সম্পূর্ণ নাটকের পিডিএফ পড়তে ক্লিক করুন।
প্রথম অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
[মঞ্চে প্রবেশের ক্রমানুসারে অভিনেতাগণ: বাউল, ইমাম, শিক্ষিত ছেলে, মোড়লের চ্যালা, মোড়ল এবং ঘোষক। মঞ্চের পর্দা উঠবে। নেপথ্যে বাজবে 'বকুল ফুল' গানের সুর। আলো ধীরে ধীরে আলোকিত করে তুলবে মঞ্চকে। গান চলাকালীন বাউলের প্রবেশ]
বাউল : আমি অপার হয়ে বসে আছি। ওগো দয়াময়, পার করো.... [ইমামের প্রবেশ]
ইমাম : [চরম বিরক্তি ও রাগে] আরে এই মিয়া, থামাও তোমার গান। নাইঝুবিল্লাহ... আস্তাগফিরুল্লাহ। আরে তোমাগো মত মানুষের জইন্যে আইজ গেরামের এই অবস্থা। গ্রামে বাও বৃষ্টি হচ্ছে না, নদী নালা শুকিয়ে যাচ্ছে, জমিতে ফসল ফলছে না... এসময় তোমার মত অকর্মণ্য মানুষ যদি রাস্তায় রাস্তায় এই "অপাআআর হয়ে... বসেএএ আছি" করে গান গেয়ে বেড়ায়, তাইলে সমাজের কোনো উন্নতি হবে?
বাউল : ভাই, আমি বাউল মানুষ। গানই আমার সব। এই যে পথে পথে গান গাই, চারটে পয়সা আসে তাতেই আমার পেট চলে, আমার পরিবার চলে। গান ছাড়া আমি বাচুমই না। আর দেখেন, গেরামের উন্নতির জন্যে যেমন ফসল দরকার, তেমনি আমার মনের শান্তির জন্য গান দরকার।
ইমাম : আরে মিয়া, থোও তোমার গান । মিয়া, গান দিয়ে কি গেরামের উন্নতি হবে? না, জমিতে যাসল ফলবে। এই খরার সময়ে গেরামের উন্নতির জন্যে কাজ করন লাগে, কিছু কাম কাজ করার চেষ্টা...
[শিক্ষিত ছেলের প্রবেশ]
শিক্ষিত ছেলে: আসসালামু আলাইকুম, চাচা। ভালো আছেন?
ইমাম : ওয়ালাইকুম আসসালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। এই তো বাবা, তুমি শিক্ষিত পোলা। আসো বাবা আসো। বাবা, তুমিই কও দেহি, গ্রামের এই দুর্যোগ, খরার সময়ে এই লোক রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে বেড়াচ্ছে। এই করে কি সমাজের কোনো উন্নতি হবে। কও দেহি...
বাউল : [শিক্ষিত ছেলের কাধ ধরে] বাবা দেখো, গান আমার জীবন। গান গেয়ে আমি আমার পেট চালাই। গান ছাড়া... গান ছাড়া আমি বাচুমই না বাবা।
শিক্ষিত ছেলে: আচ্ছা চাচারা, থামেন। আমি দেখছি কি সমস্যা চাচা, আপনি বলেন তো আপনার কি সমস্যা?
ইমাম : এই লোক গান গেয়ে বেড়ার, হারাম কাজ করে, উল্টা কাজকর্ম করেনা, এটাই আমার সমস্যা।
শিক্ষিত ছেলে: বাউল চাচা, আপনার কি সমস্যা বলেন দেখি।
বাউল : বাবা, আমি আমার মনের শান্তির জন্য গান গেয়ে বেড়াই, আর উনি আমারে গান গাইতে দেন না।
শিক্ষিত ছেলে : চাচা, উনি যদি তাঁর মনের শান্তির জন্য গান গান, ছেলে তাহলে আপনার তো কোনো সমস্যা দেখি না। তিনি তো কাউকে বিরক্ত করছেন না।
ইমাম: আরে থাম তুমি। তোমায় এলেম বেশি না আমার এলেম বেশী। তোমার মত কত পোলাপান মানুষ
করলাম আর তুমি আইছ আমারে জ্ঞান দিতে। আরে... এই লোক আজ গান গাচ্ছে। কাল নেশা ভাঙ করে রাস্তায় পড়ি থাকবে, আর ইদিক দিয়ে সমাজ যে রসাতলে চলে যাবে। হ্যাহ... আরে আরে, ওই তো.... ওই তো মোড়ল সাহেব আসছেন....
