পোস্টস

ফিকশন

মিরপুরে মেরিকান ভিসা

১৮ মে ২০২৪

সাজিদ রহমান

মূল লেখক সাজিদ রহমান

যেটা কখনও ভাবিনি তাই হল। মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। অনেকটা এই মতবাদকে অনুসরণ করেই।  

মিরপুরে শুয়ে-বসেই ভিসা পেয়ে গেলাম। সেটাও উগান্ডা, বুরুণ্ডি কিংবা সোমালিয়ার ভিসা নয়। উগান্ডা বুরুন্ডির ভিসা যদি পেয়েও যাই, তাইলে সেটা নিয়ে কী করব! ওদের ভিসা পেলে ঢোল পিটিয়ে আপনাদের জানানোর বা কি আছে? আমি জানি, জানেন আপনারাও। দিনের পর দিন না খেয়ে ওদের শিশুদের শরীর হয়েছে হাড় জিরজিরে। নেই বিশুদ্ধ খাবার পানি, নেই ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা। সেখানে এমন কারখানা আছে, যারা মাটির বিস্কুট তৈরি করে। দিনের পড় দিন অভুক্ত শিশুর শুধু ক্ষুধা মেটানোর জন্য সেই বিস্কুট তৈরি হয়। দুনিয়াজুড়ে কত মহাজ্ঞানি আছেন, রয়েছেন কত মহাজন। ইদানিং সেই জ্ঞানীরা, মহাজনেরা মঙ্গল গ্রহ ছাড়িয়ে অন্য নক্ষত্রপুঞ্জে পৌছার পরিকল্পনা করছেন। সমুদ্র তলদেশের জীবের অস্তিত্ব সঙ্কট নিয়ে গবেষণা করছেন। শুধু মাটির উপরে হাজার হাজার মানুষের ক্ষুধার আহাজারি তাদের কাছে পৌছে না। আমি কবি নই যে, ওদের নিয়ে কবিতা লিখে দুনিয়া জুড়ে শোরগোল ফেলে দিবো। নই কোন গণমাধ্যম কর্মী, এমনকি গবেষকও নই। তাদের তুলনায় আমি তেলাপোকার সমান। কখনও কখনও তেলাপোকাওআমার চাইতে উত্তম। কারন সে যা কোন অবস্থায় সে টিকে থাকতে পারে। আমার সে শক্তিও নেই। যে আমরা সব সময় শান্তি চাই,সেই আমরাই জীবনভর যুদ্ধ জয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকি। এই চিত্র সারা দুনিয়ায় প্রায় একইরকম। উগান্ডা, বুরুনডির দুঃখ দেইখ্যা আমিআর কি করতে পারবো। হা হুতাশ ছাড়া।

আমার এই ভিসা প্রাপ্তির সাথে মিল আছে আঙ্গুর ফলের। সেই আঙ্গুর ফলের, যেটা আমরা মনে মনে চাই। না পাইলে হয়ে যায় টক। আমি পেয়েছি খোদ ‘মেরিকান ভিসা। দুনিয়ার তাবৎ মানুষ ‘মেরিকাকে ঘৃণা করে, কিন্তু অন্তর থেকে সেখানে যাওয়ার প্রচণ্ড বাসনা পুষে রাখে। সেই ভিসা যেন সারা জীবনের বহু আরাধ্য জিনিস। আমি অনেকটা হেলে-দুলে সেই ভিসা পেয়ে গেলাম। খোদ ‘মেরিকানভিসা। ভাবতেই বেশ চনমনে লাগছে।

ছোট্ট একটা দুর্ঘটনা, সারা জীবনের কান্না। সেটা নাকি বলে গেছেন প্রয়াত নায়ক রাজেশ খান্না। এই কথা যেই বলুক, আমার হয়েছে সেই দশা। ছোট্ট এক ভুলে কি সর্বনাশটাই না হল! না পারি সইতে, না পারি কারও কইতে। এখন আমার অলিন্দ না চেনে নিলয়কে। দম বন্ধ হয়ে আসে প্রায়। সারা জীবনের জন্য আফসোস থেকে গেল। কী সেই আফসোস, শুধু সেটা বলার জন্য আজ এই কলমপেষার আয়োজন করেছি। মূল কথা বলার আগে একটু পিছনের গল্পটা জানানো খুব জরুরী। পিছনের গল্প ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মত  কাজ করে। তখন মূল গল্পের ভিতরের গল্পটা বের হয়ে আসে। পুরো বিষয়কে হৃদয়াঙ্গম করতে বেশ সহায়তা করে।    

বলে রাখি, জীবনের প্রয়োজনে আমরাও একসময় ঢাকায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। জীবনের সেই অধ্যায় শুরু হয়েছিল উত্তরায়। এরপরপলাশীতে দীর্ঘদিন কাটিয়ে চলে যাই পুর্ব রাজাবাজার ও ইন্দিরা রোডে। এরপর নসিব আমাদের নিয়ে যায় মোহাম্মাদপুরে। ‘হয় না আর এমন তো হয় না, নদীর বুকে বৃষ্টি ঝরে, পাহাড় তারে সয়না।‘ কবির এই কথ্যাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দেয় ঢাকা। ঢাকা সয় না বলেএকটা সময় কিক-আউট হয়ে ঢাকার বাইরে চলে যাই। এসে পড়ি সেই উত্তরেই। মাঝে আবার জোয়ার ভাটার মত উত্তর থেকে দক্ষিনে যাই। দক্ষিণে দুয়েকটা ঘুর্নন খেয়ে সেই উত্তরেই এসে পড়ি। ঘুরে ঘুরে শেষে, উত্তরে এসে পড়বনা কেন? কথায় আছে, বন্যেরা বনে সুন্দরমফিজেরা উত্তরে।

