পোস্টস

গল্প

শূন্যতার শুকতারা

২৩ মে ২০২৪

মাহবুব হোসেন

সার্জারির এসোসিয়েট প্রফেসর ডাঃ এস আহমেদ বারের এক কোণে বসে আছেন, সামনে স্কচের বোতল। 

গ্লাসে দু'কিউব বরফ রাখতে রাখতে তার অহনার কথা মনে পড়ে গেল। অহনা এইভাবে কোক খাওয়ার আগে আইস-কিউব রাখতো, তারপর এক টুকরো লেবু দিত, শেষে ধীরে ধীরে কোক ঢালত। 

তখন তিনি শুধুই সুলতান, ডাঃ সুলতান আহমেদ হওয়ার বহু আগের কথা। অহনা তখন ইকোনমিক্সে অনার্স পড়ে। ঢাকা মেডিকেল থেকে নীলক্ষেতের মোড়ে এসে সুলতান দাঁড়াত, হোস্টেল থেকে এসে অহনা কখন পাশে দাঁড়াবে এই অপেক্ষায়। তারপর দুজন মিলে রিকশায় ঘোরাঘুরি, ফুচকা-চটপটি, একসাথে বৃষ্টিতে ভেজা, বৃষ্টির জলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা, অস্ফুটস্বরে বলা 'ভালোবাসি' ... 

সুলতান এমবিবিএস পাশ করার আগেই অহনার বিয়ে হয়ে যায়, পাত্র পুলিশ অফিসার। তখনকার সময়ে প্রেম শব্দটা তেমন একটা গুরুত্ব পেত না মুরুব্বিদের কাছে, তাদের কাছে পাত্র কি চাকরি করে সেটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মোবাইল সে যুগে ছিল না, অহনাদের বাড়ির ল্যান্ডফোনে কয়েকবার চেষ্টা করেও পাওয়া যায় নি। সুলতান অহনাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান দেখল, বড় বড় গাড়ি এসে থামল বাড়ির সামনে। হাজারো মানুষের ভিড়ে একজন নগণ্য দর্শকের মত দাঁড়িয়ে অহনার বিদায় দৃশ্য দেখল সুলতান। দূর থেকে অহনাকে দেখা ছাড়া কিছু করার ছিল না সেদিন। অহনা কাঁদছিল অঝোর ধারায়, হতভম্ব সুলতান বুঝে উঠতে পারছিল না এই কান্না একটা মেয়ের নিজের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার, নাকি ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে অন্যের ঘরণী হওয়ার। 

সেটা জানার সুযোগ আরেকদিন এসেছিল। বছরখানেক পরে, সুলতান তখন ইন্টার্ন ডাক্তার। ওটি শেষে কলিগ দেবাশীষকে নিয়ে নিউমার্কেটে এসেছিল কি একটা কাজে, হঠাৎ অহনার সাথে দেখা। অহনার হাতে ব্যাগ, শাড়িপড়া অহনার সামনে পড়ে সুলতান বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। অহনা মাথা নিচু করে হেঁটে চলে গিয়েছিল সেদিন।

দেবাশীষ সুলতানকে জিজ্ঞেস করেছিল,'তুই ওর সাথে কথা বললি না কেন? তোকে ছেড়ে গেল কেন সেটা শুনবি না?' সুলতান আনমনে উত্তর দিয়েছিল, 'সেকথা জেনে কি হবে রে... ও সুখী আছে কিনা সেটা জিজ্ঞেস করা যেত... ওকে পেতে চাওয়াটা ছিল ক্ষুদ্রতা, এরচেয়েও অনেক বেশি জরুরী ছিল ওর ভালো থাকা... ' 

দেবাশীষ আর কথা বাড়ায় নি, হয়তো পুরনো ক্ষত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায়নি। 

-------------------- 

এরপর বহু বছর কেটে গেছে। 

ছোট ভাইবোনদের মানুষ করার তাগিদে চাকরি করতে হয়েছে, ডিগ্রী করতে হয়েছে। তিন বছর আগে ছোট বোনটার বিয়ে দেয়ার পর থেকে সুলতান সাহেবের দায়বোধ অনেকটা কমেছে। অবিবাহিত থাকায় আর কোন পিছুটানও নেই। জীবন বা ক্যারিয়ার নিয়ে কোন উচ্চাশা তো দূরের কথা, নূন্যতম চিন্তাও সুলতান সাহেবের মাথায় নেই। বয়স পঞ্চাশ পার হলেও দেখলে মনে হয় আরও বেশি, ড্রিঙ্ক করার অভ্যেসটা কি চেহারার উপর বয়সের ছাপ ফেলে দেয়? 'এজিং ফিজিওলজি' নিয়ে প্রফেসর শরাফাতের সাথে কথা বলা দরকার, নিঃসঙ্গ সুলতান সাহেবকে মাঝেমধ্যে বারে সঙ্গ দেয় শরাফাত। আজ অবশ্য শরাফাত কাছে নেই, জেলা শহরের নতুন মেডিকেল কলেজের মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান হওয়ায় শরাফাতের প্র্যাকটিস এর মধ্যেই বেশ জমে উঠেছে। 