[মোড়লের চ্যালা পেছনে পেছনের মোড়লের প্রবেশ]\
মোড়লের চ্যালা: হ্যাহ.. হ্যাহ.. হ্যাহ.. আসেন মোড়ল সাব আসেন। থু থু থু ( থুথু দিয়ে চেয়ার পরিষ্কার করে) বসেন চাচা বসেন...আরে মিয়া, থামেন আপনারা। দেহেন না মোড়ল সাব আইছেন।
মোড়ল: (পান খেতে খেতে) আরে শামসু, এইনে কি হইছেরে?
মোড়ল চ্যালা: চাচা, গাঁও গেরামের মানুষ অশিক্ষিত। দেহেন, কি নিজেগো মাঝে কাইজ্জা শুরু করছে।
মোড়ল: আরে মানুষ, গ্রামের এই দুর্দিনে তোমরা এইগুলা কি লাগাইছ। আরে ইমাম, তুমি! বাউলও আছ দেখতাছি। এই শামসু, এই নতুন পোলাডা ক্যাডা?
মোড়ল চ্যালা : চাচা, বিদেশ থেইক্যা পে..পে... কি জানি কয় ঐ যে পেইস... পেইস লইয়া আইছে । বহুত শিক্ষিত।
মোড়ল : পেইস আবার কী?
শিক্ষিত ছেলে: পিএইচডি চাচা। আমি লন্ডন থেকে পিএইচডি করে এসেছি।
মোড়ল চ্যালা: হ চাচা... বড় পেইস...
মোড়ল: তা বাবা পেয়াজ আলু যাই লইয়া আও না ক্যান, ভালা করছ। দেশে পেঁয়াজের বড় অভাব, পেঁয়াজের দাম বেশি। বিদেশী পেয়াজ আনছ ভা1লোই হইসে। তা তোমরা এই নে কি প্যাচাল লাগাইছ কও দেহি? আহ... চোখটা যে কি যন্ত্রণা করে রে...! ( চোখ মালিশ করতে করতে)
বাউল: (পা জড়িয়ে ধরে) মোড়ল সাব, আমি গরিব মানুষ, গান গেয়ে দু চারটা পয়স কামাই। কিন্তু ইমাম সাব আমারে দেয় না, মানা করে।
ইমাম: এই থামো তুমি। দেখছেন মোড়ল সাব, কেমন বেয়াদব। আপনের পায়ে ধইরছে। আপনের বেইজ্জতি করে।
মোড়ল: ধুরো মিয়ারা, গ্রামের মানুষ খাইতে পায় না, আর এই অভাবের মাঝে তুমরা নিজেগো মাঝে লাগাইছ কাইজ্জা। যাও যাও বাড়ি যাও সব। এই শামসু, চল দেহি...
[ঘোষকের প্রবেশ]
ঘোষক: একটি বিশেষ ঘোষনা, একটি বিশেষ ঘোষণা। গ্রামের দক্ষিণ কান্দার জমিতে পাওয়া যাইতাছে সোনা, সোনা, সোনাআআ....
ইমাম : (খুশিতে লাফিয়ে উঠে) মোড়ল সাব, জমিতে নাকি সোনা পাওয়া যাইতাছে, আমাগো আর কোনো অভাব থাকবো না...।
মোড়ল চ্যালা: চাচা.. চাচা । দক্ষিণ কান্দার জমিডা না আফনের।
মোড়ল: আরে... তাইতো.. । আরে ইমাম, আসো আসো। জমিতে সোনা পামু। আমরা তো ধনী হইয়া গেলাম।
[বলতে বলতে মোড়ল, মোড়লের চ্যালা ও ইমামের প্রস্থান]
শিক্ষিত ছেলে: (চিন্তিত ভঙ্গিতে) চাচা, আপনার কি মনে হয়, জমিতে কি কখনও সোনা পাওয়া যায়?
