তিতাস উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা আইসিটি কমিটির সভাপতি, মঙ্গলকান্দি সিনিয়ার ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা নুরুল আমিন স্যার এই কুয়াকাটা আনন্দ ভ্রমণ এর ব্যবস্থা করেন। এছাড়া তিতাস উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা আইসিটি কমিটির অন্যান্য সদস্য যেমন, গাজীপুর খান কলেজের ফারুক আহমেদ, শাহাদাত হোসেন মানিক, জগতপুর সাধান উচ্চ বিদ্যালয়ের ফারুক মিয়া, লালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের হোসাইন সরকার বাবু, ইউসুফ স্যার, গাজীপুর আজিজিয়া মাদ্রাসার মোজাম্মেল হক, মজিদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের আতিকুর রহমান, কেশব বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাওলানা বিল্লাল হোসেন (মৌসুমী আপার স্বামী), জিয়ারকান্দি সিনিয়ার মাদ্রাসার শ্রী প্রদীপ চন্দ্র, মঙ্গলকান্দি ফাজিল মাদ্রাসার আটজন শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দ এই কুয়াকাটা আনন্দ ভ্রমণে শরীক হয়।
আমরা ০৮ ফ্রেব্রুয়ারি তিনটায় পাচটা ঢাকা সদরঘাটে যাই এবং লঞ্চের ক্যাবিন ভাড়া করি। আমাদের অন্যান্য সদস্যদের জানিয়ে দেই বিকেল পাচটার মধ্যে ঢাকা সদরঘাটে আসতে। সবাই সময় মত চলে আসে। ইফাদ-১ লঞ্চে করে আমতলিতে যাই। লঞ্চে ফটো সেশন, ফেসবুকে লাইভ ইত্যাদি আনন্দ করতে করতে কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। রাতে লঞ্চে মুরগী, ডাল, সবজি দিয়ে ক্যাবিনেই রাতের খাবার খাই। সকালে আমরা আমতলি পৌছানোর পর গাড়ী দিয়ে কুয়াকাটায় যাই। কুয়াকাটায় ফারুক স্যারের বন্ধুর মাধ্যমে হোটেল ভাড়া করি এবং সকালের নাস্তা খাই। হোটেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা ফাতরার বনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই।
তালতলী উপজেলার বড়বগী ইউনিয়নের টেংরাগিরি মেীজায় টেংরাগিরি বন অবস্হিত। টেংরাগিরি বনই ফাতরার বন নামে পরিচিত। ফাতরার বনের দক্ষিন কোল ঘেষে যে সমুদ্র সৈকত তার নামই সোনাকাটা সৈকত। এই বন পূর্ব-পশ্মিমে ৯ কি:মি: এবং উওর দক্ষিনে ৪ কি: মি: এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এখানে বিভিন্ন প্রকারের সাপ, হরিণ, পাখি, ও প্রকৃতিক জীববৈচিত্র্র্র্ ইকো পার্ককে আকর্ষনীয় করে তুলেছে। সোনাকাটা ইকোপার্কে ও আশার চরে সোনা নেই ঠিকই, কিন্তু আছে সোনার রঙে রাঙিত বালি। সূর্যের রশ্মি যখন বালির ওপর পড়ে তখন দূর থেকে মনে হয়, সত্যি সত্যিই সোনার আবির্ভাব হয়েছে এখানে। সোনাকাটা ইকোপর্কে রয়েছে বিশাল বনভূমি। বন বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে, সুন্দরবনের পরেই আয়তনের দিক থেকে এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনাঞ্চল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সুবিশাল সমুদ্র সৈকত।
এলাকাবাসীর কাছে সোনাকাটা ও আশারচরের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের প্রতীক। সাগরে যখন জোয়ারের জল উথলে ওঠে তখন চাদের আলোয় অন্য এক সৌন্দর্যে রূপ নেয় এই আশারচর । প্রতিনিয়তই তীরে আছড়ে পড়ছে ছোট-বড় ঢেউ। ঝুরঝুরে বালি গলে পড়ছে লোনা জলে। সবুজ ঘন অরণ্যের নিবিড়তা ছেয়ে আছে চারপাশজুড়ে। মৃদু মৃদু বাতাস আর ঢেউয়ের তালে এই চরের ছোট-ছোট বাঁওড়ে অথবা খালে চলে জেলেদের নৌকাগুলো। বিভিন্ন ধরনের জাল ফেলে মাছ ধরছে জেলেরা।
