পোস্টস

গল্প

বংশ রক্ষা

১৮ মে ২০২৪

হাসান মাহমুদ আবদুল্লাহ

জয়নারায়ণপুর গ্রামের সৈয়দ বংশ ও চৌধুরী বংশের শত্রুতার ইতিহাস অনেক পুরনো। আমার বাবা ছিলেন সৈয়দ বংশের উত্তরাধিকারী, আর আমি এখন পর্যন্ত এই বংশের শেষ প্রদীপ। কিন্তু আমার জন্ম ঢাকার হলি ফ্যামিলিতে, পড়াশোনা ও বাবার চাকুরির সুবাদে শহরে থাকায় ক্রমে গ্রামে যাওয়া কমে গেল। নিজ গ্রামের বাড়ির নামটা যদিও বা জানি, সৈয়দ বংশের বাড়ির রাস্তাটা ভাল ঠাওর করতে পারি না। দাদা মূল ভিটে থেকে বসত উঠিয়ে রাস্তার এপারে নতুন বাড়ি করেছিলেন। বছরে কদাচিৎ যখন বাড়িতে যেতাম তখন এলাকার প্রবীণদের কাছে দু বংশের লোকদের ইতিহাস শুনতাম; ইতিহাস মানে মারামারি, হাকাহাকি, হাতাহাতি, লাঠালাঠি এসব। মুর‍ব্বীদের মুখে শোনা কল্পিত মিথের কল্যাণে কিংবা বাংলা সিনেমায় দেখা খানদানি বংশদ্বয়ের শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনীর কারনে আমিও নিজ বংশের লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধারে উদগ্রীব হয়ে পড়ি।
সৈয়দ বংশের উত্তরাধিকার বলে নিজেকে গ্রামের আড্ডাবাজ, রঙবাজ ও গুলবাজ ছেলেদের অঘোষিত নেতা মনে হত। কিন্তু ‘সৈয়দ বংশের ছেলে’ হিসেবে ওসব ছেলেদের থেকে প্রাপ্য সমীহ পেতাম বলে মনে হত না। শহরের ছেলে হিসেবে খাতির করে ঠিক; তা ঠিক নেতার মত নয়, আগত নতুন অতিথি টাইপের ব্যবহার। ঐতিহ্যবাহী খানদানি সৈয়দ বাড়ির সন্তান আমি, নিজ গায়েও মেহমান!
সালমান শাহের সিনেমায় দু বংশের শত্রুতার নজির দেখে শিহরিত হতাম। এত সুদর্শন নায়ক সারা দেশে এত মেয়ে থাকতে কিনা শত্রু বংশের মেয়েকেই বেছে নেয়। কী অবাক কাণ্ড! দু বংশের দুজনেই মেয়ে কিংবা দুজনেই ছেলে হয় না। এক বংশের উত্তরাধিকারী ছেলে হলে, অপর পক্ষের উত্তরাধিকার মেয়ে হবেই। তাছাড়া তাদের বয়সও প্রেমের জন্যে কেমন ম্যাচ হয়ে যায়। কত ক্লাইমেক্স। আমার ক্ষেত্রে এসব কিছুই হয় না।
একদিন উত্তেজনা বশে সাঙপাঙদের বলে বসি, 'চল চৌধুরী বাড়ির কাউকে ঠ্যাঙাই গিয়ে।' তারা অবাক হয়ে একে অপরে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। তাদের মুখে একই সাথে বিস্ময়বোধক ও প্রশ্নবোধক চিহ্ন, সেকি! হঠাৎ মারামারির করার মত কী হল! তাছাড়া, চৌধুরীরা কেউ তো গ্রামেই থাকে না। তাদের বাড়ির মূল ফটক হয়তো বা দুচার বছরে একবার খোলা দেখা যায়, তাও কোন বিশেষ উপলক্ষ্যে। বছর দুয়েক আগে তাদের কোন এক কর্তার মৃত্যু উপলক্ষ্যে তারা জ্ঞাতি গোষ্ঠী নিয়ে গ্রামে এসেছিল। আমি হতাশ হই।
নাহ!আমার কপালটাই খারাপ। আর দু তিন প্রজন্ম আগে জন্মালে হত। একটু লাঠলাঠি,হাতাহাতি করে নিজের বংশের পরিচয় দিতে পারতাম। গ্রামের লোকজন দেখি সব ভুলে বসে আছে।