বাউল: বাবা, আমি বাউল মানুষ। আমার কোন লোভ নাই। সে সোনা হোক, হীরে হোক আর যাই হোক। গ্রামের এক কোনায় দুই বিঘা জমি লইয়া বউবাচ্চা লইয়া সুখে থাকি। এতেই আমি খুশি। সোনার আমার দরকার নাই বাবা।
"খাচার ভেতর অচিন...."
[গান গাইতে গাইতে বাউলের প্রস্থান]
শিক্ষিত ছেলে: জমির মাঝে সোনা...
[মাথা নাড়তে নাড়তে শিক্ষির ছেলের প্রস্থান]
(প্রথম দৃশ্য সমাপ্ত)
দ্বিতীয় দৃশ্য
[মঞ্চে চোকার ক্রমানুসারে অভিনেতাগণ : জনাকয়েক গ্রামবাসী রহমান, একজন জ্ঞানী ব্যক্তি, মোড়ল, মোড়লের চ্যালা। গ্রামবাসীর দুটি দল মঞ্চের দুপাশে অবস্থান নিবে। দল-১ মঞ্চের ডানে, দল-২ মঞ্চের বামে। নেপথ্যে মারামারির সময় তবলা বাজবে। দল-২ এর জনৈক গ্রামবাসীর প্রবেশ]
[দল-১]
প্রথম গ্রামবাসী: দক্ষিণ কান্দার জমি আমাগো। এই জমি আমরা লমুউউ..
[দল-২]
দ্বিতীয় গ্রামবাসী: দক্ষিণ কান্দার জমি তোরা নিবি.. তাইলে আমরা কি করমু। আঙ্গুল চুষুম নাকি?
তৃতীয় গ্রামবাসী: আঙ্গুল চুষুম আমরা--
[দল-১]
গ্রামবাসী রহমান : হ... দেইখা লমু তোরা জমি কেমনে লস। এই ল সবাই...
[মারামারি শুরু হবে। প্রথমে দুই দল দুইবার মঞ্চের মাঝে চক্কর দিবে। তৃতীয়বার মারামারি শুরু হবে। এসময় তবলায় পড়বে বিরতিহীন ঢোলের বারি। এর মাঝে হঠাৎ জোরে ঢোলে বারি পড়তেই সকলে যেভাবে ছিল স্থির হয়ে যাবে]
[একজন জ্ঞানী ব্যক্তির প্রবেশ]
জ্ঞানী ব্যক্তি: আপনারা ভয় পাইছেন? [ দর্শকের দিকে আঙুল উচু করে দরাজ কন্ঠে] ভয় পাইয়েন না, ভয় পাইয়েন না। এরা তো.. এরা তো মানুষ না। কি পাইছে জমিতে... হ্যাহ? কি পাইছে? সোনা?? সোনার লোভে ওরা মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলেছে। মানুষ হতে হলে কী লাগে? শুধু হাত পা হলেই কী মানুষ হওয়া যায়? না, শুধু হাত পা হলেই মানুষ হওয়া যায় না। মানুষ হতে হলে বিবেক লাগে, বিবেক। ওরা বিবেক হারাইছে। ওরা মনুষ্যত্ব হারাইছে। মনুষ্যত্ব হারাইয়া ওরা পশুতে পরিণত হইছে। ওরা পশুতে পরিণত হয়েছে... (বিলাপপূর্ন কন্ঠ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাবে)
[বলতে বলতে জ্ঞানী ব্যক্তির প্রস্থান। আবার শুরু হবে বিরতিহীন তবলার ধ্বনি। শুরু হবে মারামারি। এর মাঝে মোড়লের প্রবেশ। এসময় সবাই মারামারি থামাবে]
[মোড়লের প্রবেশ, পেছনে চ্যালা ]
মোড়ল: এই, থাম সব। থাম কইলাম। উফফ.. চোখটা যে কী যন্ত্রণা করে...!!
মোডলের চ্যালা: চাচা, আমার তে ভালো মলম আছে দিমু...?
