লে-গ্রুপ, কিশোর বয়স প্রথম শ্রেণি, তরুণ বয়স দ্বিতীয় শ্রেণি, যৌবনকাল হলো চতুর্থ শ্রেণি আর বার্ধক্য হলো পঞ্চম শ্রেণি। পাঠশালায় প্রতিটি শ্রেণিতে নতুন নতুন বিষয়ে জ্ঞান আহরণের মধ্য দিয়ে যেমন পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে হয় অনুরূপ জীবন নামক এই পাঠশালায়ও নানাভাবে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করার মধ্য দিয়ে আমাদেরকে জীবনের পরবর্তী স্তরে পৌঁছাতে হয়। সুনির্মল বসুও যেমনটি বলেছেন- “বিশ্ব জোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র, নানান ভাবের নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র।”  

২.

আবার জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, জীবনের দর্শন নিয়েও গুণীজনদের চিন্তা-ভাবনার শেষ নেই। জীবনের অর্থ খুঁজতে গিয়ে কত জন কত কিছুই না বলেছেন! যেমন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস জীবনের দর্শন সম্পর্কে বলেছেন- “মৃত্যুর চেয়ে কঠিন হচ্ছে জীবন। কেননা দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ কেবল জীবনেই ভোগ করতে হয়, মৃত্যু তা থেকে মুক্তি দেয়।”সত্যিই এত ব্যথা-বেদনা, দুঃখ-কষ্ট, হাঁসি-কান্না সত্যেও জীবন আকাঙ্ক্ষিত। অন্ধকার আছে বলেই আলোর যেমন কদর অনুরূপ মৃত্যু আছে বলেই জীবন এত লোভনীয়, এত আকর্ষণীয়, এত মায়া, এত ভালোবাসা। তাইতো রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- “মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই।” এই বাঁচার আকাঙ্ক্ষা সর্বজনীন। আমাদের মধ্যে কে আছে যে, এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যেতে চায়? কেউ চায় না। যদিও চলে যাওয়াই চরম ও পরম সত্য। আমাদের সকল অর্জন, সকল কীর্তি, সকল প্রাপ্তি মহাকাল ঠাঁই দিলেও আমাদেরকে সে ঠাঁই দেয় না। মহাকালের অতল গহ্বরে আমরা হারিয়ে যাই। ‘সোনার তরী’ কবিতায় যেমন তিনি বলেছেন- “ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই! ছোট সে তরী আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি। শ্রাবণ গগন ঘিরে ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে, শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি, যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।” অন্যদিকে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে জীবনকে বৃষ্টির সাথে তুলনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে- “তোমরা জেনে রেখো পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক, জাঁকজমক, পারস্পরিক গর্ব-অহংকার প্রকাশ, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে আধিক্যের প্রতিযোগিতা মাত্র। এর উদাহরণ হলো বৃষ্টি, যার ফলে উৎপন্ন ফসল কৃষককে চমৎকৃত করে। অতঃপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তা হলুদ বর্ণ দেখেতে পাও, অবশেষে তা খড়-কুটায় পরিণত হয়…” (৫৭:২০)। প্রথমত এখানে জীবনের এক পরম বাস্তবতা উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে- আমাদের জীবন শুরু হয় অর্থাৎ শৈশব ও কৈশর কাটে খেলাধুলা ও ক্রীড়া-কৌতুক নিয়ে, তারপর যৌবনকালে আমরা সাজ-সজ্জা, শোভা-সৌন্দর্য্য, জাঁকজমক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরি, সবশেষ বার্ধক্য কাটাই ধন-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, সন্তানাদির আধিক্য নিয়ে গর্ব ও অহংকার করতে করতে। দ্বিতীয়ত একটি চমৎকার উপমার মাধ্যমে জীবনকে এখানে চিত্রিত করা হয়েছে। বলা হচ্ছে- বৃষ্টির ফলে যেমন গাছপালা, তৃণলতা, বৃক্ষরাজি সবুজ-শ্যামল হয়ে উঠে, ফুল-ফসলে ভরে যায় যা, কৃষককে আনন্দিত করে ঠিক তেমনি- জীবনের জন্যই ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, শোভা-সৌন্দর্য্য, প্রভাব-প্রতিপত্তি আমাদের কাছে এত মূল্যবান, লোভনীয়, আকাঙ্ক্ষিত। জীবন যতক্ষণ আছে ততক্ষণই এগুলো আমাদেরকে আনন্দ দেয়, চমৎকৃত করে। তারপর এই সবুজ, সজীব ফসল একসময় যখন শুকিয়ে ধূসর বর্ণ ধারণ করে এবং অবশেষে তা খড়-কুটায় পরিণত হয়ে যায় অনুরূপ আমরাও ধীরে ধীরে আমাদের সজীবতা হারাতে থাকি, নির্জীব হয়ে যাই, জীর্ণ-শীর্ণ হতে থাকি এবং অবশেষে জীবন প্রদীপ নিভে যায়, পঁচে-গলে মাটির সাথে মিশে যাই, ধূলিকণায় পরিণত হই। আহ! এই তো জীবন, জীবনের চরম বাস্তবতা। 