আমি ঢাকায় এসে নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। একদিন বাবা মাকে নিয়ে আমার রুমে এলেন। আমার জন্যে নাকি কোন এক পাত্রীপক্ষ থেকে প্রস্তাব এসেছে। পরিবারটি আমাদের নিজ গাঁয়েরই , তবে ঢাকায় সেটেলড। আর সবার মত আমার বাবা মাও চান নিজ জেলায় মেয়ে দেখতে ; কিংবা আরও ভালো হয় নিজ গাঁয়ের  কোন মেয়ে হলে।আমি রাজি থাকলে বাবা মা আমাকে নিয়ে পাত্রী দেখতে যেতে চান। গম্ভীর হয়ে পাত্রীর পরিচয় জানতে চাইলাম। বাবা উৎসাহের সাথে জানালেন ওই গ্রামে নাকি আমাদের বংশের সম মর্যাদার একটি বংশই আছে। আমি তখন প্রমাদ গুনতে থাকি। 'কোন বংশ এটা?বাড়িটা কোন দিকে?'
ততদিনে চৌধুরী বংশের বাড়ির রাস্তা আমার বেশ চেনা হয়ে গিয়েছিল। বাবা যেই না বললেন,' দিঘীরজানের উত্তর দিকে যে রাস্তাটা, রাস্তার দু ধারে গাছের সারি......'
'চৌধুরী বাড়ি?'
'হ্যা, হ্যা। তুমি তো দেখি চেন বাড়িটা।'
আমি বিস্মিত হয়ে বলি,'বাবা,তুমি আমায় চৌধুরী বাড়িতে বিয়ে করতে বলছ?'
বাবা তারচেয়ে অধিক বিস্মিত হয়ে বলেন,'কেন? ওই বাড়িতে কী সমস্যা?'
আমি অবিশ্বাসের সাথে বলি,'কেন, ওই বংশের সাথে যে আমাদের বিরোধ তা কি তুমি জান না?'
সরকারী চাকুরীর সুবাদে ২৫/৩০ বছর দেশ বিদেশ থাকায় গ্রামের সাথে বাবার তেমন যোগাযোগ ছিল না। শৈশবে চৌধুরী বংশের বাচ্চা কাচ্চাদের দু একবার দেখে থাকলেও বড় হওয়ার পরে তাদের সাথে দেখা হওয়ার কারণ ঘটেনি। তারাও যে তেমন গ্রামে যায় না। এতেই হয়ত বাবার ওসব বংশ মর্যাদা বোধ এতদিনে উবে গেছে। টাইম ইজ অ্যা গ্রেট হিলার। তবুও অন্তত আত্মীয়তা করতে চাওয়াটা কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
'সে তো বহু যুগ আগের কথা।আমার দুই পুরুষেও তো কখনও মারামারি হয়েছে বলে জানি না।' বাবা যেন আমার এই অতি বংশ মর্যাদাবোধ দেখে ব্যথিত হন। 'আজকালকার দিনে কি মানুষ ওসব আদি শত্রুতা নিয়ে পড়ে থাকে,বাবা? যুগ বদলেছে।'
এমন এক পাওয়ালা থিউরির উপর তর্ক চলে না। আমি গম্ভীর হয়ে রইলাম। আদি পুরুষদের সাথে অন্তত আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।
আমার এই প্রত্যাখানের অবশ্য অন্যদিকও ছিল। সেটা হচ্ছে অনামিকা। তার সাথে আমার সম্পর্ক অনেক বছর ধরে। তার কথা বাসায় বলার সময় এসেছে এখন। বাবা মা আশা করি রাজি হবে। এতে বংশধারাও বজায় থাকে, বংশ মর্যাদাও রক্ষা পায়।
ওদিকে অনামিকাও বারবার তাগাদা দিচ্ছে, তার নাকি সম্বন্ধ আসছে। ভার্সিটির ডিবেট ক্লাব ও সাংস্কৃতিক কাজে জড়িত থাকার সুবাদে মূলত তার সাথে আমার ঘনিষ্টতা। তাদের পরিবারও ঢাকায় সেটেলড। তার বাড়ি অবশ্য ঢাকায় নয়, নিজ জেলার নাম জানলেও থানা বা গ্রামের নাম কিছুই জানে না তেমন। এই হল নিউ জেনারেশানের অবস্থা! আদি শিকড়, বংশ, গ্রাম সব বিসর্জন দিয়ে শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এদের দেশপ্রেম থাকে ডিবেটের ডায়াসে ও ভার্চুয়াল নীল জগতে, যেখানে সবুজ গ্রামের কোন সংযোগ নেই।
যাহোক, অনামিকা তার মাকে অনেক দিন আগেই আমার কথা জানিয়েছে। তিনি অনেকটা নিমরাজি। বাবার সাথে দেখা করতে চেয়েছে। আমিও ভাবছিলাম কোন একদিন সুযোগ বুঝে বাবা মাকে জানিয়ে দেব। শুভ দিন ক্ষণ দেখে একদিন গোপনে মাকে ও প্রকাশ্যে বাবাকে জানিয়ে দিলাম। খাওয়ার টেবিলে কথাটা তুললাম।
