পোস্টস

গল্প

অণু পরিমাণ অনুভূতি।

১০ জুন ২০২৪

ভোঁতা পেন্সিল

 কনকনে শীতের সকাল ।  বিছানা ত্যাগের সাহস পাচ্ছে না , শুভ্র । কম্বলের নিচে মুখ লুকিয়ে রেখে ই বোঝার চেষ্টা করছে জানালা দিয়ে রোদ্দুর প্রবেশ করছে কি না । হঠাৎ করে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো কর্ণ কুহরে । পত্নী তাহার রন্ধন কার্যে ব্যস্ত । রন্ধনশালা হতে পত্নীর কথা আর কাশির মিশ্রণে যে শব্দ শুভ্রর কর্ণ কুহরে পৌঁছাল তার পুরোটা বোঝা সম্ভব না হলেও অনুমান করে বুঝতে পারলো বাচ্চার কান্না থামাতে বলা হয়েছে তাকে ।  শুভ্র এবং নিহার বিয়ে হয়েছে চার বছর । আর , ঈশিতার বয়স ছয় মাস পেরিয়েছে । ঈশিতা , শুভ্র - নিহা দম্পতির একমাত্র সন্তান । ঈশিতার জন্য অবশ্য অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে শুভ্রকে । গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার থেকে শুরু করে শহরের নামকরা ডাক্তার সকলের দ্বারস্থ হয়েছে চিকিৎসার জন্য । চাওয়া শুধু একটাই , একটি বাচ্চা চাই তাদের । অবশেষে সব চেষ্টা যখন বিফলে গেল তখন তারা দুজনই আশা ছেড়ে দিয়েছিল । কিন্তু , আল্লাহর কাছে চাওয়ায় কোনো কমতি ছিল না তাদের । আল্লাহ তাদের চাওয়া পূরণ করে , ঈশিতার জন্মের মাধ্যমে । দেখতে দেখতে চারটি বছর পেরিয়েছে । শুভ্রর ছোট্ট চাকরির প্রমোশনও হয়েছে । এ প্রমোশন যেন ঈশিতার জন্যই হয়েছে । এতো দিনের এতো চেষ্টায় যখন কোনো প্রমোশন হয় নি সেখানে ঈশিতার জন্ম হতে না হতেই প্রমোশন পেয়ে গেল শুভ্রর । ঈশিতার জন্মের সাথে সাথে সে তার রিযিক ও নিয়ে এসেছে আল্লাহর কাছ থেকে । 
আজ শুভ্র আর নিহার বিবাহ বার্ষিকী । তাই দুজনে মিলে একটু ভালো সময় কাটাবে । সেজন্যই শুভ্র ছুটি নিয়েছে । এদিকে নিহা রান্না শেষ করে শুভ্রকে খেতে ডাকছে । খেতে খেতে তারা পরিকল্পনা করল , আজ তারা বাহিরে ঘুরতে যাবে । এটা অবশ্য , নিহার অনেকদিনের আবদার । নিহা অনেক দিন যাবত বায়না ধরছিল । ব্যস্ততার কারণে সময় করে উঠতে পারেনি শুভ্র । আজ সময় হয়েছে । রাতে শুভ্র একটা সাদা পাঞ্জাবী পরল আর নিহা নীল শাড়ি আর খোপায় ফুল । ঈশিতাকে সাথে নিয়ে ঘুরতে গেল শিশু পার্কে । ঘুরতে ঘুরতে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো । রেস্টুরেন্টে খেতে খেতে নিজেদের বিয়ের গল্প করছিল দুজন । টানা তিন বছরের প্রেমের পুর্নতা দিতে সবার অমতে বিয়ে করেছিল তারা । আজও দুই পরিবারের কেউ ই মেনে নেয় নি তাদের । তবে , ঈশিতার জন্মের পর মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নেয় দুই পরিবার ই । শুভ্র যখন নিহাকে বিয়ে করে তখন সে বেকার ছিল তাই শুভ্রর পরিবার মেনে নেয় নি ।  ওদিকে ছোটবেলায় নিহার বিয়ে ঠিক করা ছিল তার মামাতো ভাইয়ের সাথে । নিহার মামাতো ভাই আমেরিকায় থাকে । কথা ছিলো সে দেশে এসে বিয়ে করে নিহাকে নিয়ে আবার আমেরিকায় চলে যাবে । তাই নিহার মামাতো ভাই দেশে ফিরতেই সে বিয়ের জন্য শুভ্রকে চাপ দেয় । শুভ্র ও কোনো উপায়ান্তর না দেখে কোনো কিছু না ভেবে ই বিয়ে করে ফেলে ।  বিয়ের পর শুভ্র খুব পেরেশানিতে ছিলো এ কথা ভেবে যে , সে তো কোনো কাজ করে না । তাহলে সংসার চালাবে কিভাবে । ওদিকে নিহা বুদ্ধি করে তার নামে করা ডিপোজিট একাউন্টের চেক বই সাথে নিয়ে এসেছিল । সেই টাকা দিয়ে ই শুভ্রর চাকরি না পাওয়া অবধি সংসার চালিয়েছে । গল্প আর খাওয়া শেষ করে বাড়ি ফিরল দুজনে । সংসার ভালো মতোই চলছিল । দুজনের কোনো কষ্ট ছিলো না ।