যে মিরপুরকে নিয়ে আমাদের গর্বিত হওয়ার কথা, একসময় তারে ঠেলেছি পায়ে। মিরপুর নিজের কাঁধে নিয়েছে ঢাকার সবচেয়ে বেশি মানুষের ভার। অতি ধনী, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত সহ লাখো মানুষের বাস। সে কাউকে খালি হাতে ফেরায় না। মিরপুর কাউকে হতাশওকরেনা। অথচ সেই মিরপুরকে নিয়ে কতজনের নাক উঁচু ভাব। সেই উঁচু নাকের কিছু কারনও ছিল বৈকি। মিরপুর তখনও পিউর আবাসিক, ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিল গুলিস্তান থেকে বেশ দূরে। এখনকার মত জমকালো মার্কেট গড়ে উঠেনি। বাধ্য হয়ে মিরপুরবাসিকেনাকাটার জন্য নিউমার্কেট, গাওসিয়া, মৌচাকে যেত। মার্কেটে যাওয়ার সময় কেউ জিজ্ঞেস করলে বলত, ঢাকায় যাচ্ছি। দুর্জনেরা সেই সুযোগটাই নিত। তারা সুযোগ পেলেই বলে বসত,  মিরপুর ঢাকার বাইরের এক অজপাড়া।

সঙ্গদোষে যেমন লোহা ভাসে, তেমনি আমিও দুর্জনদের পাল্লায় পড়ে মিরপুরকে অবজ্ঞা করেছি। সঙ্গদোষে লোহা ভাসার বিষয়টা আমি আবার মেনে নিতে পারিনা। লোহা পানিতে ডুবে, এটা স্বাভাবিক। যখন লোহা একটা নির্দিস্ট আকার ধারণ করে, বিশেষ গুন লাভ করে, কেবল তখনই সে ভাসতে পারে। এটা কিভাবে দোষের হয়, আমার বুঝে আসেনা। সে প্রসঙ্গে না যাই। এখন অবশ্য সেই দিননাই। ঝা চকচকে সব মার্কেট দেখলে চোখ ঝলসে যেতে চায়। কালশি হয়ে উত্তরা যাওয়ার ফ্লাইওভার আর মেট্রোরেলের সংযোগমিরপুরকে এনে দিয়েছে আভিজাত্যের ছাপ। এই আভিজাত্য লাভের বহু আগে একবারই মিরপুরে এক রাত ছিলাম বটে। এক বন্ধুরআপন আলয়ে। সেদিনও বেশ খাতির যত্ন পেয়েছিলাম। সেই বন্ধু এখন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। এরপরে বহুবার অনেক বন্ধু, আপন জনেরসাথে সাক্ষাতের জন্য মিরপুরে গিয়েছি। এখনও যাই। কিন্তু রাতে থাকা হয়ে ওঠেনি। অথচ সেই মিরপুর থেকেই সুসংবাদটা পেলাম।‘মেরিকান ভিসা লাভ। সেই ভিসা লাভ আমাকে ভীষণ আনন্দ দিয়েছে। কিন্তু তা উদযাপন করতে পারলাম না। জীবনে রয়ে গেলোবড় আফসোস!!   

২।

বিষয়টা খোলাসা করি। দিন কয়েক আগে জরুরী কাজে ঢাকা যেতে হয়। সাথে পরিবার ছিল। ঢাকার মিরপুরে শ্যালিকার আবাস।সারা দিনের দৌড়-ঝাপ শেষে রাত্রি যাপনের জন্য সেখানেই আশ্রয় নেই। মিরপুরে গিয়ে সেই সুসংবাদটা পাই। ‘মেরিকান ভিসা পেয়েগেছি। আহ, কী আনন্দ!  সাথে সাথে কত প্লান করলাম! পৃথিবীর রাজধানী নিউইয়র্ক যাবো। বছরের পর বছর ধরে কিভাবে ক্লান্তি ছাড়াই আমেরিকান স্বাধীনতার মশাল ধরে রেখেছে মিশরীয় কিষাণী ফালাহ। দেখতে চেয়েছিলাম, শত শত গৃহহীন মানুষকে কিভাবে গর্তের মাঝে ফেলে রেখে পাপের শহরের উপাধি পেয়েছে লাসভেগাস। হলিউড-লসএঞ্জেলস, নায়াগ্রা ফল কত কিছু দেখার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সকাল হওয়ার আগেই বিপত্তিটা বাধে। কোন ভাবেই ভিসা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এবং শেষে হাল ছেড়ে দিলাম। ভীষণ মনখারাপ। এরকম সুযোগ কি বারবার আসে! 

৩।

বিষয়টা আরেকটু বেশি করে খোলাসা করা দরকার। সেদিন খুব ক্লান্ত ছিলাম। বিছানায় যাওয়া মাত্র ঘুম বাবাজির কোলে ঢলে পড়ি।ঘুমের মধ্যে অনেক দিন পর স্বপ্ন দেখি। আর সেই স্বপ্নেই ‘মেরিকান ভিসা পাই। স্বপ্নে অনেক উল্লাস করতে থাকি। সেই উল্লাসের মাঝেই সেটা হারিয়েও ফেলি।

সেই তখন থেকে আফসোস আমাকে আর ছেড়ে যাচ্ছেই না! মিরপুরে ‘মেরিকান ভিসা পেলাম বলেই কি সেটা আবার হারালাম না তো? ভিসা পাওয়ার পর মিরপুরের এত যে প্রশংসা করলাম, সেটার এখন কি হবে! সেটার জন্য আরেক দফা আফসোস হচ্ছে!!