মোড়ল: আরে তুই চুপ থাক। এই মিয়ারা, তোমরা কি শুরু করছ ? অ্যা.. গ্রামের মানুষ.. খাইতে পায় না, না খাইয়া মরতাছে, আর তোমরা শুরু করছ মারামারি। এই.. কি হইছে রে? কি লাগাইলি?
জনৈক গ্রামবাসী: মোড়ল সাব, আপনে জানেন না, জমিতে সোনা পাওয়া যাইতাছে। আমাগো বউবাচ্চা না খাইয়া মরতাছে। সোনা পাওয়া গেলে, আমাগোর আর কোনো দুঃখ থাকবো না।
রহমান: মগের মুল্লুক্ পাইছ? এই জমিতে আমরা আগে আমরা আগে আইছি। এই জমি আমরা লমু।
মোড়ল: অ্যাই হারামজাদা... চুপ কর। এ কয় সোনা আমার, এ কয় সোনা আমি লমু। এই... জমি কি তগো নাকি। আমার জমি, আমি কারে দিমু আর কারে ভরমু... হেই খবর আমি জানি। দরকার পরলে...
( ভারী স্বরে) জমি আমি নিলামে তুলুম।
মোড়লের চ্যালা: চাচা, ওইডা করেন ওইডা।
মোড়ল: কোনডা!
মোড়লের চ্যালা: ওই যে.. ওই কামডা করেন।
মোড়ল: ওও...। আহ.. চোখটা যে কি যন্ত্রনা করে!! আইচ্ছা শোন... সোনা যদি তোরা চাস, তবে আমি দিবার পারি। কিন্তু... একটা শর্ত আছে?
সকলে: শর্ত !!! (সমস্বরে)
মোড়ল: হ... শর্ত! শর্তডা হইলো... তোরা যারা সোনা চাস, তারা সবাই তগো জমির, তিনভাগের দুই ভাগ জমি... কত?? তিনভাগের দুইভাগ জমি, আমার নামে লেইখ্যা দিতে হইবো।
রহমান : কিহ...! এই, সামান্য সোনার লাইগ্যা, আমি আমার বাপ দাদার জমি লেইখ্যা দিমু। না, আমি এইডা করুম না [রাগত স্বরে]
মোড়ল: কিঃ, (দাড়িয়ে পড়ে) আমার সাথে বেয়াদবি। তগো মতো পুলাপান একসময় আমারে দেখলে ডরে মুইত্যা দিতো, আর তোরা.. তগো এতো সাহস বাড়ছে!!!
[ দল-১ এর একজন বয়স্ক ব্যক্তি]
বয়স্ক ব্যক্তি: (দৌড়ে এসে) চাচা চাচা। থামেন চাচা, এরা জোয়ান মানুষ, মাথাডা গরম হইলেও মনটা বড় নরম, চাচা। আপনে কিছু মনে কইরেন না।
মোড়ল : আরে মিয়া থাম তুমি। এই পুচকে পোলাপান আমার সাথে বিয়াদবি করে, আর তোমরা দেহ বইয়া বইয়া... (রহমানকে বয়স্ক ব্যক্তি মারার ভান করবে) এত সাহস হইছে হেগো। জমি না দিলে... আমি সোনা দিমু না...। চাইলে..
রহমান: লাগব না আমরার সোনা। এই চল তোরা।
[রহমান সহ বয়স্ক ব্যক্তি ছাড়া দল ১ এর সকলের প্রস্থান]
মোড়ল: যা গা তোরা। হ্যাহ.. দিলাম না তগোরে সোনা। তোমরা যারা শর্ত মানবা, জমি খোর গা, যাও। আরে বাউল আসতাছে যে। এই বাউল, ইদিকে আস। শুনলা তো সব। তো, তুমি কী বল।
বাউল : মোড়ল সাব, সোনার প্রতি আমার লোভ নাই। আমার কাছে সোনাও যা, হীরাও তা। আমার কোনো সোনাদানা লাগব না।
মোড়ল: ও... তারমানে তুমি জমি দিবা না..
