অধিকাংশ মানুষ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে নিজের সামর্থ্যকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে চায়। কারণ সেটা সম্পর্কে তার তুলনামূলকভাবে স্পষ্ট ধারণা থাকে। ফলে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসীও থাকে। কিন্তু রিচার্ড রামেল্ট তার গুড স্ট্র্যাটেজি, ব্যাড স্ট্র্যাটেজি বইয়ে বলেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের দুর্বল জায়গায় যথাসময়ে নিজের শক্তি প্রয়োগ করার মাধ্যমে প্রত্যাশিত সফলতা পাওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ হয়। এক্ষেত্রে তিনি ইরাক-কুয়েত (১৯৯০-১৯৯১) যুদ্ধের কৌশল ব্যাখ্যা করেছেন।
যুদ্ধের শুরুতে সাদ্দাম হোসেন আপাতদৃষ্টিতে অনেকগুলো অ্যাডভান্টেজ ভোগ করছিলেন। তাছাড়া তিনি স্বল্প সময়ে অনেক বেশি শক্তি প্রয়োগ করেছিলেন। সেগুলোর ফলাফল তাকে ‘অতি আত্মবিশ্বাসী’ করে তোলে। কিন্তু কুয়েতের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া যৌথ বাহিনী চেয়েছিল নিজেদের সম্পদের ন্যূনতম ক্ষতি করে যুদ্ধে জয়ী হতে।
তাই মরুভূমিতে যুদ্ধের ব্যাপারে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইরাকি সৈন্যবাহিনী যে যেদিক থেকে সম্ভাব্য আক্রমণের কথা ভেবেছিল, তার সব পথ যৌথ বাহিনী পরিহার করে। বরং পেছন থেকে অপ্রত্যাশিত পন্থায় আকস্মিক আক্রমণ করে শত্রুদের মনোবল পুরোপুরি ভেঙে দেয়।
এটাকে বলা হয় এনভেলপমেন্ট স্ট্র্যাটেজি। এর মূল কথা হলো শত্রু যেখানে শক্তিশালী ও সুরক্ষিত সেই জায়গাগুলো এড়িয়ে চলো। যেদিক থেকে আক্রমণের কথা তারা কল্পনাও করেনি এমন স্থানে আকস্মিক আঘাত করো। তেমনটা করলে তারা বিদ্যমান পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে আসতেই যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারিত (বা লক্ষ্য অর্জিত) হয়ে যাবে।
এ কৌশলের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো-- কল্পনাতীত কিছু ঘটিয়ে ফেলা। অর্থাৎ প্রতিপক্ষ ঠিক যত উপায়ে সম্ভাব্য আক্রমণের কথা অনুমান করতে পারে, তার বাইরে একটা কিছু করতে হবে। সেক্ষেত্রে ‘ফোকাস’ থাকতে হবে খুব স্পষ্ট। তাছাড়া কৌশল বাস্তবায়নে যারা মাঠে থাকবে তাদের নেতৃত্বের প্রতি অগাধ বিশ্বাস রাখতে হবে। কোনো দ্বন্দ্ব-শঙ্কা-ভয় যেন তাদের মনে স্থান না পায়।
হিটলার সম্পর্কে যতগুলো মিথ প্রচলিত আছে তার অন্যতম হলো… হিটলারের সৈন্যদের ওপর তার কমান্ডের কার্যকারিতা। অর্থাৎ নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও তারা সংকোচ বোধ করত না বা পিছু হটার কথা কল্পনাও করত না!
মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রেও নেতৃত্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছা সম্ভব। গোটা দুনিয়ায় স্টিভ জবস এক্ষেত্রে ক্ল্যাসিক উদাহরণে পরিণত হয়েছেন। তার অধীনে কাজ করা কর্মীরা হয়তো তাৎক্ষণিক নির্দেশনার অন্তর্নিহিত তাত্পর্য ধরতে পারতেন না। কিন্তু জানতেন, ঠিকমতো কাজ করতে পারলে দিন শেষে বিশেষ কিছু অর্জিত হবেই। ফলে তাদের ফোকাস থাকত শুধু নেতৃত্বের চাওয়া বাস্তবায়নে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাওয়া।
আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে যারা নিজ ক্যারিশমা দিয়ে প্রতিষ্ঠানকে অনেক ওপরে নিতে সক্ষম হয়েছেন তারাও এ বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে অর্জন করেছেন। তাদের অধীনে কাজ করা লোকদের মত হলো, তারা লক্ষ্য অর্জনে অতিশয় কঠোর ও অনমনীয়। তবে অধীনদের বিপদে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন, বুক দিয়ে আগলে রাখেন। হয়তো সে কারণেই তাদের কর্মীরা নিজেদের উজাড় করে দেন, আশাতীত ফলাফল অর্জন করা সম্ভব হয়।
দৃশ্যমান শত্রুতা পরিহার করে লক্ষ্য অর্জনের দক্ষতা তাদের বিশেষ শ্রদ্ধা ও মর্যাদার আসনে বসায়। এক্ষেত্রে নেতৃত্বের প্রশ্ন এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে সফল হওয়ার পূর্বশর্ত হলো: গুড স্ট্র্যাটেজি রিকোয়ারস লিডারস হু আর উইলিং অ্যান্ড অ্যাবল টু সে ‘নো’ টু আ ওয়াইড ভ্যারাইটি অব অ্যাকশনস অ্যান্ড ইন্টারেস্টস।
তবে মনে রাখতে হবে, কোনো প্রতিষ্ঠানে একই সঙ্গে ভালো ও মন্দ কৌশলের চর্চা হলে দীর্ঘমেয়াদে ভালো স্ট্র্যাটেজিগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। অনেক সময় আগাছা যেমন ফসলকে ছাপিয়ে বড় হয়ে যায়, অনেকটা সে রকম। তাই প্রতিষ্ঠানে ভালো স্ট্র্যাটেজি চর্চার পরিবেশ গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তর থেকে সাপোর্ট পাওয়াটা খুব দরকার। নইলে কার্যকর কৌশলগুলোও দীর্ঘমেয়াদে ভোঁতা হয়ে পড়ে।
বৈশিষ্ট্যগতভাবে স্ট্র্যাটেজি হলো ভবিষ্যতমূখী। আমরা বোঝার সুবিধার্থে অতীত নিয়ে আলোচনা করি, নানা দৃষ্টান্ত দিই। কিন্তু বাস্তবে যখন সিদ্ধান্ত নিই তখন কিন্তু অনুমান ও বুদ্ধিমত্তার ওপর ভর করেই নিতে হয়। অতীতে কার্যকর কোনো কৌশলের সরাসরি অনুকরণ প্রতিষ্ঠানের জন্য মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। কারণ ওই জ্ঞান বা অভিজ্ঞতায় আপনার মতো প্রতিপক্ষের লোকদের অনুপ্রবেশের সুযোগ রয়েছে। ফলে তারা খুব সহজেই আপনার কৌশলকে অকার্যকর করে দিতে পারে। অর্থাৎ আপনার কৌশল ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
তাই যেখানে যা পড়বেন, শুনবেন বা শিখবেন—ঘটনার চেয়ে সেখান থেকে শিক্ষাটা আত্মস্থ করতে বেশি তত্পর থাকবেন। তারপর স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় নিয়ে ‘ব্র্যান্ড নিউ’ স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করবেন। সেক্ষেত্রে আপনার মনোবল হবে বিখ্যাত সেনাপতিদের মতো। যুদ্ধ জয় ছাড়া বিকল্প কোনো ভাবনা আপনার মনে স্থান পাবে না!
এবার একটু অন্যভাবে বিষয়টাকে দেখা যাক। তরুণ উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে প্রায়ই একটা বিষয় লক্ষ করা যায়। সেটা হলো-- তাদের নিজ নিজ পছন্দ বা ভালো লাগাকে কেন্দ্র করে ব্যবসা শুরু করা। সিলেটে মাঝেমধ্যেই অনেক মূলধন নিয়ে, খুব সুন্দর ডেকোরেশন করে স্টুডিও, মোবাইল ফোনের দোকান এমনকি গাড়ির শোরুম উদ্বোধন করতে দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো এমন লোকেশনে হয় যে তাদের আত্মীয়স্বজন ছাড়া অন্য কেউ সেখানে ওই উদ্দেশ্যে যাওয়ার কথা না।
কিন্তু দোকান খুলে তারা প্রত্যাশা করেন যে খুব ভালো ব্যবসা হবে। শিগগিরই তারা সফলতা পাবেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। মাস ছয়েক পরে খুব হতাশ হয়ে মালপত্র সব বিক্রি করে দেয়। আত্মীয়স্বজনকে বলতে থাকে, আমি তো অনেক চেষ্টা করলাম। কাস্টমার আসে না, আমি কী করব?