আচ্ছা, এই জীবন কি শুধুই খাওয়া-দাওয়া আর ভোগ বিলাসের নিমিত্ত মাত্র? জন্ম ও মৃত্যুর মাঝের সময়টুকুকে অতিবাহিত করাই কী জীবনের লক্ষ্য? তাই বা যদি হবে তাহলে অন্যান্য সৃষ্টির সাথে মানুষের পার্থক্য কোথায়? তাহলে এত মূল্যবান জীবন স্রষ্টা মানুষকে কেন দিলেন? আবার সৃষ্টির সেরা হিসেবেও কেন আখ্যায়িত করলেন? জীবন নিয়ে আমরা ভাবি না বলেই এর উত্তর আমরা খুঁজে পাই না, জীবনের মূল্য আমরা বুঝতে পারি না, জীবনকে আমরা হেলায় নষ্ট করি। জীবনের চেয়ে জীবিকাই (জীবনকে যাপনের উপকরণ) আমাদের কাছে মূখ্য হয়ে উঠে। অথচ আমরা ভুলে যাই যে, জীবনের জন্যই জীবিকা, জীবিকার জন্য জীবন নয়। জীবনই যদি না থাকে তাহলে জীবিকার কিই বা প্রয়োজন। সত্যি বলতে কি, আমরা জীবনকে অনুভব করি না, জীবনের অর্থ বুঝি না, জীবনের দর্শন খুঁজি না। জীবন সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানি তা আমাদের পরিপার্শ্ব থেকেই জানা যা, ভুলে ভরা। আবার এর জন্য আমরা জানার চেষ্টাও করি না বা নিজেরা চিন্তা-ভাবনা করি না, পড়াশোনা করি না। আর করবোই বা কিভাবে যেখানে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় জীবনের কোনো আলোচনাই নেই, যা কিছু আছে তার পুরোটাই জীবিকা (ক্যারিয়ার) সম্পর্কিত। প্রচলিত এই ব্যবস্থায় জীবিকাকে যতটা গুরুত্ব দেয়া হয় জীবনকে ঠিক ততটাই গুরুত্বহীন মনে করা হয়। ফলস্বরূপ আমরা দেখি বড় বড় নামিদামি প্রতিষ্ঠান থেকে লেখাপড়া করে ক্যারিয়ারে সাফল্য লাভ করলেও জীবনের মঞ্চে অনেকেই ব্যর্থ। আর এই ব্যর্থতা অনেকাংশে তাদেরকে জীবন সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ করে, আত্মহননে অনুপ্রেরণা জোগায়। জীবনকে কী করে সুন্দর করতে হয়, অর্থবহ করে তুলতে হয়, আনন্দময় করতে হয়, মহান করতে হয় তা আমরা শিখি না। এজন্যই দিন শেষে জীবন নিয়ে আমরা কেউ সুখী নই, হতাশায় ভরা আমাদের জীবন। জীবন সম্পর্কে, জীবনের সত্যিকার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমরা জানি না বলেই জীবন নিয়ে আমাদের এত হতাশা, এত অভিযোগ। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই সময়ে এসে যে সত্যটি আমরা আরও বেশি করে প্রত্যক্ষ করছি। উদাহরণস্বরূপ আমরা বলতে পারি সারা পৃথিবীতে আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) Suicide worldwide in 2019 শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- সারা বিশ্বে প্রতিবছর ৭০৩০০০ জন মানুষ আত্মহত্যাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করে এবং এই সংখ্যাটি ম্যালেরিয়া, এইডস, স্তন-ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে বা যুদ্ধ ও হানাহানিতে মৃত্যুর থেকেও বেশি। আর এরকম অকাল মৃত্যুর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হলো- জীবনের মূল্য না বুঝা। তাই আসুন- জীবন নিয়ে চিন্তা করি, জীবনকে অনুভব করি, জীবনের মূল্য বুঝি, জীবনকে ভালোবাসি।