সেদিন ছিল বছরের শেষ দিন থার্টি ফার্স্ট নাইট। সকাল থেকে পাড়া গাঁয়ে চলছে কিশোর-কিশোরীদের মাঝে আনন্দ-উল্লাস। বিভিন্ন রকমের বাদ্যযন্ত্র বাজানোর প্রতিযোগিতা। এই সব আনন্দ-উল্লাস দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে যায় রহিম। তার মনে ইচ্ছে জাগে সেও এবার বন্ধুদের সাথে মনের আনন্দে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করবে। কিন্তু রহিম বয়সের পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবতা যে বড়ই কঠিন এখনো বুঝে ওঠতে পারেনি। সে শুধু মাত্র জানে তারা গরিব। বহুদিন আগে তার বাবা কোন এক দূর্ঘটনায় মারা গেছে। বাবার অবর্তমানে সংসার চালানো জন্য তার জনম দুঃখিনী মাকে পরের বাড়িতে কাজ করে খেতে হয়। এক মুঠো ভাতের আশায় তাকেও পথে পথে ফুলের মালা বেচে বেড়াতে হয়।
এমন দুর্দশার পরেও রহিম মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, সে এবার যে ভাবেই হোক বন্ধুদের সাথে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করবে। এই জন্য সেদিন, সে খুব ভোরে ফুলের মালা বেচার জন্য বাজারে দিকে ছুটে যায়। বাজারে পৌঁছানোর পর পলিথিনের ব্যাগ থেকে গোটা কয়েকটি ফুলের মালা হাতে নিয়ে মানুষের ভিড়ে সে বলতে থাকে, ফুলের মালা নিবেন বাবু, বকুল ফুলের মালা। আমার মা নিজের হাতে বানিয়েছে। মালাগুলো খুব সুন্দর হবে। একটি মালার দাম বিশ টাকা, তিনটি মালার দাম পঞ্চাশ টাকা। আজকে থার্টি ফার্স্ট নাইট আপনারা সবাই বাড়িতে ফুলের মালা নিয়ে যান।
এভাবে সেদিন রহিম ফুলের মালা বেচারা জন্য পথে পথে ঘুরতে থাকে। আর মনে মনে ভাবতে থাকে, আজকে ফুলের মালা বিক্রি করে যা টাকা হবে, সব টাকা দিয়ে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করব। বারোটা এক মিনিটে রাতের আকাশে আতশবাজি ফাটাবো এবং বন্ধুদের সাথে মজা করে মাংস,পোলাও খাব। কতদিন হয়ে গেল, ভাল-মন্দ খাবার খাওয়া হয়নি। আজকে যখন সুযোগ এসেছে, ফুলের মালা বেচে যা টাকা হবে, সব টাকা দিয়ে থার্টি ফার্স্ট নাইটের উদ্দেশ্যে বন্ধুদের সাথে পিকনিক করব।
কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস, সেদিন বাজারের মানুষ শুধু মাত্র থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনের কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। অন্যকোন জিনিস কেনাকাটার দিকে তাদের কোন লক্ষ্য ছিল না। যার কারণে সেদিন রহিমের ফুলের মালা একটাও বেচাকেনা হল না। অবশেষে কোন উপায় না পেয়ে, রহিমকে মন খারাপ করে সন্ধ্যার দিকে চুপি চুপি বাড়ি ফিরে আসতে হল ।
এদিকে রহিমকে মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে আসে দেখে তার মা তাকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘কিরে রহিম, তোর মন খারাপ কেনো? তোকে কেউ মেরেছে নাকি? তুই তো কোনদিন মন খারাপ করে বাড়িতে ফিরে আসিসনে। কি হয়েছে তোর? আমার কাছে সব খুলে বল?’
তখন অবুঝ শিশু রহিম তার মাকে বলছে, ‘মা তুমি জানো না, আজকে থার্টি ফার্স্ট নাইট বছরের শেষ দিন।এই দিন বিশ্বের সব দেশের মানুষ ঢাকঢোল পিটিয়ে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করে থাকে। রাতের আকাশে আতশবাজি ফাটিয়ে আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে।’ এই জন্য আজকে আমারও খুব ইচ্ছে ছিল, ফুলের মালা বেচে যা টাকা হবে, সব টাকা দিয়ে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনের উদ্দেশ্যে বন্ধুদের সাথে পিকনিক করব। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস আজকে একটা ফুলের মালাও বিক্রি হয়নি। অবশেষে আমাকে মন খারাপ করে খালি হাতে বাড়ি ফিরে আসতে হল। চারিদিকে গান বাজনার আওয়াজ শুনে আমার অবুঝ মনটা কেঁদে উঠছে মা। আজকে যদি বাবা বেঁচে থাকত তাহলে আমার কোন অভাব অনাটন বিন্দুমাত্র আঁচ লাগতে দিত না। যখন যা চাইতাম, বাবা হাসি মুখে পূরণ করে দিত। তোমাকে যে পরের বাড়িতে কাজ করে খেতে হতো না। আমাকেও এত ছোট বয়সে পথে পথে ফুলের মালা বেচে বেড়াতে হত না।
ছোট্ট ছেলের মুখে করুণ কাহিনী শুনে জনম দুঃখিনী মা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। আর ব্যথা ভরা মন নিয়ে তিনি বলতে থাকে, ‘বাবা, আমরা যে গরিব মানুষ। থার্টি ফার্স্ট নাইট পালন করার জন্য আমাদের তো যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ নেই। কোথায় পাবো থার্টি ফাস্ট নাইট উদযাপনের টাকা। আর এমনিতেই থার্টি ফাস্ট নাইট ঢাকঢোল পিটিয়ে উদযাপন করা উচিত নয়। কারণ এই দিন আমাদের জীবন থেকে একটি মূল্যবান বছর হারিয়ে যায় এবং শুরু হয় প্রতিটা মানব জীবনের নতুন একটা অধ্যায়। এই দিন আমাদের জীবনের সব অন্যায়, পাপাচার থেকে মুক্তি পেতে সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চাইতে হয়।’