বাউল: না মোড়ল সাব। আমি আমার যা আছে তাই নিয়া থাকুম।
মোড়ল : আচ্ছা, ঠিকাছে। যাও তুমি। তোমার মত বাউলারে কেমনে সাইজ করন লাগে, সব সিস্টেম আমার জানা আছে।
(ক্রুর স্বরে চাপা কন্ঠে) শামসু, বাউলের চাবিটা যদি ঘুরায়ে দেই,
তাইলে...হাহাহা, চল শামসু চল।
মোড়ল চ্যালা: চাচা... কত যে সোনা পাইব, তা তো আমরা জানি। কি যে মজা লাগে...
[দ্বিতীয় দৃশ্য সমাপ্ত]
দ্বিতীয় অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
[মঞ্চে প্রবেশের ক্রমানুসারে অভিনেতাগণ: জনৈক গ্রামবাসী, শিক্ষিত ছেলে, রহমান, রহমানের সাথী, মোড়লের চ্যালা]
[মঞ্চের একপাশে সোনালোভী গ্রামবাসী মাটি খুড়তে থাকবে].
গ্রামবাসী: [নিজেরা মাঝে আলাপ করছে] আরে তোরা এত আস্তে খোড়তাছস ক্যান। জোরে খোড়। যত তাড়াতাড়ি খোড়বি, তত তাড়াতাড়ি সোনা পাবি।
(অন্যজন)জমি খোড়মু, সোনা পামু। সোনা দিয়া একখান ঘর বানামু। আর একখান বিয়া করমু...।
ধুর, তোরা আউল ফাউল কথা রাখতো। মন দিয়া... সোনা খোড়।
[ শিক্ষিত ছেলের প্রবেশ]
শিক্ষিত ছেলে: (দৌড়ে এসে) ভাই, আপনারা কি করছেন? জমি খোড়ছেন কেন?
জনৈক গ্রামবাসীঃ ভাই তুমি শোন নাই? এই জমিতে সোনা পাওয়া যাইব। সোনা পাইলে আমগোর আর দুঃখ থাকবো না।
শিক্ষিত ছেলে: জমিতে সোনা!!! বিদেশ থেকে এত বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে আসলাম, জমিতে সোনা পাওয়া যায়, এই কথা তে কখনো শুনি নাই। ভাই, তোমরা, মাটি খোড়া কন্ধ কর। জমিতে কখনো সোনা পাওয়া যায় না। এই গুলা গুজব।
জনৈক গ্রামবাসী : এই মিয়া, তুমি.. শিক্ষিত ছেলে আমরা মুর্খ দুঃখী মানুষ... আমাগো.. আমাগো ভালো তোমার সয় না... না.!! যাও তুমি । নাইলে বুকে শাবল চালায় দিমুI (শিক্ষিত ছেলে ভয় পেয়ে চলে যাবে) অ্যাই তোরা খোড়, খোড়তে থাক।
শিক্ষিত ছেলে: (মঞ্চের অন্য পাশে) রহমান ভাই, তোমার কি হয়েছে? মুখ কালো করে আছ কেন?
রহমান: এই জমি আমার বাপ দাদার জমি... আমারে দিয়া দিবার কয়। (চিৎকার করে) হেই মিয়া, (দর্শকের দিকে) আপনেরাই কন, (করুণ বাজনা নেপথ্যে) এই জমিতে (মাটিতে বসে পড়ে)... এই জমিতে
আমি জন্ম লইছি। এই জমি আমারে খাওয়াইছে, বড় করছে। আমারে দিয়া দিবার কয়। (হটাৎ তীব্রস্বরে) না, এই জমি আমি দিবার পারুম না। (আবারো কাঁদতে কাঁদতে ভেঙে পড়ে) এই জমি আমি দিবার পারুম না... এই জমি আমি...
জনৈক গ্রামবাসী: জমিতে নাকি সোনা পাওয়া যাইব। এখন, জমি না দিয়া ভুলই করলাম নাকি।
শিক্ষিত ছেলে: (রহমানকে দুহাতে তুলে ও অপর গ্রামবাসীর কাধে হাত রেখে) রহমান, ভাই। ওরা আপনেগো জমি কাইড়া নিতে চায়। কিন্তু আমরা ওদের দেব না। আমরা প্রতিবাদ করবই।
[এমন সময় নেপথ্যে]
আগুন, আগুন, আগুন...