বিপত্তি বাঁধলো ঈশিতার তৃতীয় জন্মদিনে । বিয়ের পর শুভ্র নিহা ও ঈশিতাকে তেমন কিছু ই দিতে পারেনি । তাই , ঈশিতার জন্মের পর একটু একটু করে টাকা জমিয়ে একটি ডিপোজিট করেছিল । ঈশিতার জন্মদিন উপলক্ষে নিহা আর ঈশিতা কে সারপ্রাইজ দিবে বলে ডিপোজিটের টাকা তুলে মা মেয়ের জন্য দুটো স্বর্ণের হার কিনে বাসায় ফিরলছিল শুভ্র । শুভ্র আজ ভীষণ খুশি । রিকশায় যেতে যেতে ভাবছিল , হার দুটো নিহার হাতে তুলে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলবে , " অনেক ধন্যবাদ , সুন্দর একটা পরী উপহার দেয়ার জন্য " । কিন্তু , শুভ্রর কল্পনায় ব্যাঘাত ঘটালো ছিনতাইকারী । রিকশা থামিয়ে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নিয়ে যায় শখের হার দুটো । বিষন্ন মনে বাসায় ঢুকতেই সে বিষন্নতা বেড়ে গেলো কয়েকগুণ । ঘরে ঢোকার আগেই নিহার কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল সে । শুভ্র কিছু বলার আগেই নিহা তাকে অ্যাম্বুলেন্স কল করতে বলে , ঈশিতাকে হাসপাতালে নিতে হবে । শুভ্রকে বাসার নিচে দেখতে পেয়ে দোতলা থেকে ছুটে যাচ্ছিল ঈশিতা । সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে যায় । আর তাতে প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে । ঈশিতাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য প্রতিবেশীর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে যায় শুভ্র । হাসপাতালে যাওয়ার সাথে সাথে ঈশিতাকে নিয়ে যাওয়া হলো অপারেশন থিয়েটারে । জরুরী অপারেশন করতে হবে । শুভ্র ডাক্তারদের সাথে কথা বলছে । আর নিহা অঝোর ধারায় কেঁদে যাচ্ছে । কিছুতেই নিহার কান্না থামছে না । ডাক্তার শুভ্রকে জানিয়েছে ঈশিতার মাথায় অপারেশন করতে হবে । সব মিলিয়ে লাখ তিনেক টাকা প্রয়োজন । কিন্তু , অপারেশন করার জন্য এই মুহুর্তে এক লাখ টাকা প্রয়োজন । কাউন্টারে টাকা জমা না দিলে অপারেশন শুরু হবে না । শুভ্র খুব ভেঙে পড়ল , তার কাছে আছে মাত্র বিশ হাজার টাকা সেটাও আবার প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার করা । শুভ্র বিশ হাজার টাকা জমা দিয়ে অপারেশন শুরু করতে বলে , কিন্তু ডাক্তার পুরো এক লাখ টাকা পরিশোধ করার পূর্বে অপারেশন শুরু করতে নারাজ ।  উপায়ান্তর না পেয়ে শুভ্র তার বাবার কাছে ফোন দিল , সব কিছু খুলে বলল । শুভ্রর বাবা এত দিন রাগ করে থাকলেও আজ আর রাগ করে থাকতে পারলো না । শুভ্রর বাবা ডাক্তার কে জানায় , তারা টাকা নিয়ে আসছে তাই ডাক্তার যেন এখনই অপারেশন শুরু করে দেয় । শুভ্রর বাবার কথায় ডাক্তার রাজি হয়ে যায় । কথা শেষ করে শুভ্রর বাবা সাথে সাথে  টাকা নিয়ে রওয়ানা দিলো হাসপাতালে । ওদিকে নিহাও তার বাবা মা কে জানিয়েছে , তারাও হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে । শুভ্র অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে বসে কান্না করছে । যেদিন ঈশিতার জন্ম হয় সেদিন নিহা শুভ্রকে জিজ্ঞেস করেছিল , আমাদের কারো পরিবার থেকে কেউ আসেনি ? শুভ্র জবাবে বলেছিল , একদিন আমাদের মেয়ে ই আমাদের সবাইকে এক করে দিবে । আজ সে দিন এসেছে । আজ সবাই ঈশিতার জন্যই এক হয়ে যাচ্ছে । ইতোমধ্যে সবাই হাসপাতালে পৌঁছেছে । কাউন্টারে সব টাকা পরিশোধ করা হয়েছে । ঈশিতাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে নিহা নামাজে দাঁড়িয়ে গেছে । নিহা আজ অনেক দীর্ঘ সিজদাহ দিচ্ছে । কান্নায় তার চোখ ভিজে একাকার । প্রায় চার ঘণ্টা পর ঈশিতার অপারেশন শেষ হলো । ডাক্তার জানিয়েছে এখনও ঈশিতার জ্ঞান ফেরেনি । তাই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না । এই পুরো চার ঘণ্টা সময় নিহা জায়নামাজে কাটিয়েছে । একাধারে শুধু নফল নামাজ পড়ে গেছে সে । ঈশিতাকে একনজর দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে গেছে নিহা । অপারেশন শেষ হতে ই নিহা ছুটে গেলো অপারেশন থিয়েটারের দিকে । ডাক্তার ঢুকতে মানা করলো । কিন্তু , নিহা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঢুকলো অপারেশন থিয়েটারে । নিহা কোনো শব্দ করছে না । শুধু কান্না করছে । ঈশিতার চোখের দিকে তাকিয়ে নিহা আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারছে না । ঈশিতা আইসিইউ তে আছে , সবাই বাহিরে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনছে । অপারেশন হয়েছে একদিন হলো কিন্তু ঈশিতার এখনও জ্ঞান ফেরেনি । পরিস্থিতি আরো কঠিন হয়ে পড়ছে । কারো চোখে ঘুম নেই । সবার খাওয়া দাওয়াও বন্ধ । সব চিন্তা শুধু ঈশিতাকে নিয়ে । পরদিন বিকাল বেলা ডাক্তার জানালো ঈশিতা আর দুনিয়ায় নেই । একথা নিহার কানে পৌঁছাতে ই নিহা অজ্ঞান হয়ে পড়ল । রাতে যখন ঈশিতার জ্ঞান ফিরল ততক্ষণে ঈশিতার দাফন সম্পন্ন হয়েছে । দাফন শেষ করে এসে ই শুভ্র দাঁড়িয়ে যায় নামাজ পড়তে । নিহাও নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে যায় শুভ্রর সাথে । সারারাত ধরে শুভ্র এবং নিহা নফল নামাজ পড়ে । ফজরের নামাজ পড়ে ক্লান্ত হয়ে শুভ্র ঘুমিয়ে পড়ে । কিন্তু , নিহার চোখে ঘুম নেই । শরীরে ক্লান্তি নেমে এলে সে নামাজ পড়া বাদ দিয়ে কোরআন তিলাওয়াত করা শুরু করে । কোরআন তিলাওয়াত করতে করতে  নিহা ঘুমিয়ে পড়ে জায়নামাজে । তখন সকাল এগারোটা বাজে । নিহা স্বপ্ন দেখে ঈশিতা জান্নাতে খেলা করছে । স্বপ্ন দেখে নিহা মনে প্রশান্তি অনুভব করে । কিন্তু , মেয়েকে হারিয়ে নিহা এখন ছন্নছাড়া জীবন যাপন করে । তার কাছে এখন কোনো কিছু ই ভালো লাগে না । সে চায় ঈশিতার কাছে চলে যেতে । প্রতিরাতে সে ঈশিতাকে স্বপ্নে দেখে কান্না করে ওঠে । শুভ্র এখন চাকরি ছেড়ে দিয়েছে । সে এখন বাবার ব্যবসা সামলায় । নিহা কে নিয়ে বাবা মার সাথে ই থাকে ।