‘মেয়ের বাবা কী করে?’ বাবার প্রথম প্রশ্ন।
‘উকিল।‘ মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। কেন যেন উকিলদের সবাই কেমন বাঁকা চোখে দেখে।
‘চেম্বার কোথায়? চেন তুমি?’
‘না বাবা। সেভাবে তো চিনি না। তবে ভদ্রলোক।‘
‘ভদ্রলোকেরা ওকালতি করে শুনেছ কখনও? কোট কাচারি কি ভদ্রলোকের জায়গা?’
কিছু বললাম না। মা উদ্ধার করলেন। ‘তা হোক, মেয়ের বাবার পেশা দিয়ে আমাদের কী কাজ? ভাই বোন ক’জন?’
‘এক ভাই, দু’বোন। সে সবার বড়।‘
‘হুম।‘ বাবা গম্ভীর হয়ে গেলেন।
আমিও গুম হয়ে রইলাম। বাতাস বোঝার চেষ্টা করছিলাম। শেষে কি ওই চৌধুরী বংশের ডাইনীটাকেই বিয়ে করতে হবে? তবে কি আমাকে দিয়েই সৈয়দ বংশের মুখে চুনকালি লেপন শুরু হবে?
'ওকে, তার বাবাকে একদিন আসতে বল।' যাক বাবা! এবারের মত ফাড়া কেটেছে।
অতএব আমি আবারও শুভ ক্ষণ দেখে শেষ দান চাললাম। এলাকার দোকানে দোকানে আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে ক্লাবের ছেলে ছোকরাদের সেট করে রাখলাম। উকিল সাহেব নির্ঘাৎ জনে জনে জেরা করে হবু জামাইয়ের খোজ খবর নেবেন। কিন্তু উকিল সাহেব কাউকে জেরা করার কোন লক্ষণ দেখালেন না। সব প্ল্যান ভেস্তে যাচ্ছে দেখে আমার অনুগত অত্যুৎসাহী অনুসারীরা ব্যাকুল হয়ে আগ বাড়িয়ে স্বয়ং উকিল দম্পতিকেই জেরা করতে গেল। 
'কাউকে খুজছেন আঙ্কেল?'
'সৈয়দ সাহেবের বাড়ি তো?'
'উনার ছেলের কথা বলছেন তো? হ্যা হ্যা,খুব ভাল ...!' 
চতুর্মুখী উৎসাহে উকিল সাহেব জেরা না করেও অনেক কিছু জেনে ফেললেন। আমি ছাদ থেকে দূরের মোড়ে অত্যুৎসাহী জোকারগুলির সার্কাস দেখছিলাম।আর দাঁত কিড়মিড় করছিলাম। কী কুক্ষণেই যে ওই অলক্ষুণেগুলিকে জুটিয়েছিলাম।
যাহোক, আমাদের বাসায় পৌছলে বাবা অতিথিদের অভ্যর্থনা জানালেন। প্রাথমিক আলাপের পরে আমার ডাক পড়ল। ড্রয়ং রুমে ঢুকতেই শুনি বাবা বলছেন,''আপনাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে? ভাইজানের বাড়ি কি চট্রগ্রামের দিকে কোথাও?'
এই রে! হবু শ্বশুর কী আবার বাবার বিরোধী পক্ষের হয়ে কোন মামলা লড়েছেন কিনা কে জানে। এককালে মামলা মোকাদ্দমার কাজে বাবার কোর্ট কাচারিতে যাওয়া পড়ত।
'ওই দক্ষিণ অঞ্চলেই আমার বাড়ি ভাইসাব। ফেনী জেলাতে। সবই খোদার ইশারা ভাই, ক্ষণিক দেখায়ও কতজনকে আপন লাগে।'
বাহ! উকিল সাহেবের কথা শুনে তো মনে হচ্ছে অবস্থা অনুকূলে।
'ফেনীতে?কোন থানায়?' বাবা আবার জিজ্ঞাসা করলেন।
'দাঞনভূইয়া থানা।আমার মেয়ে বলল আপনার বাড়িও নাকি ফেনীর দিকেই।'
'জ্বি ভাইজান। নিজ জেলার মানুষ দেখে মনটা ভরে গেল।' আন্তরিক হেসে বাবা বলেন,'তা কোন গ্রাম?'
'জয়নারায়াণপুর। তবে কী ভাইজান, গ্রামে তেমন যাওয়া হয় না। ঢাকার ব্যস্ত জীবন বোঝেনই তো।'
'কোন বাড়ি?' বাবার হৃদকম্পন যেন আমিও শুনতে পাচ্ছিলাম।
'দিঘিরজানে গিয়ে চৌধুরী বাড়ি বললে সবাই এক হাতে দেখায়া দিবে। ওই গ্রামে খানদানি বংশ ওই একটাই আছে।'