মানুষের জীবনে ব্যস্ততা এক অদ্ভুত জিনিস, নিমেষেই বন্ধুবান্ধবদের থেকে আলাদা করে দেয়। 

হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। 

সার্জারির এসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার শামস কল করেছে, অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফোনটা রিসিভ করতেই শামসের উদ্বিগ্ন গলা শোনা গেল,'স্যার, একটু ঝামেলা হয়েছে...' 

সুলতান সাহেবের চতুর্থ পেগ শেষ হয়েছে, এখন পঞ্চম পেগ চলছে। তিনি কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললেন,'হ্যাঁ বলো শামস, কি ব্যাপার?'

'স্যার, নীলগঞ্জে নির্বাচন নিয়ে মারামারি হয়েছে। পুলিশসহ ১৭ জন আহত, তার মধ্যে ৫ জন গুলিবিদ্ধ। রফিক স্যার একটা ওটিতে দাঁড়িয়ে আছেন, আমরা বাকিগুলো দেখছি কিন্তু স্যার দুটো খুবই কমপ্লিকেটেড কেস, গুলি সম্ভবত হার্টে লেগেছে। স্যার আপনি না আসলে আমরা সাহস পাচ্ছি না...' 

সার্জারির কনসালটেন্ট রফিকসহ অন্যরা মিলেই সাধারণত অপারেশন থিয়েটারের রুটিন কাজকর্ম করে, সুলতান সাহেব একাডেমিক কার্যক্রম দেখেন। রোগী দেখা কিংবা চেম্বার করা- এসব ব্যস্ততা তার ভালো লাগে না। ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে নিজের নিঃসঙ্গতা কাটানোর চেষ্টা করেন, খুব ঝামেলার অপারেশন হলে একটু গাইডলাইন দেন, কিংবা সুপারভাইজ করেন- এর বেশি না। বেশ কয়েক বছর ধরেই সুলতান সাহেব লক্ষ্য করেছেন, তার Intention Tremor তৈরি হয়েছে, ভেবেচিন্তে কিছু করতে গেলেই হাত কাঁপে। সার্জন হিসেবে এটা একটা বিশাল দুর্বলতা, তবে রোগী নিয়ে কাজ কমিয়ে দেয়ায় সুলতান সাহেব কিছুটা নির্ভাবনায় আছেন। 

এখন পঞ্চম পেগের মধ্যে হাসপাতালে যাওয়া ঠিক হবে কিনা সেটা নিয়ে সুলতান সাহেব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। সংশয়ের মধ্যে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন, কর্তব্য এড়ানো যায় না, অন্তত সুলতান সাহেব জীবনে কখনো কর্তব্য এড়াননি।

 -------------- 

সার্জারি ওয়ার্ডে উপচে পড়া ভিড়। ঠেলেঠুলে ওয়ার্ড পার হয়ে সুলতান সাহেব ওটির কাছে চলে গেলেন, সেখানেও ভিড় কম না। ডাক্তারদের চেঞ্জরুমে গিয়ে সবুজ গাউন আর মাস্ক পড়ে বের হওয়ার সময় এনেস্থেশিয়ার জুনিয়র কনসালটেন্ট জব্বারের সাথে দেখা। 

'স্যার চলে এসেছেন? যা ঝামেলা হচ্ছে। আজ রাতের কাহিনী লিখে রাখার মত,বুঝেছেন... এক গ্রুপ ইলেকশন নিয়ে হাঙ্গামা শুরু করেছে, আরেকগ্রুপ গোলাগুলি শুরু করেছে... দুপক্ষের লোকজনের সাথে পুলিশও কম খায়নি, এসপি এসআই-সহ তিনজন আহত... এসপিকে মনে হয় বাঁচানো যাবে না... আপনি একটু দেখেন... ঢাকায় রেফার করবেন কিনা... স্যার, আমি কিছু জিনিসপত্র আনতে নিচে যাচ্ছি... একটু পরেই ওটিতে আসছি...'

'যাও... আর শোনো, আমার গাড়ি পারকিং লটে আছে... ড্রাইভারকে বলবে আমার সিগারেটের প্যাকেটটা দিতে... সারারাত জাগা লাগবে কিনা কে জানে...' 

জব্বার বের হবার পর সুলতান সাহেব ওটির ভেতরে ঢুকলেন, ঠিক ঢোকার পথে গেটের পাশেই পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে দেখে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। 

এই মুখ হাজার বছর পর দেখলেও তিনি ভুল করবেন না। 

কিন্তু ও এখানে কেন? 