সরকার ১৯৬০ সালে এটিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করা হয়। আর ১৯৬৭ সালে নামকরণ হয় টেংরাগিরি বন নামে। চোখজুড়ানো এই বনের আয়তন ১৩ হাজার ৬৪৪ একর। সুন্দরবনের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় এ অরন্যে প্রবাহিত অসংখ্য ছোট খাল দিনে দু’বার জোয়ার-ভাটায় প্লাবিত হয়। লবণাক্ত ও মিষ্টি মাটির অপূর্ব মিশ্রণের কারণে এই বনে রয়েছে বিলুপ্ত প্রজাতির অসংখ্য সারি সারি গাছ, পশু-পাখি এবং সরিসৃপের বসবাস। কয়েকজন বনরক্ষী ছাড়া এখানে কোন স্থায়ীভাবে বসবাস নেই।
বনের সবুজ অরণ্যর মাঝে প্রবাহিত অসংখ্য ছোট খালের ওপর রয়েছে বাঁশের সাঁকো, বন বিভাগের রেস্টহাউস, মিঠা পানির পুকুর, পিকনিক কর্নার। ঘন গহিন অরণ্যে পেরিয়ে নামা যায় সৈকতে। নাগরিক কোলাহল থেকে ক্ষণিক সময় সাগরের বিশালতার মাঝে সবুজ এ অরন্য মুগ্ধ করে ভ্রমণপিয়াসী মানুষকে।
বিকেলে আবার কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে হাটা-চলা করি। কেউ কেউ স্থানীয়দের মাধ্যমে ছবিও তোলেছে। আমি আমার মোবাইলেই ছবি তোলেছি।
পরেরদিন সকালে ফজর নামাজ পড়ে সবাই বের হলাম সূর্্য উদয় দেখতে। স্থানীয় মোটর সাইকেল ভাড়া নিলাম। সূর্য দেখার স্থানে পর্যটকের ভীর লক্ষ্য করলাম। একটু শীত শীতও লাগছে। সাথে গাইড বলল, স্যার একটু পরেই গরম লাগবে কাজে পোশাক পরিবর্তনের দরকার নেই। শত শত মানুষ সূর্য উদয় দেখার জন্য ভীর করছে আর মোবাইলে ভিডিও ধারণ এবং ছবি তোলছে যা অসম্ভব সুন্দর লাগছে। সূর্য উঠার পর পরই আমরা ঝাউবনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। সমুদ্রের পাশে ঝাউবন দেখবো না তা কি হয়। যাবার সময় অতিথি পাখি এবং লাল কাকড়াও চোখে পড়েছে।
একটি আদিবাসীদের মন্দির ও স্কুল ভিজিট করি। কয়েকজন স্থানী আদিবাসী শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলি। তাদের লেখা পড়ার খোঁজ খবর এবং আর্থীক অবস্থা জানি। যা বুঝলাম তারা দারিদ্র সীমার নিচের বসবাস করে।
কুয়াকাটায় দেখা মিলল প্রায় ২০০ বছরের পুরাতন নৌকা। স্থানীয় রাখাইন সম্প্রদায় এবং প্রবীণ নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৮০-৯০ সাল পর্যন্ত নৌকাটি কুয়াকাটা সৈকতের একই স্থানে বালুর ওপর কিছু অংশ জেগে থাকতে দেখা যায়। পিতলের পাতে মোড়ানো নৌকার বিভিন্ন অংশ স্বর্ণের পাত ভেবে তখন দর্শনার্থীরা খুলে নিয়ে যায়। মানুষের মুখে মুখে ‘সোনার নৌকা জেগে ওঠার’ গুজব ছড়িয়ে পড়ায় তখনও সেখানে নৌকাটি দর্শনে অসংখ্য মানুষের ভিড় দেখা গেছে।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের জলোচ্ছ্বাসে এটি আবারও বালুর নিচে চাপা পড়ে। একইভাবে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে বালু সরে গিয়ে পুনরায় দৃশ্যমান হয় নৌকাটি।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় এবং খুলনা আঞ্চলিক অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ৭২ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২৪ ফুট প্রস্থের নৌকাটি তৈরি করা হয় অন্তত ২০০ বছর আগে। স-মিল বা আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকায় তখনকার সময় ছেনি বা কুঠার দিয়ে তেমন কোনো ফিনিশিং ছাড়াই তৈরি করা হয় এই নৌকা। ব্যবহার করা হয়েছে গর্জন অথবা শালকাঠ। পুরো একটি গাছ দিয়েই তৈরি করা হয় নৌকার বাহা, গছা ও গুড়ার কাজ।
কুয়াকাটা যে কুপের নামে নামকরণ করা হয়েছে সেখানে গেলাম, আমি প্রদীপ চন্দ্র এবং গৌরাঙ্গ স্যার। কুয়ার পাশে কুয়াকাটা নামকরণের সংক্ষিপ্ত দেয়া আছে। কুয়াকাটা নামকরণের ইতিহাসের পেছনে যে কুয়া সেটি এখনও টিকে আছে। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের কাছে রাখাইনদের বাসস্থল কেরাণিপাড়ার শুরুতেই প্রাচীন কুয়ার অবস্থান। জনশ্রুতি আছে ১৭৮৪ সালে বর্মী রাজা রাখাইনদের মাতৃভূমি আরাকান দখল করলে বহু রাখাইন জায়গাটি ছেড়ে নৌকাযোগে আশ্রয়ের খোঁজে বেড়িয়ে পড়েন।