'এতো ক্ষুধা কেন তোর, এই বয়সে?'
শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললাম।
মা, ক্ষমা করে দিতে পারবি তো?
তোর ক্ষুধার তৃষ্ণা মেটাতে আজ আমাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়, মা।
আমাকে ক্ষমা করতে পারবি তো?
মনে নাই, মা, সত্যিই আমার মনে নাই,
কতরাত জেগে দুপায়ের মাঝে বালিশে রেখে আমার মাথা, চোখে কাজল দিয়ে দিতিস,
আমার কপালের ডান পাশে কাজল-কালো টিপ দিয়ে দিতিস, আঙুলের আলতো ছোয়ায়,
যেন নজর না লাগে কোন শকুনের।
মনে নাই, মা, সত্যিই আমার মনে নাই।
অকারণ কান্নায় শেষ রাতে জেগে আমি কি কাঁদতাম না?
মা, তুই ছাড়া কে ছিল, অভিযোগহীন ভাবাবেগে কোলে তুলে নিতে?
আমার নড়বড়ে ঘাড়, অতি মোলায়েম করে কাধে রেখে দিতিস
পিঠে হাত রেখে অতি প্রেমের অস্ফুট স্বরে ঘুম পাড়ানীর গান
তুই ছাড়া আর কে গাইতো?
মনে নাই, মা, সত্যিই আমার মনে নাই।
ভাষা ছিল না, মা,
'আমার ক্ষুধা লেগেছে', এই কথাটা বলার ভাষাও ছিল না জানা।
নাড়ির টান এতো মজবুত কিভাবে হয়, মা
মুখে তুলে দিতিস খাবার ঠিক যখনই আমার প্রয়োজন
অতি আলতো করে, মুখে পুরে অপেক্ষা, আরেক লোপ্পা তুলে দেয়ার।
তুই ছাড়া আর কে বুঝতো?
মনে নাই, মা, সত্যিই আমার মনে নাই।
কত বর্ষা কাটিয়েছি, মা তোর আঁচলের নিচে,
কত শীত, মা, তোর সমস্ত দেহ দিয়ে উষ্ণতা দিয়েছিস
সে উষ্ণতায় কত প্রেম ছিল, কত মায়া ছিল-
সে উষ্ণতা কোথায় গেল আজ, সে মায়ার বাধন কে ছিড়িল আজ?
আমি বুঝি না, মা, সত্যিই আমি বুঝি না।
মাগো, আমি যে আজ তোর মা হতে পারলাম না,
অথচ বিধাতা আজ তোরে ছোট বাচ্চা করেই পাঠিয়েছে আমার সংসারে।
"মা" সবাই হতে পারে না।
মা হতে কলিজা লাগে, হৃদপিন্ড লাগে।
সর্বংসহা শরীর লাগে, আকাশের চেয়ে বড় মন লাগে,
আরশের মত পবিত্র, সুউচ্চ জায়গা লাগে,
হৃদয়ের গহীনে।
সবচেয়ে বড় কথা, মা হতে হলে, 'মা'-ই হতে হয়।
আমি কিভাবে তোর মত হবো?
আমায় ক্ষমা করে দিতে পারবি তো, মা
আমায় ক্ষমা করে দিতে পারবি তো?
মা শুনে আর কাঁদে।
মায়ের ছানি পড়া চোখে জল, ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকায়
কোন রাগ নেই, নেই কোন অভিমান।
কোন স্পৃহা নেই, শুধু অসহায়ত্ব।
মায়ের মুখে ভাষা নেই আজ-
দেড় বছরের বাচ্চার মত, হাত বাড়িয়ে দেয়
আমার গালের দিকে, যেন চাঁদ স্পর্শ করতে চায়।
চাঁদের চোখে তখন লবণজলের ফোয়ারা।
মায়ের চোখে তখন লবণজলের ফোয়ারা।
মায়ের হাতটা তখন আমার গাল থেকে
মায়ের পেটে নেমে যায়,
ফিরে এসে হাতটা ডানে বায়ে নড়তে থাকে, নড়তে থাকে।
যার অর্থ একটাই, "আমার ক্ষুধা নেই বাবা, আমার ক্ষুধা নেই।"
আমার কণ্ঠ কাঠ হয়ে আসে, চোখে স্রোতধারা
ঠিক তখনই-
আমার অর্ধাঙ্গিনী আমার পেছনে এসে দাঁড়ায় -
অতি অল্প বিরক্ত হয়ে বলে - “আর ঢং করতে হবে না!”
আমায় ক্ষমা করতে পারবি তো, মা?
আমায় ক্ষমা করতে পারবি তো?