টলতে টলতে সুলতান সাহেব ওটিতে ঢুকে দরজা চাপিয়ে দিলেন। উদ্বিগ্নমুখে শামস ছুটে এলো,'স্যার এসপি সাহেবের অবস্থা একটু দেখেন, এ্যাম্বুলেন্স রেডি আছে, আপনি বললেই ঢাকায় রেফার করে দিচ্ছি, আমাদের এই সাপোর্টে কার্ডিয়াক সার্জারি তো হবে না...'
 
সুলতান সাহেব ওটি টেবিলের পাশে দাঁড়ালেন। মানুষটাকে আগে কখনো দেখেননি, তবু অদ্ভুত একটা অনুভূতি সুলতান সাহেবকে আচ্ছন্ন করল। 

পালস দেখে শামসকে বললেন,'এই রোগী ঢাকায় নেয়ার আগেই মারা যাবে, হয় এখনি কিছু করতে হবে, নাহলে...' 

'তাহলে কি করব স্যার...' 

'তিনজন এসিস্ট্যান্ট দাও... এক্ষুনি...' 

সুলতান সাহেবের গলার স্বর শামসের কাছে অদ্ভুত শোনাল। 

স্যার তো সাধারণত এভাবে কথা বলেন না। শামস দ্রুত ওটির জন্য প্রস্তুত হতে লাগলো। 

সুলতান সাহেবের মাথায় ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অহনার হাসি, কাঁটাবনের ফুলের দোকান, ঢাকা মেডিকেলের ইন্টার্ন হোস্টেলের বিনিদ্র রাত, এফসিপিএসের গোল্ড মেডেলের গায়ে জড়ানো ধুলো, স্কচ-হুইস্কির শূন্য বোতলে নিজের প্রতিচ্ছবি আরও কত কি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে... 

মাথার ভেতর পিজি'র বিখ্যাত প্রফেসর রহমান সাহেবের গমগমে কণ্ঠ বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে-'it's not you fighting on the battlefield, but a soul praying to the almighty... সেবা জিনিসটারে প্রফেশন বানায়ো না বাবা, এইটা তোমার ধ্যান, এইটা তোমার ইবাদত... যত গভীরে তুমি যাবা, ঈশ্বর তোমার তত কাছে আসবে...' 

সুলতান সাহেব দ্রুত হাত লাগালেন, তাকে ধ্যানের খুব গভীরে যেতে হবে, অন্ধকার এক অনন্তের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা চাইবেন তিনি... কারো সুখের জন্য পুরনো সুরে নতুন একটি প্রার্থনা... 

সার্জারির সব ডাক্তার, ওটিবয়, নার্সরা এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। এসোসিয়েট প্রফেসর এস আহমেদের tremor-এ ভোগা হাতদুটো ইস্পাত কঠিন হয়ে ওটি টেবিলে বিচরন করছে, হাতের কাজ দেখে মনে হচ্ছে কোন এক দক্ষ কারুশিল্পী তুলির আঁচড় দিচ্ছেন পরম মমতায়। 

এস আহমেদ সাহেবের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে, কিন্তু কেউ সাহস করে চোখ মুছে দিতে পারছে না। ওটিতে কারো গায়ে হাত দেয়ার নিয়ম নেই, আর এভাবে সার্জনের কাঁদার কোন ইতিহাসও নেই। প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটার এই রূপ কেউ কোনদিন দেখেনি। 

সিগারেটের প্যাকেট হাতে জব্বার শামসের পাশে এসে দাঁড়ালো, জিজ্ঞেস করল,'কি অবস্থা?' 

শামস উত্তর দিল না। যদি এই অপারেশন সাকসেসফুল হয়, তাহলে এটা হবে এই হাসপাতালের ইতিহাসের প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি।

 ------------ 

সাড়ে তিন ঘণ্টা পরের কথা। 

পোস্ট-অপারেটিভ বেডে এসপি সাহেবকে নেয়া হয়েছে,পালস-বিপি ইমপ্রুভ করছে।

 সুলতান সাহেব হাসপাতালের ছাদে এসে দাঁড়ালেন, মার্লবোরো সিগারেট ধরিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। বহু বছর আগে একটি মেয়ে তাকে তারা দেখা শিখিয়েছিল... লুব্ধক, শুকতারা, সপ্তর্ষি- আরও অনেক তারা-ছায়াপথের নাম জানত মেয়েটি। 

আকাশের দিকে তাকিয়ে সুলতান সাহেব লুব্ধক খোঁজার চেষ্টা করলেন, কিন্তু খুঁজে পেলেন না। 

আকাশের ঐ তারার মত জীবনের অনেক কিছুই তিনি খুঁজে পাননি, তবু ভেজা চোখে আকাশপানে তাকিয়ে থাকেন... নীরবতায়... প্রার্থনায়... শূন্যতায়...