[বাউল দৌড়ে আসবে]
বাউল: ভাই, ও ভাই, আমার বাড়িত আগুন লাগছে, আমারে বাঁচান, ও ভাই..
রহমান: (দৌড়ে মাটি খোড়া লোকদের কাছে গিয়ে) ও ভাইরা, বাউল ভাইয়ের বাড়িত আগুন লাগছে, ভাই আসেন। নিভাইতে হইবো। জনৈক গ্রামবাসী: ভাই, তোমরা যাও.. যাও। এহন আমাগো সোনা খোড়ার সময়। আমরা এহন কোনো আগুন নিভাইতে পারুম না। যাও তোমরা। অ্যাই তোরা খোড়, তাড়াতাড়ি খোড়।
রহমান: এই চল চল, (তার বন্ধুদের) আমরাই গিয়া আগুন নিভাই চল।
বাউল: ভাই... আর আগুন নিভাইতে হইবো না (করুণ বাজনা) ভাই.. আমার সব শেষ হয়া গেলো। নিষ্পাপ বউটা.. আমার কইলজার মাইয়াডা.. সব গেল, সব শেষ হয়া গেলো ভাই।
(আস্তে আস্তে আলো নিভে আসবে)
[প্রথম দৃশ্য সমাপ্ত]
দ্বিতীয় দৃশ্য
[রাতের বেলা। একপাশে খোড়াখোড়ি চলমান। তারা ক্লান্ত। হালকা কথাবার্তা হবে, কিন্তু দর্শক তা শুনবে না। মঞ্চের মাঝে মোড়ল বসে থাকবে, পাশে তার চ্যালা। আলো থাকবে কম। নেপথ্যে থাকবে ঝিঝিপোকার শব্দ]
মোড়লের চ্যালা: চাচা.. বসেন চাচা... এট্টু জিরান।
মোড়ল : (বসতে বসতে কোমড়ে হাত দিয়ে] আহ.. যে বেদনা... বাতে পঙ্গু হইয়া গেলাম.. একটা পান দে তো...!
মোড়লের চ্যালা: চাচা এই লন, চাচা। দক্ষিণের হাটের থন আপনের লাইগ্যা খাসা পান লইয়া আইছি...
মোড়ল : (পান চাবাতে চাবাতে ) উঃ পান যেন অমৃত। তা শামসু..!
মোড়ল চ্যালা: চাচা কন।
মোড়ল : শামসু, তরে তো আমি ছোট থাইক্যা এত বড় করলাম, সবসময় আমার লগে থাকস। তুই সবই জানস... তা গেরামের খবর ক দেখি।
মোড়লের চ্যালা: চাচা... ওই একটা শিক্ষিত পোলা আছে না...!! হেতে তো বিরাট ঝামেলা শুরু করছে। আপনের সব কামে আঙ্গুল ঢুকাইতাছে।
মোড়ল: ওই শিক্ষিত পোলা! আরে সমস্যা নাই। আমি মোড়ল, দশ বছর ধইরা গেরামে মোড়লগিরি করতাছি, কারে কেমনে শায়েস্তা করন লাগে সব সিস্টেম আমার জানা আছে। খালি চাবি ঘুরায়া দিলেই... সব সোজা হইয়া যাইবো। (গলায় হাত দিয়ে খুনের ভঙ্গি করে) শামসু... যা ওই পোলাডার ভবের বাত্তি নিভাইয়া দিয়া আয়... তুই তো সব বোঝস।
মোড়লের চ্যালা: হ.. চাচা..। এই না হইলে আপনে মোড়ল। এখনই কাম সাইরা আইতাছি চাচা...
(মোড়লের চ্যালার প্রস্থান)
মোড়ল : উহঃ, চোখটা যে কী যন্ত্রণা করে রে... (ধীরে ধীরে মোড়লের প্রস্থান)
[শিক্ষিত ছেলে রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে । এমন সময় পেছন হতে মোড়লের চ্যালা ছুরি হাতে ও সাথে কালো কাপড়ে আবৃত আততায়ীর প্রবেশ]
[ধীরে হটাৎ তারা শিক্ষিত ছেলের পেছনে অবস্থান নেবে। একসময় আততায়ী শিক্ষিত ছেলের হাত মুখ চেপে ধরে পাকড়াও করবে]
মোড়লের চ্যালা: বিদেশ দেশাইরজ্যা তোইস লইয়া আয়া খুব ভাব বাড়ছে না.. না..!! (ছুড়ি মারতে মারতে) কই যাইব এহন তর ভাব। বোঝ ঠ্যালা...