এটা শুধু যে তরুণদের সমস্যা তাই নয়। বরং বহু প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র পজিশনের লোকজনও মনে করেন যে ব্যবসায়ের মূল কাজ হলো কীভাবে শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষা হবে তা নিশ্চিত করা। ব্যবসায়ের পুরো বিষয়টা নির্ধারিত হয় তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী। তারা কাস্টমারদের বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয় না। ক্রেতাদের প্রত্যাশিত দ্রব্য ও সেবার ব্যাপারে থাকে অনেকটা উদাসীন। অথচ ক্রেতাদের সন্তুষ্টি নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের উল্লেখিত চাওয়া (মূল লক্ষ্য) অর্জন করা খুবই সম্ভব।
এক্ষেত্রে গোটা দুনিয়ায় অসংখ্য ধারা চালু আছে। তার একটা হলো লেফট হ্যানডেড বা অর্থনৈতিক বিষয় ফোকাসড অর্গানাইজেশন। আরেকটা হলো ‘স্যাটিসফায়িং কাস্টমারস’ নির্ভর বা মার্কেট ড্রাইভেন অর্গানাইজেশন। অনেকে এটাকে ‘রাইট হ্যান্ড’ অর্গানাইজেশনও বলে থাকে।
ক্রেতাদের চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়ে পুরো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সেদিকে ড্রাইভ দেয়ার প্রবণতা চালু করেছিল জাপানি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো। অন্যদিকে, ফাইন্যান্সিয়াল ইস্যুগুলোকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে ব্যবসা করত মূলত ব্রিটিশ এবং আমেরিকান কোম্পানিগুলো। অবশ্য গত শতাব্দীর আশির দশকে এসে ম্যাকডোনাল্ডস, মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার, বিভিন্ন বিমান সংস্থা ক্রেতাদের সন্তুষ্টি নিশ্চিত করার বিষয়টি উপলব্ধি করে। তার পর থেকে এ ধারণার ব্যাপক চর্চা শুরু হয়।
এয়ারলাইনসগুলো এটা উপলব্ধি করার প্রধান কারণ ছিল: টপ ম্যানেজমেন্ট যা অনুভব করত বা প্রমোশনে কাস্টমারদের কাছে প্রমিজ করত, আলটিমেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের মাধ্যমে তা অর্জন করা বেশ কঠিন হতো।
কারণ সেই পর্যায়ের কর্মীদের সবকিছু বুঝিয়ে বলা সম্ভব হতো না। আবার তাদের ঠিক সেভাবে মোটিভেট করাও যেত না। কিন্তু যেহেতু তারা সরাসরি কাস্টমারের সান্নিধ্যে যায় সেহেতু তারা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে রিপ্রেজেন্ট করে। ফলে এয়ারলাইনসগুলো তাদের জন্য ব্যাপক ট্রেনিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম হাতে নেয় যেন কর্মীরা এর গুরুত্ব যথাযথভাবে অনুভব করতে পারে। মার্কেটিংয়ের হলিস্টিক অ্যাপ্রোচ মূলত এ বিষয় রিপ্রেজেন্ট করে।
কারণ একসময় মনে করা হচ্ছিল খুব দক্ষ নির্বাহী বা দক্ষ ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেল সাধারণ কাস্টমার যতই অশিক্ষিত বা অসচেতন হোক না কেন তাদের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি পার্থক্য গড়ে দেয়।
ফলে কোনো প্রতিষ্ঠান যদি দীর্ঘমেয়াদে সত্যিকারের পজিশন অর্জন করতে চায়, তাহলে তাদের কাস্টমার যে বিষয়গুলোকে ভ্যালু দেয় সেগুলোতে মনোযোগী হতে হবে। পাশাপাশি প্রতিযোগীদের যেখানে দুর্বলতা রয়েছে বা নিজেদের বিশেষ সক্ষমতা রয়েছে তার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে হবে। সেটা করা গেলে তবেই সফলতা টেকসই হয়।
নোট: সেলস ও মার্কেটিং বিষয়ে অধিকতর জানতে লেখকের ফেইলিওর ইন সেলস এবং মার্কেটিংয়ের সহজপাঠ বই দুটি পড়তে পারেন।