বাংলা সাহিত্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো আবির্ভূত হয়েছেন রাজা রামমোহন রায়, যিনি শুধুমাত্র নিজের সময়কালে নয়, ভবিষ্যতের সমাজের জন্যও এক মহাপুরুষ হিসেবে পরিচিত। তাঁর জীবন ছিল এক অবিচল প্রেরণার উৎস, যা ভারতীয় সমাজের সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং চিন্তার দৃষ্টিভঙ্গিতে এক বিপ্লব ঘটিয়েছিল।
১৮৭২ সালের পর যখন ভারতীয় সমাজ প্রথা, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির পাথরে বাঁধা ছিল, ঠিক তখনই জন্মগ্রহণ করেন এক মহামানব। রামমোহন রায়ের জন্ম ১৭৭২ সালে, ব্রাহ্মণ পরিবারে, কিন্তু তিনি শুধুমাত্র একটি পরিবার কিংবা একটি জাতির অন্তর্গত ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানবতার এক আদর্শ। শিশু বয়সেই তিনি বাংলা, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি এবং ইংরেজি ভাষায় দখল অর্জন করেন। তাঁর শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ছিল অসীম, এবং সেই আগ্রহ তাঁকে নিয়ে যায় শাস্ত্রের গভীরে, ধর্মের আলোচনায় এবং সমাজ সংস্কারের পথে।
রামমোহন রায় খুব তাড়াতাড়ি বুঝে ফেলেন যে, তার জাতি এবং সমাজ তার বর্তমান অবস্থানে স্থির থাকতে পারে না। ভারতীয় সমাজের নানা অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং ধর্মীয় প্রথা তখন পুরোপুরি সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছিল। একদিকে, ইংরেজি শাসন ছিল, এবং অন্যদিকে ভারতের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক জীবনে অন্ধকার রয়ে গিয়েছিল। এই সময়েই তিনি আত্মপ্রকাশ করেন সমাজ সংস্কারের একজন নেতা হিসেবে। তাঁর চিন্তা ও আদর্শকে যদি সংক্ষেপে বলা যায়, তা হলো— "ঈশ্বর এক, সমাজে সকলেই সমান, এবং মানুষকে অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্তি দিতে হবে।"
সতীপ্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম
রামমোহন রায়ের সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী কাজ ছিল সতীপ্রথার বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ। সেই সময়ে, যখন কোনো পুরুষ মারা যেত, তখন তার স্ত্রীকে তার মৃত স্বামীর চিতায় জীবন্ত পুড়িয়ে দেয়ার একটি নিষ্ঠুর প্রথা প্রচলিত ছিল। এই প্রথাটি শুধু নারীদের শোষণ করত না, বরং এটি সমাজের মানবিক মূল্যবোধেরও পরিপন্থী ছিল। রামমোহন রায় এ প্রথার বিরুদ্ধে কঠোরভাবে অবস্থান নেন। তিনি সবার সামনে তুলে ধরেন যে, এই প্রথা কেবল নারীর জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে না, এটি মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন।
তিনি প্রথমে গণসচেতনতা তৈরি করেন, প্রকাশ্যে এই প্রথার বিরোধিতা করেন, এবং একসময় ইংরেজ শাসকদের সহায়তায় সতীপ্রথার বিরোধিতায় আইন পাশ করাতে সক্ষম হন। ১৮২৯ সালে ব্রিটিশ গভর্নর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সতীপ্রথা নিষিদ্ধ করেন, এবং এই নিষেধাজ্ঞা ছিল রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে চলা আন্দোলনের একটি বিরাট সফলতা।
শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসারে তাঁর ভূমিকা
রাজা রামমোহন রায় শুধু একটি সমাজ সংস্কারকই ছিলেন না, তিনি বাংলা সাহিত্য ও শিক্ষার প্রসারে ব্যাপক কাজ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সমাজে প্রকৃত পরিবর্তন আনতে হলে শিক্ষার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন প্রয়োজন। তখনকার শিক্ষাব্যবস্থা ছিল সীমিত, আর তা ছিল পুরনো পদ্ধতিতে গঠিত। রামমোহন রায় প্রচার করলেন যে, বিজ্ঞানের জ্ঞান, আধুনিক শিক্ষা এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের উন্নতির জন্য অপরিহার্য।
তাঁর উদ্যোগে বাংলায় প্রথম ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং তিনি বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে অবদান রাখেন। সংস্কৃত, আরবি এবং ফারসি ভাষার পাশাপাশি, তিনি বাংলাকে সমৃদ্ধ করার জন্য নতুন ধারা সৃষ্টি করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষার উন্নতি ঘটে এবং বাংলা সাহিত্য নতুন একটি যুগের সূচনা করে।
তাছাড়া, তিনি বেদান্ত ও একেশ্বরবাদ ধারণার প্রচারক ছিলেন, যা পরবর্তীকালে সমাজে ধর্মীয় বিভেদকে কমিয়ে আনে। তিনি প্রতিদিনের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে আধ্যাত্মিক জীবনযাত্রার সাথে মিলিয়ে ফেলার পক্ষে ছিলেন।
রাজনৈতিক দর্শন এবং সমাজ পরিবর্তন
রাজা রামমোহন রায়ের রাজনৈতিক দর্শনও খুবই গভীর ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ধর্মের পাশাপাশি সমাজের উন্নতির জন্য রাজনৈতিক মুক্তিরও প্রয়োজন। তিনি ভারতে গণতান্ত্রিক এবং মানবাধিকার ভিত্তিক সমাজ গড়ার পক্ষে ছিলেন। তিনি ইংরেজ সরকারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে ভারতের উন্নতির জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি একাধিক গণপ্রশাসনিক পদ্ধতির সমর্থক ছিলেন যা নাগরিকদের অধিকারের দিকে মনোযোগী ছিল।
পরিণতি এবং উত্তরাধিকার
রাজা রামমোহন রায়ের জীবনে সাফল্য, সংগ্রাম, বিপ্লব আর আদর্শের মিশ্রণ ছিল। ১৮৩৩ সালে তিনি জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, তবে তাঁর চিন্তা ও কর্ম আজও আমাদের জীবনে প্রতিফলিত। তাঁর চিন্তা যে শুধু তাঁর সময়ের সমাজে পরিবর্তন এনেছিল তা নয়, বরং আজও আমাদের মাঝে প্রতিটি সিদ্ধান্তে, প্রতিটি সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, সমাজের ভেতরে ও বাইরে তাঁর প্রভাব দৃশ্যমান।
রাজা রামমোহন রায়ের জীবন কেবল একটি সময়ের ইতিহাস নয়, এটি আমাদের প্রমাণ দেয় যে, একজন ব্যক্তি যদি সত্যের আলো নিয়ে আসে, তবে সে একাই সমাজের পথে আলোর ঝিলিক ছড়িয়ে দিতে পারে। তাঁর জীবন, কাজ এবং আদর্শ আজও প্রেরণা দেয় আমাদের, আমাদের সমাজের উন্নতির জন্য।