[শিক্ষিত ছেলেকে ছুড়ি মেরে আহত করে আততায়ীরা চলে যাবে। ছেলেটি আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে]
[এসময় মোড়ল প্রবেশ করবে। অন্য পাশ থেকে তার কাছে আসবে তার চ্যালা]
মোড়লের চ্যালা: চাচা, ঝামেলা শেষ কইরা দিসি...
মোড়ল: হাহাহা... ঐ ইন্দুরের বাচ্চা, আমার লগে লাগতে আইছিলি !! হ্যা... আমার লগে যারা ঘাড়ত্যাড়ামি করে, হেগোর ইস্কুপ কেমনে ঘুরাইতে অয় হেই সিস্টেম আমার জানা আছে (মৃতদেহে লাথি মেরে) কিরে কথা কস না ক্যান। বাউলের চাবি ঘুরায়া দিচ্ছি, তুইও খতম...। হাহাহা,.. সব সিস্টেম আমার জানা আছে।
[দ্বিতীয় দৃশ্য সমাপ্ত]
তৃতীয় দৃশ্য
[সকাল বেলা। খোড়াখুড়ির ফাজ চলছে। হটাৎই...]
জনৈক গ্রামবাসী: [হাতের কোদাল ফেলে দিয়ে] ওমা. ..এ..একী মাটি খুড়তে খুড়তে পানি... পানি বাইর হয়া গেল.... সো..সোনা কই. আ..আমগো সোনা কই..... (নেপথ্যে করুণ বাজনা)
[অপর গ্রামবাসী] মোড়ল... মোড়ল আমাগারে ঠকাইছে
[আরও একজন] আমগো সব গেল... সব গেল।
[শেষজন] ও... ওই তো মোড়ল আসতাছে। সবাই চল, মোড়লের কাছে যাই।
[ সবাই মোড়লের কাছে গিয়ে আহাজারি করবে]
চাচা, আমরা সব হারাইলাম, চাচা। আমাগোরে বাচাও চাচা...
মোড়ল : এই তোরা চুপ করস না। কি শুরু করছস। চাচা, সব শেষ, সব হারাইলাম। কি হইসে ঘটনাটা তো কইবি।
গ্রামবাসী : চাচা জমি খুজতে খুড়তে পানি উইঠা গেছে... সোনা নাই চাচা...
মোড়ল : আহহ... চোখটা যে ফী জ্বালা যন্ত্রণা করে রে, তোগো জমিত্থে পানি বাইর অয়, আমার চোক্ষেতেও পানি বাইর হয়া গেছে রে। তা, কি জানি...
গ্রামবাসী : না... না.. আপনে আমাগো ঠকাইছেন... চাচা, আমাগো জমি আমাগো ফেরত দেন।
মোড়ল : ইহহ... শখ কত..! আমাগো জমি ফেরত দেন। তরা আমার থেইকা জমি চাইছস সোনার লাইগ্যা, আমি শর্ত দিছি। কি!! দেই নাই? তখন খেয়াল আছিল না.... এহন তরা সোনা পাস নাই, আমি কি করমু। যা যা, আহহ, চোখের যন্ত্রণা রে.. এই শামসু চল চল।
ওরে মালিক, সবাইরে দিলা ... ঘুঘুর বাচ্চা, আমারে দিলা শালিক। আহ.. হা..হারে...
মোড়লের চ্যালা: হিহিহি.. কী যে মজা লাগে....!
[মোড়লের প্রস্থান]
[ সকল গ্রামবাসী কাঁদতে কাঁদতে মঞ্চের সামনে জড়ো হবে। নেপথ্যে করুন বাজনা বাজবে]
(এসময় ধীরে ধীরে বাউলের প্রশ্নে)
বাউল: অ্যাই... অ্যাই ভাই। তোমরা সবাই... কানতাছো কেন? কি হইছে ভাই?
গ্রামবাসী: ভাই আমরা... আমরা ওগো...বিশ্বাস কইরা জমি লেইখা দিছিলাম...
আর.. হেরা আমগোরে ঠকাইলো
[অপর গ্রামবাসী] আগে শুনতাম, শহরের বাবুরা... কি জানি হাতে লইয়া ওই যে, কি জানি কয়... ওই যে, মোবিল, মোবিল.. হাতে লইয়া গুজব ছড়ায়। এখন দেখি... আমাগো গেরামেও গুজব আয়া পড়ছে.। গুজব আমাগো ধ্বংস কইরা দিল। আপনারা... আপনারা কেউ গুজবে বিশ্বাস কইরেন না.
বাউল: হ রে ভাই,... তোমরার তো জমি গেছে, আমারে দেখ, আমি হাসতাছি। আমার আদরের বউডা কইলজার টুকরা মাইয়াডা সবই গেল (কান্নায় ভেঙে পড়ে)
[সাদা চাদর জড়িয়ে মৃত শিক্ষিত ছেলের প্রবেশ]
শিক্ষিত ছেলে: আমি বিদেশের মাটিতে ডিগ্রি নিয়েছিলাম। বিদেশেই থাকতে পারতাম। কিন্তু এই গ্রামের মানুষ ভালোবেসে গ্রামে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করব। কিন্তু... সে সুযোগ আর দিল কই...?
বাউল: আমাগো সাথে কি... আপনেরা... আপনেরা কেউ নাই??
[দর্শকদের মাঝে থাকবে কিছু অভিনেতা। তাদের মাঝ হতে...]
আমি আছি
আমি আছি
অন্য একজন]
আমি আছি।
আমিও আছি
[এরা সকলেই মঞ্চের সামনে দৌড়ে আসবে]
[হাতে হাত মিলিয়ে] আমরা সবাই আছি...।
[ সকলে দৌড়ে মঞ্চে উঠবে। মঞ্চের দুঃস্থ গ্রামবাসীদের সহানুভূতির সাথে কারে তুলে নেবে... আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে আসবে আলো]
[ আলো জ্বলবে কিছুক্ষণ পর]
[সকলে গোল হয়ে মোড়ল ও তার চ্যালাকে মাঝে নিয়ে ঘুরতে থাকবে। ধীরে ধীরে ছোট করতে থাকবে বৃত্ত। একসময় মাথায় হাত তুলে ঢেকে ফেলবে তাদের। তবলায় পড়বে বিরতিহীন বারি।
[আস্তে আস্তে সবাই সরে আসবে। পড়ে থাকবে মৃত চ্যালা ও প্রায় মৃত মোড়ল]
আহহ..... আল্লা মালিক.... সবাইরে দিলা ঘুঘুর বাচ্চা... আমারে দিলা... শালিক
[মৃত্যুর কোলো ঢলে পড়বে]
য ব নি কা প ত ন
চরিত্রসমূহের পরিচয় :
বাউল - ওয়াজিউর রহমান প্রথম
ইমাম – সাদমান হক
শিক্ষিত পোলা- শান সিদ্দীকী
চ্যালা - জেড. এম. নাহিন
মোড়ল- আব্দুর রহমান সাকিব
গ্রামবাসী: খন্দকার সাইদুর রহমান আবির, ওয়াজি তাওসীফ রাহমী, কে. এম মেহেদী, রুমন রশীদ শোভন, জোবায়ের সিদ্দীকী, রমিজ উদ্দীন রুদ্র, রেদওয়ানুল কবীর, হৃৎকমল নিলয় মণ্ডল। রহমান – ওয়াজীহ তাওসীফ রাহমী
• ঘোষক - ইতেসাফুল হাসান খান নাসিফ
জ্ঞানী ব্যক্তি – সাইদুল্লাহ আনসারী
পরিচালনায়: সামদানী প্রত্যয়
লাইটিং: আকিব সুলতান অর্ণব
মিউজিক: আবদুল্লাহ ইবনে ওসমান দূর্জয়
লিপিকার: নাসিফ
২৬ জানুয়ারি, ২০২১